স্বৈরতান্ত্রিক নেতৃত্বে এ রাজ্যে প্রশাসন সন্ত্রস্ত

পশ্চিমবঙ্গ এখন একটি শিল্প-শ্মশানের নাম। সাধারণভাবে সারা ভারতেই একটা মন্দার বাজার বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের অভাবের অন্যতম কারণ হলেও এ রাজ্যে আইনশৃঙ্খলাজনিত অরাজকতাই সবচেয়ে বড়ো কারণ। তোলাবাজ আর দুষ্কৃতীদের দাপট এখন এমন একটা জায়গায় পৌঁছেছে যে ঢাকঢোল পিটিয়ে এবং কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে শিল্প সম্মেলন করে— ব্যয়ের সমতুল্য বিনিয়োগও আসছে না।
অ্যারিস্টটল তাঁর ‘The Politics’ গ্রন্থে বিভিন্ন প্রকারের শাসন ব্যবস্থার পর্যালোচনায়। লিখেছেন— (১) এক ব্যক্তির স্বাভাবিক শাসনব্যবস্থাটি হলো রাজতন্ত্র আর তা বিকৃত হলে সেটা স্বৈরতন্ত্র, (২) বহুজন ব্যক্তির স্বাভাবিক শাসনতন্ত্র হলো গণতন্ত্র আর সেটা বিকৃত হলে তা হলো জনতাতন্ত্র। তার বিচারে শ্রেষ্ঠ শাসনতন্ত্র হলো রাজতন্ত্র এবং নিকৃষ্টতম হলো জনতাতন্ত্র (তারমানে স্বৈরতন্ত্রের থেকেও খারাপ)। তাঁর এই শ্রেণীবিভাগ মোটামুটি মেনে নিলেও মাননির্ণয়ের সঙ্গে আধুনিক বিশেষজ্ঞরা দুটি কারণে দ্বিমত পোষণ করেন। প্রথমত, তার কালের ব্যবস্থা ছিল নগরকেন্দ্রিক এবং তাছাড়া, তিনি রাষ্ট্র ও সরকারের মধ্যে পার্থক্য করেননি।
এখন প্রশ্ন হলো, আজকের পশ্চিমবঙ্গে কী চলছে—জনতাতন্ত্রের জার্সি গায়ে স্বৈরতন্ত্র নয় কি? জনতাতন্ত্র তো বলতেই হবে, কারণ মুখ্যমন্ত্রী এবং তার দলবল নির্ঘাত জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হয়েই এসেছেন, কিন্তু তামাম জনসাধারণের বিচারে আট বছরের শাসনে জার্সির ভেতরের পরিচয়টা কী দাঁড়াল ? বিধানসভা দিয়েই শুরু করা যাক। কারণ সংবিধান মোতাবেক রাজ্যের উচচতম গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান এটি। স্মরণে থাকতে পারে ক্ষমতায় এসে ‘মা-মাটি-মানুষের বা পরিচয় ভেদে ‘পরিবর্তনের সরকারের প্রধান সেই বিধানসভায় দাঁড়িয়ে বিরোধী সদস্যদের একটি মূল্যবান উপদেশ দিয়েছিলেন— “আপনারা, দশটি বছর ঠোটে লিউকোপ্লাস্ট লাগিয়ে চুপটি করে বসে থাকুন।” এই নির্দেশ অমান্য করার ধৃষ্টতা যাঁরা দেখিয়েছেন তারা হেডদিদিমণির কড়া ধমক এবং সাঙ্গোপাঙ্গদের টিটকারির শিকার হয়েছেন। আর শাসকদলের বিধায়করা, মন্ত্রীসভার সদস্যগণ এবং এমনকী জেলাপরিষদ, পৌরসভা, পঞ্চায়েত সমিতি মায় গ্রাম পঞ্চায়েতের নির্বাচিত সদস্যরাও তো তারই মর্জি, থুড়ি অনুপ্রেণায় চলতে বাধ্য হচ্ছেন। ‘দিদিকে বলো চালু হয়েছে তো সেই কারণেই।
