শ্রী শ্রী মা জ্জগদ্ধাত্রী দুর্গায়ৈ ও রাজরাজেন্দ্র: পর্ব ৩

দেবী জগদ্ধাত্রীর পূজা অনুষ্ঠিত হয় দুর্গাপূজার ঠিক একমাস পর কার্তিক মাসের শুক্লা নবমী তিথিতে। কাত্যায়নীতন্ত্র–এ কার্তিকী শুক্লা নবমীতে দেবী জগদ্ধাত্রীর আবির্ভূত হওয়ার কথা আছে। দুর্গাকল্প–এ আছে:

কার্তিকে শুক্লপক্ষেঽহনি ভৌমবারে জগৎপ্রসূঃ।
সর্বদেবহিতার্থায় দুর্বৃত্তশমনায় চ।।
আবিরাসীৎ জগচ্ছান্ত্যৈ যুগাদৌ পরমেশ্বরী।।

-দেবগণের হিত, দুর্বত্তের প্রশমন এবং জগতের শান্তিবিধানের জন্য যুগের প্রারম্ভে কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের মঙ্গলবারে পরমেশ্বরী (জগদ্ধাত্রী) আবির্ভূতা হলেন।

সুতরাং এত সোজা না বোঝার চেয়ে সহজ সিদ্ধান্ত হলো বঙ্গে জগদ্ধাত্রীর মূর্তি কল্পনা বহুকালের , পূজাপদ্ধতিও শাস্ত্র লিখিত। কিন্তু সম্ভবত গৃহস্থবাড়িতে সে পূজা হতো না। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র প্রথম তাঁর গৃহে পূজার ব্যবস্থা চালু করেছিলেন। এ ব্যাপারে তাঁর রাজপুরোহিত এবং পরামর্শদাতা পন্ডিতগন নিশ্চয়ই সহায়তা করেছিলেন। কৃষ্ণচন্দ্রের হিসেবে পশ্চিমবঙ্গে জগদ্ধাত্রী পূজার বয়স দুই শত বছর পেরিয়েছে।

জগদ্ধাত্রী পূজার কাল নির্নয় কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির দেবী প্রতিমা আমাদের কিছুটা সাহায্য করতে পারে। প্রথমেই উল্লেখ করতে হয় যে , ভাস্কর্য এবং মন্দিরগাত্রে যে সকল জগদ্ধাত্রীর মূর্তি পাওয়া গিয়েছে তাঁর সঙ্গে এই বিগ্রহের কোন মিল নেই । এখানে দেবী যেন অশ্বপৃষ্ঠে আসীন। দেবী জগদ্ধাত্রী যোদ্ধা রূপ ধারণ করেছেন ।আরও দেখা যাবে যে এই সিংহ আমাদের পরিচিত কেশর যুক্ত সিংহ নন। এ একরকম সাদা ঘোড়া।

আবার অবিকল সাদা ঘোড়ার মতো দেখতে অথচ ঘোড়া ও নয়। এই রূপ সিংহ মূর্তির অর্থ হল বা এর নাম হলো নরসিংহ মূর্তি । এ মূর্তি কোথা হতে এল ? হিরণ্যকশিপু কে বধ করেছিলেন ভগবান বিষ্ণু, তিনি নরসিংহ অবতার ধারণ করেছিলেন । এদেশের পুরনো মন্দির গাত্রে আর প্রত্নতত্ত্ব মূর্তিতে যেখানেই সিংহ দেখা যায় সেখানে অনেকটা নরসিংহ আকৃতির সিংহ দেখতে পাওয়া যায় । সেটা না বুঝে অনেকে ভাবেন সেটা সাদা ঘোড়া।

পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত প্রতিমার কথা গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে-

সে সিংহবাহিনী সিংহ আর একরকম ছিল, এখনকার আফ্রিকান লায়ন ছিল না। সে অলৌকিক সিংহ, ঘাড় খুব লম্বা, মুখখানা কতটা ঘোড়ার মত, কতকটা মকরের ন্যায়, সাদা, রোগা, টানা ও লম্বা। সে এক অপূর্ব জীব।

