(দ্বিতীয় অধ্যায়ের পর)

তিন

যে বীজগুলি পল্লবিত হয়েছিল

কলেজের পড়া শেষ করবার চার বছর বাদে আমি যখন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিতে প্রস্তুত, সেই সময় পার্টি সদ্যোজাত ভারতীয় গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। সালটা ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দ, ফেব্রুয়ারি মাস। আমার সিদ্ধান্তের কথা জানালাম বন্ধু রাম স্বরূপকে, যার সাথে আমার সাক্ষাৎ হয়েছিল কলেজ ছাড়বার পরে, এবং যে পরবর্তীকালে আমার বৌদ্ধিক বিবর্তনের উপর সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করেছিল। সে তৎক্ষণাৎ এই উত্তর লিখে পাঠিয়েছিল : “তুমি এত বেশি বুদ্ধিমান যে কমিউনিস্ট না হয়ে তোমার উপায় নেই। কিন্তু সেইসঙ্গে এও সত্যি – তুমি এত বেশি বুদ্ধিমান যে খুব বেশিদিন তোমার পক্ষে কমিউনিস্ট হয়ে থাকাও সম্ভব হবে না।”

এই ভবিষ্যদ্বাণীটি ফ’লে গিয়েছিল। পার্টিতে যোগ দেবার মাত্র এক বছর এবং কিছু মাস বাদে আমি মার্ক্সবাদকে একখানি অপর্যাপ্ত দর্শন ব’লে পরিত্যাগ করলাম, উপলব্ধি করলাম যে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি হচ্ছে স্রেফ একখানি ঘরশত্রু যার কাজ হ’ল ভারতের অভ্যন্তরে রাশিয়ান সাম্রাজ্যবাদের প্রবেশপথ প্রস্তুত করা, এবং সেইসঙ্গে স্তালিনের নেতৃত্বাধীন সোভিয়েত ইউনিয়নকে দাসপ্রথার উপর দণ্ডায়মান একখানি বিশাল সাম্রাজ্য ব’লে বুঝতে পেরে প্রকাশ্যে ভর্ত্‌সনা করতঃ একে সর্বথা বর্জন করলাম। এই পরিবর্তনের গল্পটি শোনানোর আগে আমায় একটু অতীতের দিকে ফিরে তাকাতে হচ্ছে, যাতে আমি নিজের মনের ভেতরে অন্য কয়েকটি বীজ কীভাবে পোঁতা হ’ল তা দেখাতে পারি। মার্ক্সবাদের মায়াজাল কেটে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই এই বীজগুলি প্রাণ পেয়ে পল্লবিত হ’তে থাকে, এবং শেষমেশ তারা পরিণত হয় সনাতন ধর্মের উপর গভীর অটল বিশ্বাসের মহীরুহে।

কলেজের অধ্যাপকদের মধ্যে প্রথম যিনি আমার উপর চিরস্থায়ী ছাপ ফেলতে পেরেছিলেন, তিনি ছিলেন আমাদের সংস্কৃতের অধ্যাপক। এই অনুপম ভাষা ও সাহিত্য বিএ অনার্সে আমার প্রধান পাঠ্যবিষয় ছিল না। এতে কেবল একটি অতিরিক্ত পত্রে পাশ করবার পর সব ভুলে গেলেও চলত। এর জন্য যে পাঠ্যসূচীটি নির্দিষ্ট ছিল তা হচ্ছে দণ্ডীর “দশকুমারচরিত”-এর প্রথম চারটি অধ্যায়, ভারবি রচিত “কিরাতার্জুনীয়ম্‌”-এর কয়েকটি কাণ্ড, এবং তার সঙ্গে সহায়ক পাঠ হিসেবে জুড়ে দেওয়া ছিল কিছুটা ব্যাকরণ ও অনুবাদচর্চা। ফলে এমনিতে আমার মতো একজন অতিরিক্ত বিষয়ের ছাত্রকে আমাদের সংস্কৃত অধ্যাপকের চোখেই পড়বার কথা নয়, আমারও তাঁর প্রতি বিশেষ কোনো আকর্ষণ গ’ড়ে ওঠার কথা নয়। কিন্তু আমাদের একে অপরের গুণমুগ্ধ হয়ে ওঠাটা যেন নিয়তিনির্দিষ্ট ছিল। এই যোগাযোগের ফলে শুধু যে সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি আমার চিরস্থায়ী অনুরাগ তৈরি হ’ল তা-ই নয়, সমগ্র হিন্দু দর্শন ও ইতিহাসকে বুঝে ওঠবার জন্য আমার সামনে অনেকগুলি সুস্পষ্ট রাস্তাও খুলে গেল।

