প্রিয় কৃষক ও কৃষ্টিবিদ,
আপনারা জানেন, প্রায় এক দশক আগে বিটি-বেগুন চাষ নিয়ে ভারতবর্ষের নানান প্রান্ত থেকে প্রতিবাদ সংঘটিত হওয়ায়, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে ভারত সরকার তার চাষ, বীজ উৎপাদন, প্রচার ও প্রসার বন্ধ রাখে। ভারতবর্ষে বিটি- কটন বা তুলো চাষেই একমাত্র জিন প্রযুক্তির অনুমোদন ও ব্যবহার বলবৎ আছে। কোনো খাদ্য ফসলে এখনও পর্যন্ত এই অনুমোদন নেই। কিন্তু আমরা নতুন করে দেখলাম লকডাউনের মধ্যে আটটি রাজ্য বিটি-বেগুন চাষ বিষয়ে কিছু অনুমতি পেয়েছে, তারমধ্যে পশ্চিমবঙ্গ অন্যতম।
বাংলার আত্মনির্ভর কৃষি আর জেনেটিক্যালি মডিফাইড ক্রপ এবং বিটি–ব্রিঞ্জালের আগ্রহ-আগমন একেবারেই বিপরীত প্রান্তে দাঁড়িয়ে! জিএম ফসল মানেই মানুষের মনে হারাই, হারাই ভয়। বিটি বেগুন মানেই বৈচিত্র্য হারানোর হাতছানি। সমীক্ষা করতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে কয়েকজন গেয়েই দিলেন বাংলার জনপ্রিয় একটি গান। একটা হতাশা, হাহাকারের গান। কীসের হাহাকার? Loss of Biodiversity-র। জিএম ক্রপ এলে নিজের কৌলিক সম্পদ হারাতে পারি — এই হাহাকার। দেশীয় জাতপ্রজাতিগুলি হারিয়ে যেতে পারে — এই হতাশা! এই সম্পদ হারিয়ে গেলে কোন্ বহুজাতিক সংস্থা তা ফিরিয়ে দেবে? কে দায়িত্ব নেবে তার? ভারতের লক্ষ-কোটি জাত হাইব্রিডের ভীড়ে ইতোমধ্যে হারিয়ে গেছে, হাই-ইল্ডিং-ভ্যারাইটির ভীড়ে হারিয়ে গেছে। দেশমৃত্তিকায় তা কি আবার খুঁজে পাবো? যে জাতবৈচিত্র হারিয়েছি, তা তো খুঁজে পাই নি! আবার না জানি কী হারাতে হয়ে! জিএম ক্রপের দৌরাত্ম্যে। মাধুরী চট্টোপাধ্যায়ের গাওয়া, সলিল চৌধুরীর সুরে গান। “নিজেরে হারায়ে খুঁজি”।
আত্মনির্ভর কৃষি কাকে বলে?
সাবলম্বী ভারতের একটা বৃহৎ মানে হল, ভারতের গ্রামগুলিকে যথাসম্ভব উৎপাদনে, আয়োজনে, জীবনচর্যায় আগের মতোই সাবলম্বী করে তোলা, যেটা স্বাধীন ভারতবর্ষে হারিয়ে গিয়েছিল। কৃষি পণ্য তো বটেই, গ্রামীণ জীবনচর্যা ও মানসচর্চার পরতে পরতে স্বাবলম্বন দরকার। এরই নাম আত্মনির্ভর কৃষি।
ব্যবহারের নানান সামগ্রীতে স্বাবলম্বন আনতে হবে। কৃষির ক্ষেত্রে স্বাবলম্বিতা মানে হল — বীজ, সার, কীটঘ্ন ও কৃষি যন্ত্রপাতির ক্ষেত্রে স্বাবলম্বন। বীজ নীতি এমন হওয়া উচিত, যাতে কৃষক চাষের কাজে নিজের বীজ নিজেই তৈরি করে নিতে পারেন, কোনো বহুজাতিক বীজ কোম্পানিগুলোর উপর অন্যায়ভাবে নির্ভর করতে না হয়। এতে বীজের খরচ যেমন কমে, তেমন নির্দিষ্ট ফসল চাষ করিয়ে, বীজ ব্যবহার করিয়ে কৃষককে পরিচালিত করার বহুজাতিক স্বার্থ ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। কৃষক চাষ থেকে লাভবান হন।
