(চতুর্থ অধ্যায়ের পর)
পাঁচ
কমিউনিস্ট পার্টির সান্নিধ্যে
১৯৪৬-এর ১৬-১৭ অগাস্ট জুড়ে যে ‘দ্য গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’[1] সংঘটিত হয়েছিল, তার অনেকখানিই আমি স্বচক্ষে দেখেছিলাম। রাস্তায় রাস্তায় ছিল মৃতদেহের স্তূপ। আরো বহুসংখ্যক মৃতদেহ হুগলী নদীতে ভাসছিল। অগ্নিসংযোগ এবং উন্মত্ত জনতার আক্রোশের ফলস্বরূপ প্রভূত ব্যক্তিগত এবং সরকারী সম্পত্তি ধ্বংস হতেও চাক্ষুষ দেখেছিলাম। চারিদিকে মৃত্যু এবং খাঁ খাঁ শূন্যতা আমার মধ্যে মানবপ্রকৃতির সম্পর্কে নৈরাশ্য জাগিয়ে তুলল। কিন্তু আমি এই ব্যাপক গণহত্যার প্রকৃত কারণগুলি অনুসন্ধান করবার চেষ্টাই করলাম না – এমনকী যে রাজনৈতিক আন্দোলনটি[2] এই গণহত্যার ইন্ধন জুগিয়েছিল সেটিকেও এর জন্য দায়ী ব’লে ঠাওরানোর কোনোরকম চেষ্টা করলাম না। তার বদলে আমি “দ্য ডেভিল ডান্স ইন ক্যালকাটা”[3] শীর্ষক একটি দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখলাম, যাতে এই অনর্থক নরসংহারের জন্য আমি হিন্দু এবং মুসলমান উভয় পক্ষকেই সমান দায়ী ব’লে বর্ণনা করেছিলাম। আমার কিছু বন্ধুরা মিলে দিল্লী থেকে সাইক্লোস্টাইল প্রতিলিপির মাধ্যমে ছাপা একটি সংবাদপত্র চালাত, তাতে এই প্রবন্ধটি প্রকাশ ক’রে জনসমক্ষে প্রচারিত হয়েছিল। এদের মধ্যে কয়েকজন বন্ধু আমার প্রবন্ধটিতে নরসংহারের যে পুঙ্খানুপুঙ্খ চিত্র অঙ্কিত হয়েছে, এবং সেটির মধ্যে দিয়ে যে সাহিত্যিক উৎকর্ষ প্রকাশ পেয়েছে, তার তারিফ করেছিল।
কিন্তু এর দিনকয়েক বাদে রাম স্বরূপের কাছ থেকে যে চিঠিটি আমি পেলাম তার বয়ান ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। সে আমার এই পক্ষপাতহীন অবস্থান এবং মুসলিমদের দ্বারা সংঘটিত হিংসার সঙ্গে হিন্দুদের দ্বারা সংঘটিত হিংসাকে এক ক’রে ফেলাটা মোটেই ভালো চোখে দেখেনি। আমি যাকে উভয়পক্ষের জন্যেই ধ্বংসাত্মক বিরোধ ব’লে বর্ণনা করেছিলাম তার মধ্যে ভালো এবং মন্দের বিচার করাতে সে জোর দিয়েছিল। তার মতে, মুসলিমদের দ্বারা সংঘটিত হিংসাত্মক কার্যকলাপ ছিল আক্রমণাত্মক, এবং এর পিছনে ছিল একটি অত্যন্ত প্রতিক্রিয়াশীল এবং পশ্চাদগামী উদ্দেশ্য চরিতার্থ করবার বাসনা, যে উদ্দেশ্যটি হচ্ছে ভারতবর্ষের বিভাজন। আর অপরপক্ষে হিন্দুদের দ্বারা সংঘটিত হিংসামূলক কাজকর্ম করতে হয়েছিল আত্মরক্ষার্থে। এটি হিন্দুদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল, কারণ তারা একটি অত্যন্ত মহৎ আদর্শ রক্ষা করবার কাজে ব্রতী হয়েছিল, যা হচ্ছে ভারতবর্ষের ঐক্য এবং অখণ্ডতা রক্ষা করা, যার জন্যে গৃহযুদ্ধেও জড়িয়ে পড়া চলে। আমায় স্বীকার করতেই হচ্ছে যে তার এই যুক্তিগুলির মধ্যে আমি সেসময় কোনো যৌক্তিকতা খুঁজে পাইনি। যে হত্যালীলায় হিন্দুরাও অংশগ্রহণ করেছে তার দায় থেকে হিন্দুদের মুক্ত ক’রে তাদের ক্ষমা করতে আমি প্রস্তুত ছিলাম না। এটা যদি মেনেও নেওয়া হয় যে মুসলিমরাই ব্যাপারটা শুরু করেছিল, তাহলেই বা কীভাবে বলি যে হিন্দুদের অবস্থান নৈতিক দিক দিয়ে উচ্চতর?
