- বাংলাদেশে ক্রমশই কমে যাচ্ছে হিন্দুদের সংখ্যা
- দেশভাগের সময় যে হিন্দুদের সংখ্যা ছিল তা এখন নেই
- বলা হচ্ছে এঁদের অধিকাংশই ধর্মান্তরিত হয়েছেন
- অথবা কেউ কেউ ভারতবর্ষে পালিয়ে এসেছেন
পরিবেশ কর্মী তথা মানবাধিকার আন্দোলনের কর্মী ও দীর্ঘ দু-দশক ধরে উদ্বাস্তু আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত মোহিত রায়-এর সঙ্গে কথা বললেন সবুজ মুখোপাধ্যায়।
সবুজ–বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন নিয়ে আপনি দীর্ঘদিন ধরে সরব। মুজিবের বাংলাদেশ এইদিকে বাঁক নিল কী করে?
মোহিত–মোটামুটি ১৯৭৫-এর পর থেকেই সমস্যা শুরু। মুজিবর রহমান খুন হযে যাওযার পর থেকে। যদিও তার আগে থেকেই চাপ তৈরি হচ্ছিল মুজিবের ওপর, তবে সংবিধান সেকুলার ছিল। কিন্তু মুসলিম অধ্যুষিত একটা দেশে যা হয় আর কি। সিরিয়ার মতো অনেক খ্রিস্টান দেশে আজ যা হয়েছে। তা, পূর্ব পাকিস্তান যখন ছিল তখন আমরা দোষ চাপাতাম বিহারি মুসলমানদের ওপর। ওরাই যত নষ্টের মূল। কিন্তু পরে দেখলাম, তা ঠিক নয়।
সবুজ–প্রথমদিকে তো ওরা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রই ছিল। পরে…
মোহিত— হ্যাঁ, এটা হল জিয়ায়ুর রহমান যখন এল, ১৯৭৭ সালে। ভার্চুযালি এইগুলো হয়ে গেল। সরকারি ভাবে ১৯৮৮ সালে এরশাদ এসে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম ঘোষণা করল। তবে সেগুলো সবই কাগজ কলমের ব্যাপার, দেশ কিন্তু অনেকদিন ধরেই ইসলাম হয়ে গিয়েছিল মনেপ্রাণে।
সবুজ— আপনি তো দীর্ঘদিন ধরে উদ্বাস্তুদের নিয়ে কাজ করছেন। সত্যিই কি বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দুদের অবস্থা এতটা খারাপ… যতটা আপনি দাবি করেন?
মোহিত— ওখানে সংখ্যালঘুদের অবস্থা কীরকম জানেন… বলি তাহলে… হুমায়ুন আহমেদের উপন্যাসের হিমুকে তার এক মামা বলছে, হিমু তোর এবার একটা বিয়া দিয়া দিমু। তা হিমু তো পাগলা টাইপের। বলছে, আমি খাব কী। তখন তাকে বলছে, না ওই যে সাহাদের একটা দোকান আছে, ওদের একটু টাইট দিযে দিলেই ইন্ডিয়া পালাবো, তখন ওই দোকানটা তোরে দিযা দিমু।… তা এই হল বাংলাদেশ। সেদিন স্বপন দাশগুপ্ত একটা কথা বলছিলেন। বাংলাদেশের এক হিন্দু মহিলাকে তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন– কী, কেমন আছেন? উত্তর ওই মহিলা বললেন: ভালই আছি, এখনও রেপড হইনি।
সবুজ–বিতর্ক ওঠে আর এক জায়গায়। এখানে সংখ্যালঘুরা কতটা ভাল আছেন?
