একবার স্থানীয় এক ব্যবসায়ী এসে না কি জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “সর্বাধিক কত বড় সাইজের চমচম বানাতে পারেন আপনারা? আমাকে তেমনই দু’খানা চমচম বানিয়ে দিতে পারেন?”
চ্যালেঞ্জটা নিয়েই ফেলেছিলেন লাটাগুড়ির মিষ্টি বিক্রেতা রাধেশ্যাম ঘোষের দুই ছেলে। দেখিয়ে দিয়েছিলেন ঠিক কতটা বড় চমচম বানাতে পারেন তাঁরা। সেই শুরু। এখন এই বিশালাকার চমচমই আলাদা করে চিনিয়ে দেয় গোটা লাটাগুড়িকে।
সবথেকে কম ওজনের চমচমের ওজন ৫০০ গ্রাম। এক একটির দাম দেড়শো চাকা। ৭০০ গ্রাম ওজনের যে চমচম তৈরি করেন তাঁরা, তার দাম ২০০ টাকা। আর এক কিলো ওজনের এক একটি চমচম কিনতে গেলে গুনে দিতে হবে কড়কড়ে তিনশো টাকা। ভাবছেন হয়তো, এমন ধারা চমচম ক’টা আর বিক্রি হয়?
লাটাগুড়ির মিষ্টি ব্যবসায়ী বিশ্বজিৎ ঘোষের কথায়,“লাটাগুড়িতে যাঁরা ঘুরতে আসেন এই চমচমের খোঁজে তাঁরা একবার আসবেনই। এই তো পয়লা জানুয়ারি একদল পর্যটক এসেছিলেন হুগলির আদি সপ্তগ্রাম থেকে। কেকের বদলে আমাদের জায়ান্ট চমচম কেটে নিউইয়ার সেলিব্রেট করলেন। এই আনন্দের মুহূর্ত গুলি ঘুরে ফিরেই আসে।”
গত ৬৫ বছর ধরে ডুয়ার্সের লাটাগুড়িতে মিষ্টি বিক্রি করছেন ঢাকার বিক্রমপুরের বাসিন্দা রাধেশ্যাম ঘোষের পরিবার। রাধেশ্যামবাবুর ছেলেরা জানালেন, এক সময় তাঁদের দোকান মুলত কমলাভোগ ও রসগোল্লার জন্য বিখ্যাত ছিল। ডুয়ার্সের চা বাগানের মালিক ও বাবুদের পরিবারের সামাজিক অনুষ্ঠানে টিন বোঝাই করে মিষ্টি যেত তাঁদেরই দোকান থেকে। জঙ্গল লাগোয়া লাটাগুড়িতে একসময় কাঠের ব্যবসাও ছিল রমরমা। কাঠ কিনতে আসতেন বাইরের বহু মানুষ। ফলে এই দোকানও চলতো রমরমিয়ে। ৮০ দশকের শেষের দিকে গরুমারাকে অভয়ারণ্য ঘোষণার পর থেকে গাছ কাটার উপর কড়া নিষেধাজ্ঞা জারি করে সরকার। এরফলে ধীরে ধীরে কমে আসে গাছ কাটা। ফলে একের পর এক কাঠের মিল বন্ধ হয়ে যায়। লোক সমাগম তলানিতে ঠেকায় তার প্রভাব পরে এলাকার ব্যবসার উপরেও। সমস্যায় পড়লেও টিকে যায় রাধেশ্যামবাবুর মিষ্টির দোকান।
এলাকার মানুষকে বিকল্প রুজিরুটির সন্ধান দিতে ২০০০ সালের গোড়ার দিকে সরকার উদ্যোগী হয় ইকো ট্যুরিজমে। রাজ্যের পর্যটন মানচিত্রে ধীরে ধীরে জায়গা করে নিতে থাকে ডুয়ার্স ও গরুমারা জাতীয় উদ্যান। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে জমে ওঠে রিসর্ট ব্যবসা। ঘুরে দাঁড়ায় গোটা এলাকা।
রাধেশ্যামবাবুর বড় ছেলে সমর ঘোষ জানান, ৯০ সালে তাঁদের বাবা মারা যান। এরপর থেকে তাঁরা দুই ভাই মিলে দোকান চালাতে শুরু করেন। অন্যান্য মিষ্টির সঙ্গে চমচমও বানাতেন। কিন্তু তা ছিলো ছোট সাইজের।
তাঁর কথায়, “২০০৩ সালে এই চমচম প্রথম তৈরি করেছিলাম আমরা। ময়নাগুড়ির এক ব্যবসায়ী আমাদের দোকানে এসে বলেছিলেন যতবড় সাইজের চমচম বানানো সম্ভব তাঁকে দু পিস বানিয়ে দিতে হবে। চ্যালেঞ্জ নিয়ে বানাতে গিয়ে দেখি সেই চমচম চিনির শিরায় জ্বাল দিতে গেলে ভেঙে যাচ্ছে। কিন্তু আমরা থেমে যাইনি। তিনদিন ধরে লাগাতার চেষ্টার পর বুঝি শিরা আরও ঘন করতে হবে। এরপরে বিশেষ ভাবে কড়া পাকের শিরা বানিয়ে তৈরি করে ফেলি এই ফ্যামিলি প্যাকেজ চমচম। পরে যার নাম দেওয়া হয়েছে জায়ান্ট চমচম।”
এ বার আসুন দেখি, কী এই জায়ান্ট চমচম?
ছানার সঙ্গে বিভিন্ন রকম ড্রাই ফ্রুট ও খোয়া ক্ষীর দিয়ে তৈরি হয় এই পেল্লাই মাপের চমচম। এরপর জ্বাল দেওয়া হয় কড়া পাকের চিনির শিরায়। সব থেকে ছোট চমচমের ওজন ৫০০ গ্রাম। আর বড় এক কিলো।
সমরবাবু জানান, রোজ নিয়ম করে এই পেল্লাই চমচম তৈরি করেন তাঁরা। বিক্রিও হয়ে যায়। পর্যটকমহলে দারুণ কদর যে।
পাকের জোরেই এই মিষ্টি গরমকালে অন্তত ৩ দিন আর শীতকালে ৭ দিন থেকে যায়। নষ্ট হয় না। এমন কী দরকার পড়ে না ফ্রিজে রাখারও।