এইসব ব্যাখ্যান পড়ে সন্দেহ থাকে না যে কৃষ্ণনগরের রাজবাড়ির জগদ্ধাত্রী মূর্তির কল্পনা বহু প্রাচীন। কিন্তু কৃষ্ণনগর ও চন্দন নগরের কোনো বারোয়ারি জগদ্ধাত্রীর বা পশ্চিনবঙ্গের কোনো জগদ্ধাত্রী মূর্তির মিল নেই। কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির জগদ্ধাত্রী প্রতিমা ভঙ্গি অভিনব।এ মূর্তি মহারাজ স্বপ্নে দেখে ছিলেন । স্বপ্ন দর্শনের পশ্চাৎপটে একখানা কিংবদন্তি রয়েছে। সেটি কি?….

এসব বলতে গেলে একটু জগৎ শেঠের কথা বলতে হয়।

জগৎ শেঠ পরিবার আঠারো শতকে প্রতিষ্ঠিত একটি ব্যাংকার-পরিবার। ‘জগৎ’ শব্দের অর্থ বিশ্ব এবং ‘শেঠ’ অর্থ ব্যাংকার। ‘জগৎ শেঠ’-এর অর্থ ‘বিশ্ব ব্যাংকার’। এটি একটি বংশগত রাজকীয় উপাধি। জগৎ শেঠ পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা মানিক চাঁদ। আঠারো শতকের শেষভাগে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাংকিং পদ্ধতি চালু হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত জগৎ শেঠ পরিবারই ঢাকা ও মুর্শিদাবাদের অর্থ জগৎ নিয়ন্ত্রণ করতো। পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা মানিক চাঁদ ১৭ শতকের শেষ দশকে পাটনা থেকে ঢাকায় এসে ব্যবসা শুরু করেন এবং সরকারের পক্ষে ব্যাংকার বা অর্থ যোগানকদার হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। বাংলার দীউয়ান মুর্শিদ কুলী খান ১৭০৪ খ্রিস্টাব্দে তাঁর খালসা বা রাজস্ব দপ্তর স্থানান্তর করে মুর্শিদাবাদ এ স্থাপন করলে মানিক চাঁদও তাঁর দপ্তর ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদে স্থানান্তর করেন। সেখানে তিনি নবাবের প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ও ব্যাংকারে পরিণত হন। শিঘ্রই মানিক চাঁদ সরকারের একচ্ছত্র ব্যাংকার হিসেবে নিজের স্থান করে নেন।

১৭১২ খ্রিস্টাব্দে মুর্শিদকুলী খান মানিক চাঁদকে ‘নগর শেঠ’ উপাধি দেওয়ার জন্য সম্রাট ফররুখ সিয়ার এর নিকট সুপারিশ করেন। ১৭১৪ খ্রিস্টাব্দে মানিক চাঁদ-এর মৃত্যু হয়। মানিক চাঁদ তাঁর ভাতিজা (ভাইপুত্র) ফতেহ চাঁদকে দত্তক পুত্র হিসেবে গ্রহণ করেন। পরবর্তীকালে ফতেহ চাঁদ এ পরিবারিক প্রতিষ্ঠানের প্রধানে পরিণত হন। ফতেহ চাঁদই ভারতের সর্বত্র তার ব্যাংক-ব্যবসার প্রসার ঘটান। তাঁর ব্যাংকের বিশ্বাসযোগ্যতা এমন বেড়ে যায় যে, তাঁর ইস্যুকৃত হুন্ডি ভারতের সর্বত্র দেখামাত্র পরিশোধ করার মর্যাদা লাভ করে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ফতেহ চাঁদ-এর চমৎকারিত্ব ও একজন ব্যাংকার হিসেবে তাঁর আন্তঃআঞ্চলিক প্রভাবের কারণে ১৭২৩ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট মাহমুদ শাহ তাঁকে ‘জগৎ শেঠ’ উপাধিতে ভূষিত করেন। ‘জগৎ শেঠ’ উপাধিটি ছিলো বাংলায় ও বাংলার বাইরে ফতেহ চাঁদ-এর প্রতিষ্ঠিত ব্যাংকিং হাউজ এর ব্যাপক কর্মকান্ডের স্বীকৃতির সরকারী প্রত্যয়নপত্র। মুর্শিদাবাদে প্রধান দপ্তর ছাড়াও জগৎ শেঠের ব্যাংক-এর শাখা ঢাকা, পাটনা, দিল্লি ও সুরাটসহ বাংলার ও উত্তর ভারতের প্রায় সব কয়টি গুরুত্বপূর্ণ শহরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো।

