২০ জুন। পশ্চিমবঙ্গের জন্মদিন। ভারতের অন্য অনেক রাজ্যের জন্মদিন খুব ঘটা করে পালিত হয়। ওড়িশায় ১ এপ্রিল ‘উৎকল দিবস’ পালন করা হয় খুব ধুমধাম করে। ১৯৩৬ সালের ওই তারিখেই জন্ম হয়েছিল আজকের ওড়িশার। ঠিক তেমনই ১৯৪৭-এর ২০ জুন তারিখেই জন্ম নেয় আজকের পশ্চিমবঙ্গ। বঙ্গীয় আইনসভা ভেঙে এই দিনেই তৈরি হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ আইনসভা আর পূর্ববঙ্গ আইনসভা। অখণ্ড বাংলার মুসলমান বহুল অংশ বাদে বাকি অংশের বিধায়করা ৫৮ বনাম ২১ ভোটের সংখ্যাগরিষ্ঠতায় ঠিক করলেন বাংলা ভাগ হবে আর এই অংশটুকু ভারতের একটি রাজ্য হিসেবে থেকে যাবে
সময়টা বাংলার মানুষের জন্য ভয়াবহ ছিল। ১৯৪৬ সালে কলকাতার ভয়াবহ দাঙ্গা পৃথিবীর নরসংহারের ইতিহাসের এক বীভৎস দলিল। যার নেতৃত্বে ছিলেন মুসলিম লিগের নেতা বঙ্গপ্রদেশের প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহিদ সোহরাবর্দি। বাংলায় তখন লিগের শাসন। কলকাতায় দাঙ্গা পূর্ববঙ্গে সাম্প্রদায়িক শক্তিকে উৎসাহিত করেছিল। সেবছর কোজাগরী লক্ষীপূজার দিনে নোয়াখালিতে গোলাম সারওয়ার হুসেইনির জল্লাদ বাহিনী দাঙ্গা শুরু করল। ভয়ানক সে অত্যাচারে। শত শত মানুষের মৃত্যু, হাজার হাজার মহিলার সম্মানহানির খবরে উৎকণ্ঠিত মহাত্মা গান্ধী ছুটে গিয়েছিলেন নোয়াখালিতে। চারমাস ছিলেন সেখানে। কিন্তু অত্যাচারীদের শাস্তি হল না, অত্যাচারিতরা আর ঘরে ফিরলেন না।


এইসব ঘটনা শান্তিকামী মানুষের চোখ খুলে দিয়েছিল। লিগের নেতৃত্বের হাতে পাকিস্তানে হিন্দুরা থাকতে পারবে না। তাই চাই ‘বেঙ্গলি হিন্দু হোমল্যান্ড’। এই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন হিন্দুমহাসভার ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় (Dr. Shyamaprasad Mukherjee)। কিন্ত বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের (বিপিসি) সিংহভাগ নেতৃত্ব শ্যামাপ্রসাদকে সমর্থন করেছিলেন। শ্যামাপ্রসাদ পূর্ববঙ্গের গ্রামে গ্রামে ঘুরে ঘুরে মানুষকে বোঝাতে শুরু করেন। মুসলিম লিগের পরিকল্পনা ছিল সমগ্র বাংলাকেই পাকিস্তানে নিয়ে নেওয়ার। তাই শ্যামাপ্রসাদের সক্রিয়তায় প্রমাদ গুনলেন জিন্না। বাংলার খনিজ বহুল অঞ্চল, শিল্পাঞ্চল, ভারতের তদানীন্তন বৃহত্তম বন্দর আর সর্বোপরি কলকাতা, কোনও কিছুই পাবে না পাকিস্তান! ১৯৪৭ সালের ৪ মে, নতুন দিল্লিতে জিন্না সাহেবের বক্তব্যে সেই ক্ষোভ ফুটে উঠেছিল। তিনি বললেন,‘বাংলায় হিন্দু মহাসভা বঙ্গবিভাজনের জন্য ব্যপক প্রচার চালাচ্ছে, এটা দুর্ভাগ্যজনক।’ সিপিআই মুসলিম লিগের দ্বিজাতিতত্ত্বের এবং ভারত বিভাজনের সমর্থক ছিল। ১৯৪৭-এর ২৩ এপ্রিল সম্পূর্ণ বাংলার পাকিস্তানভুক্তির বিরুদ্ধে সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিলেন শ্যামাপ্রসাদবাবুরা। বামেরা বিরোধিতা করেছিল। বেঙ্গল প্রভিন্সিয়াল ডিপ্রেসড ক্লাসেস লিগের নেতা যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল পাকিস্তানের সমর্থক ছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন অখণ্ড বঙ্গদেশ পাকিস্তানে যাক। কিন্তু ওই দলের রাজ্য সম্পাদক আর দাস প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন, যোগেন্দ্রনাথের মত সংখ্যাগরিষ্ঠের মত নয়। শ্যামাপ্রসাদ বিভিন্ন দলের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সব মানুষের মতকে পশ্চিমবঙ্গের পক্ষে আনতে পেরেছিলেন। সেই সময় সোহরাবর্দি সাহেব আরেকটি পরিকল্পনা নিয়েছিলেন—অখণ্ড বাংলা ভারত বা পাকিস্তানে কারও সঙ্গেই যাবে না, বাংলা স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হবে। শরৎচন্দ্র বসু ও কিরণশঙ্কর রায়ের মতো কংগ্রেসের শীর্ষ নেতারাও তাতে সায় দিয়েছিলেন! তবে, সব জল্পনার অবসান ঘটিয়ে ‘পশ্চিমবঙ্গ’ (West Bengal) জন্ম নিল।


সেদিন ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়রা (Dr. Shyamaprasad Mukherjee) যে অসাধ্যসাধন করেছিলেন তারই সুফল আজ পাচ্ছেন এরাজ্যের মানুষ। অখণ্ড বাংলা পাকিস্তানে গেলে আজ কী পরিণতি হতো? বাংলা স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হলেই বা বাংলার মানুষ কী পেত? পশ্চিমবঙ্গ কি কেবলমাত্র হিন্দুদেরই রক্ষা করেছে না কি আরও বেশি কিছু দিয়েছে? বাঙালির অস্তিত্বের সঙ্গেই বা এই জন্মদিনের কী সম্পর্ক? আজ ২০২০ সালে আধুনিক পশ্চিমবঙ্গের প্রেক্ষাপটে এই সবকটি প্রশ্নের উত্তর খোঁজা একান্ত প্রয়োজন। সম্পূর্ণ বাংলা পাকিস্তানে গেলে কী হতো? উওরটা যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলের পরিণতি দিয়ে বোঝালেই ভালো হবে। মুসলিম লিগ নেতৃত্ব যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলকে স্বাধীন পাকিস্তানের প্রথম আইনমন্ত্রী বানিয়ে সম্মান দিয়েছিল। কাশ্মীর বিষয়ও তিনিই দেখতেন। করাচিতে ঝাঁ চকচকে বাংলোতে মাত্র তিনবছর থাকতে পেরেছিলেন। ১৯৫০-এর ৮ অক্টোবর ইস্তফাপত্র পাঠান প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খানের কাছে। প্রায় পালিয়েই ভারতে চলে আসেন সপরিবারে। ইস্তফাপত্রে লিখলেন যে পাকিস্তানে হিন্দুরা সম্মান নিয়ে থাকতে পারবে না। ১৯৬৮-তে এই পশ্চিমবঙ্গেই শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন
পাকিস্তানে হিন্দু আইনমন্ত্রীর এই অবস্থা হলে সাধারণ মানুষের কী অবস্থা হয়েছিল তা সহজেই বোঝা যায়
