রাতের মহানগর প্রয়োজনীয় সুরক্ষা দিতে পারছে না মেয়েদের৷ সম্প্রতি প্রাক্তন মিস ইন্ডিয়া উষসী সেনগুপ্তের হেনস্তা আরও একবার প্রমাণ করল রাতের কলকাতা শহর ক্রমশ বিপজ্জনক হয়ে উঠছে মেয়েদের জন্য৷ কিন্তু এটাই কী প্রথমবার? উত্তরটা অবশ্যই নয়৷ কখনও ভরা বাসে মেয়েদের দেখে হস্তমৈথুন তো কখনও সরাসরি ধর্ষণ! মাঝেমাঝেই আতঙ্ক ফিরিয়ে দিয়েছে মহানগর৷
৩১শে ডিসেম্বর, ২০০২। বর্ষ শেষ কিংবা বর্ষবরণের রাতে ওয়েলিংটন স্কোয়্যার, হিন্দ সিনেমার কাছে মদ্যপ অবস্থায় কয়েকজন যুবক একজন মেয়ের শ্লীলতাহানি করতে উদ্যত হয়৷ কলকাতা পুলিশের সার্জেন্ট বাপি সেন মেয়েটিকে বাঁচাতে এগিয়ে এলে তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়৷ পরে জানা যায় দোষীরাও কলকাতা পুলিশে কর্মরত ছিলেন৷ এটা অবশ্য তাদের আইনের হাত থেকে রক্ষা করতে পারেনি৷ দোষীরা প্রত্যেকেই যাবজ্জীবনের সাজা পান৷
তবে এরপরও কী কমেছে কলকাতা শহরে বিশেষ করে রাতে মেয়েদের উপর হওয়া অত্যাচার? পরিসংখ্যান বলছে, ‘না’৷
৫ ফেব্রুয়ারি ২০১২, পার্কস্ট্রিটের একটি ক্লাব থেকে বেরিয়ে রাতে বাড়ি যাওয়ার সময় একটি বিলাসবহুল গাড়িতে জোর করে তুলে ধর্ষণ করা হয় বেহালার বাসিন্দা সুজেট জর্ডনকে৷ ভীত সন্ত্রস্ত নির্যাতিতা ঘটনার কয়েকদিন পর সাহস যুগিয়ে পার্কস্ট্রিট থানায় অভিযোগ করেন৷ কিন্তু পুলিশ প্রথমে তাঁর অভিযোগ নিতে চায়নি৷ পরে অভিযোগ নথিভুক্ত হলেও তদন্তে আগ্রহ দেখায়নি পুলিশ৷ তৎকালীন পুলিশ কমিশনার দময়ন্তী সেনের হস্তক্ষেপে এবং নেতৃত্বে তদন্ত সঠিক পথে এগোয়৷
সম্প্রতি উষসীর ঘটনাটি সামনে আসায় আরও বেশি করে ভীত হয়ে পড়ছেন কলকাতার মেয়েরা? উত্তরে কর্পোরেট সংস্থায় কর্মরতা মিঠু চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘বেশ কিছুদিন আগেও রাতের কলকাতায় নিরাপত্তাহীনতায় ভুগিনি৷ কাজ সেরে অথবা নাইটশো সিনেমা দেখেও বোনেদের সাথে বাড়ি ফিরেছি কোনপদ অসুবিধে হয় নি কোনোদিন। কিন্তু শহরের রাতের পরিবেশ বেশ কিছু সময় যাবৎ কেমন যেন বদলে গেছে। এক শ্রেণীর মানুষের মধ্যে দুঃসাহসটা অনেক বেড়ে গেছে হঠাৎ করেই। বেশি রাতে চলাফেরায় আমি আর নিরাপদ বোধ করি না৷’’ (বক্তা- মিঠু চ্যাটার্জী, কলকাতায় কর্পোরেট সংস্থায় কর্মরতা)