প্রয়োজনে কৃষকের জমিতে পার্টিসিপেটরি সীড প্রোডাকশনের জন্য ফারমার, ব্রিডার, সীড সার্টিফিকেশন অফিসারদের জুড়তে হবে। আপনারা জানেন, রাসায়নিক সারের জন্য প্রচুর বিদেশি নির্ভরতা আছে। জৈবিক চাষাবাদের মাধ্যমে রাসায়নিক সারের ব্যবহার যথাসম্ভব কমিয়ে শূণ্যে আনাটা যেখানে সবচাইতে বড় স্বাবলম্বন, সেখানে GM Crops, BT Brinjal চরম আপদ বলে মনে হচ্ছে।
পুঞ্জীভূত ধার আমাদের। Recurrent Rent. এই ধার না মিটিয়ে Multinational Company-র ট্র্যাপে আবার কেন পড়বো? পুঞ্জীভূত ধার মেটানোর মানসচর্চা থেকেই স্বদেশী জাগরণ করা উচিত। গ্লোবালাইজেশনের মধ্যে কেবল প্রযোজনীয় সামগ্রীর ব্যবহারটুকু থাকা উচিত। বিজ্ঞানের তত্ত্বের ও প্রযুক্তির প্রয়োজনীয় ব্যবহারটুকু গৃহীত হওয়া উচিত, প্রয়োজনীয় জিনিসের বাইরে কোনো জিনিসই আমদানি করা উচিত নয়। ভারতবর্ষের এখনও এমন পরিস্থিতি তৈরি হয় নি, যে জি.এম. ক্রপকে এখনই নাছোড়-ছাড়পত্র দিতে হবে! আরে পকেট থেকে প্রকৃত সত্য বেরোক!
দেশের খাদ্যশস্যের একটা ছদ্ম অভাব থাকে, Pseudo-crisis বলে তাকে। সেই অভাব তাড়াতে GM Crop প্রচলন করিয়ে দেবার চেষ্টা বলে মনে হচ্ছে। “GM crops আপাতদৃষ্টিতে দরকার” আর “GM crops প্রকৃত পক্ষে দরকার” — এই দুই ‘দরকার’-এর মধ্যে যে ফারাক, তাকে বলে ব্যুরোক্র্যাটিক ডিফারেন্স, টেকনোক্র্যাটিক ডিফারেন্স। জাতীয় ভাণ্ডারের অডিট না করে জিএম ক্রপে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত নয়। ক্রাইসিস যেটা, সেটা হল জনবিস্ফোরণ। ওটায় লাগাম দিতে হবে। সবার জন্য একই নিয়ম হোক। সারা বিশ্বের হত্যা-কর্তা-বিধাতারা আগে জনসংখ্যার টগবগানো ঘোড়া থামান, দয়া করে। এই প্রযুক্তি জনবিস্ফোরণের দিকটিকে পাশে সরিয়ে রাখতে চায়, বলে মনে হচ্ছে।
তারমধ্যে World Health Organization -এর সাম্প্রতিক চীনের প্রতি বিশেষ পক্ষপাতিত্ব, বড় বড় কর্মকর্তাদের অপরাধীদের আড়াল করার অশুভ চেষ্টা, বিশ্বব্যাপী অভূতপূর্ব সংকট তৈরি হওয়া — আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে অপরাধের শিকড় কতটা! বিজ্ঞান-প্রশাসনিক-দুর্নীতির গাছে বিষাক্ত ফলের অবস্থান কত উঁচুতে!