এই অধ্যাপকটি নিজের পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করবার তাগিদে অনেকগুলি বছর ইউরোপে কাটিয়েছিলেন। কিছু সময়ের জন্য তিনি শান্তিনিকেতনেও অধ্যাপনা করেছিলেন। কিন্তু এগুলি ছিল স্রেফ তাঁর বহিরঙ্গের সাফল্য, যা নিজ নিজ ক্ষেত্রে অন্য অনেক অধ্যাপকও অর্জন করেছেন। কিন্তু তাঁর যে ব্যাপারটি আমাকে সবচেয়ে বেশি টানত তা হচ্ছে সনাতন ভারতীয় দর্শন, ভারতের ইতিহাস, ভারতীয় ভাষা ও সাহিত্যের বিপুল পরিসরগুলিতে তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য। পাঠ্যসূচীর অন্তর্গত গদ্য ও পদ্যের প্রত্যেকটি পঙক্তি তাঁর কাছে ছিল তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব, আধ্যাত্মিকতা, ইতিহাস এবং না জানি আরো কতরকম বিষয়ে বিদগ্ধ আলোচনা শুরু করবার উপলক্ষ্য মাত্র। আধুনিককালের ভারততত্ত্ববিদ্‌দের প্রতি তাঁর অবজ্ঞা যতটা প্রকট ছিল, ঠিক ততটাই প্রকট ছিল যাবতীয় যা কিছু সনাতন হিন্দু সেসবের প্রতি তাঁর সমাদর।

একদিন তিনি স্যার সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণ সম্পর্কে নিজের বিতৃষ্ণার কথা অকপটে প্রকাশ ক’রে আমাকে চমকে দিলেন। তাঁর মতে, রাধাকৃষ্ণণ পাশ্চাত্য দর্শনের থেকে ধার ক’রে আনা একটি ধারণাগত কাঠামোর মধ্যে হিন্দু দর্শনকে জোর ক’রে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করেছেন। তখনো পর্যন্ত হিন্দু দর্শন সম্পর্কে আমার কিছুই প’ড়ে ওঠা হয়নি। এমনকী রাধাকৃষ্ণণের কোনো রচনাও তখনো আমি পড়িনি। কিন্তু তাঁর নামটি ছিল এতই বিখ্যাত যে প্রত্যেক ভারতীয় এই নাম শুনে স্বাভাবিকভাবেই গর্ববোধ করতেন। আমার অধ্যাপক তাঁর তর্কের চূড়ান্ত যুক্তিটি পেশ করলেন এই ব’লে যে, সংস্কৃত বিষয়ে জ্ঞানশূন্য কোনো ব্যক্তির পক্ষে ভারতীয় দর্শন সম্পর্কে লেখালেখি করা আর ব্যাঙ্ক ব্যালেন্সহীন কোনো ব্যক্তির পক্ষে চেক সই করা একই ব্যাপার। অধ্যাপকের এই অভিযোগটি যে কতখানি সঠিক তা আমি কালক্রমে জানতে পেরেছিলাম।

আরেকদিন তিনি যে তত্ত্বটিকে প্রবল আক্রমণ ক’রে বসেন সেটি হচ্ছে খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দে আর্যজাতি কর্তৃক ভারত আক্রমণের তত্ত্ব। এ সন্দেহ আগে কখনো আমার মনে আসেনি যে এটি সেইসব পশ্চিমী ভারততত্ত্ববিদ্‌দের জোর ক’রে আমদানি করা একখানি তত্ত্ব, যারা ভারতকে স্রেফ একটি পান্থনিবাস হিসেবে উপস্থাপিত করতে চায়, যাতে ভারতের কোনো জাতি, ধর্ম কিংবা ভাষাভিত্তিক সম্প্রদায় এদেশকে নিজেদের আদি বাসভূমি ব’লে দাবী করতে না পারে। স্কুলে অথবা কলেজে আমাদের ইতিহাসের শিক্ষকেরা সবসময় ভারতের ইতিহাসের প্রথম পাঠটি শুরু করেছেন যাযাবর আর্যজাতির আগমনের কথা ব’লে; যারা সিন্ধু সভ্যতার নগরগুলি ধ্বংস করেছিল, দ্রাবিড়জাতিকে দক্ষিণের দিকে হটিয়ে দিয়েছিল, আর যাদের যুদ্ধবিগ্রহের গাথা সংরক্ষিত আছে ঋগ্বেদে। এই গোটা ইতিহাসটিকে আমাদের অধ্যাপক উড়িয়ে দিলেন একটা গাঁজাখুরি গল্প আখ্যা দিয়ে, যার সপক্ষে কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক অথবা সাহিত্যিক প্রমাণ নেই।

আমাদের ইতিহাসের অধ্যাপক যখন দাবী করলেন যে ভারতের মধ্যযুগের ভক্তি আন্দোলনের মূলে ইসলামের প্রভাব রয়েছে, তখন সংস্কৃতের অধ্যাপকের প্রবল প্রভাবের দরুনই আমি উঠে দাঁড়িয়ে এর প্রতিবাদ করতে সাহস পেয়েছিলাম। এটা শুনে রীতিমতো জ্বলে উঠেছিলাম যখন তিনি আমাদের পড়াতে পড়াতে ডঃ তারাচাঁদের উদ্ধৃতিকে সমর্থন ক’রে ব’লে বসলেন যে খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকের শেষদিকে কেরলে ঘাঁটি গেড়ে বসা কিছু আরব বণিকদের সংস্পর্শে এসেই নাকি শঙ্করাচার্য একেশ্বরবাদের ধারণাটির প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। তারাচাঁদ যে তত্ত্বের অবতারণা করেছেন তার প্রতিস্পর্ধী তত্ত্বের প্রতিপাদন ক’রে একখানি গবেষণামূলক প্রবন্ধ লিখতে ইতিহাসের শিক্ষকটি আমায় আহ্বান জানালেন। এর জবাবে আমি ভক্তি আন্দোলন বিষয়ে একখানি দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখে ফেললাম, যা গোটা ক্লাসের সামনে প’ড়ে শেষ করতে আমার এক ঘণ্টা সময় লেগেছিল। সম্পূর্ণ নিজস্ব মতামত ও বুদ্ধিমত্তার উপর দাঁড়িয়ে নিজের যুক্তিকে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে পেশ করতে পারার জন্য ইতিহাসের শিক্ষকটি আমায় বাহবা দিয়েছিলেন বটে, কিন্তু তিনি এই ব’লে গোঁ ধ’রে রইলেন যে তারাচাঁদের মতো একজন নামকরা বিশেষজ্ঞ ভুল হ’তে পারেন না।

