মেট্রোর কাজে ভাঙা পড়েছে রানী রাসমণির বাড়িতে। এমনটাই জানানো হয়েছে রানী রাসমণির পরিবারের পক্ষে। মেট্রোর বোরিং মেশিনের কম্পনের জেরে এই অবস্থার সম্মুখীন কলকাতার ঐতিহাসিক এবং হেরিটেজ তকমাপ্রাপ্ত ১৮ রানী রাসমণি রোডের এই বাড়িটি। রাসমণির পরিবারের প্রত্যেককেই এই মুহূর্তে অন্য একটি হোটেলে এনে রাখা হয়েছে।
পরিবারের পক্ষে শশী হাজরা বলেন , “আমাদের বলা হয়েছিল মেট্রোর কাজ হলেও বাড়ির কোনও ক্ষতি হবে না। আমরা সেই মতো নিশ্চিন্তেই ছিলাম। কাল সন্ধ্যা বেলা হঠাৎ করেই বাড়ির চাঙর , ইট খসে পড়তে শুরু করে। ঠাকুরদালান থেকে শুরু করে থাম প্রত্যেক জায়গায় বিশাল বিশাল ফাটল ধরে গিয়েছে। আমরা সঙ্গে সঙ্গে মেট্রো কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। ওরা আমাদের হোটেলে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। আমরা এখন সবাই রয়েছি এমব্যাসি হোটেলে।” একইসঙ্গে তিনি বলেন , “এখন আমাদের দিন চারেক এখানে থাকতে হবে। যতদিন ওই কাজ চলছে ততদিন তো
থাকতেই হবে বাড়ির বাইরে। তারপর দেখি কি করা যায়।”
চৌরঙ্গী থেকে সারকুলার রোডের দিকে প্রায় মাইল খানেক রাস্তাটির উনবিংশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্তও নাম ছিল জানবাজার স্ট্রীট। পরে নাম হয় কর্পোরেশন স্ট্রীট, বর্তমান নাম সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী রোড। এই এস এন ব্যানার্জী রোড ও রানী রাসমণি এভিনিউ র ক্রসিং এই অবস্থিত রানী রাসমণি ভবন। এই প্রাসাদটির স্থাপত্য ইন্দো-ব্রিটিশ ঘরানার। বাড়ির বারান্দার সামনেই আছে নাট মন্দির। এই নাট মন্দিরেই হয় দুর্গাপূজো। কলকাতার বনেদী দুর্গাপূজো গুলোর মধ্যে এটি অন্যতম। বাবু রাজচন্দ্র ও রাসমণির চার কন্যা সন্তান পদ্মামনি, কুমারী, করুনাময়ী ও জগদম্বা।
করুনাময়ীর বিবাহের পরই মৃত্যু হয়, তাঁর স্বামীর সাথে জগদম্বার বিবাহ দেন রানীমা। বর্তমান এই বাড়িটির মালিকানা তাই তিন ভাগে বিভক্ত। কলকাতা পুরসভা এই বাড়িটিকে হেরিটেজ সাইট হিসাবে নতিভুক্ত করেছে। আর সেই বাড়ির মেট্রোর কবলে পড়েছে।
রানি রাসমণির শ্বশুর শ্রীযুক্ত বাবু প্রীতরাম মাড় (দাস) পুজো শুরু করেছিলেন । তাঁর মৃত্যুর পরে জমিদারি ও পুজোর সব দায়িত্ব-ভার নেন তাঁর পুত্র রাজচন্দ্র দাস। কিন্তু বাবু রাজচন্দ্র দাস এর সহধর্মিনী লোকমাতা রানী রাসমণির দুর্গাপুজো নামেই এই পুজো সমধিক প্রসিদ্ধ l
রানি রাসমণির পুত্রসন্তান ছিল না। তাঁর চার মেয়ে – পদ্মমণি, কুমারী, করুণাময়ী ও জগদম্বা। করুণাময়ী বিয়ের দুই বছর পরই মারা যান। তাঁর স্বামী মথুরামোহন বিশ্বাস জগদম্বাকে বিবাহ করেন। তাঁদের পুত্র ত্রৈলোক্যনাথ বিশ্বাস। ত্রৈলোক্যনাথের চার পুত্র সন্তান – ব্রজগোপাল, নিত্যগোপাল, শ্রীগোপাল আর মোহনগোপাল। ব্রজগোপালের দুই কন্যা- লাবন্যলতা এবং বিদ্যুৎলতা। লাবন্যলতার বিবাহ হয় বিজয়কৃষ্ণ হাজরার সঙ্গে। রানী রাসমণির আদি দুর্গাপূজা বাড়ির যে অংশে হতো সেই অংশেই বর্তমানে হাজরা পরিবার বসবাস করেন এবং তাঁরাই সেই দুর্গাপূজা পরিচালনা করেন। যে ঠাকুরদালানে রানীমার আদি দূর্গা পূজা অনুষ্ঠিত হয় , তা শ্রী শ্রী ঠাকুর রামকৃষ্ণের পদধূলি-ধন্য l সেই ঠাকুরদালানের থাম এবং দেওয়ালেই বিশাল ফাটল ধরেছে।
মাত্র ১১ বছর বয়সেই কলকাতার যানবাজারের জমিদার রাজচন্দ্র দাসের সাথে বিয়ে করেন, সালটা ছিলো ১৮০৪
খ্রিষ্টাব্দে। স্বামীর মৃত্যুর পর রাসমণি জমিদারির দায়িত্ব তুলে নেন নিজের হাতে। অল্প সময়েই বুঝিয়ে দেন তিনি আসলে কে, জমিদারির বিস্তার ঘটে, প্রজারা সুখে শান্তিতে থাকে, তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। ব্রিটিশদের সাথে তাঁর তিক্ত সম্পর্কের কথা সর্বজনবিদিত। গরীব মৎস্যজীবীদের স্বার্থে তিনি ব্রিটিশদের সাথে সরাসরি সংঘাতে জড়িয়ে পড়েন।
কিন্তু সর্বদাই তিনি জিতেছেন। উনবিংশ শতাব্দীর পুরুষ শাসিত সমাজে তিনিই ছিলেন নারী শক্তির প্রতীক। ১৮৬১ সালে দক্ষিণেশ্বর কালি মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন ও রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবকে পূজারী হিসাবে নিযুক্ত করেন। সাধারন মানুষের রোজ স্নানের সুবিধার্থে বাবুঘাট, আহারিটোলা ঘাট ও নিমতলা ঘাট নির্মান করেন। তাঁর স্বামীর নামেই নামাঙ্কিত বাবুঘাট। তীর্থযাত্রীদের সুবিধার্থে তিনি সুবর্ণরেখা নদী থেকে পুরী পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ করেন। তিনি ইমপেরিয়াল লাইব্রেরী ( বর্তমানে ন্যাশানাল লাইব্রেরী) ও হিন্দু কলেজে (বর্তমানে প্রেসেডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়) এ
নিয়মিত অর্থ সাহায্য করতেন।