মুর্শিদ কুলী খানের অধীনে মুর্শিদাবাদ টাকশালের দারোগা রঘুনন্দন-এর ১৭১৮ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যু হলে মুর্শিদাবাদের টাকশালের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা জগৎ শেঠের হস্তগত হয়। ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলার মুদ্রানীতি প্রথামাফিক জগৎ শেঠই নিয়ন্ত্রণ করেছেন। ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে জগৎ শেঠের ব্যাংকের অর্থ লেনদেন, ঋণ গ্রহণ ও পরিশোধ, বুলিওন বা সোনারূপা ক্রয় ও বিক্রয়ের তথ্য সমসাময়িক দলিলপত্রে পাওয়া যায়। সমসাময়িক ইউরোপীয় লেখক রবার্ট ওর্ম লিখেছেন যে, এই হিন্দু ব্যবসায়ী পরিবারটি ছিলো মুগল সাম্রাজ্যের মধ্যে সবচেয়ে ধনী পরিবার। মুর্শিদাবাদের সরকারের ওপর এই পরিবারের অসাধারন প্রভাব ছিলো। ওর্ম এর মতে, জগৎ শেঠের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান সর্বাধিক সংখ্যক জমিদার ও ব্যবসায়ীর আর্থিক নিরাপত্তা জোরদার করতে তাঁদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন।

সমকালীন সরকার ও আর্থ-সমাজ জগৎ শেঠ পরিবারের আর্থিক লেনদেন-এর কার্যক্রম সর্বদা ‘ব্যাংক অব ইংল্যান্ড’ এর সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। আঠারো শতকে ব্রিটেন সরকারের পক্ষে ব্যাংক অব ইংল্যান্ড যে ধরনের কাজ সম্পাদন করতো, জগৎ শেঠ-এর প্রতিষ্ঠানও বাংলার সরকারের পক্ষে অনুরূপ কাজ সম্পাদন করতো। তাঁর আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আয়ের উৎস ছিলো বহুবিধ। এ প্রতিষ্ঠান সরকারের পক্ষে রাজস্ব সংগ্রহকারী ও সরকারের ট্রেজারারের ভূমিকা পালন করতো। জমিদারগণ এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তাদের রাজস্ব সরকারকে জমা দিতেন এবং নবাব পুনরায় এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই দিল্লির সরকারকে বাৎসরিক খাজনা প্রদান করত। এই হাউজই মুর্শিদাবাদের টাকশাল নিয়ন্ত্রণ করতো এবং ইউরোপীয় ব্যবসায়ী কর্তৃক সোনারূপার পিন্ড বাংলায় আমদানি করা হলে তা ক্রয় করে মুর্শিদাবাদের টাকশালে মুদ্রায় পরিণত করা হত।

১৭৪৪ খ্রিস্টাব্দে ফতেহ চাঁদ-এর দৌহিত্র মাহতাপ চাঁদ পারিবারিক পদবিটি (জগৎ শেঠ) উত্তরাধিকার সূত্রে ধারন করেন। তাঁর ভাই মহারাজা স্বরূপ চাঁদ নবাব আলীবর্দী খানের দরবারের অভিজাতদের মধ্যে অন্যতম একজনে পরিণত হন। পলাশীর যুদ্ধ এবং তার পরবর্তী সময়ে মীরজাফর অবধি এহেন জগৎ শেঠ ওরফে বঙ্গ রাজনীতি ও অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেন। কিন্তু মীরকাশীমের সময় থেকে তিনি পুনরায় মীরকাশীমের বিরাগভাজন হন। মীরকাশীম বক্সার যুদ্ধে পরাজিত হলে দুই শেঠ ভাইকে গ্রেপ্তার করেন ও তাঁদের মৃত্যু দন্ড দেন।

