আজ ২৩ জানুয়ারি নেতাজি সুভাষচন্দ্ৰ বসুর ১২৯ তম জন্মদিন। নেতাজি ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্ৰামের একজন কিংবদন্তি নেতা। চলতি বছর কেন্দ্ৰীয় সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এবার থেকে প্ৰতিবছর সুভাষচন্দ্ৰ বসুর জন্মদিনকে ‘পরাক্ৰম দিবস’ হিসেবে পালন করা হবে। তাঁর পরাক্রমে দেশ স্বাধীন হয়েছে। এছাড়া আজ অসমবাসীর কাছে তিনটি বিষয়ের জন্য উল্লেখযোগ্য দিন। তিনটি বিষয় হল স্বাভিমান, স্বাধীনতা এবং সুরক্ষার সমন্বয়। আজ শনিবার উজান অসমের শিবসাগরের জেরেঙাপথারে (জেরেঙা ময়দান) বিশাল জনসভায় গোটা রাজ্যের ১,০৬,৯০০ জন সুবিধাভোগী পরিবারকে আনুষ্ঠানিকভাবে ভূমিপাট্টা প্রদান কর্মসূচির সূচনা করে উদাত্ত ভাষণ দিচ্ছিলেন প্ৰধানমন্ত্ৰী নরেন্দ্ৰ মোদী।
আজ সকাল ঠিক ১১টায় ঐতিহাসিক জেরেঙাপথারের জনসভায় উপস্থিত হন প্রধানমন্ত্রী । এর আগে বিশেষ বিমানে যোরহাটের ররইয়া বিমানবন্দরে অবতরণ করেন তিনি। সেখান থেকে বিএসএফের হেলিকপ্টারে জেরেঙাপথারে অস্থায়ী হেলিপ্যাডে অবতরণ করলে প্ৰধানমন্ত্ৰী মোদীকে অসমের মুখ্যমন্ত্ৰী সৰ্বানন্দ সনোয়াল, স্বাস্থ্যমন্ত্ৰী হিমন্তবিশ্ব শৰ্মা সহ কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রামেশ্বর তেলি, রাজ্যের অন্য মন্ত্রী, সাংসদ এবং বিধায়কগণ তাঁকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান। আজকের সমাবেশমঞ্চে ১০ জন ভূমিপুত্রের হাতে জমিপাট্টার সাৰ্টিফিকেট তুলে দিয়ে প্রকল্পের সূচনা করে শুরু করেন ভাষণ।
অসমিয়া ভাষায় ইংরেজি নববর্ষ এবং ভোগালি বিহুর শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করে প্ৰধানমন্ত্ৰী সতী জয়মতীকে স্মরণ করেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ত্যাগের প্ৰতীক জয়মতীর এই পবিত্ৰ স্থান জেরেঙাপথার থেকে আজ এই পবিত্ৰ প্রকল্পের শুভারম্ভ হয়েছে। তিনি সুধাকণ্ঠ ভূপেন হাজরিকার অসমিয়া ভাষায় একটি গানের পঙক্তি ’অ মোর ধরিত্ৰী আই চরণতে দিবা ঠাই, খেতিয়কর নিস্তার নাই মাটি বিনে অসহায়…’ উচ্চারণ করে হিন্দিতে এর ব্যাখ্যা করে ভূমিপুত্রদের প্রতি বিজেপি সরকার যে কতটা দায়বদ্ধ তার ব্যাখ্যা করেন। বলেন, আজকের পবিত্র দিনে ভূমিপুত্ৰদের আইনি মৰ্যাদা প্ৰদান করা হয়েছে।
মোদী বলেন, ভূমিপুত্র (খিলঞ্জিয়া) ভূমিহীন কৃষকগণ এতদিন শঙ্কায় ছিলেন। এখন তাঁরা শঙ্কামুক্ত হয়েছেন। ভূমি পাট্টা পেয়ে তাঁরা উপকৃত হবেন। বলেন, সরকার ভূমিপাট্টা প্ৰদান করায় খিলঞ্জিয়া জনসাধারণের দীৰ্ঘদিনের স্বপ্ন আজ পূরণ হয়েছে। বিজেপি সরকার এঁদের মঙ্গলের কথা ভেবে ভূমি আইন সংশোধনের মাধ্যমে লক্ষজনের ভূমিপাট্টা প্ৰদান করেছে। এই যে জমির পাট্টা, তা কেবল একটি কাগজ নয়, এর দ্বারা এঁরা ভারত সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পের