অলিম্পিকের ভিক্ট্রি ল্যাপে দাঁড়িয়ে পুরস্কার নিচ্ছেন উসেইন বোল্ট। প্রথম স্থান অধিকার করেছেন তিনি। সারা বিশ্বের অভিনন্দন বর্ষিত হচ্ছে তাঁর উপর। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় স্থানাধিকারী প্রতিযোগীরাও করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। এমন সময় দেখা গেল যিনি সকলের শেষে দৌড় শেষ করেছেন সেই প্রতিযোগী তাঁর ক্ষোভ উগড়ে দিয়ে বলছেন উসেইন বোল্ট দুর্নীতির সাহায্য নিয়ে প্রতিযোগিতা জিতেছেন। সর্বশেষ স্থানাধিকারী প্রতিযোগীর সাথে অলিম্পিক সংস্থা বঞ্চনা করেছে। এতদূর পড়ে নিশ্চয়ই ভাবছেন এমনটা হওয়া কি সম্ভব? নিশ্চয়ই এই প্রতিযোগীর কথাগুলি আপনাদের হাসির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এরকমই কিছু হাস্যকর অভিযোগ উঠছে ইভিএম মেশিনে ভোট গ্রহণকে কেন্দ্র করে। বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে লোকসভা নির্বাচনে ইভিএম গরমিলের মাধ্যমে তারা বিপুল ভোটে জয়ী হওয়ার চেষ্টা করছে। বর্তমান সময়ে আপ নেতা অরবিন্দ কেজরিয়াল এবং বিএসপি নেত্রী মায়াবতী, এমনকি কংগ্রেসও বারবার এই ধরনের অভিযোগ এনে হাসির পাত্র হয়েছেন। এখন দেখা যাক ইভিএম-এর গঠন কৌশলটি ঠিক কী, এবং তাতে আদৌ কোনও রকম বিকৃতি ঘটানো সম্ভব কিনা।
ইভিএম মেশিনে থাকে দুটি ইউনিট সিইউ এবং বিইউ । সিইউ হল কন্ট্রোল ইউনিট আর বিইউ ব্যালট ইউনিট। বিইউ নির্দিষ্ট বোতামে ভোট গ্রহণ করে আর সিউ গৃহীত ভোট জমা করে ও গণনার কাজে ব্যবহার হয়। দুটি ইউনিট পাঁচ মিটার লম্বা একটি তার দ্বারা যুক্ত থাকে। রিড ওনলি সিলিকন চিপে সংরক্ষিত অপারেটিং সিস্টেম পরিবর্তন করা অসম্ভব। যিনি সিস্টেম তৈরি করেছেন তাঁর পক্ষেও একবার তৈরি করে ফেলার পর আর পরিবর্তন করা অসম্ভব হয়ে পড়ে । সর্বোত্তম প্রযুক্তি ব্যবহার করেও ইভিএম-এর প্রোগ্রাম পরিবর্তন করা অসম্ভব। ইভিএম-কে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে যে ছয় ভোল্টের অ্যালকাইন ব্যাটারি তার নির্মাণ করে ভারত ইলেকট্রনিক্স বেঙ্গালুরু এবং ইলেকট্রনিক্স কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া হায়দ্রাবাদ। এই দুটি সংস্থাই বহু পুরনো ও বিশ্বস্ত।
