যদি শুধু বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করে বাঙ্গালি আইডেন্টিটি রক্ষা করার জন্য পূর্ব আর পশ্চিম পাকিস্তানের আদর্শগত লড়াই হতো তাহলে বাংলাদেশ আজ আর একটি আরবিস্থান হওয়ার দৌড়ে পাকিস্তানের সঙ্গে পাল্লা দিত না।
এই আশঙ্কা অনেক আগে করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বঙ্গভঙ্গের (১৯০৫) বিরোধিতা প্রসঙ্গে তার ‘ভাষার কথা’ প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন—“যখন বঙ্গবিভাগের বিভীষিকায়। আমাদের গায়ে কাটা দিয়েছিল তখন আমাদের ভয়ের একটি প্রধান কারণ ছিল এই যে, এটা রাজনৈতিক ভূগোলের ভাগ নয়, ভাষার ভাগকে আশ্রয় করিয়া বাঙ্গলার পূর্ব-পশ্চিম একটি চিত্তের ভাগ হইবে।
প্রথমদিকে না হলেও পরে কিন্তু রবীন্দ্রনাথের আশঙ্কাই সত্যে পরিণত হয়েছিল। যদিও রবীন্দ্রযুগে অনেক মুসলমান কবি সাহিত্যিকরা রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্যে এসে সমৃদ্ধ হয়েছেন। কিন্তু পাকিস্তান জন্মের পর থেকে তো বটেই এবং নবগঠিত বাংলাদেশেও তাদের অনেকেই রবীন্দ্রনাথকে বর্জনের বা আরও ভালো করে বললে হিন্দু বাঙ্গালি সাহিত্যিকদের লেখা বর্জনের পক্ষে ছিলেন। হবিবুল্লাহ বাহার, শ্যামসুন্নাহার মাহমুদ থেকে সংগীত শিল্পী ওস্তাদ আয়েত আলি খান, ফুলঝুরি খান রবীন্দ্ররচনা থেকে রবীন্দ্রসংগীত বর্জনের পক্ষে ছিলেন সবাই।
বাংলা ভাষার ইসলামিকরণের বিরুদ্ধে কলম ধরেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ১৯৩৪ সালের ২৭ মার্চ (১১ চৈত্র ১৩৪০) রবীন্দ্রনাথ, এম এ আজানকে এক পত্রে লেখেন— ‘বাংলা ভাষায় সহজেই হাজার হাজার পার্সি আরবি শব্দ চলে এসেছে। তার মধ্যে আড়াআড়ি বা কৃত্রিম জেদের কোনো লক্ষণ নেই। কিন্তু যেসব পার্সি, আরবি শব্দ সাধারণ্যে অপ্রচলিত অথবা হয়তো কোনো এক শ্রেণীর মধ্যেই বদ্ধ, তাকে বাঙ্গলা ভাষার মধ্যে পদক্ষেপ করাকে জবরদস্তি বলতেই হবে। হত্যা অর্থে খুন ব্যবহার করলে সেটি বেখাপ্পা হয় না, বাংলায় সর্বজনের ভাষায় সেটা বেমালুম চলে গেছে। কিন্তু রক্ত অর্থে খুন চলেনি, তা নিয়ে তর্ক করা নিষ্ফল।
১৯৩৬ সাল মুসলিম লিগের বয়স তখন তিরিশ পূর্ণ হয়েছে। মৌলানা আক্রাম খান তখন যৌবনের মধ্যগগনে। তিনি মুসলমান নবজাগরণের বার্তা প্রকাশ করছিলেন তাঁর সম্পাদিত মোহাম্মদী’ পত্রিকায়। এই পত্রিকা তখন শিক্ষিত মুসলমানদের ঘরে ঘরে। রবীন্দ্রনাথের ‘পূজারিণী’ ও ‘গান্ধারীর আবেদন’ কবিতা দুটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্য