অংশীদার হতে পারবেন, ব্যবসার জন্য ঋণ পেতে সহজ হবে, বলেন প্রধানমন্ত্রী। প্ৰধানমন্ত্ৰী বিরোধীদের কটাক্ষ করে বলেন, বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার আগে অসমের ছয় লক্ষ পরিবার ভূমির পাট্টা পারছিলেন না। পূর্বতন সরকার বিস্ময়করভাবে এঁদের কথা ভাবার সময়ই পায়নি। অথচ আমাদের সরকার আজ ১ লক্ষ ৬ হাজার নাগরিকের হাতে পাট্টা প্ৰদান করেছে তা যে প্ৰশংসার দাবি রাখে তা বিরোধীদের অবশ্যই স্বীকার করতে হবে। তিনি বলেন, খুব শিগগির আরও এক লক্ষ পরিবারকে ভূমির পাট্টা দেওয়া হবে।
এদিকে আরেকটি কারণে আজ যে বিশেষ দিন তার বর্ণনা করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজ ২৩ জানুয়ারি নেতাজি সুভাষচন্দ্ৰ বসুর ১২৯ তম জন্মদিন। নেতাজি ছিলেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্ৰামের একজন কিংবদন্তি নেতা। চলতি বছর কেন্দ্ৰীয় সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এবার থেকে প্ৰতিবছর সুভাষচন্দ্ৰ বসুর জন্মদিনকে পরাক্ৰম দিবস হিসেবে পালন করবে দেশ। তাঁর পরাক্রমে ভারতবর্ষ স্বাধীন হয়েছে। সুভাষবাবু প্রকৃতার্থে একজন ভারতীয় এবং ভারত মাতার সুসন্তান। দেশ চিরদিন তাঁর ত্যাগ এবং দেশপ্ৰেমকে শ্ৰদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে। আজ গোটা দেশ অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে নেতাজিকে নানাভাবে স্মরণ করছে, বলেন প্রধানমন্ত্রী।
তাছাড়া চা জনগোষ্ঠীয় জনসাধারণের প্ৰসঙ্গে মোদী বলেন, চা জনজাতির মানুষজন বিগত দিন অত্যন্ত শোচনীয়ভাবে দিন কাটাচ্ছিলেন। এখন তাঁরা বসতঘর, পানীয় জল, অনাময়, ব্যাঙ্কে সরকারি টাকা ইত্যাদি সব ধরনের সুবিধা পাচ্ছেন। ব্যাঙ্কের সঙ্গে চা বাগানে কর্মরতদের সরাসরি সংযুক্ত করা হয়েছে।
এছাড়া বড়ো চুক্তির ব্যাপারে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বড়ো চুক্তি অসমের দীৰ্ঘদিনের এক জ্বলন্ত সমস্যার যবনিকা ঘটিয়েছে। বড়োদের আতংক আজ শেষ হয়েছে। বড়ো সমস্যা ইতিমধ্যে সরকার সমাধান করেছে। এখন কেবল উন্নয়নের পথে অগ্রসর হবে বিটিআর। প্রধানমন্ত্রী মোদী বলেন, আজ অসম তথা উত্তর-পূর্বাঞ্চল দ্রুত বিকাশের পথে। লুক-ইস্ট পলিসির অংশীদার হয়েছে অসম। অসমকে পূর্বঞ্চলের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করে যাতায়তের ক্ষেত্রে উন্নীত করা হয়েছে। বহু রাস্তা-সেতু নিৰ্মাণ হয়েছে। যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নতি হওয়ায় ঔদ্যোগিক বিকাশের পথ খুলেছে। আকাশপথে যোগাযোগের উন্নতি হয়েছে।
