গড় দুর্গের কোচবিহার – পর্ব ৩

তৃতীয়াংশ: কামতাপুর দুর্গ

রাজপাট বা রাজপ্রাসাদটি দুর্গের প্রায় মাঝখানেই ছিল, কিন্তু এখন এক বিরাট ঢিবির উপরে কিয়দ্ পাথর ও মূর্তি ব্যতীত আর কিছু দেখা যায় না। ঢিবিটি চারকোণা ও প্রায় ৪০ ফুট (১২.৪ মিটার ) উঁচু। হ্যামিল্টনের সময় ঢিবির  উত্তর দক্ষিণে প্রায় ১৮৮০ ফুট ও পূর্ব পশ্চিম প্রায় ১৮৬০ ফুট বিস্তৃত ছিল এবং সেটিকে ঘিরে ৬০ ফুট গভীর একটি পরিখা ছিল। পরিখাটি এখন প্রায় বুঁজে গেছে। এখানে বর্তমানে আর দেখবার কিছু নেই।  তবে হ্যামিল্টনের সময় দুর্গপ্রাকার ছিল দুইটি, বাইরের টি মাটির ও ভিতরেরটি ইঁটের ।

হ্যামিল্টনের মতে দুর্গের আরো ভিতরে ছিল ইঁটের একটি বেষ্ঠনী  যার মধ্যে হয়ত ছিল রাজার অন্তঃপুর। অনুমান এর বাইরে মাটির পাঁচিলঘেরা এক অংশে রাজকর্মচারীরা বাস করতেন। 
হ্যামিল্টন এবং হরেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর মতে , মা কামতেশ্বরীর আদি মন্দিরটি এখানেই অবস্থিত ছিল। হ্যামিল্টন এসব স্থাপত্য নিদর্শনাদি ব্যতীতও আরও কিছু ইঁটের প্রাসাদ ও পূজার স্থল বা প্রাঙ্গণ দেখেছিলেন যা এখন লুপ্ত। রাজপাট ইত্যাদি অঞ্চলকে প্রত্নক্ষেত্রে পরিণত করলে বহু পুরাবস্তু , পুরাকীর্তি এবং মৃত্তিকার অতলে লুপ্ত ইতিহাসকে পাওয়া যেতে পারে। আজ থেকে প্রায় ২২০ বৎসর , হ্যাঁ ২২০ বৎসর অর্থাৎ ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ রাজপাটের এই অংশ হতে যে বিষ্ণুমূর্তিটি প্রাপ্ত হয় তা এখন মা কামতেশ্বরীর মন্দিরে অবস্থান করছে। অনুমান এটি পাল যুগের। প্রসঙ্গত , কামতাপুর দুর্গটি হুসেন শাহের আক্রমণে বিনষ্ট হয়। এই বিষয় আমি আগেও বহুবার আলোচনা করেছি। 


এই প্রবন্ধের দ্বিতীয় পর্বেই আমি বলেছিলাম যে রাজপাটের ঢিবির উপর কয়েকটি অল্টো রিলিভো রীতিতে গভীরভাবে খোদিত মূর্তি একত্রে দেখা যায়।  এগুলির নির্মাণকাল সেনযুগের কিছু পরের অথবা খেন আমলের হতে পারে। এগুলির নির্মাণ শৈলীতে অহোম বা মন- খ্মের ভাস্কর্যের কিয়দ্ মিল হয়ত পেলেও পাওয়া যেতে পারে।


খেন বংশ কায়স্থ এবং একই সঙ্গে বোড়ো উপগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। আজ অবধি রক্ষিত দেবদেবী ও নরনারীর  মূর্তিগুলির মুখ একটু লম্বা ধরনের ,  দেহের গঠন একটু পাতলা ধরনের পাওয়া গেছে। তাতে বোধ হয় যেন আকৃতি গুলি কিছু মন -খমের বা অহোম প্রকৃতির।মূর্তি গুলির সজ্জাও একটু বিচিত্র ধরনের।রাজা রানীদের মাথা আছে কোণাকৃতি শিরোভূষণ ।একটি মূর্তিতে আবার এক রাজাকে চোগা এবং দোপাট্টা পড়ে থাকতে দেখা যায় ।


খেনযুগে সৈনিকের কিরূপ চেহারা ও বেশভূষা ছিল তা আমরা একটি পাথরের খণ্ডে খোদিত দুটি সৈনিকের মূর্তি থেকে জানতে পারি। তাঁরা বর্ম বা বেশ আঁটসাঁট পোশাক পড়ে হাতে তলোয়ার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন ।তাঁদের শিরোনাস্ত্র গোল, চোখা এবং একটু লম্বা ধরনের।


