পর্যটন মরশুমের শুরুতেই এক সময়ের মল্লরাজাদের রাজধানী বাঁকুড়ার বিষ্ণপুরকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলতে অভিনব উদ্যোগ নিল মহকুমা প্রশাসন। শহরের রাসতলায় ঠিক রাস মঞ্চের পাশেই শতাধিক বছরের পুরনো গোশালার প্রায় আড়াই হাজার বর্গফুট দেওয়াল জুড়ে ফুটে উঠল ‘মন্দির নগরী’ বিষ্ণুপুরের সচিত্র ইতিহাস ও প্রাচীণ পুরাকীর্তি। প্রায় ছ’মাসের চেষ্টায় সম্পূর্ণ তেল রঙ ব্যবহার করে একদল সহকারীকে সঙ্গে এই কাজ করেছেন স্থানীয় গোপালগঞ্জের যুবক সজল কাইতি। শিল্পী সজল কাইতি দেশ বিদেশে নানান প্রদর্শণী ও কর্মশালায় যোগ দেওয়ার পাশাপাশি পর্যটন দফতরের তরফে ‘প্রতিশ্রুতিমান শিল্পী’র শিরোপা পেয়েছেন বলে জানা গিয়েছে।
ডিসেম্বর মানেই ভ্রমণ প্রিয় বাঙালির বেরিয়ে পড়া শুরু। তা কাছে পিঠে হোক বা দূরে। আর সেই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্র বিন্দুতে বিষ্ণুপুরকে নিয়ে আসার নিরলস প্রয়াস চালাচ্ছেন মহকুমাশাসক মানস মণ্ডল। এবারের পর্যটন মরশুমে তাঁর উদ্যোগে নবতম সংযোজন বিষ্ণুপুরের ইতিহাসকে তুলে ধরতে দেওয়াল চিত্র। চলতি হাওয়ায় প্রায় সব পর্যটন কেন্দ্রই যখন ‘মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’ তখন বিষ্ণুপুরে এই দেওয়াল চিত্র যেন সকলের কাছে এক অন্য অনুভূতির জন্ম দেয়। ঠিক সেই কারণেই মহকুমা প্রশাসনের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দা, ইতিহাস গবেষক থেকে ভ্রমণ বিলাসী পর্যটক সকলেই। গত সোমবারই এক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে এই দেওয়ালচিত্রের আনুষ্ঠানিক প্রকাশ ঘটেছে। উপস্থিত ছিলেন রাজ্যের মন্ত্রী শ্যামল সাঁতরা, মহকুমাশাসক মানস মণ্ডল, বিশিষ্ট পুরাতাত্ত্বিক, গবেষক চিত্তরঞ্জন ভট্টাচার্য, পৌরপ্রধান শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ।
হালিশহর থেকে প্রথমবার বিষ্ণুপুরে বেড়াতে আসা অনির্বান দাস বলেন, শুধুমাত্র টেরাকোটা শিল্প আর প্রাচীণ মন্দিরের টানেই এখানে এসেছিলাম। আর এখানে এসে গোশালার দেওয়ালে অপূর্ব সুন্দর দেওয়াল চিত্র দেখলাম। একেবারে অপ্রত্যাশিতভাবে বিষ্ণুপুরের ইতিহাস সমৃদ্ধ এই ছবি দেখে তার মধ্যে এক অন্যরকম ভালো লাগা তৈরী হচ্ছে বলে তিনি জানান।
পুরো বিষয়টির দায়িত্বে থাকা শিল্পী সজল কাইতি বলেন, বিষ্ণুপুরের ঐতিহ্যবাহি পট চিত্র আগে কেমনভাবে আঁকা হতো সেই বিষয়টাকে এখানে তুলে ধরা হয়েছে। মন্দির নগরীকে সাধারণ মানুষ, পর্যটক, গবেষকদের কাছে আরও আকর্ষণীয় করে তোলার উদ্যোগ হিসেবে এই কাজ করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, মন্দিরের গায়ে যে সব ছবি ছ’ইঞ্চি আকারে রয়েছে, এখানে সেই ছবি ন্যুনতম বারো ফুটে তুলে ধরা হয়েছে। ফলে মন্দির ওই সব ছবি এক জায়গায় বড় আকারে দেখার সুযোগ মিলবে। বৈষ্ণব আন্দোলনের পর থেকে মূলত বিষ্ণুপুরের পরিবর্তন এসেছে। বিভিন্ন সংগ্রহশালা থেকে এখানকার পট চিত্রের নমুনা সংগ্রহ করে সেই অনুযায়ী এই দেওয়াল চিত্রের রং ব্যবহার করা হয়েছে বলে তিনি জানান।
