পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতির পতনের ইতিহাস : কিভাবে একটা রাজ্যের জিডিপি শেয়ার দেশের 40% থেকে 3% এ নেমে এলো – তৃতীয় পর্ব

( স্বাধীনতার সময় পশ্চিমবঙ্গ (West Bengal) দেশের 40% জিডিপি দিত l সারা দেশ থেকে মানুষ কলকাতায় আসতো নিজের ভাগ্য ফেরাতে l আজ 3% l দেশ যেখানে আজ উন্নতির শিখরে, সেখানে একটা রাজ্য কিভাবে পিছিয়ে গেল? 73 বছরের ইতিহাসের বিশ্লেষণ ও সংকট থেকে বেরিয়ে আসার উপায় নিয়ে ধারাবাহিক l )

বিল গেটসকে যদি ভারত সরকার বলে যে সে এদেশে আর ব্যবসা করতে পারবে না, আর বিল গেটস যদি সুদীপ্ত সেন বা নীরব মোদীকে তার মাইক্রোসফট ইন্ডিয়া বেচে দেয়, কি হবে ভাবতে পারে আজকের ভারত? আজকের ভারতের একটা শিশুও শুনলে হেসে উঠবে l কিন্তু নরসিমা রাও/অটলবিহারি বাজপেয়ী যুগের 20 বছর আগের বাংলায় এটা খুব স্বাভাবিক ঘটনা ছিল l শুধু স্বাভাবিক নয়, এটা তৎকালীন বিপ্লবী বামপন্থী বাঙালীর কাছে শ্লাঘার বিষয় ছিল যে বিদেশী কোম্পানির স্বদেশীকরণ হচ্ছে l আর এই সমাজতন্ত্র, স্বদেশীকরণ, জাতীয়করন, অতিজাতীয়করণই  ইন্দিরাগান্ধীর মূল রাজনৈতিক অস্ত্র ছিল l তখন ভারতে ‘ফিনান্স’ কিংবা ‘ম্যানেজমেন্ট’ বিষয়গুলি নতুন l ফিনান্স ও ইকোনমিক্স দুটি শব্দেরই বাংলা প্রতিশব্দ অর্থনীতি l ভারতের ‘ইকোনমিক্স’ চর্চার কেন্দ্র ছিল এই কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ও দিল্লি স্কুল অফ ইকোনমিক্স l দেশের প্রথম IIM চালু হল কলকাতায় 1968 তে, যার উদ্ঘাটন করলেন তৎকালীন উপপ্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাই l ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি ও ফোর্ড ফাউন্ডেশনের সাহায্যে কলকাতায় দেশের প্রথম IIM কলকাতায়  তৈরি হলেও, ম্যানেজমেন্ট, ফিনান্স, হিউমান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট, স্ট্রাটেজি ইত্যাদি বিষয়গুলি কলকাতার বুদ্ধিজীবিদের চর্চার বিষয় ছিল না সেই যুগে l কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকপাল শিক্ষকদের আলোচনা মার্ক্সিয় অর্থনীতি চর্চার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল l বদ্ধ অর্থনীতিতে সবকিছুই ঠিক করে সরকার l সেখানে বিসনেস ম্যানেজমেন্ট আবার কি বস্তু?  তারা আজ বেচে থাকলে তাঁদের কাছে বিল গেটস ও নীরব মোদী একই শ্রেণীভুক্ত হতেন l তা হল দুজনেই ‘বুর্জোয়া’ l যথারীতি সাধারণ মানুষ,  সংবাদমাধ্যম, কফি হাউস থেকে রাজনৈতিক নেতারা সবাই সেভাবেই চিন্তা করতো l সাধারণ বাঙালী  তখনও মুক্ত অর্থনীতি, কর্পোরেট ফিনান্স, ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কিং ইত্যাদি বিষয়গুলি সম্পর্কে কারো আগ্রহ ছিল না l আর এখানেই গন্ডগোলের সূত্রপাত l MNC কর্পোরেট আর দেশি অযোগ্য পারিবারিক প্রতিষ্ঠানকে একই গোত্রে ফেলা হল l দুজনকেই যে শ্রেণীতে শ্রেণীভুক্ত করা হল, তা হল ‘বুর্জোয়া’ তথা ‘শ্রেণী শত্রু’ l কালা জ্বর, ডেঙ্গু জ্বর, সাধারণ জ্বর সবকিছুতেই একই মিক্সচার l