ধীরে ধীরে আমাদের সংস্কৃত অধ্যাপক আমার খুব কাছের মানুষ হয়ে উঠলেন, আমিও ছাত্র হিসেবে তাঁর অত্যন্ত প্রিয়পাত্র হয়ে উঠলাম। উনি একটি সংস্কৃত পরিষদ গঠন করলেন, আর তার প্রথম সভাপতি হিসেবে বাছলেন আমায়। তিনি যেকোনো বিষয়ে ঝর্‌ঝর্‌ ক’রে সংস্কৃতে বক্তৃতা দিতে পারতেন, এবং আমাকেও সংস্কৃতে বক্তৃতা লিখে প্রস্তুত করতে ও সেগুলি পাঠ ক’রে শোনাতে উৎসাহ যোগাতেন। এই কাজে আমায় অত্যন্ত বেগ পেতে হ’ত, তবে তিনি আমায় যথেষ্ট সাহায্য করতেন। শেষ অব্দি আমি সফল হয়েছিলাম এবং এমন বহু মানুষকে অবাক করেছিলাম যাঁরা কখনো আমার সংস্কৃতজ্ঞানের কথা শোনেননি। এমন অনেক বিখ্যাত পণ্ডিতদের কাছ থেকে শোনবার অভিজ্ঞতাও আমার হয়েছিল, যাঁরা আমাদের সংস্কৃত পরিষদের পরপর দুটি বার্ষিক সভায় বক্তৃতা দিতে এসেছিলেন।

তবে হরিজন সংক্রান্ত কাজের সঙ্গে আমার যুক্ত থাকার তিনি ছিলেন ঘোর বিরোধী। একবার আমার এক বন্ধু তাঁর সামনে আমার প্রশংসা করতে গিয়ে এই খবরটা তাঁর কানে তুললে তিনি প্রথমে বিশ্বাসই করতে চাননি যে আমি অমন একটা “হীন” কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারি। তিনি তৎক্ষণাৎ আমায় নিজের কাছে ডেকে পাঠিয়ে সরাসরি কথাটা জিজ্ঞেস করলেন। আমি তাঁকে সত্যিটাই জানালাম। কিন্তু এর ফলে তাঁর চোখের চাউনিতে কিংবা কথায় কোনো তিরস্কার টের পেলাম না। তিনি খুব নরম গলায় আমার মত পাল্টানোর চেষ্টা করলেন, দু-একটা উদাহরণ দেখিয়ে বোঝাতে চাইলেন যে কিছু বিশেষ শ্রেণীর লোকে বংশানুক্রমিকভাবেই দুরাচারী হয়ে থাকে। তাঁর প্রতি আমার এতটাই শ্রদ্ধা ছিল যে আমি কোনোরকম তর্কের ভেতরে গেলাম না। তবে আমি তাঁকে জানান দিয়েছিলাম যে আমি তাঁর সঙ্গে একমত নই।

আমি মার্ক্সবাদের প্রতি আকৃষ্ট হ’তে শুরু করবার আগেই এই অসামান্য পণ্ডিত তথা শিক্ষক মানুষটি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। এবং আমার কলেজের পাঠ শেষ হবার আগে উনি দেহত্যাগ করেন। ওঁর ছত্রছায়ায় থাকলে আমি কখনো মার্ক্সবাদ কিংবা নাস্তিকতার কবলে পড়তাম কিনা সন্দেহ। অস্পৃশ্যতার বিষয়ে আমাদের দুজনের অভিমত কখনো কোনোভাবে মিলত কিনা তাও বলা শক্ত। কিন্তু অতীতের দিকে ফিরে তাকালে এই ভেবে কৃতজ্ঞতায় আমার হৃদয় পূর্ণ হয়ে ওঠে যে তিনিই প্রথম আমার মনে হিন্দু সংস্কৃতি এবং ইতিহাস সম্পর্কে গৌরব বোধ করবার বীজগুলি বপন ক’রে গিয়েছিলেন।