খেন যুগে রাজাদের উপাস্য দেবতা সম্বন্ধে আলোচনা করা শক্ত হলেও কঠোর নয়। কারণ, রাজবংশ শক্তির উপাসনা করতেন।  তাঁদের উপাস্য দেবী ছিলেন মা কামতেশ্বরী। রাজ পাটের ঢিবির উপর  অনেক গুলি  গৌরীপট্ট দেখ যায়। অর্থাৎ সেথায় শিবলিঙ্গ নিশ্চয়ই ছিল। তাছাড়া শক্তি যেথায় সেথায় শিব থাকবেন এটাই তো স্বাভাবিক। শিবশক্তি এরই মিলনে তো এই সুবিশাল সৃষ্টি।


  বাণেশ্বর মন্দিরের নির্মাতা হিসাবে খেন রাজাদের নামও শোনা যায় । শিবলিঙ্গ সমেত গৌরীপট্টগুলি যদি খেন যুগের পরের না হয় আর বাণে শ্বরের আদি মন্দির যদি খেন রাজা দ্বারা নির্মিত হয়ে থাকে তবে ওই সময় শিবের পূজাও হতো । তাছাড়া উত্তরবঙ্গ শিবের উপত্যকা নামে পরিচিত । এখানে তিস্তাবুড়ি থেকে মাশান ঠাকুর সর্বত্র  তিনি নানাভাবে বিরাজ করেন।

 
খেন রাজাদের সময় কোচবিহার বা কামতায় বৈষ্ণবমার্গের যথেষ্ট জনপ্রিয়তা ছিল । তার সব থেকে বড় প্রমাণ হলো কামতাদুর্গে  চৈতন্যদেবের নামে নিমাই দুয়ারের অবস্থান। এছাড়াও এখানে বেশ কিছু মূর্তি পাওয়া যায় । আমি পূর্বেই বলেছি এছাড়া এখানে একটি প্রাচীন বিষ্ণুমূর্তি পাওয়া গিয়েছিল। তা থেকে অনুমিত হয় যে ,  খেন যুগে বিষ্ণু এবং তাঁর রূপ পুরুষোত্তম শ্ৰী কৃষ্ণের পূজার যথেষ্ট প্রচলন ছিল। 


 এখানে প্রাপ্ত এবং সংরক্ষিত মূর্তিগুলিতে একটিতে কৃষ্ণ এবং এক নাগিনীকে দেখা যায়। সম্ভবত এটি কালীয়দমনের পর নাগপত্নী কর্তৃক কৃষ্ণস্তুতির আখ্যানকে রূপায়িত করছে।  অন্য একটিতে বালক কৃষ্ণের লীলাখেলার আখ্যান খোদিত হয়েছে।  সেখানে ব্রজগোপিনীদের হস্তে মাখন, দধির ভান্ড দেখা যায় । যে থেকে অনুমিত হয় যে, এইটি ভাগবতের #ভারখণ্ডের কোনো দৃশ্যের রূপায়ন । ফলে উপলব্ধি হয় যে,  সে যুগে কৃষ্ণ বা বিষ্ণু পূজাও যথেষ্ট জনপ্রিয় ছিল । এছাড়া খেন বংশের রাজাদের নাম বিষ্ণু বা কৃষ্ণের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয় । যেমন – চক্রধ্বজ , নীলাম্বর ইত্যাদি।


 রাজপাটের ঢিপির উপর মোট নয়টি মূর্তি ফলক পাওয়া গেছে। এর মধ্যে দুটি মূর্তি বেশ ক্ষয়িত এবং অস্পষ্ট।  উক্ত প্রাপ্ত মূর্তিগুলিকে হ্যামিল্টন বোধয় আদাবাড়ির নিকট দেখেছিলেন। ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব সমীক্ষার মহা অধিকর্তা স্বর্গত #মাধোস্বরূপ_বৎসও ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে এবং তারও আগে এই মূর্তি গুলি এবং রাজপাটের ঢিবিটি পরিদর্শন করেছিলেন।  সে সম্পর্কে তাঁর একটি বিবরণ #কোচবিহার_জেলার_সেন্সাস_হ্যান্ডবুক (১৯৫১) তে মুদ্রিত হয়। 


মূর্তিগুলির বিবরণ ছিল নিম্ন রূপ :
১) উপাসনা বা পূজারত অবস্থায় সম্ভবত এক রাজদম্পতি যুগল মূর্তি উপাসনার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন। মূর্তি দুটির মাথায় তিনকোনা চোখা মুকুট ও অন্যান্য রাজনোচিত সাজসজ্জা। 