তালিকার অন্তর্ভুক্ত। এর প্রতিবাদ স্বরূপ মৌলানা আক্রাম খান ‘মোহাম্মদী’ পত্রিকায় জ্যৈষ্ঠ, ১৩৪৩ (মে-জুন, ১৯৩৬) সংখ্যাটি বিশেষ বিশ্ববিদ্যালয় সংখ্যারূপে প্রকাশ করে সেই কবিতা দুটির তীব্র সমালোচনা করে লেখেন — “স্কুল কলেজের পাঠ্য পুস্তকগুলির এক বিরাট অংশ পরিপূর্ণ করিয়া দেওয়া হইয়াছে, নরপূজার, জড়পূজার, প্রকৃতি-পূজার কুশিক্ষায় এবং আদিম যুগের অসভ্য মানুষের পৌরাণিক অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের মহিমা প্রচারে। অন্যদিকে মুসলমানকে নিতান্ত হেয়, নিতান্ত নগণ্য, এমনকী একটা নিতান্ত জঘন্য জাতিরূপে প্রতিপন্ন করিবার জন্যও ওই সমস্ত পাঠ্য ও ইতিহাস পুস্তকে নীচতা ও নিষ্ঠুরতার পরকাষ্ঠা প্রদর্শন করা হইয়া থাকে।”
এই মৌলানা আক্রাম খান দেশভাগ অবধি কলকাতায় ছিলেন, তারপর ঢাকায় গিয়ে দৈনিক আজাদ’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক হয়েছিলেন। দৈনিক আজাদ’ পত্রিকাও সবসময় সরব ছিল রবীন্দ্র নিন্দায়। পূর্ব পাকিস্তানে সরকারি পর্যায়ে রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ করার পিছনে ‘আজাদ’ পত্রিকা অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিল। পাকিস্তান আন্দোলনের প্রত্যক্ষ প্রভাব সাহিত্য সংস্কৃতির অঙ্গনও অধিকার করেছিল। ১৯৪২ সালে মুসলমান চিন্তাবিদদের জন্য যথাক্রমে কলকাতা ও ঢাকায় গড়ে উঠেছিল পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটি এবং পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ।
১৯৪৪ সালের জুলাই মাসে কলকাতায়। অনুষ্ঠিত রেনেসাঁ সোসাইটির প্রথম। অধিবেশনে আবুল মনসুর আহমেদ বলেন— (১) “রাজনীতির বিচারে পাকিস্তানের অর্থ যাই হোক না কেন, সাহিত্যিকের কাছে তার অর্থ তমুদ্দনী আজাদি, সাংস্কৃতিক স্বরাজ, কালচারাল অটোনমি।
(২) একথা মানি যে, হিন্দুর সংস্কৃতিতে ও মুসলমানের তমুদ্দনের মধ্যে ১০১টি মিল রয়েছে। কিন্তু এটাও মানতে হবে যে তাদের মধ্যে গরমিলও আছে প্রচুর।
(৩) ধর্ম ও সংস্কৃতি এক জিনিস নয়। ধর্ম ভূগোলের সীমা ছাপিয়ে উঠতে পারে। কিন্তু তমুদ্দন ভূগোলের সীমা এড়াতে পারে না। বরঞ্চ সেই সীমাকে আশ্রয় করেই সংস্কৃতির পয়দায়েশ ও সমৃদ্ধি।
