পর্ব ১
সেই জলন্দার গড়, সেখানের জলন্দীর গল্প করব আজ। শ্ৰী বিশ্বম্ভর মিশ্র কৃষ্ণ প্রেমে মাতোয়ারা হয়ে শ্ৰী চৈতন্য মহাপ্রভু হলেন। শ্ৰীমন্মহাপ্রভুর ছোঁয়ায় সেই ভীষণ এক সময় সমগ্র দেশে সনাতনের মধ্যে পুনরায় নবজাগরণের সূচনা হল।
প্রভাত সময়ে শচীর আঙিনা মাঝে ,
গৌরচাঁদ নাচিয়া বেড়ায় রে,
জাগো নি গো শচীমাতা
,গৌর আইলো প্রেম দাতা,
ঘরে ঘরে হরির নাম বিলায় রে
বাঙ্গালার গৃহে গৃহে – বিশেষত পশ্চিমবঙ্গের রাঢ় অঞ্চলের নানা স্থানে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সংস্কৃতি কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে মহাপ্রভুর অনুবর্তিগণ জাতিগঠনে অগ্রবর্তী হন। বীরভূম জেলার #জলন্দার_গড়_জলন্দী এইরূপ একটি সংস্কৃতি কেন্দ্র। শ্ৰী মন্মচৈতন্যদেবের সমসাময়িক মহাপ্রভুর অন্যতম পার্ষদ ধনঞ্জয় পন্ডিতের এক শিষ্য জলন্দার গড়ে এসে বাস শুরু করেন। সে আজ প্রায় চারিশত বৎসর পূর্বের কথা ।
জলন্দার গড়ের ঠাকুরগণ বলেন – ধনঞ্জয় পন্ডিতের এই শিষ্য ও আত্মীয়ের নাম সঞ্জয় পন্ডিত। আড়াই শত বৎসর পূর্বে সঞ্জয় পন্ডিতের বংশে যদুচৈতন্য ঠাকুরের জন্ম হয় । ধনঞ্জয় পন্ডিতের পূজিত #শ্ৰীনরসিংহ বিগ্রহ আজও পূজা প্রাপ্ত হচ্ছেন। যদুচৈতন্য ঠাকুর জলন্দার গড়ে শ্রীরাধাবিনোদ যুগলবিগ্রহের প্রতিষ্ঠা করেন।
যদুচৈতন্যের তিন পুত্র – জ্যেষ্ঠ রামজয় । এনার বংশধর জলন্দায় বাস করছেন ।মধ্যম পররাম, এনার দৌহিত্রগণ শ্রীরামপুরে বাস করেন। কনিষ্ঠ কানুরাম বা রামকানাই মুলুকে চলে যান । মুলুক রামকানাই ঠাকুরের পাট নামে পরিচিত হয় । বীরভূমের মুলুকের ঠাকুরবাড়ি সুপরিচিত। বীরভূমের বাইরেও নানা স্থানে মুলুকের ঠাকুরবাড়ির শিষ্য আছে। বীরভূম বোলপুরের একক্রোশ পূর্বে মুলুক গ্রাম। গ্রামে ব্রাহ্মণ, বৈষ্ণব, সদগোপ, বেনে, গোয়ালা, বাগদী, কলু, ধোপা, মুচি , হাঁড়ি, ডোম প্রমুখ সকলেই একত্রে এবং সৎভাবে বাস করেন। এখানে লোক সংখ্যা হাজারের কম হবে না ।
বীরভূম অনেক প্রাচীন। রামায়ণ , মহাভারত , পুরানাদিতে , তন্ত্রে নানাভাবে বঙ্গ সহ তার নানা স্থানের উল্লেখ আছে। বীরভূমের নানা স্থানে ত্রিকালজ্ঞ মুনি ঋষিদের আশ্রম ছিল এরূপ প্রবাদ আছে। জলন্দার গড়ের কিছু দূরে আঙ্গোরা নামক স্থানের ঋষি অঙ্গীরার আশ্রম ছিল। মুলুকের নিকটবর্তী শিয়ান গ্রামে ঋষ্যশৃঙ্গ মুনির আশ্রম ছিল । মুলুকের অনতি উত্তরে ঋষ্যশৃঙ্গের পিতা বিভান্ডকের আশ্রম ছিল বলে কিংবদন্তি আছে।
শিয়ান গ্রামের পশ্চিমে পতিত ডাঙ্গায় একটি বৃক্ষলতা সমাকীর্ণ স্থান ঋষ্যশৃঙ্গ মুুনির এবং মুলুকের উত্তরে
যেখানে মুনিকুণ্ড নামে একটি শীতপস্রবণ আছে, সেই স্থানে ঋষি বিভান্ডকের আশ্রম ছিল। শিয়ানের আশ্রমে পৌষ সংক্রান্তির মেলা হয় । মুনিকুণ্ডের জলে অনেক মানুষ সে সময় স্নান করে পুণ্যার্জন করেন।