এর কয়েক মাস আগে রাম স্বরূপ আমাকে তার বার্নার্ড শ’-এর কায়দায় লেখা একটি দীর্ঘ সংলাপের টাইপ করা প্রতিলিপি পাঠিয়েছিল, যার শিরোনাম ছিল “লেট আস্ হ্যাভ্ রায়ট্স্ : দ্য ফিলজফি অফ দোজ্ হু ওয়ন্ট টু ডিভাইড ইন্ডিয়া বাই স্ট্রীট রায়ট্স্”[4]। এই সংলাপের মধ্যে কংগ্রেস, মুসলিম লীগ এবং হিন্দু মহাসভার অনেক শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক নেতার দেখা মিলেছিল। এমনকী এতে পার্টিশনের বিষয়টিতে ডঃ আম্বেদকরও তাঁর নিজস্ব ভঙ্গিমায় কিছু অবদান রেখেছিলেন। এটি বারবার ক’রে পড়তে পড়তে আমি খুব হেসেছিলাম। এতে মুসলিম লীগের নেতারা – বিশেষ করে মি. জিন্নাহ্ – নিজেদের যারপরনাই হাসির খোরাক বানিয়ে তুলেছিলেন। এই সংলাপে পণ্ডিত নেহরুরও একই অবস্থা হয়েছিল, যিনি তাঁর নিজের ভাষায় “হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা” ছাড়া আর কিছু দেখতেই পান না; এবং কোনো বিষয়েই একবারে দু-তিনটের বেশি সুসংলগ্ন বাক্য বলতে পারেন না। অনেক নেতারই মুখের কথা তাদেরকে দিয়ে এমনভাবে বলিয়ে নেবার ক্ষমতা রাম স্বরূপের ছিল যাতে ক’রে জনতার সমক্ষে তাদের ভাষণ যে চাকচিক্যে মোড়া থাকে তা সম্পূর্ণ উবে গিয়ে কথাগুলির আসল মূল্য বেরিয়ে পড়ত – এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেগুলির মূল্য হ’ত শোচনীয় রকমের কম। কিন্তু এই সংলাপের ছত্রে ছত্রে যে গুরুতর তাৎপর্যটি প্রকাশ পাচ্ছিল সেটি অনুধাবন করতে আমি আবারও ব্যর্থ হলাম। একদল গুণ্ডা, মস্তান, সং এবং উন্মাদের পদতলে একটি জাতির সমগ্র নেতৃবৃন্দ শুধু তাঁদের রাজনৈতিক সদিচ্ছাই নয়, এমনকী নৈতিক মূল্যবোধ তথা বিচারবুদ্ধিও যেভাবে বন্ধক রেখেছেন, সেই ট্র্যাজিক পরিণতিটি আমি দেখতে পাচ্ছিলাম না। এই ট্র্যাজিক পরিণতিটি আরও বেশি করুণ হয়ে পড়েছিল এই কারণে যে এই জাতীয় নেতৃবৃন্দের একটি বৃহৎ অংশ ছিলেন শিক্ষিত হিন্দুরা, যাঁদেরকে চিন্তাবিদ এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে শ্রেষ্ঠ অংশ ব’লে গণ্য করা হ’ত।
ইতিমধ্যে আমি মানসিকভাবে এবং বৌদ্ধিক বিবেচনায় হিন্দু ও মুসলিমদের থেকে সমদূরত্ব বজায় রাখবার অবস্থানে চলে এসেছিলাম। তবে বলে রাখি যে তখনো আমি হয়তো সামান্য হলেও মুসলিম দৃষ্টিভঙ্গির দিকে কিছুটা ঝুঁকে ছিলাম। পাকিস্তানের দাবীর সমর্থনে যেসব কমিউনিস্ট পুস্তিকা আমি পড়েছিলাম সেগুলি আমার মধ্যে তেমন কোনো সাড়া জাগাতে পারেনি। কিন্তু সেসময় “নিউ এজ” শীর্ষক যে কমিউনিস্ট সাপ্তাহিক পত্রিকাটি আমি নিয়মিত কিনে পড়তে শুরু করেছিলাম, সেটি আমার উপর প্রভাব বিস্তার করতে আরম্ভ করল। এই সাপ্তাহিক পত্রিকাটিতে সবসময় মুসলিমদের নিপীড়িত কৃষক সম্প্রদায় এবং সর্বহারা গোষ্ঠী হিসেবে চিত্রিত করা হ’ত; আর হিন্দুদের চিত্রিত করা হ’ত শোষক জমিদার এবং পুঁজিবাদী হিসেবে। কংগ্রেস নেতৃবৃন্দকে এই পত্রিকায় লাগাতার ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সঙ্গে আপস করা, এমনকী দালালি করবার অভিযোগ তুলে আক্রমণ করা হ’ত। অভিযোগটি ছিল এই যে মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে একজোট হয়ে গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা ছিনিয়ে নেবার লক্ষ্যে কাজ না ক’রে কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের সঙ্গে ক্ষমতা এবং সম্পদ হস্তান্তরের চুক্তি করছে।
