ফ্রি-তে গরিব পড়ুয়াদের আইআইটি-জয়েন্ট কোচিং, আনন্দ কুমার ও দেশের আরও চার শিক্ষক

সিনেমা সুপারহিট। তাঁর জীবনের গল্প নিয়ে ১২ জুলাই মুক্তি পেয়েছে হৃতিক রোশন অভিনীত ‘সুপার ৩০।’ গণিতবিদ পটনার আনন্দ কুমারকে এখন চেনে গোটা দেশ। তবে আনন্দ একা নন। তাঁরই মতো আঁধার থেকে আলোতে উত্তরণের পথ দেখাচ্ছেন আরও চার জন। নিশ্চুপে, নিঃস্বার্থ ভাবে।

পাঁপড় বিক্রেতা থেকে গণিতবিদ— আনন্দ কুমারের লড়াইয়ের গল্পই হৃতিকের ‘সুপার ৩০’

স্কুল থেকে ফেরার সময় সাইকেলটা বাড়ির গলির একটু আগে রেখে, আকাশের দিকে চাইত ছোট্ট ছেলেটা। স্বপ্নগুলো চোখের তারা থেকে বায়োস্কোপের মতো ভেসে উঠত সামনে। অক্সফোর্ড বা কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস। শিক্ষকের সামনে বসে একমনে অঙ্ক কষে যাচ্ছে। তার মেধা দেখে মাথায় স্নেহের হাত রাখছেন শিক্ষক। স্বপ্নটা বুদবুদের মতো উবে যেত একটু পরেই, কারণ মায়ের ডাকে বাড়ি ফিরতে হতো খুব তাড়াতাড়ি। বইগুলো রেখেই তো বেরোতে হবে পাঁপড়ের ঠেলা নিয়ে। কয়েকটা বাড়িতে বাঁধাধরা খদ্দের, আর পথচলতি যৎসামান্য যা আয় হবে তাই দিয়েই তার স্কুলের খরচ, কিছু বই খাতা দিব্যি হয়ে যাবে। বাকিটা তোলা থাকবে মায়ের ভাঁড়ারে।

আনন্দ কুমার

সাইকেলে ফেরি স্বপ্ন

পটনার প্রত্যন্ত গ্রামের সরকারি হিন্দি মিডিয়ার স্কুলের কৃতী ছাত্র। শিক্ষকরা এক ডাকে চেনে এই ছেলেটাকে। আনন্দ কুমার। বাবা সামান্য কেরানি। পটনার পোস্টাল ডিপার্টমেন্টে খুবই কম মাইনের চাকরি। তাই দিয়ে সংসার চলে না। এ দিকে ছেলে পড়াশোনায় তুখোড়। যে কোনও জটিল অঙ্ক কষে ফেলে পলক ফেলতেই। গানবাজনাতেও শখ। গরিব পরিবারে এমন রত্ন জন্মানোটা বোধহয় আশীর্বাদের চেয়ে অভিশাপ বেশি। রোজগার বাড়াতে পটনা থেকে কলকাতাতেও যাতায়াত শুরু করেন ভদ্রলোক। তবে নিয়তি মনে হয় কিছু অন্যরকমই পরিকল্পনা করেছিল ছেলেটির জন্য। বাবা চলে গেলেন হঠাৎ করেই। আঁধার নামল চারপাশে। তবে হার না মানা জেদ লড়াই চালিয়ে গেল একই ভাবে। দিনে স্কুল, বাড়ি ফিরেই অঙ্কের বইয়ে ডুবে যাওয়া। আর বিকেল গড়ালে মায়ের বানানো পাঁপড় ঠেলাগাড়িতে ভরে, ছেলে তখন ‘পাঁপড় ফেরিওয়ালা।’ অলিতে গলিতে ‘পাঁপড় নেবে গো’ হাঁক পাড়তে পাড়তেই সেরা গণিতজ্ঞ হওয়ার স্বপ্ন দেখে।

