স্মৃতিলেখা চক্রবর্ত্তী
যদি পশ্চিমবঙ্গ না থাকত… যদি পুরোটাই পূর্ব পাকিস্তানে চলে যেত… যেমন চেয়েছিল শেখ মুজিব, সুরাবর্দী, শরৎ বসুরা… যেটা হতে দেননি শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী, মেঘনাদ সাহা, সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়, পি আর ঠাকুর ইত্যাদি মহানুভব দূরদর্শী মানুষেরা আর বঙ্গের হিন্দুরা।
কী হতে পারতো? আসুন দেখা যাক –
● পশ্চিমবঙ্গ ভারতে না এলে শুধু যে বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ নামক রাজ্যটাই পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হয়ে যেত তা নয়; পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা এবং পূর্ববঙ্গ মিলিয়ে সবটাই হত পূর্ব পাকিস্তান। সবগুলিই ছিল পাকিস্তান পন্থীদের দাবি। এখনও গ্রেটার বাংলাদেশের দাবিদারেরা ঐ সব অংশগুলিও ইসলামিক বাংলাদেশের অংশ হিসাবে দেখতে চায়।
● বিহার, উত্তরপ্রদেশ এবং অন্ধ্রের হায়দ্রাবাদ অঞ্চলের বহু মুসলিম পাকিস্তানের পক্ষে ভোট দিলেও দেশভাগের সময় পাকিস্তানে যেতে চায়নি। কারন তারা বুঝেছিল সমৃদ্ধ অঞ্চল পশ্চিমবঙ্গই। পশ্চিমবঙ্গ পূর্ব পাকিস্তানে গেলে তারা অনায়াসে চলে আসত আজকের পশ্চিমবঙ্গে।
● কলকাতা শহরে এই নবাগতদেরই আধিপত্য বেশি হত। পূর্ব পাকিস্তানের নেতাদের আধিপত্য বহুলাংশে কমে যেত। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্মটাই হত না।
● কলকাতা নগর এবং বন্দর পাকিস্তানের দখলে থাকায় ব্যবসা-বাণিজ্যের দিক দিয়ে পাকিস্তান অনেক এগিয়ে যেত।
● ৬০-এর দশকে যে কলকাতা ভারতের জিডিপির প্রায় ২৫%-এর যোগান দিত; দেশভাগের সময় কলকাতা হারালে বাকি ভারতের অর্থনীতি ব্যাপক ভাবে ব্যাহত হত।
● এর প্রভাব বঙ্গের আদি জনগোষ্ঠী, বাঙ্গালী হিন্দুর উপর পড়া অবশ্যম্ভাবী ছিল। পূর্ব বঙ্গীয় বাঙ্গাল এবং পশ্চিমবঙ্গের ঘটি একই সাথে বিহার, উড়িষ্যা, দণ্ডকারণ্যের রিফিউজি ক্যাম্পে উদ্বাস্তু জীবন কাটাত।
● বাঙ্গালী সংস্কৃতি ইতিহাসে স্থান পেত। খেলাধুলা, শিল্প, সাহিত্য এবং রাজনৈতিক কচকচি বাঙ্গালী জীবন থেকে বিলুপ্ত হত। গৃহহীনের ঐ সব নিয়ে সময় ‘অপচয়’ শোভা পায় না।
● বাঙ্গালীর সমস্ত সাংস্কৃতিক সম্পদ, রসগোল্লা, রসমালাই, সন্দেশ, জামদানি, বালুচরি ইত্যাদি অন্যান্য রাজ্যের মধ্যে হরির লুঠ হত। এখানে ন্যায়-অন্যায়ের প্রশ্ন নেই। কারণ হাতি যখন নর্দমায় পড়ে, ব্যাঙেও তাকে লাথি মারে।
● থাকতো না কোন সৌরভ গাঙ্গুলী, না আসতো কোন দীপা কর্মকার। কারণ নিজেদের ভূমিপুত্রকে বাদ দিয়ে ভিটেহারা বাঙ্গালী খেলোয়াড়দের অন্য কোন রাজ্য কেন সুযোগ দেবে? ঋতুপর্ণ ঘোষ হয়তো সিনেমা না করে একটা চাকরির আশায় দোরে দোরে ঘুরতেন, প্রসেনজিৎ হয়তো হিন্দি সিনেমায় ছোটখাটো চরিত্র করে পেট চালাতেন। মুহূর্তের মধ্যে খরচের খাতায় চলে যেত ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর আশা, আকাঙ্খা, গরিমা এবং আত্মপরিচয়।