আমি আমার স্বজাতীয়দের কাছে যা শুনলাম তাতে হিন্দুদের প্রতি আমার বিরক্তি আরো বহুগুণ বেড়ে গেল। আমার পরিবারকে আমাদের গ্রামের বাড়িতে থাকতে পাঠিয়ে দেবার পর আবার আমি আমার এই স্বজাতীয়দের মাঝে থাকতে শুরু করেছিলাম। এরা ছিল সেই লোকজন যারা আমায় চিরকাল শিক্ষিত গবেট ব’লে উপহাস ক’রে এসেছে। এরা সর্বদা মহাত্মা গান্ধীর নিন্দা করত। কখনো কখনো অত্যন্ত কদর্য ভাষায় এই নিন্দেমন্দ চলত। মহাত্মা গান্ধী সেইসময় নোয়াখালী চষে বেড়াচ্ছেন, যেখানে মুসলিম লীগের জনপ্রিয় নেতাদের দ্বারা খেপিয়ে তোলা উন্মত্ত মুসলমান জনতা অসংখ্য হিন্দু নরনারীকে হত্যা ও ধর্ষণ করেছিল। সাম্প্রদায়িক উন্মত্ততার আগুন নেভানোর যথাসাধ্য চেষ্টা তিনি করছিলেন। আমার স্বজাতীয়েরা নিত্য তাঁকে যেভাবে গালিগালাজ করত তা তাঁর কখনোই প্রাপ্য ছিল না। নোয়াখালীর প্রতিশোধ নেবার জন্য বিহারের হিন্দুরা যখন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, তখন তাদের শান্ত করবার জন্য মহাত্মা গান্ধী আমরণ অনশন শুরু করলে এই গালিগালাজের তোড় আরো হিংস্র হয়ে উঠল। মহাত্মা গান্ধীর পক্ষ নিয়ে আমিও সমান ঝাঁঝালো ভাষায় জবাব দেওয়া শুরু করলাম। এর ফলে আমায় আমার জাতের লোকেরা সমাজচ্যুত ঘোষণা করল। তারা আমায় “সূয়র কা বাচ্চা সুহ্রাবর্দী” ব’লে ডাকা শুরু করল।
ততদিনে আমি আমার কর্মক্ষেত্রে সিনিয়র এগ্জিকিউটিভ্ গোছের পদাধিকারীতে পরিণত হয়েছি। মাইনে ছিল সামান্যই। তবে আমার নিজস্ব একটা চেম্বার জুটেছিল, তদুপরি একটা টেলিফোন এবং একজন আজ্ঞাবহ পিওনও ছিল। নিজের মর্জিমাফিক একটি দুস্প্রাপ্য রাসায়নিক অল্পস্বল্প পরিমাণে বিক্রি করবার ক্ষমতাও হয়েছিল। একটি ছোকরা মাড়োয়ারি দালাল ঐ রাসায়নিকের দু-এক পিপে পাওয়ার জন্য আমায় প্রায়ই জ্বালাতন করত আর আমি সবসময়ই তাকে ভাগিয়ে দিতাম। তখন আমি টেরটিও পাইনি যে এই দালালই আমায় সোজা কলকাতার কমিউনিস্ট পার্টির খপ্পরে নিয়ে গিয়ে ফেলবে।
একদিন মধ্যাহ্নভোজের বিরতির সময় আমি টেবিলে দু’পা তুলে আমার আরামকেদারায় হেলান দিয়ে “দ্য নিউ এজ”-এর সর্বশেষ সংখ্যাটি মুখের সামনে মেলে ধ’রে পড়ছি। এমন সময় সেই দালাল ছোকরাটি হুড়মুড়িয়ে আমার চেম্বারে ঢুকে পড়ল। আমার পিওন তখন কাছে ছিল না, তাই তাকে আটকানো যায়নি। আমি কোন্ পত্রিকা পড়ছি সেটা দেখতে পেয়ে তার মুখে একগাল হাসি খেলে গেল। এরপরই সে আমায় চুপিচুপি বলল : “আমি আপনার এই দিকটা একেবারেই জানতাম না। আপনি তো দেখছি প্রগতিশীল। তাহলে নিশ্চয়ই আপনি বড়বাজারের অন্য অনেক প্রগতিশীল লোকজনকে চেনেন। আপনি যে কারুর নাম করুন। আমি এঁদের প্রায় সবাইকেই চিনি।” আমি তাকে বললাম যে এক নিজেকে ছাড়া আর কোনো প্রগতিশীল ব্যক্তিকে আমি চিনি না। যাবার আগে সে আমায় আশ্বস্ত ক’রে গেল যে শীঘ্রই যাতে এঁদের কয়েকজনের সাথে আমার আলাপ হয় সেই ব্যবস্থা সে করবে।