মোহিত— একজন সংখ্যালঘুকেও বলতে শুনেছেন কখনও, হিন্দুদের মার খেয়েছি তাই ভারত থেকে বাংলাদেশে চলে এসেছি? এখান থেকে কেউ যায়নি ওখানে। কিন্তু গত ৭০ বছরে… আচ্ছা ৭০ বছর যদি ছেড়েই দিই, স্বাধীন বাংলাদেশ তৈরি হওয়ার পর থেকে আজ অবধি ৮০ লক্ষ হিন্দু বাংলাদেশ ছেড়ে চলে এসেছে। ওদের ওখানকার বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ আবুল বককতের দেওয়া তথ্যই এই কথা বলে। কোনও যুদ্ধ হলে এমনটা ঘটতে পারে, এতলোক মাইগ্রেট করতে পারে, এতলোক উদ্বাস্তু হতে পারে… কিন্তু শান্তির সময়ে এমন ঘটনার দৃষ্টান্ত বিশ্বের ইতিহাসে কোথাও নেই… ১৯৭২ থেকে আজকের দিন অবধি বাংলাদেশের সঙ্গে কোনও যুদ্ধ হয়নি, কোনও গুলিগোলাও চলেনি। একটা দেশ, সংখ্যালঘুদের প্রতি কতটা প্রতিকূল হয়ে উঠলে এমনটা ঘটে ভেবে দেখুন।
সবুজ— ওখানে তো মন্দির বা দুর্গাপুজোর প্যান্ডেল ভেঙ্গে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে প্রায়ই…
মোহিত— এই তো এবারও প্যান্ডেল ভেঙে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল…
সবুজ— বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের কথা আপনি বলছেন অনেকদিন ধরেই, কিন্তু এখানকার কাগজে তো সেরকম দেখা যায় না খুব-একটা…
মোহিত— কী করে দেখা যাবে? আমাদের পশ্চিমবঙ্গের পত্রপত্রিকা বলুন, বুদ্ধিজীবী বলুন, অ্যাকাডেমিক ইনস্টিটিউশন বলুন, সব মেরুদণ্ডহীন। তারা অ্যাকাডেমিক স্বার্থেও এগুলো ডকুমেন্ট করে না। বাংলাদেশের পত্রপত্রিকা কিন্তু এগুলো ছাপায়। বাংলাদেশের সাহসী কয়েকজন বুদ্ধিজীবী রয়েছেন, যেমন মুমতাসির মামুন, বাংলাদেশের ইতিহাসের এক আইকন বলা যেতে পারে তাঁকে, তারপর ধরুন শাহরিয়ার কবীর, এঁরা কিন্তু এগুলো বলেন, এগুলো ছাপান। ওখানকার পত্রপত্রিকায় এগুলো ছাপানো হয়। …কিছুদিন আগে এখানে একটা সেমিনার হয়েছিল। বাংলাদেশের একজন অবসরপ্রাপ্ত এয়ার মার্শাল ছিলেন, বিশিষ্ট মানুষেরা ছিলেন, অধ্যাপকরা ছিলেন, বাংলাদেশের যিনি রাষ্ট্রদূত তিনিও ছিলেন… তা তাঁরা সব সেকুলার স্ট্যান্ড নিযেছিলেন, বলছিলেন, অর্থনৈতিক উন্নযন হলেই সব ঠিক হযে যাবে। আমি সেখানে বাংলাদেশের গত তিনমাসের খবরের কাগজের কাটিং নিয়ে গিয়েছিলাম। ওগুলো হাতে নিয়ে আমি বলেছি্লাম, আমি ইতিহাস খুঁজছি না। ১৯৫০ সালে কী হযেছিল, ১৯৮০ সালে কী হযেছিল, তার দৃষ্টান্ত দিচ্ছি না। আমি শুধু গত তিনমাসের এই ঘটনাগুলো, যেগুলো খবরের কাগজে বেরিয়েছে সেগুলো দেখাচ্ছি। … আসলে ওখানে সংখ্যালঘুদের ওপর একটা কনিটিনিউয়াস অপ্রেশন চলছে।
সবুজ— পশ্চিমবঙ্গে মুসলিমপ্রধান জায়গাগুলো নিয়ে আপনার ক্ষোভ আছে শুনেছি…
মোহিত— তা তো আছেই। পশ্চিমবঙ্গে মুর্শিদাবাদের মতো মুসলিম প্রধান জাযগাগুলো ওই অবস্থায এসেছে এখন, এটা অস্বীকার করি কী করে…, সেখানে হিন্দুরা বাংলাদেশের হিন্দুদের মতোই থাকে। জানেন, সেখানে সরস্বতীপুজো বন্ধ হয়ে গিয়েছে অনেক স্কুলে?