সংস্কৃতের এই মহাপণ্ডিতের পদতলে ব’সে যে শিক্ষালাভ করেছিলাম, সে-শিক্ষার প্রভাব একটি শক্তিশালী অন্তঃসলিলা নদীর প্রবাহের মতো ভেতরে ভেতরে বইছিল ব’লেই হয়তো আমার শুরুর দিনগুলির উপাস্যগণ এবং আদর্শগুলির থেকে আমি কখনো পুরোপুরিভাবে, চিরতরে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাইনি। মার্ক্সবাদের প্রভাবের ফলে ঈশ্বরের সেই ধারণাটির উপর থেকে আমি বিশ্বাস হারিয়ে ফেললাম যাতে ঈশ্বরকে জগতের সৃষ্টিকর্তা ও নিয়ন্তা হিসেবে দেখা হয়ে থাকে। কিন্তু শ্রী গরীবদাসের প্রতি, এবং তাঁর মহাগ্রন্থ “গ্রন্থসাহেব” মারফৎ যেসকল সাধুসন্ত এবং সূফীদের সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটেছিল তাঁদের প্রতি আমার শ্রদ্ধাভক্তি অটুট রইল। গান্ধীবাদে আমার আর কোনো আস্থা ছিল না, কিন্তু তাতে মহাত্মা গান্ধীর প্রতি আমার শ্রদ্ধায় এতটুকু চিড় ধরল না। আগের মতোই তাঁর আত্মিক শক্তি এবং নৈতিক দৃঢ়তা আমার উপর প্রভাব বিস্তার করতে থাকল। আর যখনই শ্রীরামকৃষ্ণদেব কিংবা স্বামী বিবেকানন্দের পুণ্য নামগুলি উচ্চারিত হ’ত, আমার মাথা আপনা থেকে শ্রদ্ধায় অবনত হয়ে আসত।

আমার বৌদ্ধিক ধ্যানধারণা এবং অনুভূতিগত উপলব্ধিগুলির মধ্যে যে ফারাকটা রয়ে গিয়েছিল তার আরো একটি কারণ হচ্ছে এই যে আমি মার্ক্সবাদকে আংশিকরূপে স্বীকার করেছিলাম মাত্র। মার্ক্সের ঐতিহাসিক বস্তুবাদ-কে আমি মানবেতিহাসের অগ্রগতির বিভিন্ন পর্যায়ের পর্যাপ্ত ব্যাখ্যা ব’লে মেনে নিয়েছিলাম। এ পর্যন্ত মানবসমাজ যা কিছু পুঁজি অর্জন ও সঞ্চয় করতে সক্ষম হয়েছে তার উৎসের ব্যাখ্যা হিসেবে মার্ক্স প্রণীত শ্রমের মূল্যায়ন সংক্রান্ত তত্ত্বকেই আমি শিরোধার্য করেছিলাম। সেসময় আমি স্পষ্ট দেখতে পেতাম যে রাষ্ট্র হচ্ছে আসলে শ্রেণি-শোষণ করবার একটি যন্ত্র। সামাজিক প্রতিষ্ঠানসমূহ, আইনবিধান এবং প্রথাগত নৈতিক মূল্যবোধের পর্দার আড়ালে আমি নগ্ন শ্রেণিস্বার্থ খুঁজে পেতে লাগলাম। এবং আমি এও বিশ্বাস করে ফেললাম যে আন্তর্জাতিক স্তরে সর্বহারা শ্রেণী কর্তৃক বিপ্লব হওয়াটা শুধু অবশ্যম্ভাবীই নয়, কাম্যও বটে। কিন্তু বিশ্বজগতের চলনপ্রক্রিয়াটির লাগসই ব্যাখ্যা হিসেবে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদকে গ্রহণ করাটা আমার কাছে শুধু যে কঠিন ঠেকল তা-ই নয়, বরং প্রায় অসম্ভব মনে হ’ল।

ততদিনে আমি আধুনিক পাশ্চাত্য দর্শন বিষয়ে বেশ অনেকটা পড়াশুনো ক’রে ফেলেছিলাম, এবং সেইসূত্রে এটুকু বেশ বুঝতে পারছিলাম যে বস্তুবাদ আখেরে পরিণামবাদী[1] দর্শন হলেও দ্বান্দ্বিকতার[2] মধ্যে উদ্দেশ্যবাদের[3] একখানি সুস্পষ্ট ছাপ রয়েছে। অতএব বস্তুবাদ এবং দ্বান্দ্বিকতার মধ্যে সমন্বয় ঘটানো সম্ভব নয়। ব্যাপারটা আমি আমার রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপকের কাছে পাড়লাম, যাঁকে আমি একজন খুব বড় মার্ক্সবাদী ব’লে মনে করতাম। কিন্তু তিনি স্বীকার ক’রে বসলেন যে দর্শনশাস্ত্রে কোনোকালেই তাঁর ব্যুৎপত্তি ছিল না এবং তিনি কখনোই দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ নিয়ে পড়াশুনো করেননি। এরপর আমি আমাদের কলেজের একজন দর্শনের অধ্যাপকের কাছে সমস্যাটা নিয়ে গেলাম। তিনি আমার এই সন্দেহকেই মান্যতা দিলেন যে যুক্তিগ্রাহ্যভাবে বস্তুবাদ এবং দ্বান্দ্বিকতাকে মেলানো অসম্ভব। এ বিষয়টা আমি এখানেই ছেড়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু এই মতাদর্শগত ফাঁকটি থাকার কারণে আমার মনে একটা খচখচানি লেগে রইল।