সে কথা রেখেছিল। ক’দিন বাদেই একটি ছায়ানাটিকার প্রবেশপত্র হাতে ক’রে সে আমার কাছে এসে উপস্থিত হ’ল, যেটি ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের (যা ছিল কমিউনিস্টদেরই মুখপাত্র) পরিচালনায় কলকাতার একটি নামকরা নাট্যমঞ্চে উপস্থাপিত হচ্ছিল। পরদিন আমি সেটি দেখতে গেলাম, এবং দেখেশুনে বেশ মুগ্ধ হলাম। এই নাটকে ব্যঙ্গাত্মক ভঙ্গিতে কংগ্রেস নেতৃবৃন্দকে উপস্থাপিত করা হয়েছিল। নাটকটিতে দেখানো হয়েছিল যে কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ সাধারণ মানুষকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় জড়াতে প্ররোচিত করছে, যাতে কংগ্রেস মানুষের চোখে ধুলো দিয়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের সঙ্গে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য ষড়যন্ত্র করতে সক্ষম হয়। এতে আরো দেখানো হ’ল যে কলকাতার রাস্তাঘাট হিন্দু অথবা মুসলমান কারুর জন্যই আর সুরক্ষিত নয়, সেখানে একমাত্র শ্বেতাঙ্গরাই সুরক্ষিত বোধ করতে পারে। এই নাটকের মাধ্যমে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যসাধনের ডাক দেওয়া হ’ল; এবং বলা হ’ল তারা যেন একজোট হয়ে কলকাতার রাস্তাঘাট শ্বেতাঙ্গদের জন্য ফের অসুরক্ষিত ক’রে তোলে, যেমনটা হয়েছিল লাল কেল্লায় আজাদ হিন্দ ফৌজের বিচারের সময় অথবা বম্বেতে নৌবিদ্রোহের সময়।
এই নাটকটি দেখতে গিয়ে আমার কপালে যে বিশেষ প্রাপ্তিটি জুটল তা হচ্ছে আরো একদল মাড়োয়ারি যুবকের সঙ্গে পরিচয়, যাদের সঙ্গে আমার দালাল সঙ্গীটি শো-এর পরে আলাপ করিয়ে দিয়েছিল। সেই থেকে এদের একজন কফি হাউসে আমার নিত্যসঙ্গী হয়ে উঠল। সেও ছিল দালাল, তবে অপেক্ষাকৃত মর্যাদাকর শেয়ার বাজারে। কিন্তু ভারতের কমিউনিস্ট নেতৃত্বের সম্পর্কে তার জ্ঞান আমাকে সত্যিই মুগ্ধ করেছিল। মুজফ্ফর আহমেদ, পি.সি. জোশী, ডাঙ্গে, অধিকারী, রণদিভে প্রমুখ নেতাদের হরেক বীরত্বের গাথা সে আমায় শোনাত। আমার অজ্ঞতার কারণে আমি সেইসব গল্প সত্যি ব’লে ধ’রে নিয়েছিলাম এবং এইসব মহান ব্যক্তিত্বের প্রতি শ্রদ্ধায় আমার মন পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। সেসময় আমি জানতাম না যে এইসব গল্প ছিল স্রেফ কমিউনিস্ট মিথ, যা পার্টির কমরেডদের শোনানোর জন্য বানানো হ’ত।
তবে নাগপুরের এক কমিউনিস্ট নেতার ব্যাপারে একটি গল্প সে আমায় বলেছিল যা আমি সত্যি ব’লে না মেনে পারি না। ১৯৪১ সাল নাগাদ তিনি আচার্য বিনোবা ভাবের সঙ্গে একই জেলে বন্দী ছিলেন। বিনোবাজী রোজ সকালে নিজের জামাকাপড় কাচতেন আর কমিউনিস্ট নেতাটি কাছাকাছি ব’সে সিগারেট টানতেন। তাঁর জামাকাপড় কখনোই পরিষ্কার থাকত না। একদিন বিনোবাজী তাঁকে কাপড় কাচায় যোগ দিতে আহ্বান জানালেন আর সঙ্গে এও বললেন যে কাজটা ক’রে বেশ মজা পাওয়া যায়। কমিউনিস্ট নেতাটি নিঃশব্দে উঠে গেলেন, এবং তাঁর ময়লা জামাকাপড়ের একটা বস্তা নিয়ে ফিরে এলেন। বিনোবাজীর সামনে বস্তাটি রেখে তিনি বললেন : “এই নাও, ভাবে[5], আরও একটু মজা করো।”
