(পঞ্চম অধ্যায়ের পর)

ছয়

রক্ষাকর্তা রাম স্বরূপ

১৯৪৮-এর ফেব্রুয়ারি মাসে কলকাতার ময়দানে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির যে দ্বিতীয় দলীয় সমাবেশটি অনুষ্ঠিত হয়, আমি তাতে উপস্থিত ছিলাম। এই সমাবেশটি অনুষ্ঠিত হবার সামান্য কিছু দিন আগেই বি.টি. রণদিভে পি.সি. জোশীর হাত থেকে সিপিআই-এর সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বভার গ্রহণ করেছিলেন। ভারতে যা রণদিভে লাইন নামে পরিচিতি লাভ করল সেটি আসলে ছিল ১৯৪৭-এর সেপ্টেম্বর নাগাদ স্তালিন কর্তৃক প্রবর্তিত আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট কর্মসূচীরই একখানি সংস্করণ, যে কর্মসূচীর মূল প্রবক্তা ছিল স্তালিনের অনুচর জ্‌দানভ।

জ্‌দানভের কর্মসূচীর ফল হিসেবে পূর্ব ইউরোপে সোভিয়েত ইউনিয়ন কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত ক্ষুদ্র দেশগুলিতে ব্যাপক রাজনৈতিক উচ্ছেদ অভিযান শুরু হ’ল এবং শেষ অব্দি কমিউনিস্টরা চেকোস্লোভাকিয়া দখল করল। ভারতবর্ষ, বার্মা, মালয়, ইন্দোনেশিয়া এবং ফিলিপিন্সের কমিউনিস্ট পার্টিগুলি সশস্ত্র অভ্যুত্থান খাড়া করতে শুরু করল। চীনের গৃহযুদ্ধ আরো জোরদার হ’ল এবং পরিণামে ১৯৪৯ সালে মাও-এর বিজয় ঘটল। এই কর্মসূচীর চূড়ান্ত পর্যায়ে উত্তর কোরিয়ার কমিউনিস্ট সৈন্যরা দক্ষিণ কোরিয়ায় আক্রমণ হেনে বসে। ব্রিটিশ শক্তির অপসারণ এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল হ’তে মার্কিন সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করবার ফলস্বরূপ যে শূন্যস্থান তৈরি হয়েছিল তা পূরণ করতে স্তালিন আসরে নেমে পড়েছিলেন।

সিপিআই-এর এই দ্বিতীয় দলীয় সমাবেশের জন্য যে বিশাল মঞ্চটি প্রস্তুত করা হয়েছিল, সেটি ছিল মার্ক্স, এঙ্গেলস, লেনিন, স্তালিন, মাও এবং মার্শাল টিটোর প্রতিকৃতি দিয়ে সাজানো। পূর্ব ইউরোপ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। য়ুগোস্লাভিয়ার প্রতিনিধিটির পিঠে তখনো একখানি জার্মান বুলেট বিঁধে ছিল, তাই বিশেষ ক’রে তাঁকে মঞ্চে একজন বীর যোদ্ধা হিসেবে পেশ করা হ’ল। ওঁর নামটি আমার কানে “জগদীশ” ব’লে ঠেকেছিল। পরে জানলাম যে তিনি হচ্ছেন কমরেড দেদেইর। একের পর এক বক্তা অগ্নিবর্ষী ভাষণ দিয়ে গেলেন এবং “যে বুর্জোয়া হারামজাদারা ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের কাছে নিজেদের বিকিয়ে দিয়েছে তাদের রেয়াত না করবার” জন্য জনতাকে আহ্বান জানালেন।

এসব দেখেশুনে আমি তো খুবই রোমাঞ্চিত বোধ করেছিলাম এবং ঠিক ক’রে ফেলেছিলাম যে শীঘ্রই পার্টিতে যোগ দেব। এর মাত্র কয়েকমাস আগেই আমি আরেকজন বাঙালি কমিউনিস্টের সান্নিধ্যে এসেছিলাম, যে কলকাতায় পার্টির গঠনতন্ত্রের বেশ উঁচুতলায় আসীন ছিল। সে ছিল আমার আপিসের বড়কর্তার বন্ধু এবং ক্রমে আমার সঙ্গেও তার বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল। তারও একটি বড়সড় সংগ্রহ-বিশিষ্ট গ্রন্থাগার ছিল। আমি এবার তাকেই ধরলাম আমায় পার্টির সদর দপ্তরে নিয়ে গিয়ে দলীয় সদস্য হিসেবে নাম নথিভুক্ত করাতে। আমাকে সঙ্গে ক’রে নিয়ে গিয়ে কবে বিপ্লবের সঙ্গে আমার মোলাকাত করিয়ে দেবে সেসব দিনক্ষণও সে ঠিক ক’রে ফেলল। তারিখটি আসবার অপেক্ষায় আমি অধীর আগ্রহে দিন গুনতে আরম্ভ করলাম। এর আগে কখনো কোনোকিছুর জন্য এমন উদগ্রীব অপেক্ষা আমি করিনি।