ইতিমধ্যে আমি আমার মনের মন্দিরের মধ্যে বাঁধিয়ে রাখা উপাস্য সাধুসন্ত এবং ঋষিপ্রতিম ব্যক্তিদের তালিকায় আরো দু’টি নাম যোগ করে ফেলেছিলাম – সক্রেটিস এবং শ্রীঅরবিন্দ। দীর্ঘমেয়াদী পরিপ্রেক্ষিতে আমার বৌদ্ধিক বিকাশের উপর এঁরা গভীর প্রভাব ফেলেছিলেন।

গ্রীক রাজনৈতিক চিন্তাধারার ছাত্র হবার সুবাদে আমার পাঠ্যসূচী-নির্দিষ্ট তালিকার অন্তর্ভুক্ত ছিলেন প্লেটো, যিনি একপ্রকার আমায় সক্রেটিসের পদতলে এনে ফেলেছিলেন বলা যায়। তবে “রিপাব্লিক”, “ল’জ্‌”, এবং “স্টেট্‌স্‌ম্যান” শীর্ষক যে তিনটি কথোপকথন পড়লেই আমার পাঠ্যক্রম শেষ হয়ে যেত, স্রেফ সেগুলি প’ড়েই আমি ক্ষান্ত হলাম না। বিশেষ ক’রে যে ব্যক্তিত্বটির ব্যাপারে আরো বেশি ক’রে জানবার আকাঙ্ক্ষায় আমি প্লেটোর প্রায় সমস্ত রচনা প’ড়ে ফেলেছিলাম, তিনি হলেন সক্রেটিস – যে সক্রেটিসকে কেউ একসময় অত্যন্ত যথাযথ কারণেই পাশ্চাত্যের সর্বপ্রথম সত্যাগ্রহী ব’লে বর্ণনা করেছিলেন। তাঁকে সম্পূর্ণ স্বমহিমায় ভাস্বর হয়ে উঠতে দেখলাম তাঁর জীবনের শেষ দিনগুলির আধারে রচিত কথোপকথনগুলিতে, যেগুলি হ’ল “অ্যাপোলজি”, “ক্রিটো”, এবং “ফীডো”। তাঁর জ্ঞান এবং চারিত্রিক মহত্ত্ব আমায় মন্ত্রমুগ্ধ করেছিল। সক্রেটিসের চরিত্রের প্রতি এহেন অনুরাগবশতঃই পরবর্তীকালে আমি এই তিনটি কথোপকথন “সত্যকাম সক্রেটিস” শিরোনামে হিন্দিতে অনুবাদ ক’রে ছেপে বের করেছিলাম।

অন্যদিকে শ্রীঅরবিন্দের সঙ্গে আমার পরিচয় বেশ অযাচিতভাবেই ঘ’টে গিয়েছিল। প্রথমবার তাঁর নাম আমি শুনি আমার পিতৃদেবের কাছ থেকে, যিনি তাঁকে একজন মহাযোগী ব’লে মানতেন ও তাঁর গুণকীর্তন করতেন। এমনকী বাবা বিশ্বাস করতেন যে শ্রীঅরবিন্দ আক্ষরিক অর্থেই মাটি থেকে অন্ততঃ পাঁচ ফুট উপরে শূন্যে উঠে ভাসমান থাকবার ক্ষমতা রাখেন। তবে আমি তখনো পর্যন্ত শ্রীঅরবিন্দের কোনো রচনা পড়িনি; যেসব শ্রেষ্ঠ মনীষীর রচনা আমি কখনো না কখনো পড়ব ব’লে মনস্থ করেছিলাম তাঁদের তালিকাতেও তিনি ছিলেন না। কলেজের বুদ্ধিজীবী মহলের অভিজাত অংশটির মুখে যে নামগুলি বেশি ক’রে শোনা যেত সেগুলি হচ্ছে স্পেঙ্গ্‌লার, বের্গসঁ, মার্সেল প্রুস্ত, বার্নার্ড শ এবং অ্যাল্ডাস হাক্সলী; তবে এই অভিজাত বৃত্তটির কারোর মুখে শ্রীঅরবিন্দের নাম আমি কখনো শুনিনি।