যাই হোক। এ হেন মহতাপ চাঁদ জগৎ শেঠ মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের এক প্রিয় বন্ধু ছিলেন। শোনা যায় গ্রেপ্তার হবেন এমন খবর পেয়ে তিনি মহারাজকে তার অধিকাংশ সম্পত্তি দিয়ে গেছিলেন। উভয়ের বন্ধুত্বের খবর মীরকাশীমের অজানা ছিল না।ফলত,১৭৬৪ সালে মীরকাশিম মুঙ্গেরের কারাগারে বন্দি করেছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র ও তাঁর পুত্র শিবচন্দ্রকে। শোনা যায়, মীরকাশিম নাকি কৃষ্ণচন্দ্রের প্রাণদণ্ডের আদেশ দিয়েছিলেন। কৃষ্ণচন্দ্র তাঁর দূত মারফত এই সংবাদ মেরতলার প্রসিদ্ধ তান্ত্রিক কালীশঙ্কর মৈত্রের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন। এবং তাঁর প্রাণ রক্ষার প্রার্থনা জানিয়েছিলেন। কারাগারেই কৃষ্ণচন্দ্র এক কুমারী দেবীর স্বপ্নাদেশ লাভ করেন এবং কারাগার থেকে মুক্তিলাভের প্রতিশ্রুতি লাভ করেছিলেন। জনশ্রুতি, কিছু দিনের মধ্যেই তিনি সত্যি কারামুক্ত হয়েছিলেন।

এর পরেই কৃষ্ণচন্দ্র তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র শিবচন্দ্র ও গোপালভাঁড়কে নিয়ে উপস্থিত হন মেরতলার প্রসিদ্ধ তান্ত্রিক কালীশঙ্কর মৈত্রের কাছে। কৃষ্ণচন্দ্র এই স্বপ্নের কথা জানান এবং জানতে চান কে এই দেবী? কালীশঙ্কর তাঁকে জানান, এই দেবী স্বয়ং চণ্ডী। প্রাচীন কালে এই দেবীর পুজোর প্রচলন ছিল। রাজা তখন জানালেন, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তিনি এই দেবীর পুজোর আয়োজন করতে চান। এর উত্তরে কালীশঙ্কর জানান, কার্তিক মাসের শুক্লা নবমী তিথিতে দেবীর পুজোর বিধান আছে। হাতে সময় কম থাকলেও কৃষ্ণচন্দ্র পুজোর সমস্ত আয়োজন করবেন বলে জানিয়েছিলেন। কৃষ্ণচন্দ্র তাঁকে অনুরোধ করেছিলেন পুজোয় পৌরোহিত্যের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য। শোনা যায় কালীশঙ্কর রাজাকে যথাযথ সাহায্য করার আশ্বাস দিয়েছিলেন।

তবে, একটা সমস্যার কথা অনুমান করে কৃষ্ণনগরে না ফিরে সেখান থেকেই কৃষ্ণচন্দ্র সরাসরি গিয়েছিলেন চন্দননগরে তাঁর বন্ধু ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর কাছে। যাওয়ার আগে পুজোর সব দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছিলেন পুত্র শিবচন্দ্র ও গোপালভাঁড়কে। তাঁরাই জগদ্ধাত্রী পুজোর সব আয়োজন করেছিলেন। আর বলেছিলেন, পুজোর আগের দিন রাত্রে তিনি কৃষ্ণনগরে ফিরে আসবেন।

রাজপরিবারের কূলগুরু ছিলেন বৈষ্ণবাচার্য। তিনি নতুন এই শাক্ত দেবীর পুজোয় অনুমতি না দিলে পুজো করা সম্ভব হত না। তাই রাজা ঠিক করেছিলেন, পুজোর আগের দিন মধ্যরাত্রে কৃষ্ণনগরে ফিরবেন। আর পরের দিন সকালে অঞ্জলি দেবেন। তখন কূলগুরুর কোনও বাধাই কার্য্যকর হবে না।