পড়ুয়াদের সঙ্গে তাদের প্রিয় আনন্দ স্যর।

শুরু হলো এক অন্য লড়াই

১৯৯২ সাল। আনন্দ তখন পাড়ার অঙ্ক স্যর। ছাত্রদের অত্যন্ত প্রিয়। দুঃস্থ, মেধাবি ছাত্রদের মধ্যে নিজেকে খুঁজে পান আনন্দ। ঠিক করলেন বিনা পয়সায় টিউশন দেবেন। পাড়াতেই খুলে ফেলেন ছোট্ট টিউশন সেন্টার। নাম দেন রামানুজম স্কুল অব ম্যাথেমেটিক্স। ছাত্র পড়ানোর পাশাপাশি, অঙ্কের উপর গবেষণা চলতে থাকে। তিন বছরে তাঁর টিউশন সেন্টারে ছাত্রদের লম্বা লাইন। সংখ্যাটা ৫০০ ছাড়িয়েছে। এ দিকে ‘নম্বর থিওরি’-র উপর তাঁর একাধিক গবেষণার পেপার ততদিনে ছাপা হয়েছে ‘ম্যাথেমেটিকাল স্পেকট্রাম’ ও ‘দ্য ম্যাথেমেটিকাল গেজেট’-এ। নতুন করে বিদেশে পড়াশোনার স্বপ্ন দেখতে থাকেন আনন্দ।

নিজের কোচিং সেন্টারে আনন্দ।

১৯৯৫। সুযোগ এসে যায় অযাচিত ভাবেই। একই সঙ্গে কেমব্রিজ ও শেফিল্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সুযোগ এসেছে। আনন্দের চোখে জল, কিন্তু হাত শূন্য। সংসারে বিধবা মা, সঞ্চয় নেই বললেই চলে। স্বপ্নগুলোকে বাক্সবন্দি করে ফের তুলে রাখলেন মনের কুঠুরিতে। অঙ্গীকার নিলেন, তাঁর মতো হাজার হাজার ছাত্রের স্বপ্ন বিফলে যেতে দেবেন না। শুরু হলো এক নতুন লড়াই।

অঙ্ক স্যর আনন্দ তৈরি করলেন ‘সুপার ৩০’

জয়েন্ট এন্ট্রাস ও ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (আইআইটি)-র কঠিন প্রবেশিকা পরীক্ষায় এক ধাপেই বাজিমাত করার জন্য ছাত্রছাত্রীদের তৈরি করা শুরু করেন আনন্দ। সালটা ২০০২। ছাত্র সংখ্যা ততদিনে হাজার ছাড়িয়েছে। এক বছরে ৪০০০ হাজার টাকার হিসেবে নিজের কোচিং সেন্টারেই সপ্তাহে তিন দিন দু’ঘণ্টা করে জয়েন্ট ও আইআইটি-র ক্লাস নিতে শুরু করেন। তাতে যে টাকা ওঠে সেটা জমিয়ে ২০০৩ সালে তৈরি করেন তাঁর বিশেষ টিম ‘সুপার ৩০।’ দুঃস্থ পরিবারের মেধাবি ৩০ জন ছাত্রকে বেছে নেন আনন্দ। বিনা পয়সায় তাঁদের প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করেন। ওই বছরই তাঁর টিমের ১৮ জন ছাত্র আইআইটি-তে সুযোগ পায়। অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন আনন্দ। তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়ে দিকে দিকে। ছেলেমেয়েদের নিয়ে তাঁর কোচিং সেন্টারের বাইরে লম্বা লাইন দেন বাবা, মায়েরা। সাফল্যের হারও বাড়তে থাকে পাল্লা দিয়ে। ২০০৪ সালে ২২ জন, ২০০৫-এ ২৬, ২০০৬-তে ২৮, ২০০৮-এ পুরোপুরি ৩০। ২০০৩ সাল থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে তাঁর ৪৫০ জন ছাত্রছাত্রীর মধ্যে ৩৯১ জন আইআইটি ক্র্যাক করেছেন। গত বছরও তাঁর ‘সুপার ৩০’-র ২৮ জন সুযোগ পেয়েছেন আইআইটিতে।

হৃতিকের সঙ্গে আনন্দ।

বিদেশে পড়াশোনা হয়নি ঠিকই, তবে অঙ্ক স্যর আনন্দ কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দিতে যান। তাঁকে ডেকে পাঠানো হয় আমেরিকান ম্যাথেমেটিকাল সোসাইটি ও ম্যাথেমেটিক্স অ্যাসোসিয়েশন অব আমেরিকাতে। তাঁর অঙ্কের থিওরি ছাপা হয় আমেরিকা, ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়ার জার্নালে। তাঁর লড়াইয়ের গল্প বলে সিনেমার পর্দা, হৃতিক রোশন অভিনীত ‘সুপার ৩০।’ জনপ্রিয়তার শিখর ছুঁয়েও অঙ্ক স্যর আনন্দ কিন্তু অবিচল, তাঁর শুধু একটাই দাবি, ‘‘এমন কত মেধা রয়েছে যারা শুধু অভাবের কারণে হারিয়ে যাচ্ছে। আমরা কি পারিনা তাদের পাশে দাঁড়াতে?’’

