ব্রিটিশরা ভারতবর্ষে মেরুদণ্ডহীন কেরানি তৈরির শিক্ষা পদ্ধতি চালু করা এবং তাকে সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করার বহুবিধ কুফলের মধ্যে সবচেয়ে বিপজ্জনক কুফলটি হল হিন্দু সমাজে হিন্দু শাস্ত্র, সংস্কৃতি, ভাবনা, ধারণাগুলির বিনাশ। এর একটি নির্দিষ্ট ক্রম রয়েছে। তথাকথিত ইংরেজি শিক্ষা (ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষা নয়, ইংরেজ প্রবর্তিত শিক্ষার ধারা) হিন্দু ধারণাগুলির বিকৃত পরিবেশন করেছে। তার ফলে হিন্দু সমাজের মধ্যে হীনম্মন্যতা তৈরি হয়েছে। সেই হীনম্মন্যতা থেকে সমাজের মধ্য নিজ সংস্কৃতি ও ধর্মের প্রতি অনাস্থা ও অশ্রদ্ধা তৈরি হয়েছে। সেই অশ্রদ্ধার অবশ্যম্ভাবী ফল রূপে উপস্থিত হয়েছে বিস্মৃতি। অর্থাৎ হিন্দু সমাজ নিজ সংস্কৃতি ও ধর্মকে বিস্মৃত হয়েছে। নিজ সংস্কৃতি সম্পর্কে জ্ঞান বলতে রয়েছে বিভিন্ন বিষয় সম্বন্ধে কিছু খাপছাড়া ধারণা ও কিছু অর্ধপক্ব তথ্য। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সংস্কৃতির আকর গ্রন্থগুলিকে (বেদ, উপনিষদ্, ইতিহাস বা রামায়ণ ও মহাভারত, পুরাণ, স্মৃতি ইত্যাদি) বুঝতে আমরা অক্ষম। কারণ, সেখানকার শব্দগুলিকে আমরা আমাদের ইংরেজি শিক্ষার ছাঁচে গড়া ভাবনা দিয়ে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করি। এর সঙ্গে রয়েছে ‘আধুনিক বিজ্ঞান’-এর মোহ। আধ্যাত্মিক, আধিদৈবিক, আধিভৌতিক বিষয়সমূহকে ‘প্রাকৃতিক জড়বিজ্ঞান’ দিয়ে বিশ্লেষণের অপচেষ্টা। এই অপচেষ্টা হিন্দুত্ববিরোধীরা তো বটেই, হিন্দুত্বের প্রতি আস্থাশীল ব্যক্তিরাও করে থাকেন। তাতে অনর্থই হয়। লাভ কিছু হয় বলে মনে হয় না। এর সঙ্গে আরও একটি সমস্যা হল, হিন্দু আধ্যাত্মিক তত্ত্বগুলিকে সেমেটিক ধারণার সঙ্গে তুলনা এবং সিন্থেসিজম্ দিয়ে এই ধারণাগুলির বিশ্লেষণের প্রচেষ্টা।
হিন্দু সমাজে দুটি শব্দ বহুল ব্যবহৃত– ‘দেবতা’ ও ‘ভগবান্’। দুটি শব্দ প্রায় সমার্থক বলেই ধরে নেওয়া হয় এবং তেমন ব্যবহারও হয়ে থাকে। কিন্তু যে কেউ একটু ভাবলেই বুঝতে পারেন যে দুইটি শব্দ সমার্থক নয়। দুটির মধ্যে প্রচুর পার্থক্য রয়েছে। কিন্তু সেই পার্থক্যগুলি আপাতভাবে ধরা পড়ে না। বরং, সেমেটিক ধারণার প্রভাবে এই দুইটি বিষয়ে নানা ধরণে ভ্রান্তি তৈরি হয়। এই প্রবন্ধে আমরা ভগবান্ ও দেবতা নিয়ে আলোচনার প্রচেষ্টা করব। বলে রাখা ভাল, এই আলোচনাতে আমি কোন ‘সাধনালব্ধ উপলব্ধি’ বা ‘দিব্য অনুভূতি’-র কথা শোনাব না। যেগুলি বলব সেগুলি মূলতঃ আকর গ্রন্থগুলির আধারেই বলব।