ইতিমধ্যেই শিবচন্দ্র ও গোপালভাঁড় পুজোর সব আয়োজন করে রেখেছিলেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী পুজোর আগের দিন গভীর রাতে গোপনে কৃষ্ণনগরের প্রাসাদে ফিরে এসেছিলেন। এবং পর দিন সারা দিন উপবাসী থেকে পুজোয় অঞ্জলিও দিয়েছিলেন। সেই থেকেই শুরু হল রাজবাড়ির জগদ্ধাত্রী পুজো। গবেষকদের মতে, মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রই জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রবর্তক। অনেকেই মনে করেন, পরের বছর থেকে চন্দননগরে পুজোর প্রচলন হয়েছিল ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর উদ্যোগে।

ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায় বাংলার পাল-সেন যুগের বিভিন্ন তন্ত্র গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে সিংহবাহিনী জগদ্ধাত্রীর পুজোর। যেমন ‘মায়াতন্ত্র’-এ দেখা যায় ,‘প্রপূজয়েজগদ্ধাত্রীং কার্তিকে শুক্লপক্ষকে দিনোদয়ে চ মধ্যাহ্নে সায়াহ্নে নবমেহহন।’ এর অর্থ কার্তিক মাসের শুক্লা নবমী তিথিতে দিনের শুরুতে মধ্যাহ্নে এবং সায়াহ্নে জগদ্ধাত্রী পুজো করা যায়।

প্রসঙ্গত রাজপরিবারের শ্রুতি থেকে জানতে পারা যায় যে কৃষ্ণচন্দ্র যে দেবীমূর্তি দেখেছিলেন তিনি চতুর্ভূজা, রক্তাম্বর-ধারিণী, নরসিংহ আসীন, হাতে ধনুর্বাণ । পূর্বেই বলেছি একদিনের জগদ্ধাত্রী পূজায় চতুর্বর্গ ফল লাভ হয়। কৃষ্ণনগরের কার্তিক নবমীতে একই দিনে জগদ্ধাত্রী পূজা সাত্ত্বিকী, রাজসিকী ও তামসী পূজা হয় প্রাতে, মধ্যাহ্নে ও সন্ধ্যায়। চন্দননগরে চার দিন ব্যাপী পূজা হয়। এই পূজা দেবী দুর্গার পূজার অনুকল্প।রাজা তাই করলেন।সেই থেকেই কৃষ্ণনগরের চালু হল জগদ্ধাত্রী পূজা।

কৃষ্ণচন্দ্রের আগে নদীয়ার রাজা ছিলেন রুদ্র রায় (১৬৬৯ – ১৭০০)। তাঁর আদেশে শান্তিপুরের কাছে বাগআঁচড়া গ্রামে একল্পত জমিতে ১০৮ ঘর ব্রাহ্মণ পণ্ডিতকে বাস্তু দান করা হয়েছিল । গ্রামের নাম তাই হয়েছিল ব্রহ্মশাসন। পরে এই গ্রামের অনেকটা অংশ গঙ্গাগর্ভে চলে গেলে ব্রাহ্মণরা চলে আসেন সংলগ্ণ হরিপুর গ্রামে । এই গ্রামের রাজা গিরিশচন্দ্র(১৮০২ – ১৮৪১) সমসময় তন্ত্র সাধক পন্ডিত চন্দ্রচুড় তর্কচূড়ামণি জগদ্ধাত্রীর সাকার মূর্তি প্রচার করেন এবং তন্ত্র থেকে দেবীর পূজা পদ্ধতি বিধিবদ্ধ করেন। আজও সেখানে জগদ্ধাত্রী পূজা চলছে।

জগদ্ধাত্রী পূজা নিয়ে এমনি এক প্রাচীন নদিয়া নাকাশীপাড়া থানার এলাকায় বহিরগাছি গ্রামে। এই গ্রামে বসবাস করতেন নদিয়ার রাজ পরিবারের গুরুবংশ। কিন্তু চন্দননগরের জগদ্ধাত্রী পূজার প্রচলন কৃষ্ণনগরের পরে । ফরাসি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দেওয়ান ইন্দ্র নারায়ন চৌধুরীর দেওয়ানীর কার্যকাল ১৭৩০ থেকে ১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। এই সময় তাঁর সঙ্গে লেনদেন চলত মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের। এই ইন্দ্রনারায়ণই তাঁর বান্ধব মহারাজ কৃষ্ণ চন্দ্রের হাতে কবি ভারত চন্দ্রকে তুলে দেন। সুতরাং , মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র দেবীর পূজার সূচনা করলে স্বাভাবিক ভাবেই ইন্দ্রনারায়নও পূজা করবেন নিজের মত করে ,সেটাই স্বভাবিক।

কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির পূজা দেখে মুগ্ধ হয়ে ইন্দ্রনারায়ণ চন্দননগরের লক্ষ্মীগঞ্জ চাউলপট্টির নিচুপাটিতে জগদ্ধাত্রী পূজার প্রচলন করেন। লক্ষ্মীগঞ্জ প্রতিষ্ঠার কিছুকাল পরেই এই পূজার সূচনা। এই পূজা চন্দননগরে আদি পূজা নামে পরিচিত। এখনও পর্যন্ত পুরুষানুক্রমে দেওয়ান চৌধুরীদের উত্তরপুরুষের নামে পূজার সংকল্প হয়। এখানকার প্রতিমার বৈশিষ্ট্য হল সনাতনরীতির প্রতিমায় সাদা সিংহ এবং বিপরীতমুখী অবস্থানে হাতি। শোনা যায়, বিসর্জনের সময় আদি প্রতিমা জলে পড়লেই শুশুক বা সাপের দেখা পাওয়া যায়। স্থানীয় বিশ্বাসে এই দেবী অত্যন্ত জাগ্রতা।

একবার নাকি কৃষ্ণনগরের চালব্যবসায়ীগন চন্দননগরে চাল কিনতে আসেন । কিন্তু সেবার আর জগদ্ধাত্রী পূজার সময় তাঁরা কৃষ্ণনগরে ফিরতে পারেন নি। সেটি তখন ফ্রেঞ্চ চন্দন নগর । তাই সরকারের বিশেষ অনুমতিতে নিয়ে তাঁরা চুঁচড়োয় কুমোর দিয়ে মূর্তি গড়িয়ে চালপট্টি বা নিচের পটিতে বেদী বানিয়ে দেবীর পূজা হল।

পরে চাউলপট্টির চাল ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মতান্তর হওয়ায় কাপড় ব্যবসায়ী শ্রীধর বন্দ্যোপাধ্যায় (মতান্তরে শশধর) রীতিমতো চাঁদা তুলে এই পূজা প্রবর্তন করেন। এই অঞ্চলের অপর দুটি পূজা হল লক্ষ্মীগঞ্জ চৌমাথা (স্থাপিত ১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দ) ও লক্ষ্মীগঞ্জ বাজারের (স্থাপিত ১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দ) পূজা। উত্তর চন্দননগরের লক্ষ্মীগঞ্জ চাউলপট্টি, কাপড়েপট্টি, চৌমাথা ও বাজার – এই চার পূজাতেই সিংহের রং সাদা। উত্তর চন্দননগরের অন্যান্য বড়ো জগদ্ধাত্রী পূজাগুলি হল চন্দননগর বাগবাজার (স্থাপিত ১৮৩৫ খ্রিষ্টাব্দ), খলিসানী কলপুকুরধার, বউবাজার শীতলাতলা, খলিসানী বউবাজার, বাগবাজার চৌমাথা, বিদ্যালঙ্কার, পালপাড়া, বিবিরহাট উত্তরাঞ্চল, বিবিরহাট চড়কতলা তেমাথা, হরিদ্রাডাঙা, হেলাপুকুরধার, নাড়ুয়া, কাঁটাপুকুর, কাঁটাপুকুর চৌমাথা, বোড়ো কালীতলা, বোড়ো পঞ্চাননতলা, বোড়ো চাঁপাতলা, বোড়ো দিঘির ধার, বোড়ো তালডাঙা ইত্যাদি।

বাঁকুড়া জেলার জয়রামবাটী গ্রামে রামকৃষ্ণ পরমহংসের সহধর্মিণী সারদা দেবীর জন্মভিটা র জগদ্ধাত্রী পূজা বিশেষ প্রসিদ্ধ। পূজা উপলক্ষে জয়রামবাটীতে প্রচুর ভক্তসমাগম হয়। সারদা দেবীর পৈতৃক বাড়িতে এই পূজার আয়োজন করে রামকৃষ্ণ মিশন। ১৮৭৭ খ্রিষ্টাব্দে (১২৮৪ বঙ্গাব্দ)সারদা দেবীর পিতৃগৃহে প্রথম জগদ্ধাত্রী পূজার আয়োজন করেছিলেন তার জননী শ্যামাসুন্দরী দেবী।