ডাক্তারের বদলে হয়েছিলেন চায়েওয়ালা, অজয় বাহাদুর সিং জীবন বাঁচাচ্ছেন অন্য ভাবে

ক্লাসের পড়া তুলে ফেলতেন বছর শেষের আগেই। একদিন ডাক্তার হতেই হবে। প্রাণ বাঁচানোর শপথ নিয়ে ফেলেছিলেন সেই কিশোরবেলাতেই। মেধাবী অজয় বাহাদুর সিং মেডিক্যাল এন্ট্রাসে ভালো র‍্যাঙ্ক একদিন ভর্তিও হন ওড়িশার এক নামী মেডিক্যাল কলেজে। সময় গড়ায়। পরিবারের অভাব বাড়ে। স্বপ্নের চারপাশে ভিড় জমাতে থাকে কালো মেঘ। একদিন বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েন। ডাক্তাররা জবাব দিয়ে দেন, কিডনি বিকল। প্রতিস্থাপন না করতে পারলে বাঁচানো অসম্ভব। অতএব ডাক্তারি পাঠে ইতি। রোজগারের পথে পা বাড়ান অজয়।

অজয় বাহাদুর সিং

মেধাবি ডাক্তারির ছাত্র তখন রাস্তায় চা-সরবত ফেরি করেন

কোনও পেশাই ছোট নয়। পরিবারের জন্য কলেজ ছেড়েছেন, তাতে খেদ ছিল না তরুণের। পড়া তো ছাড়েননি। স্বপ্ন তো দেখা যায় অন্য ভাবেও। যাপনের মধ্যে চটক থাকতেই হবে এমনটা তো নয়। জীবন অনেক বড়, এই দর্শন কম বয়সেই বুঝে ফেলেছিলেন অজয়। তাঁর চায়ের প্রশংসা তখন এলাকার লোকের মুখে মুখে ফেরে। দিনের বেলায় ডাক্তারির বই নিয়ে নাড়াচাড়া, বিকেল হলেই চা-সরবতের ঠেলা নিয়ে অলিতে গলিতে। মাঝে সাঝে ডাক পড়ে বিয়েবাড়ি বা উৎসব-অনুষ্ঠানে। সেখানে সরবত, সফট ড্রিঙ্কস তুলে দিতে হয় নিমন্ত্রিতদের হাতে। আবার সময় পেলে সোডা বানানোর মেশিন কারখানাতেও টুকটাক কাজ করে দেন। যা পয়সা ওঠে পুরোটাই লেগে যায় বাবার চিকিৎসার খরচে। নিজের হাত খরচ তুলতে কয়েকটা টিউশন। তাতে মন না ভরলেও, তিনটে পেট কোনও রকমে চলে যায়।

চায়েওয়ালা যখন বিজ্ঞানের স্যর

গরম ধোঁয়া ওঠা চায়ের ভাঁড়টা এগিয়ে দিতে গিয়েই আলাপ হয় এক কিশোরের সঙ্গে। সেও ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখে, তবে নামী কোচিং সেন্টারে পড়ার সামর্থ নেই। নিজের লড়াই অন্যের মধ্যে খুঁজে পান অজয়। খুলে ফেলেন নিজের কোচিং সেন্টার। নাম মাত্র পয়সায় বা দুঃস্থ ছাত্রদের জন্য একেবারে বিনামূল্যে শুরু করেন মেডিক্যাল প্রবেশিকা ‘ন্যাশনাল এলিজিবিলিটি এন্ট্রান্স টেস্ট’ (NEET)-এর কোচিং। শুধু পড়াশোনা নয়, দূর দূরান্ত থেকে আসা ছাত্রদের খাবার ও থাকার জায়গাও করে দেন এই স্যর।