‘ভগবান্’ শব্দটি গুণবাচক বিশেষণ। ‘ভগ’ যার আছে সে ভগবান্। যেমন গুণবান্, ধনবান্, বিদ্যাবান্ ইত্যাদি শব্দের নিষ্পত্তি, তেমনই ভগবান্ শব্দের নিষ্পত্তি। ‘ভগ’ শব্দের অর্থ ছয়টি গুণের সমাহার। এই ছয়টি গুণ হল– ঐশ্বর্য, ধর্ম, যশ, শোভা, জ্ঞান এবং বৈরাগ্য। এই ছয়টি গুণ সম্পূর্ণ ভাবে যে ব্যক্তির মধ্যে বিরাজমান তিনি ভগবান্।
দেবতা শব্দটি যোনিবাচক। সাধারণ ভাষায় আমরা যাকে বলি জাতি, সেটিই হল যোনি। যেমন মনুষ্য যোনি বা মনু্ষ্য জাতি। দেবতা হচ্ছে মানুষের মতই একটি যোনি বা জাতি বিশেষ। দেবতা যোনি ভোগযোনি। অর্থাৎ মনুষ্য প্রচুর পুণ্য কর্ম করলে সে মনুষ্য শরীর ত্যাগের পরে দেবতা যোনিতে গমন করে। দেবতারা মানুষের তুলনায় জ্ঞান, বল, বীর্য প্রভৃতি সমস্ত দিক দিয়েই উৎকৃষ্ট। এঁদের মধ্যে কেউ কেউ আবার পরমেশ্বরের উপাসনার মাধ্যমে পরম জ্ঞান লাভ করেন। সৃষ্টির কর্ণধার পরমেশ্বর সেই দেবতাদেরকে সৃষ্টিরক্ষার জন্য বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত করেন। যেমন– সূর্যদেবতা, বায়ুদেবতা, বরুণ বা জলদেবতা, যম দেবতা ইত্যাদি। তাঁরা প্রত্যকেই সৃষ্টিরক্ষার্থে নির্দিষ্ট কাজ করেন। যেহেতু তাঁদের পরম জ্ঞান লাভ হয়েছে সেজন্য এই কাজ তাঁরা করেন অনাসক্ত হয়ে। অর্থাৎ কেবল কর্তব্যবুদ্ধিতে তাঁরা কর্ম করেন। সেজন্য সেই কর্মের ফল তাদেরকে ভোগ করতে হয় না। প্রলয়কালে অর্থৎ সৃষ্টি যখন সৃষ্টির কারণ স্বরূপ পরমাত্মাতে বিলীন হয়ে যায় তখন এই দেবতারা তাদের শরীরগুলিকে ত্যাগ করে পরমেশ্বরে বিলীন হয়ে যান। পরের কল্পে অর্থাৎ পরবর্তী সৃষ্টিতে পুনরায় অন্য কোন পুণ্যবান্ ব্যক্তি এই পদে আসীন হন। এই বিষয়ে আরও বিশদে পড়াশুনা করতে চাইলে মহর্ষি বাদরায়ণ বিরচিত ব্রহ্মসূত্রের তৃতীয় অধ্যায়ের তৃতীয় পাদের ৩২ সূত্রের ভগবান্ শঙ্করাচার্য বিরচিত ভাষ্য এবং তার টীকা টিপ্পণী প্রভৃতি দেখতে পারেন। সূত্রটি হল– যাবদধিকারম্ অবস্থিতিরাধিকারিকাণাম্।
এই দেবতাদের শরীরগুলি কেমন? যে বিরাট অগ্নিগোলক প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা দৃশ্যমান সেটিই কি সূর্যদেবতা? যে জল কুলকুল করে বয়ে চলেছে বা নল থেকে ঝরে পড়ছে বা নর্দমায় আটকে রয়েছে সেটিই কি বরুণ দেবতা? যে বিশাল জলধারা গোমুখ থেকে সাগর পর্যন্ত প্রবহমান সেটিই কি গঙ্গা দেবতা? উত্তর হল, হ্যাঁ আবার না। সূর্যদেবতা এই বিশাল অগ্নিগোলককে নিজের শরীর বলে মনে করেন। গঙ্গাদেবতা এই জলধারাকে নিজের শরীর বলে মনে করেন। কেমন? যেমন এই রক্ত-মাংস-মজ্জা-মেদ-অস্থি-শুক্র-নির্মিত শরীরটি, তাকে আশ্রয় করে থাকা ইন্দ্রিয়, মন, চিত্ত, বুদ্ধি প্রভৃতিকে ‘আমি’ বলে মনে করছি তেমন। অর্থাৎ এই বস্তুগুলির প্রতি