● পশ্চিমবঙ্গ না থাকলে উত্তর পূর্ব-এর রাজ্যগুলোও ভারতের অংশ হত না। অরুণাচলকে গিলে খেত চীন। নাগাল্যান্ড, মিজোরাম, মেঘালয় এরা চীনের হাতের পুতুল রাষ্ট্র হয়ে টিকে থাকতো।
● ভারতের সাথে ভুটান এবং বর্মার কোন সীমান্ত থাকত না। এমনকি নেপাল, ভুটান এবং সিকিম-এর চীনের অংশ হয়ে যাওয়া মোটেই অসম্ভব ছিল না।
● ভারতের তিন দিকে থাকত দুটি শক্তিশালী এবং সমৃদ্ধ শত্রু রাষ্ট্র। পাকিস্তানের পূর্ব ও পশ্চিম ভাগ এবং চীন। ফলে পাকিস্তানের পূর্ব ভাগ বা যুক্ত বঙ্গের থেকে দাবি উঠত আরো জমির। আজকের বিহার এবং ঝাড়খণ্ডের অনেক অঞ্চলই আদতে বাঙ্গলার অংশ ছিল। তাই কয়লা ও অন্যান্য খনিজ সমৃদ্ধ হাজারীবাগ, দুমকা, ধানবাদ ইত্যাদি অঞ্চলকে পূর্ব পাকিস্তান দাবি করে বসতো বঙ্গের প্রাচীন অংশ হিসেবেই।
● নিজামের রাজধানী হায়দ্রাবাদকেও মুক্ত করার জন্য জিহাদিরা প্রাণ বাজি রেখে দিত। ভারতের মধ্যেই আরেকটি ইসলামিক রাষ্ট্রের জন্ম হতো। রাষ্ট্রের ভৌগোলিক সীমার মধ্যে আরেকটি রাষ্ট্র বিশ্বে কয়েকটি মাত্র আছে। এখানেও আরেকটি হতো।
● পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানে যাবার একটা রাস্তার জন্য যতটা অংশ লাগে, ততটা জমিও পাকিস্তানকে ছেড়ে দেবার জন্য ভারতের উপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়তো।
● ভিখারী রাষ্ট্র পাকিস্তানকে সামলানো এখনকার ভারতীয় কূটনীতিকদের পক্ষে যতটা সহজ, পশ্চিমবঙ্গ সহ সমৃদ্ধ পাকিস্তানকে সামলানো ভারতের পক্ষে মোটেই অতটা সহজ হত না।
● ভারতের সাথে যে ক’টি দেশের আন্তর্জাতিক সীমান্ত রয়েছে, তার বেশিরভাগই পশ্চিমবঙ্গের জন্য। নেপাল, ভুটান এবং বাংলাদেশের সাথে পশ্চিমবঙ্গের সরাসরি সীমান্ত রয়েছে। অরুণাচলের চীন সীমান্ত এবং উত্তর পূর্বের সাথে ভারত-বর্মা সীমান্তে পশ্চিমবঙ্গ প্রত্যক্ষ ভাবে নেই। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ না থাকলে না থাকত উত্তর পূর্বের রাজ্যগুলো আর না থাকত তাদের সাথে ভারতের সীমানা। আর সেটা হলে সার্ক সংগঠন বা সার্কের মাধ্যমে এই অঞ্চলে ভারতের ছড়ি ঘোরানোও সম্ভব হত না। ভারতের আন্তর্জাতিক গুরুত্ব বজায় রাখতে পশ্চিমবঙ্গ অত্যন্ত দরকারী একটি রাজ্য। বাকি ভারতকে এবং কেন্দ্রীয় দলগুলোকে পশ্চিমবঙ্গের গুরুত্ব বোঝানো বাঙ্গালীর নিজের স্বার্থেই প্রয়োজন। ভারত-পাকিস্তান সীমান্তকে যতটা গুরুত্ব দেওয়া হয়, ততটাই গুরুত্বের সাথে ভারত-বাংলাদেশ এবং ভারত-নেপাল সীমান্তে কেন্দ্রকে তৎপর হতে হবে। তবেই বাঙ্গালার স্বার্থ, বাঙ্গালীর স্বার্থ সুরক্ষিত থাকবে।
২০ শে জুন পশ্চিমবঙ্গের জন্মদিনে এই বাস্তবতা অনুভব করুন। পশ্চিমবঙ্গের অস্তিত্ব আজ বিপন্ন। পূর্ব পাকিস্তানের প্রবক্তাদের রক্ত আজও সক্রিয়। তারা আজও চায় পশ্চিমবঙ্গকে। তাদের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে পশ্চিমবঙ্গকে, রক্ষা করতে হবে বাঙ্গালী হিন্দুর শেষ বাসভূমিকে, রক্ষা করতে হবে বাঙ্গালী সংস্কৃতিকে।