একটা কেস স্টাডি দিয়ে ব্যাপারটা বোঝানো যাক l ধরাযাক সাহাগঞ্জের ডানলপ l যখন বিদেশী মালিকানা ছিল, সাহাগঞ্জের এই কারখানা সারা পৃথিবীতে তাঁদের টায়ার বেচতো l কিন্তু নতুন দেশি মালিকের সেই বাজার যে শুধু জানা নেই তা নয়, তাকে সেই বাজারের পুরোনো ক্রেতারা ঢুকতেই দিল না l পশ্চিম জার্মানির যে গাড়ি কোম্পানি আগে ডানলপের থেকে টায়ার কিনত, তারা এই ভারতীয় মালিকানার সাহাগঞ্জের কারখানা থেকে কেনা বন্ধ করে দিল l কোম্পানির ব্যবসা কমে গেল l দেশি আম্বাসাডার ছাড়া তাঁদের আর খদ্দের নেই বললেই চলে l এর প্রভাব সরাসরি পড়লো শ্রমিক কর্মচারীদের জীবিকায় l পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ চা বাগান, খনি, পাট কল, কাগজ কল থেকে গ্রামাফোন কোম্পানি এক গল্প শুরু হল l নতুন মালিকরা ব্যবসা চালাতে ব্যর্থ হয়ে শ্রমিকদের বেতন কমানো, ছাটাই ইত্যাদি শুরু করল l বন্ধ হয়ে গেল নতুন গবেষণা l শ্রমিক ইউনিয়নগুলি জঙ্গি আন্দোলন শুরু করল কারখানার গেটের সামনে l 1966 থেকে 1977 শ্রমিক সংগঠনগুলি মোটামুটি সৎভাবেই লড়ছিল l কিন্তু, সমাধানের কোন রাস্তাই খুলছিল না, কারণ ইন্দিরা গান্ধীর আর্থিকনীতিতে বিদেশী মালিকরা কেউ এদেশে কাজ করতে রাজি নয় আর দেশি মালিকদের পক্ষে ওই শিল্পগুলি চালানো অসম্ভব l কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে শেষে দুর্যোধনের পরাজয়ের পর, অশ্বত্থামা যেমন ব্রহ্মাস্ত্র (এখানে সোভিয়েত আর্থিক মডেল ) নিঃক্ষেপ করে তা ফেরাতে না পারায় সেই অস্ত্র মাতৃগর্ভস্থ পরীক্ষিতকে আঘাত করেছিল, তেমনি এখানে সোভিয়েত আর্থিক মডেল আঘাত করল পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতি, রাজনীতি ও সমাজব্যাবস্থা l 1970 -71 l কলকাতা উত্তাল হয়ে উঠল l 

সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়কে ইন্দিরা গান্ধী বাংলার দ্বায়িত্ব দিলেন বাংলা শান্ত করার l পশ্চিমবঙ্গকে অন্যভাবে ক্ষতিপূরণ দেবার পরিকল্পনা করলেন l তিনি জানতেন, শিল্প আসবে না l কিন্তু পরিকাঠামো ও পরিষেবা দিয়ে যদি কিছুটা পোষানো যায় l নক্সালবাড়ি আন্দোলনের পর দক্ষিণ ও উত্তরবঙ্গকে সড়ক ও রেল বরাবর জুড়তে ফারাক্কার কাজের গতি বাড়িয়ে দেন l 1972 এর বদলে 1971 এই ফারাক্কা ব্যারেজ কমিশনিং করান ইন্দিরা গান্ধীর (Indira Gandhi) নবনিযুক্ত কেন্দ্রীয় ‘পশ্চিমবঙ্গ বিষয়ক’ কেবিনেট মন্ত্রী l 1972 এ মুখ্যমন্ত্রী হয়ে রাজ্যে ফিরে এলেন সিদ্ধার্থবাবু (Siddhartha babu) l তাঁর মন্ত্রীসভায় কিছু দক্ষ প্রশাসককে মন্ত্রী করলেন l তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য গণিখান চৌধুরী (Gani Khan Chowdhury) ও আব্দুল সাত্তার (Abdul Sattar) l অন্যদিকে 24 বছরের ডাকাবুকো ছাত্রনেতা সুব্রত মুখার্জীকে নিয়োগ করলেন সরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হিসেবে বিরোধীদের শায়েস্তা করার জন্য l বিদ্যুৎ, কৃষি, সেচ, স্বাস্থ্যতে কাজের গতি ও বিনিয়োগ বাড়ানো হল শিল্প বিনাশের ক্ষতে প্রলেপ দিতে l কিছু যুগান্তকারী প্রকল্প সিদ্ধার্থ রায় শুরু করলেন, যা সেদিন না করলে আজ পশ্চিমবঙ্গের মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী ছিল l তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য, 