(৪) পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ পূর্ববঙ্গ ও অসমের সাহিত্য বলতে আমরা যা বুঝি তা বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র থেকে রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র যুগের সাহিত্যিকদের সাহিত্য। এটা খুব উন্নত সাহিত্য। তবুও এ সাহিত্য পূর্ব পাকিস্তানের সাহিত্য নয়। কারণ এটা বাঙ্গলার মুসলমানের সাহিত্য নয়। এ সাহিত্য থেকে মুসলমান সমাজ কোনো প্রেরণা পায়নি এবং পাচ্ছে না, এর কারণ আছে। সে কারণ এই যে, এই সাহিত্যের স্রষ্টাও মুসলমান নয়। এর বিষয়বস্তু মুসলমানি নয়, এর স্পিরিটও মুসলমানি নয়, এর ভাষাও মুসলমানের ভাষা নয়।
(৫) বস্তুত, বাঙ্গলার মুসলমানের যেমন একটি নিজস্ব সংস্কৃতি আছে, তেমনি তাদের একটি নিজস্ব সাহিত্যও আছে। সে সাহিত্যের নাম মুসলমানি বাঙ্গলা সাহিত্য বা পুঁথি সাহিত্য। পূর্ব পাকিস্তানের সাহিত্য রচিত হবে পূর্ব পাকিস্তানবাসীর মুখের ভাষায়, হিন্দুর ভাষায় নয়। সে ভাষা সংস্কৃত বা তথাকথিত বাংলা ব্যাকরণের তোয়াক্কা করে না। বাংলা ভাষায় কথা বলতে গেলেই হরফের কথাও এসে পড়ে। আমি শুধু এইটুকু বলে রাখছি যে বাংলার বর্তমান বর্ণমালার আবর্জনা আমরা রাখবনা না।”
ওই একই সমাবেশে আবুল কালাম শামসুদ্দিন বলেন— “এতে অনাবশ্যক অক্ষর বাংলা বর্ণমালায় ভিড় করে আছে। সংস্কৃত ভাষার প্রতি অতিরিক্ত মোহবশত স্বভাবতই রক্ষণশীল হিন্দু সাহিত্যিকদের এ ব্যাপারে কুণ্ঠা হয়তো স্বাভাবিক। কিন্তু মুলমান সাহিত্যিক জানেন বাংলা ভাষা একটি মিশ্র ভাষা সংস্কৃতের সঙ্গে এর কোনো যোগ নেই। শুধু তাই নয়, পরোক্ষ যোগও অত্যন্ত ক্ষীণ। কাজেই অনাবশ্যক অক্ষরের মোহ তার থাকতে পারে না।”
মনসুর আহমেদ কিংবা শামসুদ্দিন সাহেবের বক্তব্য কিন্তু শুধু রেনেসাঁ সোসাইটির কথা ছিল না, তা ছিল আপামর পাকিস্তানপন্থী শিক্ষিত বাঙ্গালি মুসলমানদের মানস চেতনা। মনসুর আহমেদ শুধু খ্যাতনামা সাংবাদিক-সাহিত্যিক ছিলেন না, তিনি স্বাধীনোত্তর পাকিস্তানে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ভূমিকাও পালন করেছিলেন। পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদ ও রবীন্দ্রবর্জন আন্দোলনে অন্যতম প্রধান ভূমিকাও পালন করেছিলেন। পূর্ব পাকিস্তান অধুনা বাংলাদেশ থেকে ভারতে বিতাড়িত হয়ে আসা অধিকাংশ কমিউনিস্টদের একসময়কার নয়নের মণি ছিলেন কবি গোলাম মোস্তাফা। তা এহেন ভদ্রলোক ১৯৫০ সালে লিখেছেন- “Not only Bengali Literture even the Bengali alphabet is full of idolatry. Each Bengali letter is associated with this or that God or Goddess of Hindu Pantheon. The Arabic language and the script must be the best language and the best script in the world.