শিয়ানে শ্বেতবসন্ত নামে এক রাজা ছিলেন । ১৭ জন অশ্বারোহীর নবদ্বীপ বিজয়ের গুলির আড্ডার গেলগল্পে বিশ্বাস করেন তাঁরা রাঢ়ের পল্লীতে পল্লীতে করলে দেখতে পাবেন হিন্দুবীরদের স্মৃতিজড়িত অসংখ্য ধ্বংসস্তূপ এবং শুনতে পাবেন শ্বেতবসন্তের মতো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজার মর্মন্ত্তুদ পরিণামের করুন কাহিনী। বাঙ্গালা এমনকি পশ্চিমবঙ্গের রাঢ় অঞ্চলও একদিনে বিজিত হয়নি। সমগ্র দেশ অধিকার করতে বৈদেশিক ম্লেচ্ছদের বহুকাল গত হয়েছিল। রাজধানী অধিকারের পরেও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘাটোয়াল বা ঘাটরক্ষকগণ , সমৃদ্ধ পল্লীর ভূস্বামীগণ বহুদিন এই বিদেশীদের বাঁধাদান করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
নানা ম্লেচ্ছ প্রচারক বা ভাগ্যান্বেষী সৈনিকরূপে এই সব ঘাটোয়াল বা ভূস্বামীর অধিকারে প্রবেশ করে বিরোধ বাঁধিয়েছে। পরে সেই বিরোধের ছল করে নবাব বা নিকটবর্তী কোনো শাসন কর্তার নিকট নালিশ করে সৈন্য সাহায্য নিয়ে সেই সেই স্থান অধিকার করেছে। কোথাও নিজে স্বেচ্ছায় হত হয়ে নানা উপাধি লাভ করেছে। এসকল বিরোধের মধ্যে রাজা বা ভূস্বামীগণের সঙ্গে হয়েছে বিশ্বাসঘাটকতা এবং ষড়যন্ত্র। সেসব না বলা ইতিহাসও গুমরে বেড়ায় রাঢ়ভূমির গ্রামে গঞ্জে।
শিয়ানের রাজা শ্বেতবসন্ত মঙ্গলকোটের শ্বেতরাজার বংশধর। এই শ্বেতরাজাই অন্যতম বিক্রমাদিত্য নামে পরিচিত। বীরভূমের বক্রেশ্বর তীর্থ মঙ্গলকোট বা উজানির শ্বেতরাজারই প্রতিষ্ঠিত। সেসব ইতিহাস বলছি পরে….
একটু এই উজনীর বিক্রমাদিত্য ,মঙ্গলকোট ইত্যাদি নিয়ে ব্যাখ্যা প্রদান করি। ঐতিহাসিক দীনেশচন্দ্র সরকার তাঁর The Shaktipithas গ্রন্থে পীঠনির্ণয় অনুসারে বা মহাপীঠনিরুপন অনুসারে সতীপীঠ হিসাবে পাঁচটি স্থাননাম যথা উজ্জয়িনি, উজ্জনি, উজানি, উর্জন, উর্জয়িনি উল্লেখ করেছেন। এখানে সতীর কূর্পার পতিত হয়েছিল। দেবীর নাম মঙ্গলা বা মঙ্গলচন্ডী। ভৈরব হলেন কপিলাস্বর বা কপিলেশ্বর। সতী পীঠের দাবিদার দুই স্থান – ১. মঙ্গলকোট উজানি ২. অবন্তী উজ্জয়নি।
অনেক অবন্তীর হয়ে সওয়াল করেন। হয়তো বা কোগ্রাম উজানির সঙ্গে কিংবদন্তি মহারাজ বিক্রমাদিত্যের নাম জড়িত আছে ….সেই কারণে এমন সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন।
অন্নদামঙ্গলে আছে –
উজানিতে কফোনি মঙ্গলচন্ডী দেবী।
ভৈরব কপিলাম্বর শুভ যাঁরে সেবি।।
উজ্জয়নি , যা ইতিহাসে অবন্তী নামেও সুপরিচিত । এই নগরীর সঙ্গে ভগবান শ্ৰী কৃষ্ণ, সম্রাট অশোক বা মহাকবি কালিদাস প্রমুখদের স্মৃতি বিজড়িত আছে। প্রতি ১২ বৎসর অন্তর উজ্জয়নিতে কুম্ভমেলা অনুষ্ঠিত হয়। সেথায় অবস্থান করছেন সন্দীপন মুনির আশ্রম, যে আশ্রমে স্বয়ং ভগবান কৃষ্ণ, শেষনাগ বলরাম এবং সখা সুদামা অধ্যয়ন ও ব্রহ্মচর্য পালন করেছিলেন। এখানেই রয়েছে বিখ্যাত মহাকালেশ্বর মন্দির। যে মন্দিরের প্রাচীর গাত্র ধরে দাঁড়িয়ে ক্লান্ত , বিতাড়িত কালিদাস সব যন্ত্রণার অবসান চেয়েছিলেন।
মহাকালেশ্বর দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের অন্যতম ….