কিন্তু বিধির বিধান ছিল অন্যরকম। ঠিক ঐ নির্দিষ্ট দিনটিতেই বাংলায় কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ঘোষিত হ’ল। সেসময় যে বাড়িটিতে আমি থাকতাম তার নীচের তলায় একখানা টেলিফোন ছিল। তার নম্বরটা আমি আমার বাঙালি বন্ধুটিকে দিয়ে রেখেছিলাম, যাতে দরকার পড়লেই সে আমার সাথে যোগাযোগ করতে পারে। সেদিন সে আমায় ফোন করেছিল। ভোরবেলা। পার্টি যে নিষিদ্ধ হয়েছে সে খবর তখনো আমি পাইনি। ভারি গম্ভীর গলায় সে আমায় এই গুরুতর খবরটি জানালে। আমার প্রতি তার উপদেশ ছিল পার্টি অফিস কিংবা পার্টির কোনো গণসংগঠনের অফিসের কাছাকাছি যেন না যাই এবং প্রকাশ্যে যেন কমিউনিজমের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত না করি। এর কিছুদিন বাদে শেয়ার বাজারের মাড়োয়ারি বন্ধুটি আমায় জানালে যে যেহেতু আমার বাসস্থানটি পুলিশের সন্দেহের তালিকায় নেই তাই সেখানে রাজস্থান হ’তে আগত একজন কমিউনিস্ট নেতার থাকবার বন্দোবস্ত করা হ’তে পারে, যিনি আর মাত্র একপক্ষকালের মধ্যেই কলকাতায় এসে উপস্থিত হবেন। আমি তৎক্ষণাৎ ঐ বর্ষীয়ান নেতাকে স্বাগত জানাতে তৈরি হ’তে লাগলাম।

কিন্তু এবারেও বিধি বাম। ওঁকে স্বাগত জানাবার ‘সম্মান’টি আমার কপালে জুটল না। আমার পরম মিত্র রাম স্বরূপ হঠাৎ করেই এসে উপস্থিত হ’ল এবং আমার এখানে বেশ কিছুকাল থেকে যাবার ইচ্ছে ব্যক্ত করল। সেবারই ছিল তার প্রথম কলকাতা দর্শন। আমি তো যারপরনাই আনন্দিত হলাম, কারণ দুনিয়ায় তার মতন ভালো বন্ধু আমার আর দু’টি ছিল না। আমার জানা ছিল না যে ততদিনে রাম স্বরূপ কমিউনিজমকে এমন একখানি ভয়ঙ্কর ব্যাধি ব’লে গণ্য করতে শুরু করেছে, যা মানবজাতির ভবিষ্যতকে গ্রাস করে ফেলবার ক্ষমতা রাখে। তার চিঠিপত্রে কোথাও এই গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনটির কোনো আঁচ পাইনি। সে শুধু আমার ব্যাপারে একখানি ভবিষ্যদ্বাণী ক’রে বলেছিল যে আমার মত বুদ্ধিমান ব্যক্তির পক্ষে বেশিদিন কমিউনিস্ট হয়ে থাকা সম্ভব নয়। তবে একথাও সে স্বীকার করেছিল যে আমার মত বুদ্ধিমান ব্যক্তির কমিউনিস্ট না হয়েও গতি নেই। তার সাবধানবাণীতে আমি কান দিইনি, কিন্তু তার স্বীকারোক্তিটি আমি বেশ গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করেছিলাম।