বিশ্ব কৃষি গবেষণায় এরকম অবাঞ্ছিত ব্যক্তিদের মৌরুসি পাট্টা নেই — কে বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবে? যেখানে সারাবিশ্বেই নৈতিকতার অবক্ষয়, টেবিলের তলা দিয়ে দেওয়া নেওয়ার অপ্রকাশিত গল্প, সেখানে জিএম ক্রপ নিয়ে আরও গভীর ও প্রকৃত গবেষণা জরুরী। হোমড়াচোমরা ব্যক্তিত্বের প্রভাবহীন অনুসন্ধান অবশ্যিক, মানুষ এখন এটাই দেখতে চান। মানুষ যখন বিশ্বাস করবেন দুর্নীতিমুক্তির হাওয়া সহজ বহমান, গবেষণার অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ সকলের কাছে খোলা চিঠির মতো হাজির — তখনই গোলটেবিল বৈঠক হওয়া উচিত। জিএম ক্রপে কতটা প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিঘ্নিত হয়, কতটা বৈচিত্র্য ধ্বংস হয়, কতটা মানুষের শারীরবৃত্তীয় ক্ষতি সাধন করে — বাঁধাহীন গবেষণায় জানাক মুক্ত বিহঙ্গের বিজ্ঞানীর দল। যেখানে কোভিড-মৃত্যু নিয়ে সেন্সর হয়, জিএম নিয়েও সংবাদ সেন্সর হবে না, কে বলতে পারে!
প্রায়ই শুনি, মানুষ বলছেন, বহুজাতিক সংস্থাগুলির মহা মৌন অবস্থান এবং কিছু বিজ্ঞানী ও আধিকারিকের মাত্রাতিরিক্ত হাইজাম্প, সন্দেহের যথেষ্ট কারণ আছে। অনেকের বক্তব্য, জিএম ক্রপ যদি এতই উত্তম, তবে উন্নত দেশগুলি তার আদ্যন্ত ব্যবহার কেন করছে না? কেন বিদেশি ধনকুবেররা নিজেদের জন্য বিষমুক্ত, প্রাকৃতিক ফসলের কেনাকাটায় কাড়াকাড়ি করছেন?
কোথাও মনে হচ্ছে, কৃষকের স্বাবলম্বনের বেড়া নেই, কোথাও মনে হচ্ছে, কৃষিবিজ্ঞানীকে বলতেই হবে, “আগে দিয়ে বেড়া/তবে ধরো গাছের গোড়া।” দেশকে আত্মনির্ভরতা দিয়ে, অর্থনৈতিক সুরক্ষা দিয়েই সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট বা চিরায়ত উন্নয়ন করতে হবে। প্রতিটি জীবকূলকে বাঁচিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করতে হবে, এরই নাম Real Fencing. Multinational Company-র হাতছানি মানে কী? কিছু বিজ্ঞানীর শিখিয়ে পড়িয়ে দেওয়া বিজ্ঞান-আধারীয় ব্যবসা কী নয়? বুকে হাত দিয়ে বলার সাহস আছে, আপনার?
বিদেশী নির্ভরতা কমিয়ে ভারতীয় সামগ্রীর উৎপাদন ও উৎকর্ষতা বৃদ্ধির নতুন নামকরণ হোক স্বদেশী জাগরণ। জিএম ক্রপ, বিটি ফসল এর চূড়ান্ত অন্তরায়। আলবাত দু’টো বিষয় এক পংক্তিতে বসবার নয়।
সাধারণভাবে জেনেটিক্যালি মডিফাইড ক্রপস অর্থাৎ জিন ঘটিত ফসল বলতে বোঝায় পরীক্ষাগারে দুটি জীবন্ত বস্তুর মধ্যে জিনের আদান-প্রদানের মাধ্যমে গঠিত শস্য। কোনো কোনো বিশেষ পছন্দের জিনকে DNA তে প্রতিস্থাপিত করে কোষ গঠনের মাধ্যমে জিন ঘটিত ফসল তৈরি করা হয়। শুধু উদ্ভিদ বা ফসল নয়, জেনেটিক ইঞ্জিনীয়ারিং পদ্ধতি অবলম্বন করে জিন-ঘটিত পশু, ব্যাক্টেরিয়া অথবা ভাইরাস প্রভৃতি বিশেষ সুবিধা প্রাপ্ত জীবনও তৈরি হয়ে থাকে।