সৌরাষ্ট্রে সোমনাথং চ শ্রীশৈলে মল্লিকার্জুনম্।
উজ্জয়িন্যাং মহাকালমোঙ্কারামমলেশ্বরম্।। |
পরল্যাং বৈদ্যনাথং চ ডাকিন্যাং ভীমশঙ্করম্।
সেতুবন্ধে তু রামেশং নাগেশং দারুকাবনে।।
বারাণস্যাং তু বিশ্বেশম ত্র্যম্বকং গৌতমীতটে।
হিমালয়ে তু কেদারং ঘুশ্মেশং চ শিবালয়ে।।
এতানি জ্যোতির্লিঙ্গানি সায়ং প্রাতঃ পঠেন্নরঃ।
সপ্তজন্মকৃতং পাপং স্মরণেন বিনশ্যতি।।
এতেশাং দর্শনাদেব পাতকং নৈব তিষ্ঠতি।
কর্মক্ষয়ো ভবেত্তস্য যস্য তুষ্টো মহেশ্বরাঃ।।
উজ্জয়নি এক সময় জ্যোতিষচর্চা এবং তন্ত্রসাধনার অন্যতম পীঠস্থান। এখানেই ভৈরবের সুপ্রাচীম এবং প্রসিদ্ধ মন্দিরের অবস্থান। মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত এবং দুর্ধরার পুত্র বিন্দুসারের রাজধানী উজ্জয়নি তথা অবন্তী। গুপ্তযুগের এই নগরী সনাতনের অন্যতম তীর্থস্থানে পরিণত হয় । তালবেতাল তন্ত্র সিদ্ধ রাজা বিক্রমাদিত্য আরাধ্য দেবী অন্নপূর্ণা বা হরসিদ্ধি মাতার মন্দিরের অবস্থান এখানে। আর আছে মহাকবি কালিদাসের বরদাত্রী মহামেধা, মহাবিদ্যা, মহামায়া, আদিশক্তি বিশালাকার কালিমূর্তি।
শিপ্রানদীর তট সংলগ্ন উজ্জয়নির নাম সাদৃশ্য ব্যতীত অজয় নদের তীরবর্তী উজানির আর কি সাদৃশ্য আছে?