টেকনিক্যাল যে কারণগুলোর জন্য ইভিএম কখনোই হ্যাক হতে পারে না, সেগুলি হল— ইভিএম ইন্টারনেটের সাথে যুক্ত থাকে না তাই হ্যাক হওয়া কোনোমতেই সম্ভব নয়। একজন আমেরিকান ‘ইন্ডিয়ান ইভিএম’ হ্যাক করেছেন, এটিও ভিত্তিহীন একটি প্রচার । কারণ ইভিএম-এর পার্টস পরিবর্তন না করে ইভিএম হ্যাক করা যায় না। এইভাবে ব্যাপক হারে পার্টস পরিবর্তন করে ইভিএম হ্যাক করা অসম্ভব কারণ তা স্ট্রং রুমে কড়া পাহারায় থাকে এবং সেখানে সমস্ত দলের প্রতিনিধিরাই উপস্থিত থাকেন। ইভিএম কোনোরকম ব্লু-টুথ বা ওয়াই-ফাই-এর সংকেতও গ্রহণ করতে পারে না। এ ছাড়াও ডেপ্লয়মেন্টের পূর্বে যন্ত্রের সাফলিং-ও হয় একাধিক বার। তাই কোন ইভিএম কোথায় ব্যবহার হবে তা কেউই জানেন না। অতএব, বলা যায় ইভিএম হ্যাক হওয়ার অভিযোগ একদমই ভিত্তিহীন।
ব্যালট পেপারে ভোট গ্রহণের ক্ষেত্রে বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা থাকে যা ইভিএম-এ নেই। একটি ইভিএম একটানা ৩৮৪০ টি ভোট গ্রহণ করতে পারে এবং তাও একসঙ্গে ৬৪ জন প্রার্থীর জন্য। যেখানে একটি সাধারণ মাপের ব্যালট পেপারে মাত্র ১৬ জন প্রার্থীর জন্য জায়গা বরাদ্দ থাকে। যার মধ্যে মাত্র ৪ জন সমান্তরালভাবে এক সারিতে থাকবে। তাই একমাত্র ৬৪ জনের বেশি প্রার্থী থাকলেই ব্যালট বক্স ব্যবহার করা জেতে পারে, তাও বিশাল মাপের কাগজে। ইভিএম-এর একটি বোতাম বারবার টিপে একই প্রার্থীকে বারবার ভোট দেওয়া যায় না। যেখানে ব্যালট পেপারের ক্ষেত্রে সহজেই বারবার ছাপ্পা মারা যেতে পারে। কোনও ইভিএম প্রি প্রোগ্রামড হতে পারে না। হলে নির্মাণকারী সংস্থাকে নির্বাচন কমিশনের কাছে জবাবদিহি করতে হবে ও আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ভারতের নির্বাচন কমিশন একটি স্বচ্ছ ও স্বশাসিত সংস্থা। তাই তাদের প্রভাবিত হওয়ার কোনও প্রশ্নই ওঠে না।
পূর্ব অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে ব্যালট পেপারে ভোট গ্রহণের পথও মসৃণ ছিল না। পেপারে ভোট গ্রহণের দিনগুলিতে ব্যালট বক্স ছিনতাই হতে দেখা গেছে বহুবার। বুথ দখল করে একের পর এক ছাপ্পা ভোট করার ঘটনা তো ছিল হামেশাই। উত্তরপ্রদেশে প্রায় সাড়ে তিন কোটি পর্যন্ত ছাপ্পা ভোট পড়তেও দেখা গেছে এক সময়ে। এই দুর্নীতি রুখতেই ১৯৯৮ সাল থেকে ইভিএম-এ ভোট গ্রহণের সিদ্ধান্ত কার্যকারী হয়। ১৯৯৮ সালে প্রথম ১৬টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে মেশিনে ভোট গৃহীত হয়। এরপর ১৯৯৯ তে সাধারণ নির্বাচনে ব্যাপকভাবে মেশিনে ভোট গ্রহণ চালু হয়ে যায়। এটি সম্ভব হয় জেমস মাইকেল লিংডোর একান্ত সহযোগিতায়। আর এই ক্ষেত্রে তাঁর মেন্টর ছিলেন টিএন সেশান। সেশান নির্বাচন কমিশনকে সমস্ত প্রভাবমুক্ত করে স্বশাসিত সংস্থায় পরিণত হতে সাহায্য করেন। ২০১৭ তে ভিভি-প্যাটে ভোট গ্রহণ শুরু হয় ৫টি বিধান সভা কেন্দ্রে বিধায়ক নির্বাচনের মাধ্যমে।
