সরকারের সঙ্গে রাজ্যপালের সংঘাত নতুন নয়। সেই বাম আমল থেকে চলছে। কিন্তু এমন রাজ্যপাল কি আগে দেখেছে বাংলা?
কবে কোন রাজ্যপাল প্রশাসনিক বৈঠক ডেকেছেন? কবে কোন রাজ্যপাল বলেছেন, তিনি বাংলার জেলায় জেলায় ঘুরবেন? বাংলার রাজনীতি ঠোঁটস্থ থাকা অনেকেই এমন উদাহরণ খুঁজে পাচ্ছেন না। উত্তরবঙ্গ সফরে গিয়ে সাংবাদিক বৈঠকে বাংলার নতুন রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড় যা বললেন, তা শুধু নতুনই নয়, বৈচিত্র্যপূর্ণও বটে।
সাংবাদিক সম্মেলনের শুরুতেই ঘরোয়া আড্ডার মেজাজ তৈরি করে দিলেন রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধান। শিলিগুড়িতে বসে বললেন, “আমি প্রোটোকল মানার লোক নই!” হতে পারে সাংবাদিকরা যাতে আড়ষ্ঠ না হন সে কারণেই এ কথা বলেছেন রাজ্যপাল। তারপর কথার পিঠে কথা বলতে বলতে বলেই চললেন, বলেই চললেন। একেবারে আড্ডার মেজাজে। নিরাপত্তারক্ষীকে এসে শেষমেশ বলতে হল, “স্যার ফ্লাইটের সময় হয়ে যাচ্ছে!”
কী বললেন রাজ্যপাল?
উত্তরবঙ্গে গিয়ে তিনি প্রশাসনিক বৈঠক ডেকেছিলেন। ডেকেছিলেন, রাজ্যের স্বরাষ্ট্রসচিব, মন্ত্রী, জনপ্রতিনিধি, পুলিশ কর্তা, বিরোধী দলের নেতাদেরও। কিন্তু সরকারি দলের জনপ্রতিনিধি আর আমলা-পুলিশ ছাড়া বাকি সবাই ছিলেন বৈঠকে। প্রশাসনের মাথাদের বৈঠকে গড় হাজিরা নিয়ে রাজ্যপালের সরস মন্তব্য, “হয়তো স্বরাষ্ট্র সচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়, মন্ত্রী গৌতম দেব, পুলিশ কর্তা—সবার একসঙ্গে কাজ পড়ে গিয়েছে। তাই আসতে পারেননি। পরের বার নিশ্চয়ই তাঁরা আসবেন!”
ব্যারাকপুরের বিজেপি সাংসদ অর্জুন সিং-কে হাসপাতালে দেখতে যাওয়া থেকে বাবুল সুপ্রিয়কে ছাত্র বিক্ষোভ থেকে উদ্ধার করতে যাদবপুর ক্যাম্পাসে পৌঁছে যাওয়া—সব দেখে শাসক দলের অনেকেই বলতে শুরু করেছিলেন, নতুন এসে অতিসক্রিয়তা দেখাচ্ছেন রাজ্যপাল। কিন্তু ধনকড় স্পষ্ট বলে দিলেন, “আমি অতিসক্রিয় নই। সক্রিয়। আমি মনে করি এটাই যথেষ্ট! আমি রুদ্ধদ্বার বৈঠকে বিশ্বাস করি না।”
ধনকড় আরও বলেন, “আমি কপিবুক রাজ্যপাল। সংবিধানের নামে শপথ নিয়েছি। মানুষের জন্য কাজ করব বলে শপথ নিয়েছি। আমি রাজনৈতিক সার্কাসের লোক নই। সংবিধানের লোক। আমি জাত, ধর্ম, রং, দল দেখিনা। কারণ সংবিধানই আমার কাছে সব। আমি সেটাই দেখি। সেটাই দেখব।”
যাদবপুর কাণ্ড নিয়ে এ দিন তাঁকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “আমি যাদবপুরের আচার্য। তাই আমি সে দিন ওখানে গিয়েছিলাম। রাজভবনের বর্ধিত অংশ হিসেবে সরকারের যা করার ছিল সেটা করা হয়নি বলেই আচার্য হিসেবে আমাকে যেতে হয়েছিল।” একই সঙ্গে রাজ্যপাল বলেন, “আমার গাড়ি আটকানো হয়েছিল ঠিকই। কিন্তু ক্যাম্পাসে যখনই আমি ঢুকেছি, তখন থেকে ছাত্ররা তাঁদের আচার্যকে শ্রেষ্ঠ সম্মান দিয়েছে।” তাঁর কথায়, “শিক্ষায় ধ্বংস আমাদের আটকাতেই হবে। আমি আশাবাদী এটা সম্ভব।”
এই সব প্রশ্ন পর্ব চলতে চলতেই তাঁর নিরাপত্তারক্ষী এসে রাজ্যপালকে ঘড়ির দিকে দেখতে বলেন। কিন্তু রাজ্যপাল যেন অন্য মুডে। স্পষ্ট বলে দিলেন, “আপনি দেখুন এখান থেকে বিমানবন্দর যাওয়ার ব্যবস্থা করা যায় কিনা!” তারপর সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেন, “আমি আমার স্ত্রীকে গাড়িতে চলে আসতে বলেছি। আর রুমে যাব না। আপনাদের সঙ্গে তাহলে আরও মিনিট পনেরো কথা বলা যাবে।” বুঝিয়ে দিলেন সত্যিই তিনিই প্রোটোকল মানার লোক নন।
সাংবাদিকরাও লোভ সামলাতে পারেননি। চা বাগান, জিটিএ, পাহাড় সমস্যা, রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা—একের পর এক প্রশ্ন আসতে থাকে রাজ্যপালের দিকে। এর মধ্যেই প্রশ্ন আসে রাজীব কুমার এবং সিবিআই দ্বৈরথ নিয়ে। জিজ্ঞেস করা হয়, আপনি রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধান। আর রাজ্যের একজন শীর্ষ পুলিশ কর্তা সিবিআইয়ের চোখ এড়িয়ে পালিয়ে বেরাচ্ছেন। কী বলবেন? ‘কপিবুক’ রাজ্যপালের ইঙ্গিতপূর্ণ জবাব, “আইনের উপরে কেউ নন। এই আইনের শক্তি অনেক। কর্ণাটকের জন্য সুপ্রিম কোর্টে মাঝরাতে শুনানি হয়েছিল এই আইনের জোরেই। যে যতই আইন জানুক, আইনের সামনে তাঁকে মাথা ঝোঁকাতেই হবে।”
সাংবাদিক সম্মেলন থেকে ওঠার আগে বলে এলেন, আবার আসবেন শিলিগুড়িতে। কলকাতায় ফিরে শুরু করবেন জেলায় জেলায় ঘোরা।
যা দেখে অনেকেই বলছেন, নাহ! এমন রাজ্যপাল আগে দেখেইনি বাংলা।