। গত সাত দশক পূর্ববঙ্গের হিন্দুর অবর্ণনীয় কষ্টের আখ্যান সারা পৃথিবীর ইতিহাসের করুণতম উদাহরণ। গত দশকগুলোতে কেবলমাত্র হিন্দু হওয়ার অপরাধে নির্যাতিত হয়ে এই পশ্চিমবঙ্গেই পালিয়ে আসতে হয়েছে তাঁদের। ১৯৫১ সালের আদমশুমারি অনুসারে পূর্বপাকিস্তানে হিন্দু ছিল ২২ শতাংশ, আজ যা ৮.৫ শতাংশ। চোদ্দোপুরুষের ভিটেমাটি ফেলে চলে আসা মানুষের ১০০ শতাংশই অত্যাচারের কারণে এদেশে এসেছেন। শ্যামাপ্রসাদেরা পশ্চিমবঙ্গটুকু না রাখলে হয়তো সব হিন্দু বাঙালিকেই দণ্ডকারণ্যে, বিহারে, ওড়িশাতে বা অন্য কোথাও উদ্বাস্তু হিসাবে থাকতে হতো। স্বাধীন ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ ১৯৮৮ সালে পাল্টে গেল। মুসলিম লিগ নেতা সোহরাবর্দির হাতে এই পরিবর্তন হতে এত সময়ও লাগত না। স্বাধীন বাংলা হয়তো পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হতো না, তবে ইসলামিক রাষ্ট্র অবশ্যই হতো।


পশ্চিমবঙ্গ যে কেবল হিন্দু বাঙালির আশ্রয়স্থান হয়েছে তাই নয়, স্বাধীন মুক্ত চিন্তাকেও জায়গা করে দিয়েছে। এখানে মানুষ প্রাণখুলে নিজের কথা বলতে পেরেছেন। এখানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মানুষ স্বাধীন মত প্রকাশ করতে পেরেছেন। স্বাধীনতার পরে পরেই রাজশাহিতে কৃষক আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন ইলা মিত্র। পাকিস্তানের পুলিস আর আনসার বাহিনী এই কমিউনিস্ট নেত্রীকে অবর্ণনীয় অত্যাচার করেছিল। ১৯৫৪ সালে পাকিস্তান সরকার খানিকটা দয়া করেই অসুস্থ ইলা মিত্রকে প্যারোলে কলকাতায় পাঠায়। তিনি আর পাকিস্তানে ফেরেননি। সিপিআইয়ের টিকিটে দু’বার বিধায়ক হন ইলা মিত্র। পশ্চিমবঙ্গের জন্ম হয়েছিল বলেই বামফ্রন্ট এরাজ্যে টানা ৩৪ বছর শাসন ক্ষমতায় থাকতে পেরেছে। পূর্ববঙ্গের কমিউনিস্ট নেতা ম঩ণি সিংহের আত্মজীবনী ‘জীবন সংগ্রাম’-এর প্রতিটি পাতা সেই কথাই মনে করিয়ে দেয়।
পশ্চিমবঙ্গ কেবল একটা রাজ্যের নাম নয়, পশ্চিমবঙ্গ বাঙালি অস্তিত্বের একমাত্র ভরসার স্থান। ভারতের নবজাগরণের পথ প্রদর্শক ছিল বাংলা। সেই বাংলা কেবল একটা ভূমিখণ্ড বা একটি ভাষা নয়, একটি সম্পূর্ণ সংস্কৃতি। পশ্চিমবঙ্গ সেই সংস্কৃতির শেষ ঠিকানা। কিন্তু দুঃখের বিষয়, রোজ একটু একটু করে মুছে যাচ্ছে সেই গৌরবচিহ্ন।
২০০৪ সালে বিবিসি সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালিদের এক তালিকা প্রকাশ করে। ১১ ফেব্রুয়ারি থেকে ২২ মার্চ পর্যন্ত চলা ওই সমীক্ষায় শেখ মুজিবর রহমান সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি নির্বাচিত হয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দ্বিতীয়, নবম স্থানে বিদ্যাসাগর আর সতেরতম স্থানে আছেন স্বামী বিবেকানন্দ। তাহলে ভারতের নবজাগরণ, তাতে বাঙালির ভূমিকা সব মিথ্যা?