এই তো তার নিজের দলের কিসসা। কেমন এই দল?নীতি-আদর্শ-লক্ষ্য সবকিছু একটিমাত্র ঠোঙায় পুরে তিনি দলটাকে বাজারে ছেড়েছিলেন— ঠোঙায় লেখা ছিল ‘সিপিএম। তথা বামফ্রন্টকে ক্ষমতাচ্যুত করো। ইতিহাস ও রাজনীতির পরিচিত অধ্যাপকদের প্রশ্ন করে জানা গেল এমন একনিষ্ঠ লক্ষ্যে ভারতবর্ষে কোনও রাজনৈতিক দল গঠিত হয়নি। কারণ কংগ্রেস দিয়ে শুরু করে সব দলই নানান গুরুগম্ভীর কথা বলে খাতা খুলেছিল, তা পরে যত গেজিয়েই যাক। এখন একমাত্র পুরোহিতই ঠিক করবেন বলি দেওয়ার সময় শুরু করবেন কোনদিক থেকে ল্যাজা না মুড়ো?
আমাদের উর্বর দেশে হাজার হাজার এমন রাজনৈতিক দল আছে যাদের উদয়-অস্তের খবর তেমন গুরুত্ব পায় না। কিন্তু তেমন একটি দল যদি একবার কংগ্রেসকে সঙ্গে নিয়ে এবং দ্বিতীয়বার একা একাই রাজ্যের সিংহাসনে বসে, তাদের তো আর এলেবেলে বলা যায় না। তবে যত জবরদস্তই হোক, সরকার বলতে তো শুধু দলটাকেই বোঝায় না সে যতই শাসনক্ষমতা কবজা করার সুবাদে সরকারি নীতি প্রণয়ন করুক না। সরকারের ক্ষমতায় পরতে পরতে রয়েছেন নানান পরিচয়ের লোকলশকর— যাঁরা কেউই জনগণের রায়ে আসরে অবতীর্ণ হননি আবার সকলেই জনগণেরই অর্থে প্রতিপালিত— মুখ্যসচিব থেকে শুরু করে থানার কনস্টেবল। বইপত্তর পত্রপত্রিকায় পাওয়া যায় যে এঁরা সকলেই আইনকানুনের দ্বারা লিপিবদ্ধ প্রথায় কাজ করার জন্যই মাস গেলে মাইনে পান। কিন্তু এই পোড়া রাজ্যে আসলে কী হচ্ছে দেখা যাক।
শরীরে, মনে এবং পরিচয়ে বিধানচন্দ্র রায় এক বিরাট মানুষ ছিলেন। তিনি ঘনিষ্ঠ কয়েকজন অফিসারকে ‘তুমি’ সম্বোধনে কথা বলতেন— আবার শোনা যায় কেউ আপত্তি করলে সংশোধন করে নিতেন। সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় শারীরিক দৈর্ঘ্যে এবং পরিচয়ে তার কাছাকাছি হলেও সামগ্রিক বিচারে হয়তো অতটা বিরাট ছিলেন না। তিনিও মুষ্ঠিমেয় ঘনিষ্ঠ কয়েকজনকেই মাত্র ‘তুমি’ সম্বোধন করতেন। আপাতদৃষ্টিতে জ্যোতিবাবু রাশভারী মানুষ হলেও কাউকে তুমি বলা দূরে থাক—সবকথাই ভাববাচ্যে এবং অসম্পূর্ণ বাক্যে সেরে নিতেন। তবে সহকর্মীদের নাড়িনক্ষত্র তার নখদর্পণে থাকলেও তাদের ভালো করে না চেনার একটা ভান তিনি করতেন। এ সম্পর্কে তার সচিবালয়ে কাজ করা আমার এক সহকর্মী বন্ধুর কাছে এমন একটি ঘটনা শুনেছি। এক সচিব সকালে একটা ফাইল নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর ঘরে গিয়েছিলেন এবং তিনি বলেছিলেন ফাইলটা বিকেলে ফেরত নিয়ে যেতে। বিকেলে ফাইলের খোঁজে সচিব তাঁর ঘরে গেলে জ্যোতিবাবু