পড়ুয়াদের প্রিয় অজয় স্যর

২০১৭ সালে তৈরি করেন ‘জিন্দেগি ফাউন্ডেশন।’ ২০ জন পড়ুয়ার মধ্যে ১৮ জনই উত্তীর্ণ হন মেডিক্যাল প্রবেশিকায়। সাফল্যের হার বাড়তে থাকে ধীরে ধীরে। এনইইটি কোচিং সেন্টার বলতে ওড়িশার অজয় বাহাদুর সিংয়ের নাম এখন ছড়িয়ে গেছে রাজ্যে রাজ্যে। বর্তমানে ‘আদ্যন্ত এডুকেশনাল অ্যান্ড চ্যারিটেবল ট্রাস্ট’-এর অধীনে কাজ করে অজয়ের ‘জিন্দেগি ফাউন্ডেশন।’ তাঁকে নিয়ে মোট ২০ জন শিক্ষক। এই সেন্টার থেকে পাস করা কৃতী ছাত্রদের হাতে পুরস্কার তুলে দিয়েছেন ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়ক। সত্যিই ডাক্তার না হয়েও জীবন বাঁচাচ্ছেন অজয়। তাঁর কথায়, ‘‘আমি ডাক্তার হতে পারিনি ঠিকই। কিন্তু আমার পরিশ্রম শত শত ছাত্রের স্বপ্ন পূরণ করছে। এটাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সাফল্য।’’

আনন্দ কুমারের ‘সুপার ৩০’ অনুপ্রেরণায় রাজস্থানের এই ডাক্তার তৈরি করেছেন ’৫০ ভিলেজারস সেবা সংস্থান’

২০১২ সাল। রাজস্থানের বারমেরে ৫০ জন দুঃস্থ ও মেধাবি ছাত্রকে নিয়ে একটি কোচিং সেন্টার তৈরি করেন ডঃ ভারত সরন। স্কুল ফাইনালে ভালো ফল করেও, পয়সার অভাবে থমকে গেছে যাদের ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন, তাদের গড়েপিঠে তৈরি করতেই এই কোচিং সেন্টার ‘৫০ ভিলেজারস সেবা সংস্থান’।

ডঃ ভারত সরনের ৫০ ভিলেজারস টিম

 ‘কম বয়সে মা-বাবাকে হারানোর যন্ত্রণা, দায়িত্ববোধ থেকেই ভিন্ন লড়াইয়ের স্বপ্ন দেখেছি’

‘‘একটা দুর্ঘটনায় খুব কম বয়সেই মা-বাবাকে একসঙ্গে হারাই। ছোট দুই ভাইকে নিয়ে কী ভাবে বাঁচার লড়াই চালিয়েছি, সেটা আজ আর মনে করতে চাই না। তবে এই লড়াই আমাকে অনেক পরিণত করেছে, শুধু নিজের জন্য নয়, আরও পাঁচ জনের জন্য বাঁচতে শিখিয়েছে,’’ ডঃ সরন বলেছেন, অনেক ছাত্রদেরই দেখেছি দশম শ্রেণিতে ৮০ শতাংশ নম্বর পেয়েছে। অথচ পরিবারের অভাবের কারণে পড়াশোনা চালাতে পারেনি। তাই সেই সব ছাত্রদের জন্যই এই সেবা সংস্থান। এখানে স্বপ্নকে বাঁচানোর শপথ নেওয়া হয়।

বর্তমানে এই সেবা সংস্থান আড়ে বহরে অনেকটাই বেড়েছে। এখানকার ছাত্রদের বিশেষ ইউনিফর্মও রয়েছে। ডঃ সরনের কথায়, ‘‘প্রতি ছাত্রের জন্য ২৫ হাজার টাকার বাজেট রেখেছি। তাঁদের বইপত্র, জামাকাপড়, থাকা-খাওয়া মিলিয়ে আমরা খরচ করি। আমাদের সেবা সদন চলে অনুদানের উপর। ৫০০ টাকা থেকে ৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত আমরা অনুদান পেয়েছি।’’ অনেকেই এই উদ্যোগকে ভালো চোখে দেখেননি, জানিয়েছেন ডঃ সরন। অনেক তির্যক মন্তব্য, বাঁকা চাউনি সইতে হয়েছে। তবে হার মানেনি এই সেবা সংস্থান। ২০১৫ সালেই ৫০ জনের মধ্যে ২৮ জন ক্র্যাক করেছে মেডিক্যাল এন্ট্রাস। সাফল্যের এই সংখ্যাটা এখন অনেক বেশি বলে জানিয়েছেন ডাক্তারবাবু।