শুনতে অদ্ভুত লাগতে পারে, কিন্তু শ্রীঅরবিন্দের সান্নিধ্যে আমি পৌঁছতে পেরেছিলাম মনোবিশ্লেষণের[4] প্রবর্তক সিগমন্ড ফ্রয়েডের প্রতি আমার আগ্রহের কারণে। মনোবিশ্লেষণ কলেজে আমার পাঠ্যবিষয়ের অন্তর্ভুক্ত ছিল না। কিন্তু আমার দার্শনিক বন্ধুটি পাশ্চাত্য দর্শনের পাশাপাশি পাশ্চাত্য মনোবিজ্ঞান সম্পর্কেও আমার আগ্রহ জাগিয়ে তুলেছিল। সেকালে মনোবিজ্ঞানের[5] যে ছয়টি ধারা প্রচলিত ছিল, তাদের সবকটির বিষয়ে আমি প’ড়ে ফেললাম। কিন্তু আমার নজর কেড়েছিল শুধুমাত্র ফ্রয়েডের স্তরীয় মনোবিজ্ঞান[6]। তদবধি তাঁর যতগুলি বই প্রকাশিত হয়েছিল, সেগুলির প্রায় সবক’টি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে ছিল, তাঁর বিশালকায় কেস স্টাডিগুলি সমেত। এইসব মোটা মোটা বই নেবার মতো পাঠক ছিল বিরল। কাজেই আমি নিজের ইচ্ছেমত অবসর সময়ে এই বইগুলি পড়তে পারতাম। এই বইগুলি থেকে আদৌ কোনো চিন্তাভাবনার রসদ আমি লাভ করতে পেরেছিলাম কিনা বলতে পারিনা। তবে আমার মনে আছে যে এরপর থেকে আমি নিজের মানসিক গঠনের মধ্যে নানান ধরণের ঘাত-প্রতিঘাত এবং গূঢ়ৈষার অস্তিত্ব দেখতে পেতে শুরু করলাম। হোমিওপ্যাথির অপরিণত ছাত্র যেমন মেটেরিয়া মেডিকায় বর্ণিত যাবতীয় রোগভোগের লক্ষণ নিজের ভেতরে টের পাচ্ছে ব’লে আশঙ্কা করতে শুরু করে, আমার দশা হয়েছিল অনেকটা তেমনই।

আমার এইসব অস্বাস্থ্যকর আশঙ্কার কারণে আমি আমাদের কলেজের একজন অধ্যাপকের দ্বারস্থ হলাম, যিনি ছিলেন একজন নামকরা মনোবিশ্লেষক[7]। তিনি আমায় ফ্রয়েড অনুমোদিত চিকিৎসা পদ্ধতি “অবাধ ভাবানুষঙ্গ”[8]-এর কয়েকটি সেশন করালেন। ওতে আমার কোনো লাভ হয়েছিল ব’লে মনে পড়ে না। আমি যে আসলে অটো-সাজেশনের শিকার সেটা বুঝতে অধ্যাপকটির নিশ্চয়ই খুব বেশি সময় লাগেনি। তবে একদিন আমি বেশ হকচকিয়ে গিয়েছিলাম, যখন তিনি আমায় হঠাৎ জিজ্ঞাসা ক’রে বসলেন যে আমি ঈশ্বরে বিশ্বাস করি কি না। আমি তাঁকে নেতিবাচক উত্তর দেওয়ায় তিনি আবার জিজ্ঞাসা করলেন যে আমি মানবচেতনার কোনো উচ্চতর অবস্থায় বিশ্বাস করি কি না। এখন এই ব্যাপারটি আমার পক্ষে ততক্ষণ অব্দি অস্বীকার করা সম্ভব ছিল না, যতক্ষণ না আমি গরীবদাস এবং সেই সমস্ত সাধুসন্ত ও সূফীদের সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করছি যাঁরা সর্বদা নূর[9] এবং জহুর[10]-এ পরিপূর্ণ এক চেতনার জয়গান গেয়েছেন।

আমার জানা ছিল না যে অধ্যাপকটি আসলে ছিলেন শ্রীঅরবিন্দের একজন ভক্ত। তিনি একবারে নিজের সবটা আমার কাছে প্রকাশ করতে দিতে রাজি ছিলেন না। তিনি আমায় শুধু এইটুকু জানান দিলেন যে মনোবিশ্লেষণের উপর বহু বছর যাবৎ অগাধ আস্থা রাখা সত্ত্বেও তিনি অবশেষে এই সিদ্ধান্তে এসেছেন যে মানসিক বিকারগুলির প্রতিকারের জন্য যোগ অনেক বেশি কার্যকরী পন্থা।

আমি যোগ সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানতাম না। ভারতীয় দর্শনের অন্তর্গত যোগপরম্পরার একজন প্রবক্তা হিসেবে পতঞ্জলির নামটি সম্পর্কে আমার শুধু একটু ভাসা-ভাসা জ্ঞান ছিল। কিন্তু ঐ পর্যন্তই। তখনো অব্দি আমি ভারতীয় দর্শনগুলির একটিরও বিষয়ে কোনো পড়াশুনো করিনি, করবার কোনো ইচ্ছেও ছিল না। অধ্যাপকটি আমায় পরামর্শ দিলেন যে আমাকে যোগের দার্শনিক দিকটি নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না। আমার যা দরকার সেটি হচ্ছে যোগের ব্যবহারিক দিকটি নিয়ে শ্রীঅরবিন্দের কিছু সহজ ব্যাখ্যামূলক রচনা দিয়ে এই বিষয়ে পাঠ শুরু করা। যদি আমি খুঁজে না পাই তাহলে তিনি নিজেই কয়েকটি বই আমায় ধার দেবেন ব’লেও কথা দিলেন।