জিন ঘটিত বেগুন/ বিটি বেগুন কি? বিটি বেগুন হল জেনেটিক ইঞ্জিনীয়ারিং পদ্ধতির মাধ্যমে মাটিতে উপস্থিত ব্যাক্টেরিয়াম ব্যাসিলাস Bacillus thuringiensis থেকে নেওয়া ক্রিস্টাল প্রোটিন জিন (Cry 1AC) বিভিন্ন জাতের বেগুনের জিনোমে প্রতিস্থাপিত করে তৈরি করা হয়েছে। বিটি বেগুন হল লেপিডপটেরন বর্গের পোকা প্রতিরোধী জাত, বেগুনের ফল ও ডগা-ছিদ্রকারী পোকা প্রতিরোধী জাত। Leucinodes orbonalis — Brinjal Fruit abd Shoot Borer প্রতিরোধী। যখন বেগুনের ফল ও ডাঁটা ছিদ্রকারী পোকার লার্ভা বিটি বেগুন গাছের ওপর আক্রমণ করে তখন বেগুন গাছের উদ্ভিদ কোষের সাথে বিটি প্রোটিন Cry1AC লার্ভার দেহে প্রবেশ করে। লার্ভার দেহের পাকস্থলীর মধ্যে ক্ষারীয় পরিস্থিতিতে প্রোটিনের সংমিশ্রণ ঘটে এবং বিটি প্রোটিন পোকার পর্দায় অবস্থিত শ্বাস-প্রশ্বাসকারী ছিদ্রগুলোর সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়, পাকস্থলীর হজমের পদ্ধতিকে নষ্ট করে, আক্রান্ত পোকার পক্ষাঘাত হয়, পোকা মারা যায়। হলেও বিটি বেগুনে জীবাণুনাশক প্রতিরোধী নির্দেশক জিন থাকে। সাধারণ বেগুনের তুলনায় ১৫ শতাংশ ক্যালোরি কম থাকে। বিভিন্ন ধরনের অ্যালকালয়েড থাকে। এর বিরূপ প্রভাব পড়ে রক্ত তঞ্চনের সময়, বিশেষ করে ছাগল আর খরগোশে। বিটি বেগুন পরিবেশবান্ধব নয় বলে গবেষণায় জানা গেছে। নানান পতঙ্গ আর মথের উপর বিরূপ প্রভাব আছে। অনিয়মিত বৃষ্টিপাতের সমস্যা, জলবায়ু-আবহাওয়ার পরিবর্তন, চাষের জমি ক্ষুধার্ত হওয়ার মোকাবিলায় এটি কোনো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে না, বলে জানা গেছে।
জিন-ঘটিত ফসলের কিছু উপকারী দিক যেমন আছে, তেমনই অনুপযোগী দিকও রয়েছে। জিন-ঘটিত ফসল চাষের মাধ্যমে পরিবেশ, সর্বোপরি বাস্তুতন্ত্রে এর কু-প্রভাব ছড়িয়ে পড়বে। কৃষক বন্ধুদের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক কাঠামো দুর্বল হয়ে পড়বে। কিছু কিছু বহুজাতিক সংস্থা সুযোগ নিয়ে কৃষকবন্ধুদের মাধ্যমে তাদের অজান্তে ভারতবর্ষের কৃষিক্ষেত্রে বিভিন্ন জিন-ঘটিত ফসলের চাষ বৃদ্ধি করতে চাইছে। ঐ সমস্ত কোম্পানিগুলির অভিসন্ধি হল অতিরিক্ত মুনাফা লাভ। কারণ জিন-ঘটিত ফসল চাষ করার মাধ্যমে যে বীজ উৎপাদিত হয় — তা পরবর্তী বছরে চাষীভাইরা ফসল চাষের জন্য বীজ হিসাবে ব্যবহার করতে পারে না। কাজেই কৃষককে প্রতি বছর জিন-ঘটিত ফসলের বীজের জন্য ঐ সমস্ত বহুজাতিক সংস্থাগুলির ওপর নির্ভর করতে হবে। প্রচুর দাম দিয়ে ঐ বীজ ওদের কিনতে হবে। তাই আখেরে লাভ হবে কোম্পানিগুলোর। আর চাষের খরচ বাড়বে। পরিবেশ-বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য বিনষ্ট হবে।