কমিউনিজম সম্পর্কে রাম স্বরূপের সিদ্ধান্তগুলি তার আগমনের কিছুদিনের মধ্যেই আমার কাছে প্রকাশ হয়ে পড়ল যখন সে আমার মাড়োয়ারি বন্ধুটির সঙ্গে বাদানুবাদে জড়িয়ে পড়েছিল। রাম স্বরূপ সম্পর্কে আমি সবসময় এত স্নেহ এবং শ্রদ্ধা মিশিয়ে কথা বলতাম যে সেসময় মাড়োয়ারি বন্ধুটি বিশেষ ক’রে তার সঙ্গে আলাপ করবার জন্যেই এসেছিল। আমার এই দু’জন ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মধ্যে সদ্ভাব গ’ড়ে ওঠবার কোনো সম্ভাবনা নেই দেখে আমার দুঃখ হ’ল। মাড়োয়ারি বন্ধুটি বিদায় নেবার সময় আমি তাকে নীচের তলা অব্দি এগিয়ে দিয়ে আসতে গেলে সে আমায় জানালো যে রাজস্থান থেকে আগত কমিউনিস্ট নেতাটিকে এইরকম একটি অবাঞ্ছিত রাজনৈতিক মতাবলম্বী ব্যক্তির সঙ্গে একই ছাদের তলায় রাখা সে একেবারে বরদাস্ত করবে না। আমি তো শুনে আকাশ থেকে পড়লাম। রাম স্বরূপকে অবাঞ্ছিত ব’লে ভাবতে আমি একেবারেই পারতাম না। কিন্তু তার যুক্তি কী ক’রে খণ্ডাবো তাও ভেবে পেলাম না। উপরের তলায় আমার ঘরে ফিরে এসে রাম স্বরূপের কাছে মাড়োয়ারি বন্ধুটির সম্পর্কে তার কী ধারণা হয়েছে তা জানতে চাইলাম। সে একগাল হেসে বললে : “লোকটার মাথাটি নিরেট। ওর ঐ মোটা মাথায় কোনো যুক্তিই ঢুকবে ব’লে মনে হয় না।” আমি কমিউনিজম পরিহার করবার পরপরই ঐ মাড়োয়ারি ছেলেটির সঙ্গে আমার বন্ধুত্বের ইতি ঘটে এবং আমরা একে অপরের থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি।

এরপর আমার দেখতে ইচ্ছে হ’ল যে রাম স্বরূপের সঙ্গে আমার বাঙালি বন্ধুটির বনিবনা হয় কি না। তার কাছেও আমি রাম স্বরূপের গুণগান করেছিলাম এবং রাম স্বরূপের লেখা “লেট আস হ্যাভ রায়ট্‌স্‌ : দ্য ফিলজফি অফ দোজ হু ওয়ন্ট টু ডিভাইড ইন্ডিয়া বাই স্ট্রীট রায়ট্‌স্‌”[1] পড়তেও দিয়েছিলাম। একদিন এই বন্ধুটির বাড়িতে খাঁটি বাঙালি আদবকায়দা অনুযায়ী আমাদের আদর-আপ্যায়ন করা হ’ল। কিন্তু আমাদের নিমন্ত্রণকর্তা এবং রাম স্বরূপের মধ্যে তেমন কোনো কথোপকথনই হ’ল না। আমার বন্ধুটি পার্টির নতুন কর্মপন্থা বিশদে ব্যাখ্যা করছিল, রাম স্বরূপ কেবল চুপচাপ সেটি শুনে গেল। রাম স্বরূপের এই সতর্ক নৈঃশব্দ আমার মধ্যে কৌতূহল চারিয়ে তুলল। বন্ধুটির বাড়ি থেকে বেরনো মাত্র আমি তার ব্যাপারে রাম স্বরূপের অভিমত জানতে চাইলাম। রাম স্বরূপ বললে : “দেখো, কমিউনিজমের প্রতি এঁর আনুগত্য একটা রোগের আকার নিয়েছে। এই রোগ সারানো ভারি মুশকিল।” রাম স্বরূপের কলকাতায় আগমনের কিছুদিনের মধ্যে এই নিয়ে আমি দ্বিতীয়বার হতাশ হলাম।

আমার বাঙালি বন্ধুটি পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয় এবং কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই তাকে উত্তরবঙ্গের একটি বন্দিশিবিরে চালান করে দেওয়া হয়। ১৯৪৯ সাল নাগাদ সে যখন ছাড়া পেল ততদিনে আমি শুধু যে কমিউনিজম সর্বথা পরিত্যাগ করে ফেলেছি তাই নয়, এমনকী কলকাতার কয়েকটি খবরের কাগজে কমিউনিজম-বিরোধী লেখালেখিও প্রকাশ করেছি। সে একদিন আমার আপিসে দেখা করতে আসে এবং আমাকে জানায় যে আমার লেখা কয়েকটি মজার বিবৃতি তার চোখে পড়েছে। আমি তখন তাকে জানাই যে আমি যা লিখেছি তা অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারেই লিখেছি এবং সম্ভব হ’লে কোনো একদিন দুজনে ব’সে এই নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। কিন্তু সে তর্কবিতর্কের মধ্যে যাবার কোনো আগ্রহই প্রকাশ করল না। আরো একখানা সৌহার্দ্যপূর্ণ বন্ধুত্বের সম্পর্কের এখানেই ইতি ঘটল। পরবর্তীকালে হঠাৎ ক’রে কখনো দুজনের দেখা হয়ে গেলে সে সাক্ষাতে নেহাতই শীতল, লোকদেখানো সৌজন্য বিনিময়ের অতিরিক্ত আর কিছু থাকত না।

