১৯৫০ এ আমার ঠাকুমার তার জন্মভূমি পূর্ব পাকিস্তান তথা পূর্ববঙ্গ ত্যাগ করার পরিপ্রেক্ষিত সন্ধান করতে গিয়ে যে তথ্য পেয়েছি, তাতে আমি একটা ব্যাপারে নিশ্চিত, বাঙালির ইতিহাস খন্ডিত তো বটেই, এবং অর্ধসত্য। সিলেটের অধ্যাপক যতীশচন্দ্র দাসের ১৯৫০ এ নির্মম অভিজ্ঞতার কথা শুনুন :
অধ্যাপক যতীশচন্দ্র দাসের বাড়ি ছিল সিলেট। ১৯৫০ এ, যতীশচন্দ্র দাস, কিশোরগঞ্জ কলেজে দর্শনশাস্ত্রের অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন ২৫ শে জানুয়ারি। তিনি একটা বাড়ি কিশোরগঞ্জে ঠিক করে, সিলেটে ফেরত যান তাঁর পরিবারকে আনতে। সেটা ছিল ফেব্রুয়ারী মাসের ১০ তারিখ। ১২ তারিখ সকাল ৬ টায়, যতীশচন্দ্র বাবু তার স্ত্রী লীলাবতী দাস, ছেলে গৌতম, মনজু ও বাপ্পা এবং আরো কয়েকজনকে নিয়ে সিলেট থেকে ট্রেন ধরলেন। ট্রেনে মাল উঠাতে গিয়ে কিছু মাল বাদ পরল। অতএব ছেলে গৌতমকে রয়ে যেতে হলো পরদিন বাকি মাল নিয়ে আসার জন্য। সেদিন ট্রেনে একমাত্র জ্যোতিষ বাবুদের কামরাটি ছাড়া, বাকি কামরাগুলো মিলিটারিদের জন্য রিজার্ভ করা ছিল। যতীশবাবুদের কামরার ৬০ যাত্রীর মধ্যে, সকলেই মুসলিম কেবল যতীশবাবুরা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অবিনাশ ভট্টাচার্য, তার স্ত্রী ও তিন বছরের মেয়ে বাদে। ট্রেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া এসে পৌছালো, প্লাটফর্মে উল্টোদিক থেকে ঢাকা থেকেও আরেকটা ট্রেন এসে পৌঁছলো। দুটো ট্রেন পাশাপাশি দাঁড়ালো। যতীশবাবুর স্ত্রী লীলা দেবীর চোখ পরলো পাশে দাঁড়ানো ট্রেনটার একটা কামরার দিকে। কামরাটা রক্তে ভেজা, এ কি ভয়ানক দৃশ্য ! লীলা দেবী আঁতকে উঠলেন। ওই ট্রেনের এক মুসলিম যুবককে নীলা দেবী প্রশ্ন করলেন ব্যাপারটা কি ? যুবকটি হাত নেড়ে ইশারায় লীলা দেবীদের ব্রাহ্মণবাড়িয়া স্টেশনে নেমে যেতে বলল়। বিপদের সংকেত পেয়ে যতীশবাবুরা ট্রেন থেকে নামার চেষ্টা করলেন, কিন্তু নামবেন কি করে, কামরার মুখ ঠাসাঠাসি যাত্রীভর্তি ! এদিকে ট্রেন চলতে শুরু করে দিল, হিন্দু যাত্রীদের ভয়ে রক্তশূন্য অবস্থা। এইবার আস্তে আস্তে করে ট্রেন দেখতে দেখতে তালসহরে এসে পরলো। আনসারের পোশাক পরিহিত দুজন মুসলিম যুবক কামরায় উঠলো। ট্রেন স্টেশন ছাড়ার সাথে