ভারতীয় কিষান সঙ্ঘের দাবী “বীজ আমাদের অধিকার“। জিএম ক্রপ — এর একেবারে উল্টোদিকে হাঁটা। কোটি কোটি মানুষের নির্ভরতা যে কৃষি, তার উপর বেওসা করতে চায় জিএম ক্রপ, বিটি ফসল। বীজ আর বীজের সঙ্গে সংলগ্ন রাসায়নিক সার, কীটনাশক দ্রব্যের বিপুল বাজার। বীজের মূল্য আকাশ ছোঁওয়া। দেশে ফল সব্জি বীজের দাম চিন্তা করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। অথচ বীজের মালিক তো হওয়া উচিত কিষানের! রাসায়নিকের বীজের অনিয়ন্ত্রিত মূল্যবৃদ্ধি করে কিষানকে শোষণ করার যথেষ্ট সুযোগ সবুজ বিপ্লব পরবর্তী কৃষি দেখে আসছে। এবার শেষ দাওটা মারার অপেক্ষা।
কৃষকের দ্বিগুণ আয় বৃদ্ধির সুযোগ করে দেবার যখন সময়, সেই সময় কৃষকের চাষের খরচ বাড়িয়ে দেবার নতুন নাম এই নবতম বীজ। পলিসি মেকাররা কি জানেন না, কৃষিকাজ করে কৃষকের লোকসান হচ্ছে, আর্থিক দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে কৃষক কৃষিকাজ ছেড়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন! প্রতিকূল পরিস্থিতি সত্ত্বেও বিশাল জনগোষ্ঠীকে খাওয়ানোর দায়িত্ব নিয়েছে ভারতীয় কৃষক। ন্যূনতম মূল্য না পাওয়া সত্ত্বেও দেশের প্রয়োজনীয় ফসলের অতিরিক্ত ফসল ফলাচ্ছেন তারা। বরং আজকের এই সভায় প্রস্তাব নেওয়া হোক যদি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রকল্প কৃষকেট আয় দ্বিগুণ করতে হয় তাহলে “বীজ কৃষকের অধিকার” — এই মর্মে বিল আনা চাই। যদি দেশের কৃষি বিকাশের জন্য বিটি ফসল, জিএম ক্রপ অত্যাবশ্যকীয় হয়, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ আইন লাগু করা সম্ভব হচ্ছে না, খাবার গ্রহণের মুখের সংখ্যা বেড়েই যাচ্ছে — ট্রান্সজেনিক ক্রপ ছাড়া আর দ্বিতীয় কোনো পথ নেই তবে ‘বীজ কিষানের অধিকার’ এই আইন আগে প্রণয়ন করে; বীজের প্রস্তুতিকরণ, বীজের বিতরণ, বীজের মজুতিকরণ, বীজের ক্রয় বিক্রয়ের যাবতীয় অধিকার কেবলমাত্র কৃষকে দিয়ে তবে জিএম বাণিজ্য লাগু করতে হবে। বীজ বানানোর পদ্ধতির প্রশিক্ষণ কিষানদেরকে দিতে হবে। ঘোষিত বীজের সর্বোচ্চ খুচরো মূল্য নির্দিষ্ট করে দিতে হবে, বীজের যাবতীয় গুণবত্তা, দোষবার্তা কিষানের সামনে প্রকাশ করে দিতে হবে।