এই মাড়োয়ারি কমিউনিস্টদের সাথে আমার সাক্ষাৎ হবার কিছুদিন বাদে আমার বাড়িতে একজন বাঙালি কমরেড এসে উপস্থিত হ’ল। সে খুব সম্ভবতঃ বড়বাজারে কোনো একটি পার্টি ইউনিটের কার্যনির্বাহী সম্পাদক ছিল। সে আমার মাড়োয়ারি বন্ধুদের নাম ক’রে আমায় তাদের কমিউনটি দেখে আসতে নিমন্ত্রণ জানালো, যেখানে সে পার্টির আরো কয়েকজন সদস্যের সঙ্গে বাস করতো। আমি তার সঙ্গে গেলাম কাছাকাছি একটি এলাকায়; সেখানে ডজনখানেক ছেলেমেয়ের সঙ্গে দেখা হ’ল যারা একটা ছোট্ট অগোছালো ঘর আর ততোধিক ছোট রান্নাঘর নিয়ে একত্রে বাস করছিল। জানলাম যে তাদের মধ্যে তিনজোড়া বিবাহিত দম্পতিও রয়েছে। সেটিই ছিল আমার প্রথম এবং শেষবারের মতো কমিউন দর্শন। ব্যাপারটা আমার একটুও ভালো লাগেনি। ঐ বাঙালি কমিউনিস্টটির সঙ্গেও আমি বিশেষ দেখাসাক্ষাৎ করতাম না। এই যোগাযোগের ফলে আমার একমাত্র যে লাভটি হয়েছিল তা হচ্ছে এই যে একজন হকার এরপর থেকে আমার বাড়িতে বিনামূল্যে “স্বাধীনতা” নামক বাংলা কমিউনিস্ট দৈনিকটি দিয়ে যেত; আর প্রগতিশীল লেখক সঙ্ঘের[6] সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটল, যা ছিল আরো একটি কমিউনিস্ট সম্মুখ-সংগঠন।
সেসময় প্রগতিশীল লেখক সঙ্ঘের সভাপতি ছিলেন প্রখ্যাত বাঙালি ঔপন্যাসিক শ্রী তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। আমি তাঁর লেখা কয়েকটি উপন্যাস পড়েছিলাম এবং তাঁর প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধা পোষণ করতাম। আশা ছিল যে সংগঠনের অফিসে একদিন না একদিন তাঁর সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে। কিন্তু সে গুড়ে বালি; কারণ এক বছরেরও বেশি সময় ধ’রে ঐ অফিসে ঘন ঘন যাতায়াত করলেও আমি সেখানে কখনো কোনো লেখকের দেখা পাইনি। “মন্বন্তর” এবং “হাঁসুলী বাঁকের উপকথা” শীর্ষক তারাশঙ্করের যে দুটি উপন্যাস নিয়ে কমরেডরা খুব মাতামাতি করত সেগুলো আমার খুব একটা ভালো লাগেনি। পরবর্তীকালে এই মহান সাহিত্যিকটি আমায় জানিয়েছিলেন যে কমিউনিস্ট প্রভাবের আওতায় থাকাকালীন তিনি কেবলমাত্র এই দুটি উপন্যাসই লিখেছিলেন, এবং দুটিই পাঠকদের মন জয় করতে ব্যর্থ হয়েছিল। এরপর “মন্বন্তর” উপন্যাসটিতে বেশ কিছু পরিবর্তন আনবার পরেই একমাত্র তাঁর সাধারণ পাঠককুলের কাছে সেটি গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছিল।
প্রগতিশীল লেখক সঙ্ঘের সঙ্গে আমার ওঠাবসা চলাকালীন আরেকটি যে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার ঘটেছিল সেটি হচ্ছে “আইভান দ্য টেরিব্ল্” শীর্ষক একটি রাশিয়ান চলচ্চিত্রের প্রদর্শন। বিখ্যাত রাশিয়ান পরিচালক আইজেনস্টাইন পরিচালিত এই চলচ্চিত্রটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে নাৎসী আক্রমণের বিরুদ্ধে রাশিয়ান জাতীয়তাবাদ জাগিয়ে তোলবার উদ্দেশ্যে নির্মিত হয়েছিল। এটিকে রাশিয়ান চলচ্চিত্র প্রযুক্তির একটি মহৎ কীর্তি ব’লে প্রচারও করা হয়েছিল। প্রগতিশীল লেখক সঙ্ঘের একজন আমায় পঁচিশটি টিকিটের একটি গোছা দিয়েছিল পরিচিতদের মধ্যে বিক্রি করতে, কিংবা প্রগতিশীল শিল্পকলার এই চমৎকারটি দেখবার জন্য তাদের প্রভাবিত করতে। এর মধ্যে মাত্র কয়েকটাই আমি বিক্রি করতে সফল হয়েছিলাম, বাকিগুলো বিলি করতে হ’ল, আর আমার নিজের পকেট থেকে নয় নয় ক’রে ৬৪/- টাকা গচ্চা গেল। চলচ্চিত্রটি রাশিয়ান ভাষায় নির্মিত, ইংরেজি উপাখ্যা[7]-সমেত। আমি সেটির মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম না। দেখতে দেখতে আমার