শেষমেশ আমি রাম স্বরূপ এবং আমার আপিসের কর্তাটির মধ্যে একটি সাক্ষাতের ব্যবস্থা করলাম। দুজনে নিছক সৌজন্য বিনিময় করেই কাটালো, অথচ যে বিষয়টা নিয়ে ওদের মধ্যে আলোচনা হবে ব’লে আশা করেছিলাম সে নিয়ে কেউ কোনো উচ্চবাচ্য করল না। আলোচনাটা অবশেষে হয়েছিল কয়েকদিন বাদে, যখন একদিন আমার আপিসের কর্তাটি আমার বসবার জায়গার পাশ দিয়ে যেতে যেতে আমার সামনে রাম স্বরূপকে বসে থাকতে দেখতে পেল। আলোচনা হ’ল আসন্ন বিশ্বব্যাপী মহামন্দা এবং তার ফলস্বরূপ বিশ্বের পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থাটি ভেঙে পড়বার ব্যাপারে, যা আমরা কমিউনিস্টরা সেসময় যেকোনো মুহূর্তে নেমে আসতে পারে ব’লে আশঙ্কা করছিলাম। আলোচনার মাধ্যমে কোনো ঐক্যমত্যে পৌঁছনো গেল না, কারণ রাম স্বরূপের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে পুঁজিবাদীরা আরেকটি অর্থনৈতিক মন্দা কিছুতেই হ’তে দেবে না, যেহেতু তারা নিজেদের অর্থনীতির উপর বেশ ভালোরকম নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে সক্ষম হয়েছে। তখন আমার আপিসের কর্তাটি সেবছর ঠিক কতগুলি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হয়ে গিয়েছে তার পরিসংখ্যান দিলে। ঐ একই সময়সীমার মধ্যে কতগুলি নতুন প্রতিষ্ঠান গজিয়ে উঠেছে সেই পরিসংখ্যানটিও নিজের এবং আমাদের অবগতির জন্য খুঁজে বের করতে রাম স্বরূপ তাকে অনুরোধ জানালে। তার যুক্তিটি ছিল এই যে যেকোনো সুস্থ অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় কিছু সংখ্যক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান রুগ্ন হয়ে শেষমেশ দেউলিয়া হয়ে যেতেই পারে, তবে ঐ ব্যবস্থার ভেতরে এর উল্টোটাও যদি সমানতালে ঘটতে থাকে তাহলে তাতে বিশেষ চিন্তিত হবার কিছু নেই। এই যুক্তিটি গোটা তর্কের মধ্যে একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গির সঞ্চার করল। ঐদিন আমার আপিসের কর্তাটি এরপর আর কিছু বলেনি। কর্তাটিকে কেমন লাগল সেকথা রাম স্বরূপকে জিজ্ঞেস করতে সে বললে : “এই লোকটি ঢের ভালো। তথ্য-পরিসংখ্যান দিয়ে তর্ক করে, পার্টির স্লোগান আওড়ায় না।”

কয়েক মাস কেটে গেল। এই ক’মাসের মধ্যে রাম স্বরূপ আমায় কমিউনিস্ট থেকে কমিউনিস্ট-বিরোধী ক’রে তুলল। আমাকে কয়েক সপ্তাহের জন্য চাকরিসূত্রে কলকাতার বাইরে যেতে হয়েছিল। রাম স্বরূপ সেসময় কলকাতাতেই ছিল, তবে আমি ফিরে আসবার আগেই সে কলকাতা ছেড়ে যায়। আপিসের কর্তার সঙ্গে দেখা হ’তে সে প্রথমেই বললে : “তোমার বন্ধুটি একজন অসাধারণ ব্যক্তি। আমরা একসাথে অনেকখানি সময় কাটিয়েছি। কমিউনিজম সম্পর্কে ওঁর বক্তব্যের সারবত্তা এখন আমি উপলব্ধি করতে পেরেছি।” সেই থেকে তাদের মধ্যে খুব ভালো বন্ধুত্ব গ’ড়ে ওঠে।

