অন্য দেশ হলে পেতেন অস্কার, টলিউড দেয়নি প্রাপ্য সম্মান, আজও বঞ্চিত অভিনেত্রী গীতা দে।

৮০-৯০ এর দশকে পর্দার কুচুটে শাশুড়ি বা পিসিমার ভূমিকায় একেবারে যথাযথ মনে হতো তাকে। যদি অভিনয় জীবনে তার প্রবেশ বহু দশক আগে। মাত্র ৬ বছর বয়সেই অভিনয়ে হাতেখড়ি। সেই থেকে পরবর্তী ৬-৭ দশক ধরে অভিনয় জগতকে সমৃদ্ধ করেছেন তিনি। অথচ তিনি পাননি কোনও পুরস্কার। কথা হচ্ছে বলিউডের অন্যতম প্রতিভাবান শিল্পী গীতা দে’কে নিয়ে।

১৯৩১ সালের ৫ ই আগস্ট ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষের কলকাতার দর্জি পাড়ায় জন্ম হয়েছিল তার। তার পিতা অনাদি বন্ধু মিত্র ছিলেন পেশায় একজন ডাক্তার। তার মা রেনু বালা। মাত্র ৫ বছর বয়সেই বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ তার জীবনকে সংগ্রামের দিকে ঠেলে যায়। সেসময় আদালতের তরফ থেকে শিশু গীতাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল তিনি কার সঙ্গে থাকতে চান। গীতা বাবার বদলে মাকেই বেছে নিয়েছিলেন।

মেয়েকে বুকে টেনে নিয়ে মা বলেছিলেন, “কি বোকা রে তুই! ডাক্তার বাবার কাছে থাকলে কত ধনীর দুলালী হতিস। আমি কিবা তোকে দিতে পারব!” কিন্তু ধনীর দুলালী সেদিন মাকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কেঁদে বলেছিলেন, “মা আমি তোমার সঙ্গেই থাকব।” বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ তার পড়াশোনার ব্যাঘাত ঘটিয়েছিল। বড় স্কুলে ভর্তি হতে পারেননি তিনি। বেশিদূর পড়াশোনাও করতে পারেননি।

বিচ্ছেদের পর মা রেনু বালা দেবী আরেকবার বিবাহ করেন। তবে দ্বিতীয় বাবা অজিতকুমার ঘোষ তাদের দায়িত্ব নিতে চাননি। তখন নিজের দায়িত্ব নিজে নেওয়ার জন্য অভিনয় জগতে পা রাখেন গীতা। মাত্র ছয় বছর বয়সেই মায়ের সঙ্গে নাটকের দলে নাম লেখালেন গীতা। প্রবোধ গুহর মঞ্চে তখন বিখ্যাত কালিন্দী নাটক চলছে। সেই নাটকে গান গেয়ে মাসে তিনি উপার্জন করতেন ৫ টাকা।

এই মঞ্চ থেকে তার খুব নামডাক হয়েছিল। গান গাওয়ার পাশাপাশি অভিনয়ও করতেন তিনি। নাটকের সব নায়িকার রোল পেতেন তিনি। এরপর তিনি চলে আসেন নাট্য ভারতীতে। ‘দুই পুরুষ’ নাটকে ছোট মমতার চরিত্রে অভিনয় করে দর্শকের মন জিতেছিলেন। গীতার বয়স যখন ১৪-১৫, তখনই আচমকা তার মা মারা যান। পৃথিবীতে সম্পূর্ণ অভিভাবকহীন হয়ে পড়েন গীতা।

তবে এক মায়ের অভাবপূরণ করলেন আরেক মা। বন্দনা দেবী সেই সময় কিশোরী গীতার অভিভাবক হয়ে দাঁড়ালেন। তার সৌজন্যেই নাট্যকার শিশির ভাদুড়ীর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল গীতা দে’র। সেখানে প্রথম প্রথম বিনা পারিশ্রমিকে কাজ করতে হতো তাকে। এই নিয়ে তার মনে অসন্তোষ ছিল। কিন্তু শীঘ্রই তিনি বুঝতে পারেন এই নাট্যমঞ্চ তাকে তার জীবনের স্বর্গের দরজা খুলে দিয়েছে।

কৈশোর পেরিয়ে যৌবনের পা রাখতেই গীতা দে’র বিয়ে হয়। কিন্তু বৌমা নাটকে কাজ করে বলে শাশুরির তাকে মোটেই পছন্দ ছিল না। হাওয়াবদলের নাম করে গীতাকে অন্য জায়গায় পাঠিয়ে দিয়ে ছেলে অসীম দে’র আবার বিয়ে দেন তিনি। ফিরে এসে তিনি সবটা জানতে পারেন। এমনকি শ্বশুরবাড়িতেও তাকে থাকতে দেওয়া হয়নি। ছোট ছোট ভাই বোন এবং ছোট সন্তানদের নিয়ে সেদিন গীতার ঠাঁই হয়েছিল রাস্তায়।

স্বামীর থেকে প্রতারিত হয়েও তিনি আজীবন স্বামীর নামে সিঁথিতে সিঁদুর পড়েছেন। স্বামীর পদবী নিজের নামের পাশে বয়ে বেরিয়েছেন। আমৃত্যু সধবা হয়েই জীবন কাটিয়েছেন। প্রায় ছয় দশক ধরে তিনি বাংলা ছবি এবং থিয়েটারে একটানা কাজ করে গিয়েছেন। ‘ডাইনি’, ‘মৌচাক’, ‘সাথী হারা’, ‘পুত্রবধূ’, ‘পিতা পুত্র’, ‘হাটে বাজারে’, ‘মেঘে ঢাকা তারা’, ‘বসন্ত বিলাপ’, ‘তিন কন্যা’, ‘সুবর্ণরেখা’, ‘কোমল গান্ধার’, ‘মর্জিনা আব্দুল্লাহ’, ‘মেম সাহেব’, ‘আক্রোশ’, ‘ঝংকার’, ‘জতুগৃহ’, ‘দেবীপক্ষ’, ‘তিন ইয়ার কথা’য় তার অভিনয় মনে রেখেছেন দর্শক।

অভিনয়ে তাকে টেক্কা দেওয়ার মতো অভিনেত্রী সেই সময় অনেক কমই ছিলেন। শিশির ভাদুড়ী হাতে নিজেকে গড়েপিটে নিয়েছিলেন গীতা দে। শিশির ভাদুড়ীকে আজীবন নিজের নাট্যগুরু মেনেছেন। গীতার অভিনয় দেখে মুগ্ধ এক বিদেশি এক পরিচালক বলেছিলেন, “ইউরোপ বা আমেরিকায় জন্মালে অবশ্যই অস্কার পেতেন।” কিন্তু এই বাংলার তিনি না পেয়েছেন স্ত্রীর মর্যাদা, না পেয়েছেন নিজের অভিনয় দক্ষতার জন্য কোনও পুরস্কার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.