আমার যেমন একটি ‘অভিমান’ বা ‘আমিত্ব’ রয়েছে, কিন্তু আসলে আমি এইগুলি নই। তেমনই সূর্যদেবতার এই অগ্নিগোলকের প্রতি, গঙ্গাদেবতার এই জলধারার প্রতি, বরুণ দেবতার সমস্ত জলের প্রতি একটি শরীরাভিমান বর্তমান। এগুলিকে তাঁদের লৌকিক শরীর বলা যায়। এর পরে আছে তাদের অতিলৌকিক শরীর। যে শরীর আমাদের দৃষ্টির অগোচর। যে শরীর তাঁর নিজের লোক বা নিজের রাজ্যে বর্তমান। এই শরীরটির বর্ণনা আমরা পাই সেই দেবতার ধ্যানমন্ত্রে। যেমন সূর্যদেবের ধ্যানের বর্ণনা অনুযায়ী সূর্যদেব রক্ত পদ্মে আসীন। তিনি সমস্ত গুণের সমুদ্র, সমস্ত জগতের অধিপতি। তিনি চার হাতের দুইটিতে পদ্ম, অপর দুইটিতে বর এবং অভয় ধারণ করে আছেন। মুকুটে মাণিক্য ধারণকারী। তাঁর অঙ্গের বর্ণ অরুণ। তিনি ত্রিনেত্র।
তেমনই গঙ্গাদেবীর ধ্যানে বলা হয়েছে যে, গঙ্গাদেবী কুমীরের পীঠে বসে আছেন। তিনি চতুর্হস্তবিশিষ্টা ইত্যাদি।
এই অতিলৌকিক শরীরকে সেই দেবতার পূজার সময়ে পূজক ধ্যান করেন। সেই দেবতার উপাসকগণ দেবতার উপাসনার প্রভাবে সেই দেবতার নিজস্ব লোকে স্থান পান। পরে সেই সমস্ত পুণ্যবান্ ব্যক্তিরা যদি পরমেশ্বরের উপাসনার মাধ্যমে পরম জ্ঞান লাভ করেন তবে সেখান থেকে তাঁদের উৎক্রান্তি হয় অর্থাৎ, ঊর্ধ্বতর লোকে গমন হয়ে এবং ক্রমে সংসার চক্র থেকে মুক্তি হয়।
এই দেবতাদের (অর্থাৎ সূর্য, চন্দ্র প্রভৃতি আধিকারিক জ্ঞানী পুরুষ এবং তাঁদের লোকে বসবাসকারী তাদের উপাসক) মধ্যেও ঐশ্বর্য, ধর্ম, যশ, শ্রী, জ্ঞান, বৈরাগ্য বর্তমান বলে সেই দেবতাদের আমরা ভগবান্ বলতে পারি। আবার কোন মানুষের মধ্যেও যদি তেমন ভাবেই ধর্ম, জ্ঞান, বৈরাগ্য প্রভৃতি থাকে তবে তাকেও ভগবান্ বলা হয়। যেমন পুরাণ প্রভৃতিতে বিভিন্ন ঋষি এবং মুনিদেরকে ভগবান্ বলে সম্বোধন করা হয়। বহু রাজার উদ্দেশ্যেও ভগবান্ শব্দের প্রয়োগ পাওয়া যায়। বহু সাধকের উদ্দেশ্যেও ভগবান্ শব্দের প্রয়োগ দেখা যায়। এক কথায়, শব্দটি যেহেতু গুণবাচক বিশেষণ সেজন্য যে কেউ সেই গুণের অধিকারী হবেন তার উদ্দেশ্যেই এই শব্দটির প্রয়োগ করা যেতে পারে এবং তেমনটা করা হয়েও থাকে।
কিন্তু, এর পরেও খানিকটা বাকি থেকে যায়। ব্যবহারের আতিশয্যে ভগবান্ শব্দটি ‘ঈশ্বর’ বা ‘পরমেশ্বর’ অর্থে রূঢ় হয়ে গিয়েছে। কদাচিৎ ‘God’ বা ‘আল্লাহ্’ বা অন্য কোন অহিন্দু এক-উপাস্য-বাদী সম্প্রদায়ের (Monothesitc Religion– একেশ্বরবাদ শব্দটি একেবারেই ভ্রান্ত তর্জমা) উপাস্যকে বোঝানোর জন্যও এই শব্দটিকে আমরা ব্যবহার করে থাকি। সেক্ষেত্রে ভগবান্ শব্দের দ্বারা আমরা যে ঈশ্বরকে বোঝাতে চাই তিনি কে বা কেমন? এই বিষয়ে আমরা অন্যত্র আলোচনা করব।