সবুজ–আমাদের এখানে প্রশাসনও মুসলিম হিংসার ক্ষেত্রে চুপ থাকে বলে আপনার অভিযোগ।
মোহিত— অভিযোগ কেন… এটা তো ফ্যাক্ট যে, আমাদের এখানে প্রশাসন মুসলিম ভায়োলেন্স হলে কিছু বলে না। ভারতবর্ষের কোনও মুখ্যমন্ত্রীর এমন সাংঘাতিক কৃতিত্ব নেই যে এত কম মানুষ গত দশ বছরে মারা গিয়েছে পুলিশের গুলিতে… তার কারণ একটাই, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শাসনের শুরুতেই ২০১১-তে মগরাহাটে গ্রামে গিযেছিল পুলিশ বিদ্যুৎ চুরি আটকাতে। সেখানে পুলিশের গুলিতে দুজন মুসলিম মহিলা মারা যান। তারপর থেকে আর পুলিশের গুলিতে কোনও মুসলিম মারা যায়নি…ভাঙড়ে দু-পক্ষই মারপিট করছে, দু-পক্ষই মুসলিম, পাঁচ-সাতটা পুলিশের গাড়ি জলে ডুবিয়ে দিচ্ছে… আগুন লাগিযে দিচ্ছে, তাও পুলিশ কিছু করল না। এই তো বনধের দিন সুজাপুরে কী ঘটল দেখুন না…, মুসলিমরা কিছু করলে পুলিশ গুলি চালায় না। তাই মুসলিমরা জানে, আমরা ভায়োলেন্স করলেও আমাদের কিছু করা হবে না… অথচ হিন্দু হলে ব্যাপারটা তা হবে না কিন্তু। দাঁড়িভিটে পুলিশ পর্যন্ত কোথাও বলেনি যে ছাত্ররা বোমা ছুড়েছে, বড়জোর দু-একটা ইটপাটকেল ছুড়েছে। সেখানে দুজন ওই বয়সি ছেলেকে কীরকম গুলি করে মেরে ফেলা হল।
সবুজ— কথাটা কি সাম্প্রদায়িকতায় উস্কানি দেয় না?
মোহিত–এখানে হিন্দুমুসলমানের ব্যাপারটাকে সাম্প্রদায়িক ভাবলে ভুল হবে… আমাদের পশ্চিমবঙ্গটা তৈরিই হযেছে তো হিন্দু-মুসলমানের ভিত্তিতে…শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায, আচার্য যদুনাথ সরকার, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায, এই হিন্দু নেতারা পশ্চিমবঙ্গ তৈরি করতে চেয়েছিলেন। তাঁরা যথার্থই মনে করেছিলেন, একটা মুসলিম মেজরিটির বেঙ্গলে হিন্দুরা নিরাপদ থাকবে না… তাঁরা দুশো শতাংশ সঠিক ছিলেন, আজ বোঝা যাচ্ছে।
সবুজ— বাংলাদেশে হিন্দু জনসংখ্যাও তো দিন-দিন-দিন কমছে বলে শোনা যাচ্ছে।
মোহিত— নিঃসন্দেহে। ১৯৫১-র জনগণনায় আজকের বাংলাদেশ তথা পূর্ব পাকিস্তানে ২২ শতাংশ হিন্দু ছিল, আজ সেখানে তা ৭ শতাংশে নেমে এসেছে… এগুলোকে সাম্প্রদায়িকতা বলবেন, নাকি রিয়ালিটি বলবেন, তা আপনার ওপর নির্ভর করবে…
সবুজ— আপনার কথা থেকে যা বেরিয়ে এল, তার নির্যাস হল, বাংলাদেশে হিন্দুরা ভাল নেই, নিরাপদে নেই, অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গে মুসলিম তোষণ চলছে, তাই তো…
মোহিত–পশ্চিমবঙ্গে যা হচ্ছে এখন তা আর তোষণের পর্যায়ে নেই, এ রাজ্য এখন বাংলাদেশের পথে এগচ্ছে। দেখুন না, ১৩, ১৪, ১৫ ডিসেম্বর তিনদিন ধরে কেবল মুসলিমরা রাজ্যজুড়ে কীরকম ভায়োলেন্স চালিয়ে গেল। প্রশাসন তাদের থামানোর চেষ্টাই করলো না। এটা কিন্তু একটা পরিষ্কার বার্তা দিল, মুসলিমরা যা খুশি করতে পারে এই রাজ্যে…ওই ঘটনার পরই কিন্তু সারা ভারতবর্ষে শুরু হল ভায়োলেন্স…
সবুজ–ওই জাযগায় ফেজটুপি পরে বিজেপির কিছু সমর্থরা আগুন লাগিয়েছিল বলে জানা গিয়েছে…
মোহিত— ওটা ফিল্ম করছিল, ওটার সত্যমিথ্যে জানি না, সত্যি হলে অন্যায়। কিন্তু কোনা এক্সপ্রেসওয়েতে এতগুলো বাস পুড়িয়েছে…, বিজেপির যদি সেই শক্তি থাকত পশ্চিমবঙ্গ থেকে মুসলিমরা পালিয়ে যেত। সবচেয়ে বড় কথা হল, দেখবেন, কোনও সংগঠন বা পার্টি ডাক দেয়নি ওই বিক্ষোভ কর্মসূচির, তাহলে একই দিনে একইসঙ্গে এতগুলো জাযগায় কী করে সংঘর্ষ শুরু হল… মুসলিম সন্ত্রাসবাদীরা সুসংগঠিত হচ্ছে এই রাজ্যে… যারা একটা পাবলিক ঘোষণা ছাড়া কুড়িটা জাযগায় একইসঙ্গে ভায়োলেন্স শুরু করতে পারে, দে অলসো নো অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ইজ উইথ দেম… কেউ গুলিতে মরবে না, যতই হিংসা ছড়াও না কেন, কাউকে কিছু করবে না প্রশাসন, তারা যা খুশি তাই করতে পারে…
সবুজ–কিন্তু নাগরিকত্ব বিলকে কীভাবে দেখছেন, আপনি কি মুসলিমদের দেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার পক্ষে?