শ্রীঅরবিন্দের রচনা খুঁজতে খুঁজতে আমি ফের গিয়ে হাজির হলাম আমার প্রথম পছন্দ, চাঁদনী চকের সেই পুরনো গ্রন্থাগারটিতে। আমার কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারগুলি ওঁর লেখা একটিও বই তখনো অব্দি আনায়নি, তার কারণ হয়তো এই যে সেসব বই তখন সবেমাত্র প্রকাশিত হয়েছে। চাঁদনী চকের গ্রন্থাগারে অবশ্য শ্রীঅরবিন্দের বেশ অনেকগুলিই বই ছিল। “দ্য লাইফ ডিভাইন” তাদের মধ্যে একটি। আমি সঙ্গে সঙ্গে এই বইটি নিয়ে নিলাম, আর তখনকার মতো অধ্যাপক মশাই যেসব বই নিতে বলেছিলেন তাদের কথা বেমালুম ভুলে গেলাম। এরপর আমার যে বৌদ্ধিক অভিজ্ঞতাটি হয়েছিল তার কথা আমি জীবনে ভুলবো না। আমার এখনো মনে আছে, কোনো এক রাতে লন্ঠনের কেরোসিন ফুরিয়ে গেছে দেখে কীভাবে ছাদে উঠে চাঁদের আলোয় ব’সে আমি এই চমৎকার বইটি পড়বার চেষ্টা করেছিলাম। যেভাবে শ্রীঅরবিন্দ বস্তুবাদী দর্শনকে তার সমস্ত আধ্যাত্মিক এবং বৈজ্ঞানিক শ্রেণীবিন্যাসগত জটিলতা ও মানবজীবনে সেসবের তাৎপর্য সমেত সামগ্রিকভাবে এবং বস্তুনিষ্ঠ উপায়ে ব্যাখ্যা করেছেন, সেই ব্যাপারটাই আমায় তখন সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট করেছিল। এখানে আমি এমন এক মননের পরিচয় পেলাম যা মার্ক্সের মতোই ক্ষুরধার অথচ ওর চেয়ে অনেক বেশি পরিসর জুড়ে বিচরণশীল।

আজকাল যখন অতীতের দিকে ফিরে তাকাই, তখন বুঝতে পারি “দ্য লাইফ ডিভাইন” গ্রন্থটিতে শ্রীঅরবিন্দ যে সুবিশাল দৃষ্টিপথটি প্রসারিত ক’রে গেছেন, তার বেশিরভাগটাই সেসময় আমার আয়ত্তের সীমার বাইরে ছিল। বিশ্বচরাচরের ক্রিয়া এবং মানব-নিয়তির ক্রীড়াটির সাক্ষী হিসেবে যে উচ্চতায় তিনি পৌঁছতে পেরেছিলেন তা দেখে আমি আক্ষরিক অর্থেই হাঁ হয়ে গিয়েছিলাম। তবে একটা ব্যাপার প্রথম থেকেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে মানুষ সম্পর্কে তাঁর ধারণাটির মধ্যে এমন কতকগুলি মাত্রা ছিল যেগুলি আমার জানা অন্য সমস্ত মত ও পথের বক্তব্যের চাইতে ছিল একেবারে আলাদা। মানুষকে তিনি স্রেফ বস্তুপণ্যের উৎপাদক ও ভোক্তা হিসেবে দেখছিলেন না। এমনকী তিনি মানুষকে কোনো সামাজিক, রাজনৈতিক কিংবা অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের সদস্য হিসেবেও দেখছিলেন না। এমনও নয় যে মানুষকে তিনি কেবলমাত্র একটি বুদ্ধিমান প্রাণী অথবা নৈতিক উন্নতিকামী ব্যক্তি কিংবা সৌন্দর্যবিচারক হিসেবে দেখতেন। তাঁর মতে, মানুষের মধ্যে এই সমস্ত সত্তাই বিদ্যমান। কিন্তু সেইসঙ্গে মানুষ আসলে এর চাইতে অনেক বেশি কিছু। মানুষ হ’ল জ্যোতির্ময় আত্মা, দেবত্ব যার অন্তর্নিহিত সত্য। একমাত্র এই দেবত্বই পারে মানুষের ব্যক্তিত্বের বাহ্যিক প্রকাশগুলিকে ধারণ করতে এবং ওগুলিকে অর্থবহ ক’রে তুলতে।

এছাড়া মানবজাতির চরম পরিণতি সম্পর্কে শ্রীঅরবিন্দ যে ভবিষ্যদ্বাণী ক’রে গিয়েছেন তার পরিব্যাপ্তি এই একই বিষয়ে মার্ক্সের করা ভবিষ্যদ্বাণীর তুলনায় অনেক বেশি। সর্বহারা শ্রেণী কর্তৃক সংঘটিত যে আন্তর্জাতিক বিপ্লবের কথা মার্ক্স অনুমান করেছেন এবং যার সপক্ষে তিনি প্রচারও করেছেন, বলা হয়ে থাকে যে সেই বিপ্লব মানবজাতিকে এমন এক স্তরে উন্নীত করবে যেখানে মানুষ শ্রেণীস্বার্থের কারণে ঘ’টে থাকা বিকৃতিগুলি ছাড়াই যুক্তিসম্মত, নৈতিক এবং নান্দনিক ক্রিয়াকলাপে নিযুক্ত হ’তে পারবে। কিন্তু মানুষের প্রাণিক, মানসিক এবং দৈহিক অবস্থাগুলির পরামানসিকীকরণের[11] যে কথাটি শ্রীঅরবিন্দ চিত্রিত এবং অনুমোদিত ক’রে গিয়েছেন তা মানবজাতিকে একদিকে পার্থিব টানাপড়েনে জর্জরিত মানবজীবন এবং অন্যদিকে আধ্যাত্মিক সত্তা রূপে স্বতঃই বিদ্যমান মানবজীবনের অন্তর্বর্তী দুস্তর ব্যবধানটিকে অতিক্রম করবার ক্ষমতা যোগায়।