প্রযুক্তিগত ভাবে ইভিএম বিকৃতি যে অসম্ভব তা আগেই বলা হয়েছে। তবু ভাবতে অবাক লাগে যখন দেখা যায় কিছু শিক্ষিত ব্যক্তিও এই বিষয়ে একই মত পোষণ করছেন। এই অভিযোগকে কেন্দ্র করে নির্বাচন কমিশন হ্যাকথন প্রোগ্রাম নামে একটি উদ্যোগ গ্রহণ করে। এতে সর্ব সাধারণ এবং সমস্ত দলের প্রতিনিধিদের আহ্বান জানানো হয় এবং যে কোনও রকম প্রযুক্তি ব্যবহার করে মেশিন হ্যাক করে দেখাতে বলা হয়। এই প্রোগ্রামে একটি দলের প্রতিনিধিও সাহস করে শামিল হতে পারেননি। অজুহাত হিসেবে বলা হয় নির্বাচন কমিশন সঠিক সফটওয়্যার ও ইভিএম দেয়নি।
কংগ্রেস ও মায়াবতীর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ২০১৭ সালে পাঞ্জাবে কংগ্রেস জেতে, মনিপুর এবং গোয়াতেও কংগ্রেসের জিত হয়— তাহলে সেক্ষেত্রেও ইভিএম-এ রিগিং হয়েছিল বলে ধরে নিতে হয়। বাংলা, বিহারের ক্ষেত্রেও একই কথা বলা যায়। অন্যদিকে উত্তর প্রদেশে ব্যালটে ভোট হয় এবং প্রবল বিজেপি হাওয়া থাকা সত্ত্বেও মায়াবতীর দল আসন পায়, তাহলে এই ঘটনাকেই বা আমরা কিভাবে বিচার করব?
ইভিএম বিকৃতি নিয়ে ওঠা অভিযোগের প্রসঙ্গে দুঃখ প্রকাশ করে মুখ্য নির্বাচনী আধিকারিক সুনীল অরোরা বলেছেন— কিছু কিছু পার্টি নেতৃত্ব ইভিএম থেকে আস্থা হারিয়ে ব্যালটে ফিরে যেতে চাইছেন, এটি অত্যন্ত দুঃখজনক একটি ঘটনা এবং একেবারেই কাম্য নয়। ২০১৪ থেকে ব্যাপক হারে ইভিএম-এ ভোট গ্রহণ এবং ২০১৭ থেকে ভিভি-প্যাট চালু হাওয়া সত্ত্বেও জনমানসে প্রচুর ভ্রান্ত ধারনা থেকে গেছে, যা একেবারেই কাম্য নয়। এই বিষয়ে আরও বেশি করে সচেতন হতে হবে। ইভিএম নিয়ে নানা অভিযোগের মাঝেও মধ্যপ্রদেশ, ত্রিপুরা, মিজোরামে ভোট হয়েছে এবং ভিন্ন ভিন্ন ফলাফলও দেখা গেছে, ইভিএম-এ গণ্ডগোল থাকলে তা সম্ভব হত কি? নির্বাচন কমিশনের প্রযুক্তি বিষয়ক উচ্চ পদাধিকারী রজত মুনার মত হল— বিরোধীদের চাপে ব্যালট সিস্টেমে ফিরে যাওয়া যুক্তিহীন, কারণ প্রযুক্তিগতভাবে এই দুর্নীতি অসম্ভব। বরং ইভিএম দুর্নীতি মোকাবিলায় সক্ষম। টেকনোলজি এগিয়েছে তাই আমাদের উচিত তাকে স্বাগত জানানো। সমগ্র বিশ্বে আমাদের দেশের ইভিএম-এ ভোট গ্রহণ ব্যবস্থা সম্মানিত হয়েছে। মুষ্টিমেয় মানুষের স্বার্থজনিত অভিযোগের ভিত্তিতে ইভিএম-এ ভোট গ্রহণের সুবিধা ও স্বচ্ছতার বিষয়ে প্রশ্ন তোলা বোকামি ছাড়া কিছুই না।