২) বামন ও রাজা – রাজা যথাযথ সুসজ্জিত।  রাজা ও বামনের সম্মিলিত মূর্তি রূপায়ণ প্রাচীন ভারতের সুপ্রচলিত ছিল । প্রসঙ্গক্রমে আমরা গুপ্ত সম্রাটদের কিছু মুদ্রায় রাজা ও বামনের প্রতিকৃতির উল্লেখ করতে পারি । রাজা ও বামন বলতে অবশ্যই আমাদের বিষ্ণুভক্ত প্রহ্লাদের পৌত্র মহারাজ বলি এবং ভগবান বিষ্ণুর অবতার  বামন অবতারের কথা মনে পড়ে । যেখানে বামন অবতার  মহারাজ বলির নিকট এসে ৎ8ন খন্ড ভূমি চেয়েছিলেন। 


৩) রাজদম্পতি – সিংহাসন , তিনকোণা মুকুট এবং অন্যান্য সাজসজ্জা থেকে উপলব্ধি করা যায় পুরুষমূর্তিটি রাজার এবং নারী মূর্তিটি রানীর । চৌকির মত সিংহাসনে রাজা বসে আছেন আর তার পাশে রানী দাঁড়িয়ে আছেন। 


৪) রাজা বা মন্ত্রী ও তাঁর কর্মচারী বা ভৃত্য – প্রধান পুরুষ মূর্তিটি পরনে চোগা ও গলায় দোপাট্টা। 
৫) দুজন সশস্ত্র সৈনিক বা রাজপ্রহরী – মাথায় গোলাকার , চোখা ও লম্বা শিরণাস্ত্র পরে তলোয়ার হাতে নিয়ে তাঁরা দাঁড়িয়ে আছেন । 


৬) কৃষ্ণ ও নাগিনী –  কৃষ্ণ মূর্তিটি উঁচুকিরীটী মুকুট এবং সালঙ্কার নারী মূর্তিটি জোড় হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। মাথায় সর্পছত্র ও দেহের নিচের অংশ সর্প থাকায় নারীমূর্তিটি যে কোনও নাগিনী সেবিষয় সন্দেহ নেই। এই ভাস্কর্যটিতে নাগপত্নী কর্তৃক কৃষ্ণস্তুতির আখ্যানকে রূপায়িত করছে।


৭) গোপি ও কৃষ্ণ –  এটিতে মোহনচূড়া মাথায় ও নানা অলঙ্কারে ভূষিত বালক কৃষ্ণ ও সুসজ্জিতা দুইজন গোপিনীকে দেখা যায় খেলা করতে দেখা যায় । বালক কৃষ্ণের পরনে চোগা ও গোপিনী পরনে শাড়ি বা ঘাগড়া। গোপিনীদের হস্তে দধি ভান্ড বা মাখন ভান্ড কৃষ্ণের নাগালের বাইরে তুলে ধরে কৃষ্ণকে বাতাস করছেন। এই মূর্তি ভারলীলা বা দানলীলার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। 


প্রাচীন প্রসিদ্ধ প্রাগজ্যোতিষ , লৌহিত্য , কামরূপ , কামতা হয়ে কোচবিহার…..পুরাণ ও তন্ত্রে প্রাচীন কামরূপের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে । ভাস্করবর্মার তাম্রলিপি থেকে হিউয়েন সাঙ ও হর্ষচরিত সর্বত্র উল্লিখিত প্রাচীন কোচবিহার । পরশুরামের নাম জড়িত কোচবিহার । যোগিনী তন্ত্র , জাতি কৌমুদি , পদ্মপুরাণে উল্লিখিত কুবচদের কথা বলা হয়েছে । তাঁদের নামেও বিখ্যাত এই কোচবিহার । গড়, দুর্গ , প্রাচীন মন্দিরের কোচবিহার । যদি এগুলি প্রত্নক্ষেত্র হতো তবে ভারতবর্ষের সুপ্রাচীন ইতিহাস আমাদের নিকট উন্মুক্ত হতো। বর্তমানে কোথাও কোথাও মহকুমা স্তরের ইতিহাস লেখার প্রবনতা  দেখা যায়। এগুলিকে গুরুত্ব সহকারে বিচার বিশ্লেষণ করা হোক। ভবিষ্যতে আমি অন্যান্য মন্দির, প্রত্নতত্ত্ব এবং কোচবিহারের ইতিহাস সম্পর্কে আলোচনা করব।

#সমাাপ্ত
©দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ ১ . পশ্চিমবঙ্গের পুরাকীর্তি

২. কোচবিহারের পুরাকীর্তি

৩. ইতিকথায় কোচবিহার

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.