WBCS অফিসার বারাসতের বাসিন্দা স্বাগতা মন্ডলের রাতের কলকাতা আবার অনেকটাই সুরক্ষিত৷ তিনি জানান, ‘‘কলেজে পড়ার সময় থেকে বইমেলা থেকে ফেরা, আড্ডা, উৎসবের সময় ছাড়াও অন্য সাধারণ রাতে দেরি করে ফিরেছি বহুবার৷ ২০১২ সালে প্রায় প্রতি শনি-রবি সাউথ সিটি মল থেকে ফিরতাম বারাসাত এর বাড়িতে কোনো বিপদের গন্ধ পাইনি কখনো৷ পার্ক স্ট্রীট এ একা ঘোরাফেরা করতে কখনো সখনো অস্বস্তি হত তার কারণ এখানে জীবিকার তাড়নায় যারা থাকতেন তাদের সাথে অনেকসময় কিছু পথিক ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত গুলিয়ে ফেলতেন৷ অনেককিছু সংবাদমাধ্যমে পড়ি বটে, কিন্তু বহু ভালো ড্রাইভার দেখেছি৷ একা টাকা তুলব বলে যিনি ATM এর সামনে দাঁড়িয়ে পাহারা দিয়েছেন৷ তবে হ্যাঁ unsafe বলতে ভীষণ বেপরোয়া ভাবে গাড়ি চালান বহু মানুষ৷ বিশেষতঃ বাইকার রা , অনেকসময় ভয়ই করে গাড়ির সামনে না চলে আসেন৷ এছাড়া কিছু পুরুষের বিরক্তিকর দৃষ্টি ছাড়া নিজেকে ভীষণরকম unsafe কখনোই মনে হয়নি৷ (বক্তা-স্বাগতা মন্ডল ,বিশেষ রাজস্ব আধিকারিক-II, ভূমি ও ভূমিসংস্কার দফতর)
রাত তো দূর দিনের বেলাতেও কলকাতার অনেক জায়গা মেয়েদের জন্য সুরক্ষিত নয় বলে জানাচ্ছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক মহিলা সাংবাদিক৷ তিনি বলেন, ‘‘গত ২৫ ডিসেম্বর সল্টলেকের পিএনবি (পঞ্জাব নেশনাল ব্যাঙ্ক বাস স্টপ) থেকে বাড়ি ফেরার সময় এইজন বাইক আরোহী দিনের আলোয় দ্রুতগতিতে আমার শরীরে হাত ঠেকিয়ে বেরিয়ে যায়৷ আবার এরকমও হয়েছে বাসে সহযাত্রীরা আমার সঙ্গে হওয়া দূর্ব্যবহারের প্রতিবাদ করেছেন৷ তাই কলকাতা শহর বিশেষ করে রাতের কলকাতা আদৌও মেয়েদের জন্য সুরক্ষিত নয় বলেই মনে করছেন কলকাতার মহিলা সাংবাদিক৷
টালাতে থাকা এক গৃহবধূ অবন্তিকা দাস জানান, ‘ভয় তো লাগছেই৷ কিন্তু কী করব বলুন? পারিবারিক ও নিজস্ব প্রয়োজনে বাড়ির বাইরে যেতেই হয়৷ সংবাদমাধ্যমে কলকাতার বিভিন্ন খবর শুনি দেখি৷ তাতে ভয়টা বাড়ে৷ তবে রাত হোক আর দিন আমি সচেতন থাকার চেষ্টা করি৷’’
কলকাতার একটি কলেজে বাংলা বিষয় নিয়ে দ্বিতীয় বর্ষের পড়ুয়া অরিত্রিকা সিংহর বক্তব্য, ‘‘প্রতিদিনই যে আমাদের শহরে (কলকাতায়) এরকম অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটছে এমনটা নয়৷ আবার কলকাতার বিভিন্ন জায়গাতে বিশেষ করে রাতের দিকে মেয়েদের যথেষ্ট ভয়ঙ্কর অবস্থার মধ্যেও পড়তে হয়, এটাও সত্যি৷ তাই ওভাবে সরাসরি কলকাতা বা তার সমস্ত মানুষকে দোষারোপ না করে বলব, আমাদের শহরে ভালো মানুষের পাশাপাশি খারাপ অসৎ মানুষও রয়েছে তাদের থেকে আমাদের সাবধান থাকতে হবে৷’’