রাশিয়া- ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে পাওয়া পাঁচটি শিক্ষা
লেফটেন্যান্ট জেনারেল অজয় কুমার সিং, জেনারেল অফিসার কমান্ডিং-ইন-চিফ পুনে-সদর দফতরের দক্ষিণ কমান্ড, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর জন্য পাঁচটি শিক্ষা সনাক্ত করেছেন।
সেগুলো হল –
১- চিরাচরিত নিয়মে যুদ্ধ এখনো সম্ভব
অনেক মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল যে আগের মত (Conventional war) দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ এখন আর হবে না। বর্তমানে যুদ্ধ হবে কোন সংক্ষিপ্ত অঞ্চলে সীমাবদ্ধ‚ খুব দ্রুত এবং বিকল্প পথে।
কিন্তু রাশিয়া- ইউক্রেনের যুদ্ধ সেই ধারণা ভেঙে দিয়েছে। মানুষ এখন বুঝতে পারছে যে এই যুগেও দীর্ঘস্থায়ী চিরাচরিত নিয়মে যুদ্ধ সম্ভব। তাই ভারতের উচিত যে কোন মুহূর্তে দীর্ঘ টানা প্রচলিত যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকা কারণ আমাদের দুটি প্রতিবেশী দেশের সাথে সীমান্ত সমস্যা রয়েছে। তাদের নিয়ে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। যেকোনো সময়েই এখানে যেকোনো কিছু ঘটে যেতে পারে।
- ড্রোন যুদ্ধ
জেনারেল সিং বলেছেন যে মনুষ্যবিহীন এরিয়াল ভেহিকেল (ইউএভি) এবং ড্রোন যুদ্ধের মাঠে একটি বড় সম্পদ হয়ে উঠেছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে ড্রোনের গুরুত্ব আসলেই চোখে পরার মতো বেড়েছে।
তুর্কি বায়রাক্টার টিবি ২ হোক বা রাশিয়ান বাহিনীর ব্যবহার করা সস্তা ইরানী শাহেদ-১৩৬ আত্মঘাতী ড্রোন হোক – ড্রোন অবশ্যই এই যুদ্ধে অত্যন্ত কার্যকরী ভূমিকা রাখছে।
আর শুধু যুদ্ধের কাজে না অর্থাৎ শুধু ধ্বংসের কাজে না বরং উন্নত মানের ছবি তোলার কাজেও এই ড্রোন খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। যুদ্ধের এত ভালো ছবি এর আগে কখনোই তোলা হয়নি। এছাড়াও জাপোরিঝিয়া অঞ্চলে ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীর সরবরাহ লাইনকে নষ্ট করার কাজে রাশিয়ার আত্মঘাতী ড্রোন হামলার কথাও আমরা জানি।
৩- প্রোপাগান্ডা
প্রোপাগান্ডা কিভাবে বর্তমান যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে তাও ভারতের শেখা উচিত। সাধারণ মানুষ ও সৈন্যদের মনোবল বাড়ানোর জন্য বা বহির্বিশ্বের সমর্থন আদায়ের জন্য প্রোপাগান্ডার ভূমিকা প্রচুর। ২ নং পয়েন্টে যেটা বলা হয়েছে‚ ড্রোন থেকে তোলা ছবি আর ভিডিও এই প্রোপাগান্ডা মেশিনারিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
৪- বেসামরিক অংশগ্রহণ –
জেনারেল সিং বলেছেন যে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ একটা মাল্টি-ডোমেন দ্বন্দ্বের মতো হয়ে উঠেছে। তাই, সংঘাত শুধু যে যুদ্ধের ময়দানে দুই সেনাবাহিনীর মধ্যে হচ্ছে তাই নয়, তার বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে।
ইউনিফর্ম পরা এবং ইউনিফর্ম না পড়া দুই ধরনের মানুষই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে! তাই ভারতেও আমাদের সামরিক বাহিনীর পাশাপাশি বেসামরিক জনগণকেও তৈরী রাখার কথা ভাবতে হবে। যা দেশের প্রতিরক্ষা এবং ক্ষমতাকে আরও শক্তিশালী করবে।
আরও বিশদভাবে জেনারেল সিং বলেন যে বেসামরিক ডোমেনে অনেক ক্ষমতা রয়েছে। রাজস্থান এবং গুজরাট এই দুই রাজ্যে পরিকাঠামোর যে উন্নতি হয়েছে তা অসাধারণ। তিনি বলেছেন যে আগে সীমান্ত এলাকায় সীমিত যোগাযোগ ছিল। প্রতিরক্ষার জন্য আমাদের কৌশল ছিল এই এলাকায় প্রবেশাধিকার অস্বীকার করা, কিন্তু এখন তা পরিবর্তিত হয়েছে।
তিনি বলেন‚ “আমার কথা হল প্রতিরক্ষার উদ্দেশ্যে দেশের যে সামর্থ্য রয়েছে তা আমরা কীভাবে কাজে লাগাতে পারি। “
- লজিস্টিকস এবং আত্মনির্ভরতা
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ দেখিয়েছে, যদি কেউ একটি দীর্ঘ টানা পরিপূর্ণ প্রচলিত যুদ্ধে জয়ী হওয়ার পরিকল্পনা করে তাহলে লজিস্টিক হচ্ছে এই পরিকল্পনার মূল উপাদান।
“আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল রসদ,” জেনারেল প্রশ্ন করেন যে “যদি যুদ্ধ দীর্ঘ সময় ধরে চলে, তার জন্য আমরা কতটা প্রস্তুত?”
এখনো পর্যন্ত, ভারত মিনিমাম অ্যাকসেপ্টেবল রিস্ক লেভেল অফ অ্যামুনিশন (MARL) অনুযায়ী গোলাবারুদ সংরক্ষণ করত, যা ভারতীয় সেনাবাহিনীকে ২০ দিনের জন্য উচ্চ-তীব্রতার পূর্ণ-স্কেল যুদ্ধের জন্য পর্যাপ্ত গোলাবারুদ মজুদ রাখতে দিত।
যাইহোক, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ দেখিয়েছে যে প্রচলিত যুদ্ধ প্রায় সবসময়ই এই সময়কালকে ছাড়িয়ে যায়। তাছাড়াও জেনারেল গোলাবারুদ উৎপাদনে স্বনির্ভরতার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও তুলে ধরেছেন।
তিনি বলেন‚ আরেকটি মূল বিষয় হল আত্মনির্ভরতা। অস্ত্রশস্ত্র এবং প্রযুক্তির ক্ষেত্রে আত্মনির্ভরতাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই দিকগুলির দিকেও সরকারের মনোযোগ রয়েছে বলে তিনি জানান।
জেনারেল আরো বলেন‚ সশস্ত্র বাহিনীকে একটি খুব গঠনমূলক এবং ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে হবে। আমাদের অনেক সরঞ্জাম রাশিয়ান এবং খুচরা জিনিসগুলি সেখান থেকে আসতে হবে। সুতরাং, এখন আমাদের জন্য সময় এসেছে যে আমরা রাশিয়ান সরঞ্জামের যত্ন নেওয়ার ক্ষেত্রেও কতটা স্বাবলম্বী তা নিশ্চিত করার। রাশিয়ান অস্ত্রের বিকল্পের কথাও তিনি বলেন। বিদেশী অস্ত্র থেকে ভারতীয় অস্ত্রে সেনাবাহিনীকে স্থানান্তর করা কঠিন হবে না বলে তিনি জানান।
ভারত তার প্রস্তুতিকে প্রভাবিত না করেও একটি পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুত বলেও তিনি জানান।
সৌভিক দত্ত