মোহিত–কোনও মুসলামানের তো নাগরিকত্ব কেড়ে নেওযা হচ্ছে না। বিলের মধ্যে কোথাও মুসলিম কথাটাই নেই। তাহলে কেন এত ভয়? স্পষ্ট বলা হচ্ছে, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, বাংলাদেশ থেকে নিগৃহীত হয়ে কেউ এলে তাঁদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে… তাই গোটা ভারতবর্ষে হিন্দু বা মুসলমান কাউরই কোনও মাথাব্যথা থাকারই কথা নয়। আর একটা কথা জেনে রাখবেন, পশ্চিম ভারতে যে উদ্বাস্তুরা এসেছেন, তাঁদের ৯৯ শতাংশই ১৯৫০-এর আগেই চলে এসেছেন। পপুলেশন এক্সচেঞ্জড হয়েছে। রাজস্থান, পাঞ্জাব, গুজরাতের মতো সীমান্তবর্তী রাজ্যে কোনও রাজনৈতিক দলের কোনও ইস্যুই নয় উদ্বাস্তু সমস্যা। হ্যাঁ, কিছু লোক মাঝেমাঝে চলে আসে, তাদের নাগরিত্ব পেতে অসুবিধে হয, তাদের নাগরিকত্ব দেওয়া হচ্ছে। শুধু পশ্চিমবঙ্গ আর অসমে উদ্বাস্তু সমস্যা একটা বড় ইস্যু। এখানকার আশি লক্ষ মানুষ যাদের নাগরিত্ব নেই তাদের নাগরিকত্ব দেওযা হবে এই আইনে, একে খারাপভাবে দেখবো কেন…
সবুজ–অসমে কত লাখ হিন্দু বাদ পড়ল এনআরসি থেকে, মেনে নিতে পারছেন?
মোহিত–অসমের এনাআরসি আর আমাদের এখানকার এনআরসি এক নয়, ২০০৩ সালে আমাদের দেশে নাগরিকত্ব আইন সংশোধন হয়, তাতে বলা হয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার এনআরসি করতে পারবে… আর, অসমে এনআরসসি হয়েছে ১৯৮৫ সালে রাজীব গান্ধির সঙ্গে যে চুক্তি হয়েছিল তার ভিত্তিতে। তারপর সুপ্রিম কোর্টও বলেছে। এরসঙ্গে বিজেপির কোনও সম্পর্ক নেই। নাগরিকত্ব আইনেরও কোনও সম্পর্ক নেই। অসমে যে ১৯ লাখ লোক বাদ পড়েছে তাদের কিন্তু বাদ পড়বারই কথা, এরা বাংলাদেশ থেকে এসেছে।
সবুজ— শেষ প্রশ্ন। ঋত্বিক ঘটককে নিয়ে একটা প্রচার চালাচ্ছে বিজেপি, এনআরসি-র সঙ্গে। কীভাবে দেখছেন?
মোহিত— শুনেছি একটা ভিডিয়ো করা হয়েছে, ভিডিয়োটা আমি দেখিনি… তবে ঋত্বিক উদ্বাস্তুদের নিয়ে ছবি বানিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু ওই যে অতবড় বিশ্বাসঘাতকতা হল, তা নিয়ে কিন্তু কিছু বলেননি। তাই আমি ঋত্বিককে উদ্বাস্তুদের প্রকৃত বন্ধু বলে মনে করি না।