আমার তিন-তিনজন একনিষ্ঠ কমিউনিস্ট বন্ধুকে রাম স্বরূপের বিরুদ্ধে তর্কে প্রণোদিত করতে ব্যর্থ হবার পর আমায় একাই তার মুখোমুখি হতে হ’ল। মাসের পর মাস জুড়ে আলোচনা চলতে থাকল। আমি অধিকাংশ সময়েই পার্টির স্লোগান আওড়ে যেতাম, কখনো কখনো প্রচণ্ড উদ্দীপনার বশেই তেমনটা করতাম। রাম স্বরূপ হাসিমুখে সেসব অগ্রাহ্য করত। একদিন এরকম তর্ক চলতে চলতে উত্তেজনার বশে আমি একটা হামবড়া ভাব ক’রে বললাম : “আমরা যে কোনো ঐকমত্যে পৌঁছতে পারছি না তার কারণ হচ্ছে আমার দর্শন পড়া আছে, কিন্তু তুমি কেবলমাত্র অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির দিক দিয়ে বিষয়টি দেখছ।” তখন রাম স্বরূপ আমায় জিজ্ঞেস করল যে দর্শন বলতে আমি ঠিক কী বোঝাতে চাইছি। আমি তৎক্ষণাৎ আমার মনে মনে প্রস্তুত ক’রে রাখা তালিকাটি গড়গড় ক’রে ব’লে গেলাম – লক, বার্কলে, হিউম, দেকার্ত, স্পিনোজা, লীবনিৎজ্‌, কান্ট, হেগেল, শোপেনহাওয়ার ইত্যাদি। রাম স্বরূপ বললে যে সে কোনো না কোনো সময় এঁদের প্রত্যেকের লেখা সে পড়েছে, কিন্তু প্রত্যেককেই তার অপ্রাসঙ্গিক এবং নিষ্ফল মনে হয়েছে। শুনে আমি যুগপৎ অবাক এবং ব্যথিত বোধ করলাম। রাম স্বরূপ ব্যাখ্যা ক’রে বলল : “ধরা যাক কেউ একজন এক বা একাধিক দার্শনিক মতবাদ সম্পর্কে জানেন। কিন্তু তাতে কোনোভাবে কী সেই ব্যক্তিটি একজন ভালো মানুষ হয়ে উঠতে পারবেন? এই দার্শনিক মতবাদগুলি মস্তিষ্কের কসরত বই কিছু নয়, ব্যবহারিক জীবনে এদের প্রয়োগ খুব কমই হয়ে থাকে।” তারপর থেকে “মস্তিষ্কের কসরত” শব্দবন্ধটি আমার মনের মধ্যে কেবলই ঘুরপাক খেতে থাকল, আর আমার পক্ষে কোনো বিমূর্ত দার্শনিক ধারণা সম্পর্কে পড়াশোনা করা একপ্রকার অসম্ভব হয়ে দাঁড়াল। এর আগে অব্দি পাশ্চাত্য অধিবিদ্যা[2] এবং জ্ঞানতত্ত্ব[3] আমার অত্যন্ত প্রিয় বিষয় ছিল।

একদিন রাম স্বরূপ আমায় এসপ্ল্যানেডে অবস্থিত ইউএস ইনফর্মেশন লাইব্রেরীতে গিয়ে ডেভিড ড্যালিন রচিত “স্লেভ লেবার ইন সোভিয়েত রাশিয়া” নামক বইটিতে সংগৃহীত তথ্যপঞ্জীটিতে একবার চোখ বুলিয়ে আসতে বলল। এই গ্রন্থাগারটির ধারেকাছেও যেতে আমার ভীষণ কুণ্ঠা বোধ হ’ত তার কারণ এতদিন এটিকে আমি নগ্ন সাম্রাজ্যবাদী প্রচারযন্ত্রের অধিষ্ঠান ব’লে গণ্য করে এসেছি। এ ছিল ঠিক সেই রকমের কুণ্ঠা যা এককালে আমি শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণ পড়বার সময় টের পেয়েছিলাম। কিন্তু ততদিনে আমার কৌতূহলও জেগেছে। আমি চোরের মত গুটি গুটি পায়ে ঐ গ্রন্থাগারটিতে গেলাম এবং বইটি খুলে দেখলাম। সেখানে যে বিশদ এবং তথ্যসমৃদ্ধ পঞ্জীটি পেলাম তা আদতে হচ্ছে সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাধ্যতামূলক শ্রমশিবিরগুলিতে বন্দী মানুষজনকে দেওয়া পরিচয়পত্রগুলির প্রতিলিপি। কমিউনিজমের উপর আমার বিশ্বাসের ভিত্তিটি নড়ে উঠল। আমার তখনই মনে প’ড়ে গেল যে মস্কো থেকে প্রকাশিত “নিউ টাইমস” শীর্ষক সংবাদপত্রটিতে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, রাষ্ট্রপুঞ্জে বাধ্যতামূলক শ্রম বিষয়ক একটি বিতর্ক চলাকালীন মলোটভ সোভিয়েত ইউনিয়নে “সংশোধনমূলক শ্রমশিবির”-এর অস্তিত্বের কথা স্বীকার করে নিয়েছিলেন।