১৯৬০ সালে গোলাম মোস্তাফা আবার লিখলেন— “উর্দু ও বাংলা যে আজ এত প্রগতিশীল ও জীবন্ত তাহার কারণ যে উহারা আর্যভাষা নহে। অন্যকথায় সংস্কৃত হইতে উহাদের জন্ম হয় নাই। সংস্কৃত হইতে যে ভাষা যত দূর রহিয়াছে, সে ভাষা আজ তত জীবন্ত, তত প্রগতিশীল।
স্বাধীন বাংলাদেশ গঠিত হওয়ার পরেও এই প্রবণতা কমার বদলে উত্তরোত্তর বেড়েছে। আমার সোনার বাংলা’কে জাতীয় সংগীত হিসেবে বর্জনের প্রথম দাবি উঠেছিল ৭ মার্চ, ১৯৭৬ সালে সোহরাবর্দি উদ্যানের জনসমাগমে যার প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন জিয়াউর রহমানের ঘনিষ্ঠ সামরিক আইন প্রশাসক বিমান বাহিনী প্রধান এম. জি. তাওয়াব। আর এই ট্র্যাডিশন বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদের তাত্ত্বিক প্রবক্তা বলে পরিচিত খোন্দকার আব্দুল হামিদের বক্তব্য শুনলে ব্যাপারটি আরও পরিষ্কার হয়। তিনি বলেছেন— “রাজবাড়ি বহর’নামে একটি জায়গা আছে, যেখানে পদ্মা ও মেঘনা মিশেছে কিন্তু এক দেহে লীন হয় নাই। হাজারো বছর পাশাপাশি প্রবাহিত হওয়া সত্ত্বেও না। মেঘনার পানি কিচকিচা কালো। পদ্মার পানি সাদা ঘোলাটে। এপার বাঙ্গলা ওপার বাঙ্গলার মধ্যে তেমনি চিরন্তন তফাত। সে তফাত রঙের, খুনের, মানসের, আবেগের, অনুভূতির, ধর্মের, কর্মের, এবাদত-বন্দেগির, নামের, নিশানের, ঐতিহ্যের, উত্তরাধিকারের, খোরাকের, পোশাকের, আদাবর, লেহাজের, কায়দা-কানুনের, জীবনবোধের, জীবনধারার, জীবন-দর্শনের এবং জীবন-সাধনার। হৃদয়ানুভূতির নিবিড় বন্ধন দুয়ের মধ্যে চিরকাল অবর্তমান। এমনকী উভয় বাঙ্গলার ভাষা মূলত একটা হলেও বড়োলোকের বৈঠকখানা, বিদগ্ধদের সাহিত্য অঙ্গনের বাইরে জনগণের যে ভাষা তা যবানে-লিসানে-মুখরেজে-তালাফফুজে পর্যন্ত আলাদা।
ওপরে আব্দুল হামিদ যে শব্দগুলো ব্যবহার করেছেন তা পাকিস্তান যুগে বাংলা ভাষার ইসলামিকরণের কথা মনে করিয়ে দেয়। আসলে খোন্দকার আব্দুল হামিদের ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী দর্শনের নমুনা ছড়িয়ে গিয়েছে বাংলাদেশের সর্বত্র যার নাম এককথায় আরবিকরণ।
ওপার বাঙ্গলায় বাংলাভাষার আরবিকরণ দীর্ঘকাল ধরে শুরু হলেও এপার বাঙ্গলায় তার ছাপ পড়েনি এতকাল— সুচারুভাবে এই প্রচেষ্টা শুরু হলো ২০১১ সালে তৃণমূল রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পর থেকে— রামধনুকে রংধনু বা আকাশিকে আশমানি শব্দ হিসেবে সরকারি পাঠ্যপুস্তকে ব্যবহার করা আসলে এক সুবিশাল চক্রান্তের অংশমাত্র বা হিমশৈলের চূড়ামাত্র।
আমাদের নিজেদেরই সুনিশ্চিত করতে হবে যাতে কোনো অবস্থাতেই আমাদের সাধের বাংলা ভাষা উর্দু, পার্সি বা আরবির গহ্বরে তলিয়ে না যায়, আমরা যেন আমাদের গৌরবময় অতীত এবং শক্তিসাধনার উত্তরাধিকার ভুলে ইসলামের পদতলে আত্মসম্মান খুইয়ে না বসে সত্যিকারের বাঙ্গালি হয়ে উঠতে পারি।
সৌভিক রাতুল বসু

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.