কিংবদন্তি অনুসারে, প্রতি বছর শ্যামাসুন্দরী দেবী প্রতিবেশী নব মুখুয্যের বাড়ির কালীপূজা উপলক্ষে নৈবেদ্যের চাল পাঠাতেন। ওইবছর কোনো বিবাদের কারণে নব মুখুজ্যে চাল নিতে অস্বীকার করেন। নৈবেদ্যদানে অসমর্থ হয়ে শ্যামাসুন্দরী দেবী অত্যন্ত মর্মাহত হন। সেই রাতেই তিনি দেবী জগদ্ধাত্রীকে স্বপ্নে দেখেন এবং তার স্বপ্নাদেশে ওই চালে জগদ্ধাত্রী পূজার আয়োজন করেন। প্রথম বছর বিসর্জনের দিন বৃহস্পতিবার ছিল। তাই সারদা দেবী লক্ষ্মীবারে বিসর্জনে আপত্তি করেছিলেন। পরদিন সংক্রান্তি ও তার পরদিন মাস পয়লা থাকায় ওই দুই দিনও বিসর্জন দেওয়া যায়নি। বিসর্জন হয় চতুর্থ দিনে। আরও কথিত আছে যে, পরের বছর সারদা দেবী জগদ্ধাত্রী পূজা বন্ধ করে দিতে চাইলে দেবী জগদ্ধাত্রী তাকে স্বপ্নাদেশে পূজা বন্ধ করা থেকে নিরস্ত করেন। এরপর প্রথম চার বছর পূজা হয়েছিল শ্যামাসুন্দরী দেবীর নামে; দ্বিতীয় চার বছর সারদা দেবীর নামে এবং তৃতীয় চার বছর তার কাকা নীলমাধব মুখোপাধ্যায়ের নামে। বারো বছর পর সারদা দেবী পুনরায় পূজা বন্ধ করবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। শোনা যায়, এই বারও জগদ্ধাত্রীর স্বপ্নাদেশ পেয়ে তিনি নিরস্ত হন।

জীবদ্দশায় প্রতি বছরই জগদ্ধাত্রী পূজায় উপস্থিত থাকতেন সারদা দেবী। পূজা পরিচালনার জন্য তিনি সাড়ে দশ বিঘার কিছু বেশি জমি দেবোত্তর সম্পত্তিরূপে দিয়ে যান। ১৯১৯ সালে সারদা দেবী এই পূজায় শেষবার উপস্থিত ছিলেন। পরের বছর তিনি প্রয়াত হন।

প্রথম পূজার ঐতিহ্য অনুযায়ী আজও শুক্লা নবমীতে মূল পূজার পরও দুই দিন প্রতিমা রেখে দিয়ে বিশেষ পূজার আয়োজন করা হয়। দুর্গাপূজার মতোই পূজার সঙ্কল্প হয় সারদা দেবীর নামে। জগদ্ধাত্রীর প্রতিমার পাশে জয়া-বিজয়া ও নারদ মুনির প্রতিমা থাকে। নবমীতে ষোড়শোপচারে পূজা, তিন বার চণ্ডীপাঠ ও মাতৃমন্দিরে দরিদ্রনারায়ণ সেবা হয়। দশমীর দিন দশোপচারে পূজা হয়। এই দিন সন্ধ্যারতির পর যাত্রাগানের আসর বসে। একাদশীর দিনও দশোপচারে পূজা ও বিসর্জনকৃত্য সম্পন্ন হয়। এই দিন ধুনুচি নৃত্য, কর্পূরারতি, কনকাঞ্জলি প্রদান প্রভৃতিও অনুষ্ঠিত হয়। ধুনুচি নাচের পর বাদ্যঘণ্টা ও শোভাযাত্রা সহকারে মায়ের দিঘিতে প্রতিমা নিরঞ্জন হয়। প্রতিমা নিরঞ্জনে আশ্রমবাসী, অতিথি এবং গ্রামবাসী সকলে অংশ নেন। পূজা উপলক্ষে আশ্রমপ্রাঙ্গনে মেলাও বসে।