আমি আমার সন্দেহের কথা আমার আপিসের কর্তাটিকে জানালাম। সে হেসে আমায় বললে যে আমি যেন ভিক্টর ক্রাভচেঙ্কোর “আই চোজ্‌ ফ্রীডম” বইটি প’ড়ে দেখি, যেটি কিছুকাল পূর্বেই প্রকাশিত হয়েছিল। একই সঙ্গে আমার মনে প’ড়ে গেল যে মাসকয়েক আগে কর্তাটি এই বইয়ের একটি কপি আমায় ধার দিতে চেয়েছিল, আর আমি ঘৃণাভ’রে সেটি প্রত্যাখ্যান ক’রে বলেছিলাম যে সাম্রাজ্যবাদীদের প্রচারসাহিত্যের পেছনে নষ্ট করবার মত সময় আমার নেই। এবারে আমি তার কাছ থেকে বইটি চেয়ে নিলাম এবং একনিঃশ্বাসে প’ড়েও ফেললাম। এককালে লাস্কি’র “কমিউনিজম” পড়বার পর যে অভিজ্ঞতা আমার হয়েছিল এবারেও তার পুনরাবৃত্তি হ’ল। এবারে কমিউনিজম আমার চারধারে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ল। এবারে আমি বুঝতে পারলাম কেন আমার আপিসের কর্তাটি – যে কিনা এককালে পার্টি কর্মসূচীর অন্ধ সমর্থক ছিল – ১৯৪৮-এর ফেব্রুয়ারিতে পার্টি কর্তৃক গৃহীত নতুন কর্মসূচীর ব্যাপারে কোনো আগ্রহ দেখায়নি। ক্রাভচেঙ্কোর বইটি পাঠ করবার ফলে সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্পর্কে তার যাবতীয় উদ্দীপনা অনেকটাই ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিল। পরদিন আমি তাকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে সেকথা সে স্বীকারও ক’রে নিয়েছিল।

সোভিয়েত ইউনিয়নের নামকরা ধাতুবিদ্যার প্রকৌশলী ক্রাভচেঙ্কোকে “লেন্ড লীজ্‌ প্রোগ্রাম”-এর ভিত্তিতে রপ্তানি করা সামরিক সাজসরঞ্জামের তদারকি করবার জন্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ওয়াশিংটনে প্রেরণ করা হয়েছিল। এর কিছুকাল পরেই তিনি পশ্চিমী দেশগুলির শরণাপন্ন হন এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রকৃত রূপটি তুলে ধরবার জন্য নিজের জবানবন্দী হিসেবে এই বইটি লেখেন। খুব বিতর্কিত একটি বিষয়ের উপর ভিত্তি ক’রে রচিত হবার কারণে বইটি অত্যন্ত জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং অল্প সময়ের মধ্যেই বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়ে এটির বেশ কয়েকখানি সংস্করণ প্রকাশিত হয়। আমি নিজেই একসময়ে এই বইটি হিন্দিতে অনুবাদ ক’রে প্রকাশ করেছিলাম। কমিউনিস্ট সংবাদমাধ্যম অত্যন্ত কড়া ভাষায় এই বই এবং এর লেখকের নিন্দা করে। বইটি যখন আমি প্রথম পড়তে শুরু করি সেসময় ক্রাভচেঙ্কো প্যারিস থেকে প্রকাশিত একখানি বিখ্যাত ফরাসী পত্রিকার বিরুদ্ধে একটি দীর্ঘস্থায়ী মানহানির মামলা লড়ছেন। পত্রিকাটি তাঁকে সুরাসক্ত, মিথ্যেবাদী, প্রতারক ইত্যাদি নানাবিধ অভিধায় ভূষিত করেছিল। “ম্যাঞ্চেস্টার গার্ডিয়ান” এই মামলাটির পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ প্রতিদিন প্রকাশ করত। এই ইংরেজি দৈনিকটির বিমান-ডাক সংস্করণের একখানি কপি নিয়মিত কলকাতার ব্রিটিশ ইনফর্মেশন সার্ভিস লাইব্রেরীতে এসে পৌঁছত।