কেন আছে বৈকি….স্থান নাম যে হয়েছে #খড়্গমোচন।
ওমা…অবাক হচ্ছেন? তাহলে এই কথক আরো একটু গল্প বলুক: বতর্মান উজানির অজয় কুনুর সঙ্গমস্থলে আছে ভ্রমরাদহ। তার ঠিক পিছনে ছিল এক মহাশ্মশান।
সেই শ্মশানের ঠিক পিছনে খড়্গমোচন নামে স্থানটির অবস্থান। সে স্থান খুবই পবিত্র। কিংবদন্তি রাজা বিক্রমাদিত্যের বেতালসিদ্ধ বিষয় এক সন্ন্যাসীর সঙ্গে মতানৈক্য ঘটায় , রাজা খড়্গ দিয়ে তাঁকে হত্যা করেন । রাজার ব্রহ্মহত্যার পাপ লাগে। সেই পাপে হাতে খড়্গ লেগে যায়। বহু তীর্থ ভ্রমণ করেন রাজা , কিন্তু সে পাপ মোচন হয় না। শেষে রাজা এই মহাশ্মশানে এসে তপস্যা করলে হাত থেকে খড়্গ খসে পড়ে। সেই সূত্রে স্থানের নাম খড়্গমোচন হয়। বর্তমানে সেই স্থান না থাকলেও মাঠটিকে স্থানীয় মানুষজন খড়্গমোচন মাঠ বলে থাকেন। তাই, কিংবদন্তি রাজা বিক্রমাদিত্যের প্রভাব এখানে পড়েছিল বলে অনুমিত হয় ।
তাছাড়া কাটোয়াকে গুপ্ত বারাণসী বলা হয়। জয়ানন্দের চৈতন্য মঙ্গলকাব্যে কাটোয়াকে গুপ্ত বারাণসী বলা হয়েছে ।
পূর্বে ইন্দ্রেশ্বরঘাট অতি মনোহর
উত্তরে অজয়- গঙ্গা।
মধ্যে কাটোয়া গুপ্ত বারাণসী
নৃত্য নবরত সঙ্গা।। সন্ন্যাস।।
বর্ধমান জেলার গেজিটিয়ারে ১৯১০ সালে লেখা হয় যে , ” ঐতিহ্য অনুসারে শ্রেষ্ঠ রাজা বিক্রমাদিত্য প্রতিদিন তাঁর প্রাসাদ রাজপুতানার উজায়িন থেকে কাটোয়ায় পবিত্র স্নান করে পুণ্য অর্জন করতে আসতেন।এবার রাজপুতানার প্রাসাদ হতে প্রত্যহ কিভাবে কাটোয়া এসে পুণ্য স্নান করবেন রাজা সেটা অলৌকিক ব্যাপার বা বিতর্কিত , তাতে সন্দেহ নেই। তবে , #মঙ্গলকোটের বিখ্যাত প্রত্নডাঙ্গাটি #বিক্রমাদিত্যের_ডাঙ্গা নামে সুপরিচিত।
ঐতিহাসিক তথ্য এবং প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের মাধ্যেমে জ্ঞাতব্য হয় মঙ্গলকোটের নগরায়ণের সূচনা ঘটে কুষান যুগে । তার পরের স্তর হল গুপ্তযুগের স্তর। এই স্তরে নানা পোড়া ইঁটের স্থাপত্য , কুমোরের চাক, গুপ্ত ব্রাহ্মী লিপিতে খোদিত নানান সিল মোহর,মূর্তি ইত্যাদি। অতএব, অনুমান করা অসম্ভব হবে না যে গুপ্তযুগের প্রভাব মঙ্গলকোট উজানিতে ব্যাপকভাবে পড়েছিল।
হয়তো সেই সূত্র ধরেই উজ্জয়নী আরো উজানি একাকার হয়ে গেছে।
পুরাণে বর্ণিত মঙ্গলকোষ্টকম্ শব্দটি নিয়েও বিতর্ক আছে। বৃহদ্ধর্ম পুরাণে উল্লেখ আছে-
উজ্জয়নিনাম তথা পূর্বাম পীঠম মঙ্গলকোষ্টকম্।
শুভামণ্ডল চণ্ডাখ্যা যত্ৰাম বরদায়িনী।।
অধ্যাপক বিনয় ঘোষের মন্তব্য অনুযায়ী, মঙ্গলকোষ্ঠ নামে বিখ্যাত তান্ত্রিক কেন্দ্র ছিল উড্ডিয়ানে, উত্তর-পশ্চিমে । তাঁর মতে সেটি কিন্তু ওড্র উড়িষ্যা বা উজানি নয়। বৌদ্ধতন্ত্রশাস্ত্রে এই মঙ্গলকোষ্ঠের উল্লেখ আছে।বিনয় ঘোষের মনে হয় , পরবর্তীকালে বঙ্গে বৌদ্ধতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবার পর বৌদ্ধতান্ত্রিক রাই উত্তর-পশ্চিমে মঙ্গলকোষ্ঠের অনুকরণে বাংলা মঙ্গলকোট ও উজানি। নামকরণ করেন । অধ্যাপক বিনয় ঘোষের মত এই নামকরণ হয়েছিল – পাল রাজত্বকালে। একথা সত্য যে মঙ্গলকোটে খননের ফলে একাধিক বৌদ্ধমূর্তি প্রাপ্তি ঘটেছে। এখনো একটি বৌদ্ধ মূর্তি উজানি মঙ্গলচন্ডীর গর্ভগৃহে নিত্য পূজিত হন । কিন্তু প্রশ্ন এখানে যে উজানি মঙ্গলকোট থেকে কেবল বৌদ্ধ মূর্তি মিলেছে? আর কোন মূর্তি মেলেনি ?