মাথা ধ’রে গিয়েছিল, ইচ্ছে করছিল লোকভর্তি হল থেকে ছুটে পালাই। কিন্তু কফি হাউসে অন্যান্য কমরেডদের সঙ্গে যখন মতামত বিনিময় চলছিল, তখন মনে হ’ল যে ফিল্মটির ব্যাপারে কিছু ভালো ভালো কথা বলা উচিত। তারা সবাই ফিল্মটির প্রশংসায় পঞ্চমুখ হচ্ছিল আর হলিউডের অবক্ষয়ী চলচ্চিত্র শিল্পের বাপান্ত করছিল। ১৯৪৮ নাগাদ যখন আইজেনস্টাইনের জৌলুস ফিকে হয়ে এল, তখন তিনি নিজের “ভুল”গুলির উল্লেখ ক’রে একটি করুণ স্বীকারোক্তি দিয়েছিলেন। সেই ভুলগুলির একটি ছিল “আইভান দ্য টেরিব্ল্”।
কমিউনিজমের খপ্পরে পড়ব ব’লে আমি সেদিকে পূর্ণবেগে ধাবিত হচ্ছিলাম, কিন্তু ঠিক সময়ে একটা প্রবল ঝাঁকুনি জুটে গেল। ঐ সময়েই বইয়ের দোকানগুলিতে “টাইম মাস্ট হ্যাভ আ স্টপ” শীর্ষক অ্যাল্ডাস হাক্সলীর একখানা উপন্যাসের আবির্ভাব হ’ল। সেটি দেখেই আমার রাম স্বরূপের কথা মনে প’ড়ে গেল এবং পকেটে যে ক’টা টাকা প’ড়ে ছিল তা বইটির দামের সমান হওয়া সত্ত্বেও সেটি না কিনে আমি থাকতে পারলাম না। ভাবলাম এখন প্রায় মাসের শেষ, ক’দিন বাদে মাইনে তো পেয়েই যাব। তখনো অব্দি আমি হাক্সলীর লেখা একটা বইও পড়িনি। তাঁর মৌলিক প্রতিভার বিচ্ছুরণ আমি এই বইটির মাধ্যমে চাক্ষুষ দেখতে পেলাম। এই বইটিতে ব্রুনো নামের একটি চরিত্র আমায় মন্ত্রমুগ্ধ করেছিল, যার মধ্যে একজন বিদ্বান পণ্ডিতের করুণ পরিণতি গভীর সহানুভূতির সঙ্গে আমি অনুধ্যান করেছিলাম। কিন্তু যা মার্ক্সবাদ-সহ গোটা উনবিংশ শতাব্দী জুড়ে যাবতীয় পাশ্চাত্য চিন্তাধারার ভিত্তিস্বরূপ, সেই অবশ্যম্ভাবী প্রগতির মতবাদটিকে তিনি যেভাবে খণ্ডন করেছিলেন তা আমার উপর ক্রিয়ারত মার্ক্সবাদী জাদুমন্ত্রের প্রভাবটি প্রায় ভেঙে ফেলতে পেরেছিল। এছাড়াও একটি সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলবার জন্যে সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে বারংবার পুনর্গঠন করবার পক্ষে সওয়াল করাকে তিনি “উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সাজানো যুক্তিজাল”[8] ব’লে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছিলেন। তিনি যে সিদ্ধান্তে এসে উপনীত হয়েছিলেন তা হচ্ছে – সমাজের অশুভ দিকগুলির শিকড় শেষবিচারে মানবপ্রকৃতির মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে। যেরকম সমাজব্যবস্থা আমাদের পক্ষে শ্রেয় তা বাসনা-জর্জরিত মানবচেতনার পক্ষে গড়ে তোলা অসম্ভব। আমার মনে প’ড়ে গেল শ্রীঅরবিন্দের কথা।
এই বইটি আমায় ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছিল এবং এর প্রভাব পরিস্ফুট হয়েছিল দু’বছর বাদে। ইতিমধ্যে আমি হাক্সলীর রচনাগুলি নিবিড়ভাবে অধ্যয়ন করতে শুরু করলাম এবং তাঁর প্রধান প্রধান উপন্যাসগুলি সমেত “এন্ড্স্ অ্যান্ড মীন্স্” ও “পেরেনিয়াল ফিলজফি” শীর্ষক তাঁর বিখ্যাত বইদুটিও পড়ে ফেললাম। বিচার এবং অনুভূতির সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি চারণভূমিতে বিচরণ করবার জন্য আমি প্রস্তুত হচ্ছিলাম। আমার এই আশঙ্কার কথা শেয়ার বাজারের কমিউনিস্ট সঙ্গীটির নিকট প্রকাশ করলাম। সে কখনো হাক্সলীর কোনো রচনা পড়েনি। কিন্তু এই মহান লেখকটির সম্পর্কে পার্টি ঠিক কীরকম ধারণা