কোথায় বিদেশী দই-এর দম্বলটুকু নিয়ে ভারতে দই পাততে হবে, সে ধারণার খামতি আছে। জিএম বাণিজ্যে যেখানে ভারতীয় কোম্পানির হদিশ নেই, সেখানে এর পক্ষে কারা সওয়াল করছেন, চিনে নেওয়া উচিত। আত্মনির্ভর কৃষিতে ঘোষিত বীজ যাতে বাইরের কোনো কোম্পানী যাতে বিক্রি করতে না পারে, তার ব্যবস্থা করতে হবে।
এই প্রযুক্তির বড় ক্ষতিকারক দিকটি হল জৈব-বাস্তুতন্ত্রের ক্ষতির দিক। প্রযুক্তির বিরূপ প্রভাব পড়ে বাস্তুতন্ত্রের উপরে। ফসলের ক্ষতিকারক পোকাকে যখন এই প্রযুক্তির মাধ্যমে সরিয়ে ফেলি, তখন বাস্তুতন্ত্রে অন্য একটি জীবের খাদ্য-সম্ভার কমে যায়। জিনঘটিত ফসল কোনো কোনো জীবের কাছে বিষাক্ত। তাদের সংখ্যা কমে যেতে পারে, একেবারেই হারিয়ে যেতে পারে। মানব দেহের নিজস্ব Antibiotic Efficacy কমে যেতে পারে। জীবাণুনাশক ওষুধের কার্যকারিতা কমিয়ে দিতে পারে৷ কিছু গবেষণা প্রমাণ করেছে, জিনঘটিত ফসল বিভিন্ন জটিল রোগের সৃষ্টি করে, যাতে জীবের মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। উদ্ভিদের পরাগ মিলনের ওপরও জিন ঘটিত ফসলের বিরূপ প্রভাব আছে। জিনঘটিত ফসলের পরাগরেণুর সঙ্গে দেশীয় জাতগুলির পরাগ মিলনের সম্ভাবনা থাকে। তাতে দেশীয় জাতের ভাল গুণ নষ্ট হতে পারে৷ এমনকি দেশীজাতগুলির অবলুপ্তি ঘটতে পারে। জেনেটিক পলিউশন হবার সমূহ সম্ভাবনা। সয়াবীনের মতো আগাছানাশক প্রতিরোধী জিন ঘটিত ফসল চাষ করলে জমিতে আবির্ভূত হবে সুপার উইড বা অতি-আগাছা, যা আগাছানাশক প্রয়োগ করেও নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না।
জিন-ঘটিত ফসলে ক্ষতিকারক অ্যালার্জি সংঘটিত হওয়ার জন্য কিছু রাসায়নিক পদার্থ রয়েছে। GM Foods গ্রহণ করলে মানুষের শরীরে এ্যালার্জির মত বিষক্রিয়া, নানান চর্মরোগ দেখা দিতে পারে। কারণ জিন প্রতিস্থাপনের সময় বিভিন্ন প্রোটিনের সংমিশ্রণের জন্য মানুষে নতুন এ্যালার্জির বিষক্রিয়া হতে পারে। অনেকে বলেন এই খাদ্যশস্য পরিবেশ-বান্ধব। পরিবেশের কোনো ক্ষতির আশঙ্কা নেই। কিন্তু তারা কোনোভাবেই প্রমাণ করতে পারেন নি যে GM Crops পরিবেশবান্ধব। এ বিষয়ে কোনো কিছু জনসাধারণের কাছে প্রকাশ্যে আনা হয়নি। ঢাকঢাক গুড়গুড় করে এই রকম বিজ্ঞান-প্রযুক্তি আনা ঠিক হবে না। আর এত গোপনীয়তাই বা কেন? দেখেশুনে মনে হচ্ছে, একবার বহুজাতিক সংস্থা জিএম বীজের ভার কৃষিক্ষেত্রে ঝেড়ে ফেলতে পারলেই বাঁচে। R & D রিসার্চ আর ডেলেলপমেন্টের জন্য লক্ষ কোটি ডলার খরচ করে ফেলেছে কিনা৷ তুলতে হবে। যত দিন যায়, সুদে আসলে ভার বেড়ে যায়। ভার এবার ভারতীয় কৃষকদের উপর চাপাতে হবে। তারজন্য তারা অনেকানেক মানুষকে ধরবেন। কিছু মানুষও হয়তো আছেন, সুযোগসন্ধানী, উপঢৌকন-বিলাসী; যাদের অনায়াসে পাওয়া যায় যত্রতত্র। বিজ্ঞানের নামে, যুক্তির নামে অপকম্মে পারদর্শী, মোটিভেটর। সবাই লোভী নন, কেউ শুভাশুভ বিচার না করেই বিজ্ঞানের অন্ধ-ভক্ত। তবে ভয়ঙ্করী মেন্টরদের চিনে নেওয়ার সবচাইতে সহজ সুযোগ জিএম ক্রপ, বিটি বেগুন।