অসমে তেল-গ্যাসে ক্ষেত্ৰে ৪০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়েছে। এতে নতুন নতুন কর্মসংস্থানের পথ খুলেছে। তিনি বলেন, জলপথে উত্তর-পূর্বাঞ্চল থেকে মায়ানমার, বাংলাদেশে যাতায়াতের ব্যবস্থা বিজেপি সরকারের আমলে শুরু হয়েছে বলে জানিয়ে মোদী বলেন, ভবিষ্যতে অসম ইথানল প্ৰস্তুতকারী মুখ্য রাজ্য হিসেবে দেশের মধ্যে স্থান পাবে। জৈবিক ইন্ধন উৎপাদনে অসম অগ্ৰণী রাজ্য হিসেবে পরিগণিত হবে বলে দাবি করেছেন মোদী। এভাবে সরকারি বেশ কিছু প্রকল্পের সফল রূপায়ণের প্রসঙ্গে কোভিডকালে উজ্বলা যোজনা ইত্যাদির তথ্যও তুলে ধরেছেন প্রধানমন্ত্রী। ভাষণ দিতে গিয়ে প্ৰধানমন্ত্ৰী নরেন্দ্ৰ মোদী সতী জয়মতীর ত্যাগকে শতকোটি প্ৰণতি জানিয়ে বলেন, শিবসাগরকে দেশের পাঁচটি প্ৰত্নতাত্ত্বিক স্থানের মধ্যে অন্তৰ্ভুক্ত করতে সরকার ব্যবস্থা গ্ৰহণ করেছে।
রাজ্যের বিজেপি জোট সরকারের ভূয়সী প্রশংসা করে বলেন মহাপুরুষ শ্রীমন্ত শংকরদেবের জন্মস্থান বটদ্ৰবা থান, কাজিরঙাকে জবরদখলমুক্ত এই সরকার করেছে। রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকার ভূমিপুত্রদের ভাষা-সংস্কৃতি-কৃষ্টি রক্ষা এবং সুরক্ষা প্রদানে বদ্ধপরিকর। এই সরকারের গঠনমূলক সৎউদ্দেশ্য-নীতি সম্পর্কে প্রশ্ন তোলা অবান্তর।
এছাড়া করোনা পরিস্থিতিতে অসমের মুখ্যমন্ত্ৰী সর্বানন্দ সনোয়াল, স্বাস্থ্যমন্ত্ৰী হিমন্তবিশ্ব শর্মা এবং সর্বোপরি রাজ্যের জনসাধারণের বিশেষ প্রশংসা করেছেন প্রধানমন্ত্রী। বলেন, অসম যেভাবে করোনার মোকাবিলা করেছে তার প্রশংসা কেবল মুখে করা পর্যাপ্ত নয়। ভাষণের শেষে তিনি বলেন, আমি আত্মবিশ্বাসী, অসম সরকার এখন করোনা টিকাকরণ অভিযান এগিয়ে নিয়ে যাবে। আমি সকলকে টিকা নিতে আবেদন জানাচ্ছি। জনসাধারণকে কোভিড ভ্যাকসিন গ্ৰহণ করার পাশাপাশি যাবতীয় সাবধানতা আবলম্বন করতেও আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী।
আজকের ভূমিপাট্টা প্রদান উপলক্ষ্যে আয়োজিত সমাবেশে উদ্বোধনী ভাষণ দিয়েছেন অর্থ-স্বাস্থ্য-শিক্ষা-পূর্ত মন্ত্ৰী হিমন্তবিশ্ব শৰ্মা। কোভিড সংক্ৰমণের পর প্ৰথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী মোদী অসম সফরে আসায় তাঁকে অকৃত্রিম ধন্যবাদ, কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। কোভিড পরিস্থিতে অসমের জনসাধারণের প্রতি পর্যাপ্ত সহায়তা এবং ঘন ঘন খোঁজখবর নেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানান। আজকের অনুষ্ঠানে ভাষণ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সনোয়াল। নানা জাতি-জনগোষ্ঠীয় নাচেগানে আজ প্রধানমন্ত্রীকে অভ্যর্থনা জানানো হয়েছে জেরেঙ্গাপথারে। প্ৰায় ২৭ মিনিট ভাষণ দেওয়ার পর হেলিকপ্টারে জেরেঙাপথারের জনসভা থেকে যোরহাট বিমানবন্দর এবং সেখান থেকে কলকাতার উদ্দেশে যাত্রা করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। আজকের সমাবেশে প্রায় দু লক্ষাধিক দর্শক-শ্রোতা উপস্থিত ছিলেন বলে মনে করা হচ্ছে।