আমি প্রবল আগ্রহের সঙ্গে ম্যাঞ্চেস্টার গার্ডিয়ানে ক্রাভচেঙ্কোর মামলাটির উপর নজর রাখছিলাম। বইয়ে ক্রাভচেঙ্কো যা যা বলেছিলেন সে ব্যাপারে আমার মনে যেটুকু সন্দেহ ছিল তা এই মামলাটি দূর ক’রে দিল। ফরাসী পত্রিকাটি আত্মপক্ষ সমর্থন ক’রে যে আপীল করেছিল তাতে প্যারিসের সোভিয়েত দূতাবাসও এই ব’লে অংশ নিয়েছিল যে এই মামলার সঙ্গে তাদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদার প্রশ্ন জড়িয়ে রয়েছে। দূতাবাসের পক্ষ থেকে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বহুসংখ্যক সাক্ষী এনে প্যারিসের আদালতে হাজির করা হয়েছিল। প্রায় সমস্ত নামজাদা কমিউনিস্ট এবং পশ্চিম ইউরোপে তাদের যত সহমর্মী ছিল তাদের সকলকে ক্রাভচেঙ্কোর বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছিল। দেখেশুনে মনে হচ্ছিল যে আমি এক অভূতপূর্ব নাটকের সাক্ষী, যেখানে একদিকে ক্রাভচেঙ্কো নিজের বইয়ে উল্লিখিত দাবিগুলির সপক্ষে মূলতঃ সোভিয়েত ইউনিয়নের তরফ থেকে সরকারিভাবে প্রকাশিত তথ্য ও পরিসংখ্যান পেশ ক’রে চলেছিলেন, আর অন্যদিকে নামজাদা কমিউনিস্টদের একটি গোটা বাহিনী তাঁর উদ্দেশ্যে প্রথাসিদ্ধ কমিউনিস্ট গালিগালাজ ছোঁড়া ছাড়া আর বিশেষ কিছু করে উঠতে পারছিল না।

এদের মধ্যে একটি পর্ব বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কমিউনিস্টদের দাবী করেছিল যে ক্রাভচেঙ্কো বইতে নিজেকে যে একজন প্রথিতযশা ধাতুবিদ্যার প্রকৌশলী ব’লে তুলে ধরেছেন সেকথা সর্বৈব মিথ্যা। এর জবাবে ক্রাভচেঙ্কো প্রাভ্‌দা পত্রিকার একটি সংখ্যা পেশ করেন, যেখানে মলোটভ নিজেই ক্রাভচেঙ্কোর নাম ক’রে তাঁকে ভ্লাদিভস্তকে অবস্থিত সদ্যনির্মিত সোভিয়েত ধাতুবিদ্যা প্রয়োগশালাটির দায়িত্বে থাকা একজন অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধাতুবিদ্যার প্রকৌশলী ব’লে বর্ণনা করেছেন। পরের দিন লেনিনগ্রাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রযুক্তিবিদ্যার একজন প্রাক্তন অধ্যাপক আদালতে এসে উপস্থিত হলেন, যিনি অতীতে ক্রাভচেঙ্কোকে পড়িয়েছেন। তিনি আদালতে এই ব’লে সাক্ষ্য দিলেন যে ধাতুবিদ্যা বিষয়ে ক্রাভচেঙ্কো সত্যিই একজন প্রতিভাধর প্রকৌশলী এবং তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছাত্রও বটে। এই অধ্যাপকটি জার্মান আক্রমণের ফলস্বরূপ লেনিনগ্রাদ ছেড়ে গিয়েছিলেন এবং বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পশ্চিমী শক্তিগুলির মধ্যে হওয়া চুক্তির শর্ত অনুযায়ী প্রত্যার্পণ এড়ানোর জন্য পশ্চিম ইউরোপে একটি অজ্ঞাত স্থানে লুকিয়ে ছিলেন।

এর ঠিক পরপরই আরেকটি যে অসামান্য বইয়ের খোঁজ আমি পেয়েছিলাম সেটি হচ্ছে প্রখ্যাত ফরাসী সমাজবাদী রাজনৈতিক নেত্রী সুজ্যান ল্যাবাঁ রচিত “স্ট্যালিন’স রাশিয়া”। তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রত্যেকটি বিশেষ দিক পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বর্ণনা করেছিলেন এবং সোভিয়েতেরই বিভিন্ন সূত্র থেকে অত্যন্ত যত্ন সহকারে তথ্য সংগ্রহ ক’রে সেগুলি নিজের বইতে পেশ করেছিলেন। তাঁর বর্ণনাটি ছিল রোমহর্ষক। এবার আমার নিজেকে নিয়ে লজ্জাবোধ হ’তে লাগল। একজন আগুনখোর কমিউনিস্টে পরিণত হবার আগে কেন আমি সোভিয়েত ইউনিয়নে মানুষের জীবনযাত্রা কেমন সে সম্পর্কে কোনো পড়াশুনো করলাম না? এব্যাপারে রাম স্বরূপের ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্যটি ছিল : “সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্পর্কে প্রকৃত ঘটনা সর্বদা প্রকাশ্যেই ছিল, এবং সে ঘটনাগুলির বেশিরভাগটাই প্রকাশ্যে এসেছিল সোভিয়েত সূত্রগুলি থেকেই। সোভিয়েত সম্পর্কে কমিউনিস্টরা যেসব ঘটনা ও তথ্য প্রকাশ করেছে এবং কমিউনিস্ট-বিরোধীরা যেসব ঘটনাবলী ও তথ্য প্রকাশ করেছে তার মধ্যে বিশেষ কোনো পার্থক্যই নেই। পার্থক্য হচ্ছে ঘটনা ও তথ্যগুলির ব্যাখ্যায়। আর কে কীভাবে ব্যাখ্যা করছে তা নির্ভর করে তার মূল্যবোধ এবং যে সভ্যতা-সংস্কৃতি থেকে সেই মূল্যবোধগুলি উদ্ভূত হয়েছে এই দুইয়ের উপর।”