রাজ্যের পঞ্চায়েত, গ্রামোন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্য দফতরের রাষ্ট্রমন্ত্রী অধ্যাপক শ্যামল সাঁতরার কথায়, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সারা রাজ্য জুড়েই উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড চালাচ্ছেন। পর্যটন দফতরও সেই কর্মযজ্ঞে সামিল হয়ে পর্যটনক্ষেত্র গুলিকে নতুনভাবে সাজিয়ে তোলার কাজ করছে। সেই কাজের সূত্র ধরে বিষ্ণুপুরের গোশালার দেওয়ালে মন্দির নগরীর প্রাচীণ স্থাপত্য, ঐতিহ্য, ইতিহাস ছবির মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। শহরের রাসমঞ্চের পাশেই এই গোশালা। সেই কারণে রাসমঞ্চ দেখতে আসা দেশী-বিদেশী পর্যটকদের সামনে অতিসহজেই গোশালা দেওয়ালে এই দেওয়ালচিত্র তাদের বিষ্ণুপুরকে জানতে ও চিনতে সাহায্য করবে। এবছরের বিষ্ণুপুর মেলার আগেই এই দেওয়ালচিত্র আগত ভ্রমনপিপাসুদের কাছে অন্যতম বাড়তি পাওনা বলে তিনি জানান।
এই অভিনব ভাবনার অন্যতম কাণ্ডারি মহকুমাশাসক মানস মণ্ডল এই বিষয়ে বলেন, বিষ্ণুপুরের মন্দিরের প্রতি মানুষের আরও আগ্রহ তৈরী করতে, এখানকার ইতিহাস ছবির মাধ্যমে তুলে ধরতে প্রাচীণ গোশাল দেওয়াল ছাড়া এখানে দীর্ঘ আড়াই হাজার ফুটের খালি দেওয়াল আর নেই। সেকারণেই এই দেওয়ালটিকেই বাছা হয়েছে। বিভিন্ন ছবির মাধ্যমে এখানে যেমন ইতিহাস, সংস্কৃতি তুলে ধরা হয়েছে, তেমনি বিষ্ণুপুরের ইতিহাসের কিছুটা অংশ এখানে লিখিত আকারে রয়েছে। এই বিষয়ে আগ্রহীরা ইতিহাসের সম্পূর্ণ অংশ মহকুমা প্রশাসনের নিজস্ব ওয়েবসাইটে পাবেন। একই সঙ্গে মল্লরাজ বীর হাম্বিরের লেখা পদ এখানে মানুষ পড়া ও দেখার সুযোগ পাবেন জানিয়ে তিনি বলেন, যেখান থেকে বিষ্ণুপুরে বৈষ্ণব ধর্মের শুরু হলো সেই মন্দিরে পর্যটকরা যাওয়ার সুযোগ পাননি। এখানে ছবির মাধ্যমে দেখার সেই সুযোগ তারা পাবেন। বিষ্ণুপুরে মানুষ মূলত মন্দিরের টানে আসেন, এত দিন সেই সব মন্দিরের ইতিহাস তুলে ধরার কোনও ব্যবস্থা ছিলনা। এবার দেওয়াল চিত্রের মাধ্যমে সেই ব্যবস্থা করা হলো। ১৯২০ সালে তদানীন্তন মহকুমাশাসক বিষ্ণুপুরের ইতিহাস নিয়ে একটি বই লিখেছিলেন, যা আমাদের সংগ্রহশালায় রক্ষিত আছে। ওই বইটিও মহকুমা প্রশাসনের ওয়েবসাইট থেকে আগ্রহীরা পড়ে নিতে পারেন বলে তিনি জানান।
সব মিলিয়ে এখন পর্যটকদের সাদরে গ্রহণ করে নিতে প্রস্তুত ‘মন্দির নগরী’ বিষ্ণুপুর। আর এখানে আসা সেই সব অতিথিরা যাতে কোনও ধরণের সমস্যায় না পড়েন তা নিশ্চিত করতে সদাসর্বদা প্রস্তুত রয়েছে মহকুমাশাসক মানস মণ্ডলের নেতৃত্বে পুরো প্রশাসন। এখন আপনার শীতকালীন ছুটির অবসরে কয়েক দিনের জন্য ‘ডেস্টিনেশান’ হতেই পারে বাঁকুড়ার প্রাচীণ এই পৌর শহর।