মার্ক্স এবং শ্রীঅরবিন্দের মধ্যেকার পার্থক্যগুলিকে নির্দেশ করবার জন্য যেসব পারিভাষিক শব্দাবলী আমি এখন ব্যবহার করছি সেসব তখন আমার করায়ত্ত ছিল না। এখন যেটুকু স্পষ্টভাবে গুছিয়ে বলতে পারছি তার বেশিরভাগটাই এর পরবর্তী সময়ে অর্জিত জ্ঞান। তবে আমার সেই সময়কার ধারণাগুলি যতই অস্পষ্ট এবং অপরিণত হোক না কেন, আমি এটা বেশ বুঝতে পেরেছিলাম যে শ্রীঅরবিন্দ বিশ্বজগত এবং মানবজীবনের যে দিকগুলির কথা বলছেন সেগুলি একেবারেই মৌলিক। একদিকে আমার যাবতীয় জাগতিক স্বার্থ এবং অন্যদিকে শ্রীঅরবিন্দ নির্দেশিত বিরাট লক্ষ্যগুলির মধ্যে খুবই বিস্তর ব্যবধান ছিল। সেই ব্যবধানটিকে অতিক্রম করবার ইচ্ছে অথবা সাহস জুটিয়ে ওঠা আমার পক্ষে ছিল দুঃসাধ্য। কিন্তু বিশ্বজগতের রহস্য, তার মধ্যে মানুষের স্থান, এবং মানবজীবনের একটি অর্থবহ উদ্দেশ্য কী হ’তে পারে এইসমস্ত বিষয়ে আমার মনের গভীরে কৌতূহল জেগে উঠল।

এমতাবস্থায় আমার সামনে যে সমস্যাটি দেখা দিল তা হচ্ছে মার্ক্সের সঙ্গে শ্রীঅরবিন্দকে খাপ খাওয়ানো, ঐ একই ক্রম মেনে। ক্রম অনুযায়ী মার্ক্স অবশ্যই আগে থাকবেন। আমি প্রধানতঃ যে বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত তথা অত্যন্ত অতৃপ্ত ছিলাম সেটি হচ্ছে সামাজিক প্রেক্ষাপট, যার শ্রেষ্ঠ ব্যাখ্যাতা তিনিই। মার্ক্সীয় সমাজব্যবস্থার মধ্যে কোনোখানে কোনোভাবে শ্রীঅরবিন্দকে গুঁজে দেবার দরকার ছিল। এর বেশ কয়েক বছর বাদে আমি এই সঙ্গতিস্থাপন করতে পেরে অত্যন্ত আত্মপ্রসাদ লাভ করেছিলাম। আমি তখন যে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলাম তা হচ্ছে এই – মার্ক্স যেমন সমাজব্যবস্থার মধ্যে সামঞ্জস্য আনতে পেরেছেন, তেমনি মনুষ্যচরিত্রের সামঞ্জস্যবিধানের চাবিকাঠিটি রয়েছে শ্রীঅরবিন্দের হাতে। এই সঙ্গতিস্থাপনের চেষ্টাটি যে কতটা হাস্যকর ছিল, তা আমি সেই মুহূর্ত অব্দি উপলব্ধি করতে পারিনি যখন একজন নামকরা শ্রীঅরবিন্দ-বিশেষজ্ঞের কাছে আমি এই ব্যাপারটাকে আমার বুদ্ধির উৎকর্ষের একখানি নমুনা হিসেবে তুলে ধরাতে তিনি স্রেফ একটি সদাশয় হাসি হেসে বিষয়টি উড়িয়ে দিয়েছিলেন। আমি এই বিশেষজ্ঞটিকে একজন অতিশয় আত্মম্ভরী পণ্ডিত মনে ক’রে খারিজ ক’রে দিয়েছিলাম; কারণ, আমার মনে হয়েছিল যে শ্রীঅরবিন্দ সম্পর্কে তাঁর পড়াশুনো থাকলেও তিনি খুব সম্ভবতঃ মার্ক্স পড়েননি, অন্ততঃ আমার মতো অত ভালো ক’রে তো নিশ্চয়ই পড়েননি!

পাদটীকা

[1] deterministic

[2] dialectics

[3] teleology

[4] Psychoanalysis

[5] Psychology

[6] Depth psychology

[7] Psychoanalyst

[8] Free association

[9] জ্যোতি

[10] উদ্ভাস, প্রকাশ

[11] supramentalisation

মূল গ্রন্থের রচয়িতা: সীতারাম গোয়েল
বঙ্গানুবাদ : শ্রীবিজয়াদিত্য

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.