তার কথাগুলি আমায় আত্মসমীক্ষা করতে এবং সেই সময় অব্দি আমার সমগ্র দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গিটি যেভাবে বিবর্তিত হয়েছিল তার অতীতচারী পর্যালোচনা করে দেখতে উদ্বুদ্ধ করল। আমি আরেকবার মার্ক্স প’ড়ে দেখলাম, যিনি আমায় কমিউনিজমের দিকে ঠেলে দিয়েছিলেন। আমি উপলব্ধি করলাম যে লেনিন অথবা স্তালিন এদের কেউই মার্ক্সবাদী নয়। তারা কেবল নিজের নিজের স্বার্থসর্বস্ব লক্ষ্যগুলিকে মার্ক্সীয় পরিভাষা দিয়ে মুড়ে দিয়েছিল, যা মার্ক্সবাদী হবার থেকে একেবারেই আলাদা। ক্লজ্‌উইৎজ্‌ বলেছিলেন যুদ্ধ হচ্ছে রাজনীতি, শুধু তার সাধনগুলি ভিন্ন; আর এরা তাঁর বক্তব্যটিকে উল্টো ক’রে গ্রহণ করেছিল, যা দাঁড়ায় : “রাজনীতি হচ্ছে যুদ্ধ, শুধু তার সাধনগুলি ভিন্ন।” অথচ মার্ক্স তো একজন নিখাদ সমাজতাত্ত্বিক এবং অর্থনীতিবিদ ছিলেন। কিন্তু শেষ বিচারে দেখা যায় যে তাঁর দার্শনিক ব্যবস্থাটিও সেই একই ভিত্তি থেকে উদ্ভূত, যা থেকে পুঁজিবাদের উদ্ভব হয়েছে। এই ভিত্তিগুলি হচ্ছে : বস্তুবাদী বিশ্ববীক্ষা, বিবর্তনবাদী সমাজতত্ত্ব, ভোগবাদী মনস্তত্ত্ব, উপযোগবাদী নীতিবোধ, এবং ভোগ্যপণ্য-সর্বস্ব অর্থনীতি। আসলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে যে জায়গায় দাঁড়িয়ে, সোভিয়েত ইউনিয়ন তো কাল সেখানেই পৌঁছনোর আকাঙ্ক্ষা রাখে। দুজনের ক্ষেত্রেই লক্ষ্যটি এক – প্রাচুর্যের অর্থনীতি। সোভিয়েত ইউনিয়ন রাষ্ট্রচালিত পুঁজিবাদ এবং নিয়মতান্ত্রিক সন্ত্রাসের রাস্তা নিয়েছে, আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ব্যাপারটা ছেড়ে দিয়েছে বাজারের নির্দয় ওঠাপড়ার ওপর। আমি কি এই লক্ষ্যটিকেই মানবজাতির সর্বোচ্চ আকাঙ্ক্ষা ব’লে মেনে নেব? যদি তা না হয়, তাহলে এর চাইতে মহৎ আর কোনো লক্ষ্য আমাদের হাতে রয়েছে কি?

এই প্রশ্নের কোনো উত্তর আমার কাছে ছিল না। আমি নিমজ্জিত হলাম একটি দার্শনিক শূন্যতার গভীরে, যা থেকে পরের বেশ কয়েক বছরেও আমি উদ্ধার পাইনি। কমিউনিজমকে নিজের ধর্ম ব’লে মেনে নেবার পর যে অনুসন্ধানের পরিসমাপ্তি ঘটেছিল ব’লে আমি ধ’রে নিয়েছিলাম, সেই অনুসন্ধান পুনরায় শুরু হ’ল।

পাদটীকা

[1] “চলো দাঙ্গা লাগাই : যারা রাস্তার দাঙ্গার মাধ্যমে ভারত ভাগ করতে চায় তাদের দর্শন”

[2] Metaphysics

[3] Epistemology

মূল গ্রন্থের রচয়িতা: সীতারাম গোয়েল
বঙ্গানুবাদ : শ্রীবিজয়াদিত্য

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.