উত্তর হ্যাঁ, অন্য অনেক মূর্তি প্রাপ্ত হয়েছে। মঙ্গলকোটে একাধিক জৈন মূর্তিসহ কুষাণ যুগের গণধর, আল এবং সেন আমলের বিষ্ণুমূর্তি, মহিষাসুরমর্দিনী’র মূর্তিও পাওয়া গিয়েছে ।চন্ডীমঙ্গল কাব্যের বণিক খন্ডের আরাধ্য দেবী হলেন #কমলেকামিনী । পণ্ডিতদের মতে ইনিই হলেন মূর্তিরূপের বিচারে দেবী গজলক্ষ্মী ।
মঙ্গলকোটে মৌর্য – শূন্গ যুগের গজলক্ষ্মীর টেরাকোটার মূর্তি পাওয়া গিয়েছে । তেমন গুপ্ত যুগের আছে পোড়া মাটির সিলে গজলক্ষ্মীর ছাপ আছে। সুতরাং উত্তর-পশ্চিম ভারত থেকে মঙ্গলকোট কথাটি এসেছে একথা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না ।
মঙ্গলকোটের #মঙ্গল শব্দটি নিঃসন্দেহে উজানি নগরের অধিষ্ঠাত্রী দেবী চন্ডীকে নির্দেশ করে করা হয়েছে । তাছাড়া ডক্টর আশুতোষ ভট্টাচার্যের মতে #চন্ডীর_একনাম_অষ্টমঙ্গলা । তারঁ লেখা থেকে জানতে পারা যায় মঙ্গলচণ্ডী বা দুর্গা রাঢ় অঞ্চলে আজও পূজিতা হচ্ছেন । যেমন বর্ধমানের সর্বমঙ্গলা।
#কোট শব্দ থেকে কোষ্ট শব্দটি আগত কোষ্ট অর্থাৎ কোঠাবাড়ি বা ঘর অর্থাৎ মন্দির। মঙ্গলকোট সংলগ্ন আরেকটি গ্রামের নাম সিঙ্গট । সেখানের কুলদেবী সিংহবাহিনী। সিংহবাহিনীর
কোষ্ট বা মন্দির সিঙ্গট শব্দটি আগত। সুতরাং , মঙ্গলকোট হল দেবী চন্ডীর আবাসস্থল।
কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে উজয়নি, উজবানি, উজানি ইত্যাদি শব্দের উল্লেখ রয়েছে। যদিও একে সতী পীঠ বলে উল্লেখ করা হয়নি ।প্রচলিত দিগবন্দনায় ক্ষীরগ্রামের মা যোগাদ্যার নাম আছে।
তবে সদাশিব রায় মহাপরিশ্রম পায় ,ক্ষীর গ্রামে করিলা বিশ্রাম।
তাহে পৃষ্ঠদেশ পড়ে দেবের আনন্দ বাড়ে যোগাদ্যা হইল তার নাম ||
অন্নদামঙ্গলেও আছে,
‘ক্ষীরগ্রামে ডানি পার অঙ্গুষ্ঠ বৈভব৷ /যুগাদ্যা দেবতা ক্ষীরখণ্ডক ভৈরব৷৷ ’
উজানের দিকে অর্থাৎ স্রোতের বিপরীতে বহমান তাই নাম উজানি। বলা হয়, আজও মকরসংক্রান্তিতে অজয় উজানে প্রবাহিত হয়। তাই ওইদিন বহু পুণ্যর্থী মকর স্নান করে অজয় নদে। ব্রজপরিক্রমা গ্রন্থে আছে – ব্রজধামে উজানি নামে গ্রাম রয়েছে। এখানে যমুনার উজান প্রবাহ হেতু উজানি নামকরণ হয়।
দেখহ উজানি গ্রাম যমুনা এখানে।
বহএ উজান শ্রীকৃষ্ণ বংশীগানে। ।
অনেকে বলেন, কবি জয়দেবের প্রার্থনায় মকরের দিন গঙ্গা অজয়ের মধ্যে দিয়ে উজানে বাহিত হয়। অর্থাৎ, উজানি এক সময় বিশিষ্ট জনপদ ছিল। মধ্যযুগের ইতিহাস ঘাঁটলে উজানিকে সুগ্রাম বলে উল্লেখ করা হয়েছে বলে জানা যায়। তাই সতী পীঠের উজানি হল……
মঙ্গলকোটের উজানি। কিংবদন্তি আছে চৈতন্যমঙ্গলের প্রণেতা ত্রিলোচনদাস তাঁর এই জন্ম ভূমিকে কোগ্রাম এবং তাঁর স্ত্রী রাগের চোটে একে কুগ্রাম বলেছেন। সে থেকে এই নামও প্রচলিত হয়েছে।
তো যাক, বিক্রমাদিত্য , শ্বেতরাজা ইত্যাদি প্রশ্ন আপনাদের মন থেকে আপাতত নিরসন করতে পেরেছি আশা করি? এবার আবার সেই মুলুক, শিয়ান, বীরভূমে ফেরৎ যাই…..