জয়েন্ট এন্ট্রাস, এনইইটি থেকে আইনের কোচিং—দেশ কাঁপাচ্ছে ‘রহমানি ৩০’, এক শিক্ষা-আন্দোলনের গল্প

গল্পের শুরুটা হয়েছিল পটনা থেকে। অভাবী পরিবারের মৌলানা ওয়ালি রহমানির স্বপ্নটা থেমে গিয়েছিল মাঝ পথেই। ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারের বদলে পথ চলা শুরু হয়েছিল একজন কেরানি হিসেবে। কিন্তু চোখ টানত তাঁর মহল্লার ঝুপড়ি ঘরের মেধাবি ছাত্রদের বাঁচার লড়াই। সেই থেকে শুরু এক আন্দোলন।

‘রহমানি ৩০’-র সঙ্গে মৌলানা ওয়ালি রহমানি

বিহারের প্রত্যন্ত এলাকায় এক সংখ্যালঘু যুবকের নতুন কিছু করে দেখানোর ভাবনাকে স্বাগত জানায়নি তথাকথিত সমাজপতিরা। তাই চেষ্টাটা একসময় বদলে যায় আন্দোলনে। ২০০৮ সালে গুটিকয়েক ছাত্রকে নিয়ে শুরু হয় রহমানির কোচিং সেন্টার। পরে নাম হয় ‘রহমানি ৩০।’ মেডিক্যাল, আইআইটি, চাটার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট, সিএস, আইনের প্রবেশিকা পরীক্ষার জন্য পড়ুয়াদের তৈরি করতে জনা কয়েক শিক্ষক আর মেধাবি ৩০ জন পড়ুয়াকে নিয়ে শুরু হয় ওয়ালি রহমানির নতুন লড়াই। সাফল্য শুরুতেই আসেনি। সেই নিয়ে অনেক হাস্য কৌতুকও সইতে হয় ওয়ালিকে। তবে পরিবর্তনটা আসে বছর ঘুরতেই। একে একে আইআইটি, জয়েন্ট এন্ট্রাসে ক্র্যাক করা শুরু করে তাঁর কোচিং সেন্টারের পড়ুয়ারা। নাম ছড়াতে শুরু করে চতুর্দিকে। খুপড়ি ঘরের কোচিং সেন্টার এখন এক নামী প্রতিষ্ঠান। রাজ্যে রাজ্যে তার শাখা।

ওয়ালি রহমানির স্বপ্নের উড়ান এখন গোটা দেশেই

‘রহমানি ৩০’-র নাম এখন ‘রহমানি প্রোগ্রাম অব এক্সিলেন্স।’ এই প্রতিষ্ঠানের সিইও ফাহাদ রহমানি বলেছেন,  ‘‘২০০৮ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত মোট ২১৭ জন ছাত্রকে আইআইটি-তে পাঠিয়েছি। এই বছরে মোট ১৩৭ জন আমার কোচিং সেন্টার থেকে জয়েন্ট এন্ট্রাস পাস করেছে। হায়দরাবাদ, ঔরঙ্গাবাদ, চেন্নাই, বেঙ্গালুরুতে সাফল্যের হার ৭৫ শতাংশ। পটনাতে ১০০ শতাংশ।’’

এই প্রতিষ্ঠান বর্তমানে অঞ্জুমান-ই-ইসলাম নামে একটি অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করে। আর্থিক ভাবে সাহায্য করে মেমন চেম্বার অব কমার্স। ফাহাদ জানিয়েছেন, বর্তমানে অঞ্জুমান-ই-ইসলামের কিছু আর্থিক সমস্যার কারণে মুম্বইয়ের শাখাটি ঔরঙ্গাবাদে স্থানান্তরিত করা হয়েছে। ঔরঙ্গাবাদের শাখা থেকে এ বছরই ১৭ জন ছাত্র জয়েন্ট এন্ট্রাসে দুরন্ত র‍্যাঙ্ক করেছে। ওয়ালি রহমানির কথায়, ‘‘জাত, ধর্ম দেখে মেধা বিচার করা যায় না। আমাকে যে লড়াইটা করতে হয়েছে, সেটা যাতে আর পাঁচ জনকে না করতে হয় সেই চেষ্টাই করছি। গোটা দেশ থেকেই ভালো শিক্ষকদের বেছে নিয়োগ করা হয়। ছাত্রদের নিয়ে ওয়ার্কশপ চলে। আমার ছাত্রেরা আজ জীবনে প্রতিষ্ঠিত। দেশ-বিদেশের নামী সংস্থায় কর্মরত। আমার আন্দোলন সফল হয়েছে।’’