কৃষ্ণচন্দ্রের নিজস্ব উপসনার জন্য একটি জগদ্ধাত্রী মূর্তি ছিল। সেটি রাখা হত গোবিন্দবাড়িতে। দেশভাগের সময় যখন হঠাৎ কৃষ্ণনগর পূর্ব পাকিস্তানে চলে যায় তখন এই বিগ্রহও চলে যায় সেখানে। মূর্তিটি ভেঙে প্রায় নষ্ট দেয় দুষ্কৃতীরা।রানি জ্যোতির্ময়ী দেবী এবং রাজা সৌরীশচন্দ্রের উদ্যোগে ফের যখন কৃষ্ণনগরের সংযুক্তি ঘটে এ দেশের সঙ্গে তখন ভাঙা মূর্তিটি ফেরত পায় রাজপরিবার। এবার পুজোয় সেইমূর্তিটিও ঠাকুরদালানে সর্বসমক্ষে নিয়ে আসবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন রাজপরিবারের সদস্যরা।

সপ্তমী পুজোর সময় দেবীকে পায়েস, মিষ্টি, দুধ, ছানা, ফল, বাদাম, কিসমিস, কাজু, মেওয়া দেওয়া হয়। অষ্টমী পুজোর সময় দেওয়া হয় খিচুড়ি, তরকারি, মিষ্টি, চাটনি। নবমীর পুজোতে দেওয়া হয় পোলাও ও নানা রকম তরকারি। এ ছাড়াও ভোগে দেবীকে তিন থেকে পাঁচ রকমের মাছ দেওয়া হয়।

বহুকাল আগে কৃষ্ণনগরের মালোপাড়ার পুজোতে অনুদান দেওয়ার প্রথা শুরু করেছিলেন মহারাজ শ্রীশচন্দ্রের স্ত্রী বামাকালী দেবী। পনেরো টাকা অনুদান দেওয়া হত সেই সময়। সেই প্রথা এখনও চলছে। রাজবধূ অমৃতা রায় প্রতিবছর মালোপাড়ায় অনুদান দেন। বিসর্জনের সময় রাজবাড়ির চকের সামনে থেকে ঠাকুর ঘুরিয়ে রানিদের দেখিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রথাও বহুদিনের। এখনও সব ঠাকুর এখান থেকে ঘুরিয়ে নিয়ে তবেই বিসর্জন হয়। রাজপরিবারের সদস্যরা চক থেকে ওপর থেকে ঠাকুর দেখেন।

ওঁ আধারভূতে চাধেয়ে ধৃতিরূপে ধুরন্ধরে।

ধ্রূবে ধ্রূবপদে ধীরে জগদ্ধাত্রি নমোঽস্তু তে॥

শবাকারে শক্তিরূপে শক্তিস্থে শক্তিবিগ্রহে।

শাক্তাচার প্রিয়ে দেবি জগদ্ধাত্রি নমোঽস্তু তে॥

জয়দে জগদানন্দে জগদেক প্রপূজিতে।

জয় সর্ব্বগতে দুর্গে জগদ্ধাত্রি নমোঽস্তু তে॥

পরমাণু স্বরূপে চ দ্ব্যণুকাদি স্বরূপিণি।

স্থূলাতি সূক্ষ্ম রূপেণ জগদ্ধাত্রি নমোঽস্তু তে॥

সূক্ষ্মাতি সূক্ষ্ম রূপে চ প্রাণাপানাদিরূপিণি।

ভাবাভাব স্বরূপে চ জগদ্ধাত্রি নমোঽস্তু তে॥

সমাপ্ত

দুর্গেশনন্দিনী

তথ্যঃ

১. জগদ্ধাত্রী-তত্ত্ব : পূজা-বিজ্ঞান, স্বামী প্রমেয়ানন্দ

২. দেবদেবী ও তাঁদের বাহন, স্বামী নির্মলানন্দ

৩. হুতোমপ্যাঁচার নক্সা

৪. বিভূতিসুন্দর ভট্টাচার্য “কৃষ্ণচন্দ্র ও জগদ্ধাত্রী পুজো”

৫. মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র ও সমকাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.