তো , শিয়ানের রাজা শ্বেতবসন্ত রাজা মঙ্গলকোটের শ্বেতরাজার বংশধর ছিলেন। গিয়াসউদ্দীন ইয়ুজের সেনাপতি মুলুকখান শ্বেতরাজার রাজত্ব আক্রমণ করে।
সে এক ষড়যন্ত্রের ইতিহাস । শ্বেতরাজার দুই জোড়া পায়রা ছিল। একটি সাদা জোড়া অন্যটি কালো জোড়া। রাজ্য ম্লেচ্ছরা আক্রমণ করল। রাজা যুদ্ধে যাবার পূর্বে বলে গেলেন , ” রাণী গো, সাদা পায়রা যদি আসে উড়ে। জানবে জয় ধ্বজা ওড়ে । যদি কালো পায়রা উড়ে। জানবে তোমার কপাল পোড়ে। তখন নিজ নিজ মর্যাদা রাখিও।”
এদিকে যুদ্ধে রাজার জয় হল। রাজা মহানন্দে রাজঅন্তঃপুরে প্রত্যাবর্তন করে দেখলেন সেখানে কেবল শ্মশানের নীরবতা। পুররক্ষীগণের নয়নাশ্রু আর্ত ক্রন্দন প্রাসাদের কোণে কোণে ধাক্কা দিয়ে ফিরে আসছে প্রেতপুরীর ন্যায়। কি হয়েছে ? কি হয়েছে ?
কি হবে? কালো পারাবত উড়ে এসেছে। তাই, সম্মান রক্ষার্থে রাজমহিষীসহ সকল পুরনারী অগ্নিহুতা হয়েছেন। রাজা শ্বেতবসন্ত বুঝতে পারলেন পারাবত রক্ষক বিশ্বাসঘাতক। ম্লেচ্ছদের হতে উৎকোচ বশীভূত হইয়া কালনাগিনী স্বরূপ কালো পায়রা উড়িয়েছে। হায়, হায়…. কিন্তু শোক করবার অবসর কোথায় ? অবসর নেই, ফেরবার পথ নেই …..ওই শোনা যায় ঘোড়ার খুরের শব্দ ! পরাজিত ম্লেচ্ছরা উন্মাদ হয়ে সসৈন্যে রাজ অবোরধ আক্রমণ করল। দুঃখে, শোকে , তাপে , রণক্লান্ত রাজা পুররক্ষীদের নিয়েই রুখে দাঁড়ালেন। সম্মুখ সমরে প্রাণ দিয়ে বীরগতি প্রাপ্ত হলেন।
ইতিহাস বিশ্বাসঘাতকতার , ইতিহাস ষড়যন্ত্রের। এমন ইতিহাস বাংলার গাঁ ঘরে গুমরে গুমরে মরে। সেই শ্বেতরাজত্ব কালপ্রেতদের হাতে দখল হল। সেই অধিকারের দুইশত বৎসরের মধ্যে শ্বেতরাজার মুলুকের অবস্থার পরিবর্তন হল। মারী এল, মার এল। মারী – অতিমারী হয়ে , মার – অতিমার হয়ে গ্রাম উজাড় করল। তারপর কি হল ? মারের সাগর কে পাড়ি দিল ? তারপর তারপর …….তারপর…
ক্রমশঃ
©দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ ১ . মঙ্গলকোট উৎখনন : একটি প্রতিবেদন
২. গৌড়বঙ্গ : সংস্কৃতি
৩. বাংলার মঙ্গলকাব্যের ইতিহাস
৪. মঙ্গলকোট – উজানির সঙ্গে