পোষণ করে তা সে বিলক্ষণ জানত। এবং সেটা খুব একটা উচ্চ ধারণা ছিল না। এর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আমার সঙ্গীটি আমায় বুদ্ধিজীবী হবার দোষে অভিযুক্ত করল। অভিজ্ঞতার ফলে তার বদ্ধমূল ধারণা হয়েছিল যে বুদ্ধিজীবীরা পার্টিতে বেশিদিন টেঁকে না। বুদ্ধিজীবীদের গুরুতর অপরাধ এই যে তাঁরা মুখ্য সব আদর্শগত প্রশ্নে পার্টির পক্ষপাতী হ’তে পারেন না। কেন? কারণ তাঁরা বুর্জোয়া বস্তুনিষ্ঠতায় ভোগেন। দেখলাম যে আমি যথাবৎ তিরস্কৃত হয়েছি; যদিও আমার জানা ছিল যে আমার সঙ্গীটি সারাজীবনে একটিও বই খুলে দেখেনি।
১৯৪৬-এর অগাস্ট মাসে দাঙ্গা শুরু হবার কয়েকদিন আগে একজন আমেরিকান সাংবাদিকের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ ঘটে, যিনি একটি সম্ভ্রান্ত মার্কিন সংবাদসংস্থার কলকাতাস্থিত দপ্তরের অধিকর্তা ছিলেন। কথায় কথায় আমি যখন তাঁকে বললাম যে ট্রুম্যান একজন অপরাধী এবং হিরোশিমাতে ঐ অ্যাটম বোমাটি ফেলবার অপরাধে তার ফাঁসি হওয়া দরকার, তখন তিনি এত জোরে টেবিল চাপড়েছিলেন যে আমাদের কফির কাপগুলি চারদিকে ছিট্কে ছড়িয়ে পড়েছিল। ভেবেছিলাম যে ঐখানেই আমাদের আলাপচারিতার ইতি। কিন্তু কদিন বাদে তিনি আমায় ফোন করলেন এবং জবাবদিহি দেবার মতো ক’রে বললেন যে তাঁর উচিত ছিল বিষয়টিকে এশিয়ান দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বুঝে ওঠবার চেষ্টা করা। এরপর আমরা বেশ কয়েকবার দেখা করেছিলাম এবং পরস্পরের বন্ধু হয়ে গিয়েছিলাম। সেসময় তিনি ছিলেন যাকে আমেরিকানরা লিবারাল ব’লে থাকে এবং আমরা ভারতীয়রা বামপন্থী ব’লে থাকি তা-ই। তিনিই প্রথম আমায় কলকাতার ডেকার্স লেনে স্থিত কমিউনিস্ট পার্টির বইয়ের দোকানটিতে নিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি মনে করতেন যে ওখান থেকে বেশ কিছু ভালো সাহিত্যকীর্তি প্রকাশিত হয়ে থাকে এবং ওঁদের ইংরেজি সাপ্তাহিকীটি নিশ্চয়ই অত্যন্ত সুষ্ঠুভাবে সম্পাদিত একটি পত্রিকা।
মুসলিম লীগের দৈনিক মুখপত্র “মর্নিং নিউজ”-এর সম্পাদক মি. জিলানীর সঙ্গেও তাঁর গভীর বন্ধুত্ব ছিল, যিনি পরবর্তীকালে আরএসএস-এর সাপ্তাহিকী “অর্গানাইজার”-এ নিয়মিত লিখতেন। কিন্তু হিন্দু দৃষ্টিভঙ্গিটি কী সেটি তাঁকে ব্যাখ্যা করতে পারে এমন কারুর সঙ্গে তাঁর পরিচয় ছিল না। অগাস্টের দাঙ্গা চলাকালীন তিনি গোটা কলকাতা চষে বেড়িয়েছিলেন। তাঁর ধারণা হয়েছিল যে হিন্দুদের তুলনায় মুসলিমদের অনেক বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। পরে তিনি নোয়াখালী পরিদর্শন করতে যান। তাঁর মনে হয়েছিল যে হিন্দুরা যে চিত্র উপস্থাপনা করছে পরিস্থিতি মোটেই ততটা খারাপ নয়। একবার বাংলার মন্ত্রীসভায় উপস্থিত থেকে নোয়াখালী সংক্রান্ত একটি বিতর্ক শোনবার পরপরই একদিন আমার সাথে তাঁর দেখা হয়। ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় এবং অন্যান্য হিন্দু নেতৃবৃন্দ নোয়াখালীতে হিন্দুদের জোর ক’রে গোমাংস খাওয়াবার তীব্র বিরোধিতা করায় তাঁদের উপর তিনি বেজায় খেপে গিয়েছিলেন। তিনি আমার কাছে জানতে চাইলেন, “গোমাংস খাওয়ানো নিয়ে এত বাড়াবাড়ির কি আছে?” এই বিষয়ে আমার কোনো মতামত ছিল না। কিন্তু তাঁর সঙ্গে গলা মিলিয়ে “ঐ ভুঁড়িওলা ভাষণবাজ” ডঃ মুখোপাধ্যায়কে বিদ্রূপ করাতে আমি একটুও দ্বিধাবোধ করিনি। কিছু সময় বাদে আমার এই বন্ধুটি দিল্লী চলে গেলেন এবং সেখানে তাঁর দেখা হল রাম স্বরূপের সঙ্গে। এরপরেই আমি রাম স্বরূপের কাছ থেকে একটি চিঠি পেলাম, যেখানে সে লিখেছিল যে আমি এই আমেরিকান বন্ধুটিকে একজন খাঁটি মুসলিম লীগ-সমর্থক বানিয়ে তুলেছি। কিন্তু তার ইঙ্গিতটি আমি তখন বুঝে উঠতে পারিনি।
অন্য আরেকটি প্রতিষ্ঠানে ম্যানেজার হিসেবে যোগ দেবার পর আমার ব্যক্তিগত অবস্থার উন্নতি ঘটল। আগের চেয়ে অনেক ভালো মাইনে পেতে লাগলাম। কিন্তু আমার কাছে যে ব্যাপারটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঠেকল সেটা হচ্ছে এই : নতুন প্রতিষ্ঠানটির যে কর্মকর্তা – আমারই বয়েসি একজন মাড়োয়ারি যুবক – সে ছিল একজন প্রত্যয়ী কমিউনিস্ট। তার প্রচুর পড়াশোনা ছিল এবং যথেষ্ট সংখ্যক বইয়ের সংগ্রহ-সংবলিত নিজস্ব একটি গ্রন্থাগারও ছিল, যেখান থেকে আমি ইচ্ছেমত বই নিতে পারতাম। আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট ভাবধারা অনুসরণ ক’রে চলে এমন অনেক বিদেশী পত্রিকার সে নিয়মিত গ্রাহকও ছিল। আমার মনে আছে কীভাবে সপ্তাহের পর সপ্তাহ “নিউ মাসেস” এবং “নিউ রিপাবলিক” শীর্ষক মার্কিন পত্রিকাদুটি পড়তে পড়তে কমিউনিজমের বড় বড় সব টোটকা আমি গোগ্রাসে গিলতাম।
আমার আমেরিকান বন্ধুটি কলকাতা ছেড়ে যাবার আগের রাতে তাঁকে আমার নতুন চাকরি এবং নতুন কর্মকর্তাটিকে খুঁজে পাবার সুসংবাদ দিলাম। এর দিনকয়েক বাদে আমি রাম স্বরূপের কাছ থেকে একটি চিঠি পেলাম, যাতে লেখা ছিল : “শুনলাম তোমার কর্মকর্তাটি একজন কমিউনিস্ট। শুনে মনে হ’ল যেন একজন বৌদ্ধ ব্যক্তি একটা যুদ্ধ শুরু করেছে। তবে আমার মনে হয় যে একজন সাধারণ মানুষ মার্ক্স কিংবা বুদ্ধের চাইতেও বেশি প্রাজ্ঞ। এঁদেরকে সাধারণ মানুষটি নিজের বিষয়-কেন্দ্রিক আনুগত্য বাদে আর কিচ্ছুটি দেবে না।”
কিন্তু এবারেও তার কথার মর্মটি ধরতে আমি ব্যর্থ হলাম।
পাদটীকা
[1] আক্ষরিক অনুবাদে দাঁড়াবে ‘কলকাতার নারকীয় হত্যালীলা’ গোছের একটা কিছু। এখানে অনুবাদ যে করা হ’ল না তার কারণ ইংরেজি নামটি বহুল প্রচলিত এবং মুসলিম লীগের ডাকা ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন’-এর পরিপ্রেক্ষিতে যে পাশবিক হিন্দু-নিধন যজ্ঞ কলকাতায় শুরু হয়েছিল তার আলোচনায় “দ্য গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং” শব্দবন্ধটি সঙ্গত কারণেই ঐ নৃশংস গণহত্যার ঘটনায় বিশেষতঃ বাঙালি হিন্দুদের অপূরণীয় ক্ষতির কথা সহজে মনে করিয়ে দেয়।
[2] মুসলিম লীগ কর্তৃক পাকিস্তানের জন্য দাবী তুলে আন্দোলন এবং তাদের ডাকা ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’-র কথাই এখানে বলা হচ্ছে।
[3] “কলকাতায় শয়তানের তাণ্ডব”
[4] “চলো দাঙ্গা লাগাই : যারা রাস্তার দাঙ্গার মাধ্যমে ভারত ভাগ করতে চায় তাদের দর্শন”
[5] আচার্য বিনোবা ভাবে
[6] Progressive Writers’ Association
[7] Subtitles
[8] Manipulative fallacyWhatsAppFacebookTwitter
মূল গ্রন্থের রচয়িতা: সীতারাম গোয়েল
বঙ্গানুবাদ : শ্রীবিজয়াদিত্য