আজ করোনা পরিস্থিতিতে সুযোগ এসেছে বিদেশি বিদায় করে স্বদেশী আহ্বানের কাজকে বাস্তবায়ন করা। এই অবস্থায় কৃষিকেও যথাসম্ভব ভারতীয়করণ করে তোলা উচিত। অকাল দীপান্বিতা লক্ষ্মী-পূজার আয়োজন করাটাই উচিত কাজ।
ভারতে বসবাস করে যার হেড কোয়ার্টার বিদেশের সিগনাল ক্যাচ করে তিনি অবশ্যই বিদেশি। দেশী-বিদেশীকে চিনতে পারার অন্য নাম স্বাদেশিকতা। বিদেশী অলক্ষ্মীকে দূর করে স্বদেশী লক্ষ্মীকে গৃহে প্রতিষ্ঠা। জীবনের সবচাইতে বড় শিল্প হল প্রাকৃতিক পরিবেশে দেশীয় উপায়ে কৃষিকাজে সবচেয়ে বেশি ও উৎকর্ষ মানের ফসল পাওয়া।
বাংলায় একটি প্রচল কথা আছে “এক গাছের ছাল আর গাছে জোড়ে না”। ফলের বাগানে গিয়ে কলমের গাছ দেখলে এটা অনেকটা আন্দাজ করা যায়। কেবলমাত্র নিকট সম্পর্কিত গাছের ছালেই জোরকলম জোর পায়। অনেক সময় একই প্রজাতির জোরের বন্ধনেও ঠিকমতো কম্পাটিবিলিটি বা সুসামঞ্জস্য আসে না। জোরের উপরে-নীচে কম-বেশি বাড়বৃদ্ধি হয়। হয় এলাগাছের কান্ড সরু হয়, নয় পরশাখীর কান্ড সরু হয়; জোরের পর থেকে অসমান লাগে। জিএম ক্রপে যে জিনের জোর লাগানো হয়, তা প্রকৃতিতে কোনদিনই ঘটার সম্ভাবনা ছিল না; গবেষণাগারেই তার রূপায়ণ, হয়তো বা সুদূরপ্রসারীভাবে প্রকৃতি-বিরুদ্ধও বটে। কেবলমাত্র জীবন বাঁচানোর তাগিদে, রোগ সমস্যা মোকাবিলায়, উন্নত গবেষণায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এই ছাঁদ বেঁধে রাখা দরকার। নিত্যকালের ব্যবহারের জন্য প্রকৃতির সাহচর্য ও প্রাকৃতিক সম্পদ যথাসম্ভব ব্যবহার করা উচিত, প্রকৃতির নিয়ন্ত্রণ ও নিয়মের মধ্যেই বাঁচার যথাসম্ভব চেষ্টা করা উচিত।
বাংলার ‘কান্তকবি’ রজনীকান্ত সেনের দেশাত্মবোধক গানের কলিতে কলিতে স্বদেশী জাগরণের চৈতন্য হোক।
আয়রে আমরা মায়ের নামে
এই প্রতিজ্ঞা ক’রব ভাই ;
পরের জিনিষ কিনবো না, যদি
মায়ের ঘরের জিনিষ পাই।“
( ভারতীয় কিষান সঙ্ঘ, পশ্চিমবঙ্গ প্রান্তের পক্ষে প্রান্ত প্রচার প্রমুখ ড. কল্যাণ চক্রবর্তী কর্তৃক লিখিত, সাধারণ সম্পাদক শ্রী কল্যাণ মন্ডল কর্তৃক প্রকাশিত এবং কল্যাণী বিকাশখন্ডের পক্ষে সম্পাদক ড. কল্যাণ জানা কর্তৃক প্রচারিত )
ড. কল্যাণ চক্রবর্তী (Dr. Kalyan Chakraborty)