নকশাল নেতা থেকে পদার্থ বিদ্যার শিক্ষক—কুণ্ডু স্যর বসিরহাটের ‘অ্যালবার্ট আইনস্টাইন’

টাকি রোড ধরে ফাল্গুনি সিনেমা হলের ঠিক বিপরীতেই দোতলা একটা বাড়ি। এলাকার লোকজনকে কুণ্ডু স্যরের কোচিং বললেই দেখিয়ে দেবে প্রিয় কেক সেন্টার এবং জয়দেবের হোটেলের পাশের বাড়িটিকে। ভিতরে ঢুকলেই দেখা মিলবে ৭১ বছরের সুভাষ চন্দ্র কুণ্ডুর। মাদুরের উপর বসে বই হাতে ছাত্রদের পড়া ধরছেন। তাঁকে ঘিরে গোটা চার-পাঁচ আলমারি। পদার্ত বিদ্যার নানা বইতে ঠাসা। এখনও নিয়মিত বইয়ের খুদে খুদে অক্ষর নাগাড়ে পড়ে যেতে পারেন কুণ্ডু স্যর। বাড়িতে রয়েছে ল্যাবোরেটরিও। মোটামুটি একটা ছোটখাটো স্কুল বলা যেতে পারে তাঁর বাড়ি থুড়ি কোচিং সেন্টারটিকে।

ছাত্রদের সঙ্গে সুভাষ চন্দ্র কুণ্ডু

১৯৮৮ সালে যখন এই কোচিং সেন্টার তৈরি হয় তখন ছিল হাতে গোনা কয়েকজন ছাত্র। কুণ্ডু স্যর বলেন, ‘‘এখানে বেশিরভাগই দুঃস্থ পরিবারের ছেলেমেয়েরা আসে। সেন্ট জেভিয়ার্স বা আইআইটি-তে পড়ার স্বপ্ন যাদের কাছে অধরা, তাদের জন্যই আমার এই ক্লাস।’’ সুভাষ বাবুর কথায়, ‘‘বসিরহাট হাই স্কুলে যখন শিক্ষকতা করতাম, তখন থেকেই ছাত্র পড়াতাম। এক পয়সাও নিই নি। পেনশনের টাকাতেই আমার দিব্যি চলে যায়। পুরো সময়টাই ছাত্রদের তৈরি করাতে চলে যায়।’’

সক্রিয় রাজনীতি করেছেন, জেল খেটেছেন ছাত্রদের এই প্রিয় বিজ্ঞান শিক্ষক

রাজাবাজার সায়েন্স কলেজে এমএসসি করার সময় থেকেই রাজনীতিতে হাতেখড়ি। বসিরহাট কলেজে পড়ানোর সময়ে ১৯৬৮-৭১ সাল পর্যন্ত সক্রিয় ভাবে রাজনীতি করেছেন। এক সময় নকশাল আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বলেছেন, ‘‘১৯৭৪ সালে দমদম সেন্ট্রাল জেল থেকে বেরনোর পরেই আমার জীবনের লক্ষ্য বদলে যায়। নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করি। অভাবী ছাত্রদের বিজ্ঞানের শিক্ষা দেবো বলে মনস্থ করি।’’ একবার সেরিব্রাল স্ট্রোকও হয়ে গেছে সুভাষ বাবুর। তবে পড়ানো ছাড়েননি। ২০১৮ সালে তাঁকে Dr Mrs N.B. O’Brien Memorial Lifetime Achievement অ্যাওয়ার্ড দেয় টেলিগ্রাফ স্কুল অব এক্সিলেন্স।

ছাত্রদের কাছে তিনি ভগবানের মতো। অনেকেই বলেছেন, কুণ্ডু স্যর ছাড়া বিজ্ঞান ভাবাই যায় না।

চৈতালী চক্রবর্তী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.