  1. কলকাতা মেট্রো: রাজধানী দিল্লির 28 বছর আগে কলকাতার জন্য মেট্রো শুরু করেন ইন্দিরা সিদ্ধার্থ, যা আজকের দিনে কলকাতার প্রাণভ্রমরা বলা যায় l
  2. দ্বিতীয় হুগলি সেতু: যা আজকের দিনে কলকাতার মূল বাণিজ্যিক প্রবেশপথ l এটা না থাকলে কলকাতার সঙ্গে পশ্চিমের জেলাগুলি বা দেশের অন্য প্রান্তের সঙ্গে যোগাযোগ অসম্ভব হয়ে যেত l
  3. তিস্তা : এই প্রকল্প উত্তরবঙ্গকে ইসরায়েল বা গুজরাট বানিয়ে দিতে পারত l কিন্তু সিদ্ধার্থশঙ্কর ব্যারেজ বানানোর পর সেই জল পশ্চিমবঙ্গ আজও উত্তরবঙ্গের অধিকাংশ চাষীর ক্ষেতে নিয়ে যেতে পারেন নি l কারণ তার উত্তরসূরিরা সেচখাল বানাতে ব্যর্থ হয়েছে l তাই পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যায় আজও দেশের একনম্বর এই উত্তরবঙ্গ l
  4. ক্ষুদ্র সেচ: সেচ মন্ত্রী গণিখান চৌধুরীর জীবনের এক চূড়ান্ত সাফল্য, যার ফল 34 বছর আস্বাদন করেছে CPM l প্রচুর ডিপ ও স্যালো টিউবওয়েল বসিয়ে সেচের জলের একটা সমাধান করেন তিনি l
  5. গ্রামীণ বিদ্যুতিকরণ: গনিখানের আরেক বিপুল সাফল্যের জায়গা l এই প্রকল্পে বহু গ্রাম বিদ্যুৎ পায় ও বেকারদের ঠিকাদারী দিয়ে সাময়িকভাবে তাঁদের ঠান্ডা করা হয় l যদিও নিন্দুকেরা বলে, তার নিজের জেলা মালদার লোকেরাই বেশী কাজ পায় এই প্রকল্পে l
  6. কলকাতাকে সল্টলেকে বিকেন্দ্রীকরণ : ওই সময় সল্টলেকে বিভিন্ন ‘ ভবন’ তৈরি শুরু হয়, কলকাতার বিভিন্ন অফিসকে সারানোর উদেশ্যে l তার সঙ্গে আবাসনের পরিকল্পনা l
  7. ভূমি সংস্কার: 2011 পর্যন্ত যে পরিমান ভূমি সংস্কার হয়েছিল, তাঁর 40% করে গেছে এই সরকার, দ্বিতীয়বার নক্সালবাড়ি আন্দোলন রোখার জন্য l যদিও এর সম্পূর্ণ কৃতিত্ব দাবী করে CPM l এছাড়া ঘাটাল মাস্টারপ্ল্যান, সিদ্ধেশ্বরী নুনবিল, দ্বারকেশ্বর- গন্ধেশ্বরী ইত্যাদি সেচ প্রকল্পের পরিকল্পনা করলেন সিদ্ধার্থশঙ্কর l

 কিন্তু নক্সাল আন্দোলন বন্ধ করতে গিয়ে নিচুতলার কংগ্রেস কর্মী ও পুলিশের এক অংশকে কিছু সংবিধানবহির্ভূত ক্ষমতা দেয়া কাল হল সিদ্ধার্থশঙ্করের l এক অস্থিরতা সামলাতে গিয়ে আরেক অস্থিরতার জন্ম দিল তার সরকার l

ওদিকে বেকারত্ব বেড়েই চলেছে, সঙ্গে 33%  মুদ্রাস্ফীতি l তারপর জরুরি অবস্থা এবং ইন্দিরা গান্ধীর পতন l 1977 এ ক্ষমতায় এসে প্রফুল্ল সেন ও জ্যোতি বাবুদের অনুরোধে, প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাই সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়কে বরখাস্ত করলেন l কয়েক মাস পর বিধানসভা নির্বাচনে প্রফুল্ল সেনের  জনতা দল ও সিদ্ধার্থশঙ্করের কংগ্রেসের ভোট কাটাকাটিতে বাংলায় ক্ষমতায় এল বামফ্রন্ট l ইন্দিরা গান্ধীর বঙ্গনিধনের অসম্পূর্ণ কাজ সম্পূর্ণ করার দ্বায়িত্ব নিজ স্কন্ধে নিয়ে বাংলার মসনদে বসলেন জ্যোতি বসু l আগামী 24 বছর বাংলার শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সংস্কৃতি, শিল্প, বাণিজ্য, পরিকাঠামো, সমাজ, দর্শনসহ সর্বক্ষেত্রে দ্রুত ধংসের দিকে যেতে থাকল পশ্চিমবঙ্গ l আলোচনা হবে আগামী পর্বে l

সুদীপ্ত গুহ  (Sudipta Guha)

(লেখক বহুজাতিক পরামর্শদাতা সংস্থা URS কনসাল্টিং ইন্ডিয়ার ভূতপূর্ব চিফ জেনারেল ম্যানেজার )

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.