আজ ইন্টারনেটে ইংরেজিতে ‘ওয়াটার’, স্প্যানিশে ‘আগুয়া’ বা জার্মান ভাষায় ‘আসার’-এর বাংলা প্রতিশব্দ চাইলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ‘পানি’ আসবে। কিন্তু বাংলা শব্দ হল জল, অন্য কিছু নয়। পানি হিন্দি বা উর্দু শব্দ। বাঙালি হিন্দু পুজোপার্বণে কত সংস্কৃত শব্দ বলে, তা বলে কি সেগুলো বাংলা হয়ে যাবে? যে ভাষাটা এত সম্বৃদ্ধ, এত যার সাহিত্য, যেখানকার কবি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন, সেই ভাষাটাকে এভাবে পরিবর্তন করে দেওয়া যায় নাকি? রবীন্দ্রনাথ কি ‘পানি’ লিখতেন? কাজী নজরুল ইসলাম জলের বদলে পানি লিখতেন তাঁর কবিতাতে? এক ধর্মপ্রাণ সৎ মুসলমান নাবিকের জীবনের হৃদয়বিদারক কাহিনী নিয়ে লেখা সৈয়দ মুজতবা আলীর গল্প ‘নোনাজল’। উনি তো ‘নোনাপানি’ লেখেননি।
ভারতের এত সাধনার ঘনীভূত রূপ বাংলার মনীষা। জাতিভেদের মূলে কুঠারাঘাত করে আচণ্ডালে হরিনাম দিলেন শ্রীচৈতন্যদেব। উপাসনা পদ্ধতি বা সম্প্রদায়ের ঊর্ধ্বে উঠে লালন শাহের বাংলা আজও সারা পৃথিবীকে পথ দেখাতে পারে। বেদান্তের শাশ্বত বাণীকে আধুনিক পৃথিবীর মানুষের মতো করে তুলে ধরে জগতকে কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’ থেকে শ্রীঅরবিন্দ ‘বন্দেমাতরম’কে জাতীয়মন্ত্র করেছিলেন, জেগে উঠেছিল আসমুদ্র হিমাচল। উপনিষদের সমুদ্রমন্থন করে যুগোপযোগী মণিমুক্তো তুলে এনেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বিদ্রোহের রুদ্রবীণা বাজালেন নজরুল। এমন সব মনীষীর কাউকে বাদ দিলে চলে?এর কোন একটা উপাদান বা মাতৃসমা ভারতবর্ষকে বাদ দিলে সেটা আর বাংলা থাকে না। কেবলমাত্র দোয়েল, শ্যামার ডাক বা গাছে গাছে ফিঙে পাখি নাচলেই বাংলা হয় না, যেখানে চণ্ডীদাসের, রামপ্রসাদের কণ্ঠ বাজে না সেটা আর বাংলা নয়! শুধুমাত্র বাংলায় কথা বললেই বাঙালি হওয়া যায় না
কেবল সাহিত্য বা দর্শনের ক্ষেত্রেই নয়, বিগত শতাব্দীতে বিজ্ঞান গবেষণায় যুগান্ত এনেছেন বাঙালি বিজ্ঞানীরা। আজ মোবাইল থেকে উপগ্রহ, রান্না ঘর থেকে ইন্টারকন্টিনেন্টাল মিসাইল, এসবের পিছনে যে ‘মাইক্রোওয়েব’ তাঁর আবিষ্কারক আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু। মহাবিশ্বের অর্ধেক অবআণবিক কণা ‘বোসন’ যাঁর নামে সেই সত্যেন্দ্রনাথ বোসও এই বাংলারই সন্তান। স্বাধীন ভারতবর্ষেও বিজ্ঞান গবেষণায় সবার আগে ছিল পশ্চিমবঙ্গ। ১৯৪৮ সালে অধ্যাপক মেঘনাদ সাহা কলকাতায় স্থাপন করলেন দেশের সর্বপ্রথম ‘ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স’। ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করছিলেন ডঃ শ্যামাপ্রসাদবাবু। এই উদার ঐতিহ্য বহনের দায়িত্ব কেবল একা পশ্চিমবঙ্গের।

 লেখক কলকাতায় ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স-এ কর্মরত। মতামত ব্যক্তিগত 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.