স্বভাবসিদ্ধ অসম্পূর্ণ বাক্যে জানালেন— ওটা তো ও নিয়ে গেল। ও-টা কে জানতে চাইলে উত্তর পেলেন ‘ওই যে কালো মতো ছেলেটি এখানে আসে। ঘর। থেকে বেরিয়ে সচিবালয়ে খোঁজ করে জানা গেল ফাইলটি মুখ্যমন্ত্রী দিয়েছেন মুখ্যসচিব এন কৃষ্ণমূর্তিকে। আর বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তো ছিলেন। পরিপাটি মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক। অথচ বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী কাউকে ‘আপনি’ সম্বোধন করলেই সাংবাদিকরা তা প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করে থাকেন। আর এখন তো দূরদর্শনের বিভিন্ন চ্যানেলের মহিমায় (নাকি বাধ্যবাধকতায়?) এলাহি সব প্রশাসনিক সভার মোড় কে মুখ্যমন্ত্রীর। রাজনৈতিক প্রচারে দেখতে পাই ‘তুমি’ সম্প্রদায়ের বাঘা অফিসার, নেতা-মন্ত্রীরা কেমন খাতাপত্তর হাতে নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে ধরাপড়ার জবাবে কাচুমাচু ভঙ্গিতে কাঁপছেন। সেদিন তো সংবাদপত্রেই দেখলাম উর্দিপরা আইজিপি মুখ্যমন্ত্রীর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করছেন।
এখন অবস্থাটা কিন্তু অশ্রুতপূর্ব এবং এতাবৎ অকল্পনীয়। তৃণমূল কংগ্রেস দলের সদস্যদের না হয় ছেড়েই দিলাম, কারণ ওটা তো আর দল নয় যে গণতান্ত্রিক ভাবে দলীয় সিদ্ধান্ত হবে— ওখানে ‘সুপ্রিমোই সব কিছু। কাজেই হাতে মাথা নিতে আর কতক্ষণ? ‘ল্যাম্পপোস্ট’ পরিচয়টা তো গোড়াতেই জানা গেছে— এই কদিন আগে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের মতো ভারিক্কি নেতাও বললেন, তিনিও নাকি বৃক্ষগাত্রে লতাসদৃশ। কিন্তু আমজনতার প্রশ্ন হলো হোমরাচোমরা রাজপ্রভুরা তো আর চাকরি বা বেতনের জন্যে তার ওপর নির্ভরশীল নন—তাঁদের এমন দীনদরিদ্র হাল কেন? রাজ্য সরকারের প্রশাসনিক পদে কাজ করার অভিজ্ঞতায় দেখেছি— নিয়মতান্ত্রিক ঠ্যাটা অফিসারকে সরিয়ে ঘাড় নাভাকে দিয়ে কাজ হাসিল করার বামফ্রন্টীয় অস্ত্র ছিল বদলি কারণ বদলির ব্যাপারে আদালতেরও করণীয় কিছু নেই। কিন্তু অপছন্দের অফিসারকে শায়েস্তা করার ফন্দিটা চালু ছিল না।
বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীই এটির আবিষ্কর্তা। নবান্নের অফিসারকে পাঠানো হলো মেখলিগঞ্জে—যিনি কিনা সদ্য পুরুলিয়া থেকে এসেছেন। হোমরাচোমরাও যে আজকাল মসৃণ ভঙ্গিতে ঘাড় নাড়েন, তা ওই বদলির ভয়ে সবই তো‘রুটিনমাফিক। এ প্রসঙ্গে সেদিন একতরুণ অফিসার কৌতুকের ভঙ্গিতে বলছিলেন— মুখ্যসচিবকেবিডিও-র পদে বদলি করলে তিনি কী করবেন? CAT, High Court, Division Bench, Supreme Court পর্যায়ক্রমে সর্বত্রই তাঁর জয় অবশ্যম্ভাবী কিন্তু অফিসহীন, বেতনহীন, সাথীহারা অফিসার উপহাসের পাত্র হয়ে কতদিন লড়াই করবেন? কিন্তু ঘাড় নাড়া ব্যাপারটায় এত ঝামেলা নেই। দু’একজন করিতকর্মা কর্মচারী অবশ্য এমন আজগুবি বদলির পর আদালতে সফল হয়েছেন কিন্তু তাঁদের পিছনে কর্মীসংগঠনের সাহায্য ছিল বলেই তা সম্ভব হয়েছে, ওপরতলায় সেটা অনুপস্থিত।
বদলির চেয়েও ভয়ংকর ‘Compulsory waiting’— এই কলে পড়লে মহাবিপদ। অফিস নেই, বেতন হবে বিশেষ নির্দেশে এবং সেই নির্দেশ বলে পে-বিল করানো এবং তার বলে মাইনে পাওয়া অনেক লম্ফঝম্ফের ব্যাপার। বামফ্রন্ট আমলেও প্রথাটা ছিল। কিন্তু সেটা সম্পূর্ণ প্রশাসনিক একটা সাময়িক বন্দোবস্ত যার সঙ্গে রাজনৈতিক প্রভুদের কোনও সংস্ৰবই ছিল না। কিন্তু বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী এই কলটিকে প্রতিহিংসার ঘানি হিসেবেই ব্যবহার করছেন বেয়াড়া বেয়াদব অফিসারদের তেল বের করার উদ্দেশ্যে। এখন তাই প্রশাসনিক ব্যাপারে পরিচিত অফিসারদের সঙ্গে কোনো আলোচনা শুরু করতে গেলে তারা না শোনার ভান করে ধোনির ভবিষ্যৎ ইত্যাদি প্রসঙ্গে চলে যান।
সংবাদমাধ্যমের আলোচনায় এবং বিশেষ করে বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের কথাবার্তায় প্রায়ই যে কথাটা শোনা যায় তাহলো রাজ্যে প্রশাসন বলে কিছু আর অবশিষ্ট নেই। কথাটা কতখানি সত্যি সেটাতো রাজ্যবাসী পদে পদে দেখতে পাচ্ছেন। শীর্ষ আমলা থেকে হরিপদ কেরানি, ডিজিপি থেকে থানার বড়োবাবু, উপাচার্য থেকে সাধারণ শিক্ষক, স্বাস্থ্য অধিকর্তা থেকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের স্বাস্থ্যকর্মী কাউকেই যদি বিধিনির্দিষ্ট কাজকর্ম করতে না দিয়ে সরকারের প্রধান থেকে শুরু করে ‘অনুপ্রাণিত শাসকদলের নেতা-কর্মীরা দাদাগিরি করেন, তাহলে প্রশাসন তার স্বাভাবিক গতিতে চলবে কী করে? সামনে আবার পুরসভা এবং তার পিছনেই বিধানসভার নির্বাচন। বর্তমান সরকারের যা রাজনৈতিক কাঠামো, তাতে অবস্থার উন্নতির সম্ভাবনা আছে বলে মনে হয় না। হয়তো ভবিষ্যতের কোনও সরকার এমন রাজনৈতিক দখলদারি পরিহার করে স্বচ্ছ, সুন্দর, স্বাভাবিক প্রশাসনিক ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনবে এমন আশা করা ছাড়া রাজ্যবাসীর কীই বা করার আছে?
বলাইচন্দ্র চক্রবর্তী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.