সাথে, দুই যুবক অবিনাশবাবুর উপরে ঝাপিয়ে পরলো, অবিনাশবাবু স্ত্রী কেঁদে উঠলেন, মেয়েটাও কাঁদছে। যুবক দুজন চলন্ত ট্রেন থেকে অবিনাশবাবুকে ছুড়ে ফেলে দিল, সাথে সাথেই ভাবলেশহীনভাবে শ্রীমতি ভট্টাচার্যের গয়নাপত্র লুঠ করতে থাকলো। তাদের কান্নায় কেউ কর্ণপাত করলো না। এদিকে যতীশবাবুর পরিবার এইসব দেখে ভয়ে আধমরা ! এই দৃশ্য দেখে কয়েকজন মুসলিম মহিলাও ভয়ে কেঁদে উঠেছিল। বাঙালি মুসলমান পুরুষরা আশ্বাস দিল :’ মুসলমানদের কোন ভয় নেই’! আর সঙ্গে সঙ্গে আরো কিছু বাঙালি মুসলমান চেঁচিয়ে বলে উঠলো: ‘ আরে ভাই এদিকেও আছে এদিকেও আছে !’ এইবারে পালা এলো যতীশবাবুদের। লীলাবতী দেবী কেঁদে অনুরোধ করলেন:’ আমাদের যা আছে নিয়ে নাও কিন্তু আমাদের মেরো না’! কে কার কথা শোনে ? যতীশবাবুকে প্রচণ্ড পিটিয়ে ট্রেন থেকে ফেলে দেওয়া হল, ফেলে দেওয়ার আগে অনুরোধ করেছিলেন:’ আমি পাকিস্তানি আমাকে মেরোনা। ‘ ১৪ বছরের ছেলে বাপ্পাকে মেরে ট্রেনের বাইরে নিক্ষেপ করা হল, মনজুর উপরে চলল অকথ্য অত্যাচার, মনজু সিটের পায়া ধরে পরেছিল। এগুলো যখন চলছে তখন বাকি মুসলমান যাত্রীরা ‘আল্লাহু আকবর’ বলে চেচাচ্ছিল ! মনজুকে ফেলতে একটু দেরী হয়ে গেল, ট্রেন চলে এলো আশুগঞ্জ। মুসলমান হামলাকারী ট্রেন থেকে নেমে গেল। ট্রেন মাত্র এক মিনিট মত থেমেছিল তাই আবারও কেউ উঠে আসতে পারল না। ট্রেনপথের মাঝখানে অজ্ঞান হয়ে পরে রইলেন যতীশবাবু ও তার ছেলে বাপ্পা, ট্রেনের কামরায় রক্তাক্ত আধমরা মনজু ! ভৈরব বাজার স্টেশনে নেমে লীলা দেবী রেল পুলিশের দারোগাকে পাগলের মত অনুরোধ করলেন তার স্বামী ও ছেলেকে খুজে এনে দেবার জন্য। কেউ ওনার অনুরোধে একটুকু কান দিল না। অবশেষে লীলা দেবী, দুজন পুলিশের নজরদারিতে রাত্রিবেলা কিশোরগঞ্জ স্টেশনে পৌঁছেছিলেন।
সত্যি ভারী মানবিক ছিল সেদিনের বাঙালি মুসলমান, যার ঝলক আজও আমরা মাঝে মাঝে পাই। এগুলো যে ঘটবে, বা ঘটতে চলেছে, সংসার জীবনে বিচক্ষণ আমার ঠাকুমা সেদিনের পূর্ব পাকিস্তানের সামাজিক হালচালে বেশ কিছুটা টের পেয়েছিলেন, র তাই বুকে পাথর রেখে পরিবারসহ জন্মভূমি ত্যাগ করেছিলেন। নিঃশব্দে এই মানুষগুলোর দেশত্যাগ অবশ্য বাঙালী মুসলমানের মধ্যে কোন অনুশোচনা, বা অনুতাপের সঞ্চার ঘটায়নি………
সংগৃহীত ♠♠♠