পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনে রিগিং বা ইভিএম মেশিনের ব্যবহার নিয়ে নানা রকম আশঙ্কা করা কোনও নতুন ঘটনা নয়। এসব পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনী সংস্কৃতির একটা অঙ্গ হয়ে গিয়েছে এবং প্রত্যেকটি নির্বাচনেই পশ্চিমবঙ্গে এই সংস্কৃতি অটুট থাকে।
রাজ্য রাজনীতিতে হিংসার একটা কাঠামোগত চরিত্র কি তৈরি হয়েছে? -এই সব প্রশ্ন তো বারবার বিভিন্ন বিশ্লেষণে উঠে আসে। নির্বাচনী রাজনীতিতে হিংসার যেন একটা স্থায়ী উপাদান তৈরি হয়েছে। সেই যে ১৯৭২ সালের বিধানসভা নির্বাচনে ব্যপক রিগিং, ছাপ্পা এবং হিংসা দেখা দিয়েছিল, তার প্রয়োগের একটা ধারাবাহিকতা কী করে যে অক্ষুণ্ণ থেকেছে! কেন যে বাঙালি এই হিংসা এবং নির্বাচনী রাজনীতির হিংসাত্মক কার্যকলাপ থেকে বেরোতে পারছে না, সেটাই হচ্ছে সব থেকে প্রধান সমস্যা!
২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে ভোটের আবহটা তৈরি হয়েছিল ২০১৮-এর হিংসাত্মক একটা রক্তক্ষয়ী পঞ্চায়েত নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে। এই পঞ্চায়েত নির্বাচনে ৩৪ শতাংশ আসনে শাসক দলের কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে বিরোধীদের সমস্যা হয়েছিল এবং বিরোধীরা অভিযোগ করেছিল যে, বিরোধীরা প্রার্থী দিতে পারেনি। ২০১৮-র পঞ্চায়েত নির্বাচনে মনোনয়ন পত্র জমা দেওয়া থেকে শুরু করে বোর্ড গঠন, প্রত্যেকটা স্তরে হিংসা ও হানাহানি, রক্তক্ষয় –এগুলো দেশের মানুষ দেখেছিল।
নির্বাচন শুরু হওয়ার পর থেকে বোর্ড গঠন পর্যন্ত প্রায় ১০০ জন মারা গিয়েছিল। রাজ্যে অতীতের ভোট এবং তার পাশাপাশি ২০১৮-এর পঞ্চায়েত নির্বাচনে কিন্তু একটা মারাত্মক রক্তক্ষয়ী মাত্রা যোগ হয়েছিল, যেখানে বিরোধীরা বুথে কেন্দ্রীয় বাহিনী রেখে নির্বাচন পরিচালনা করার আর্জি জানিয়েছিল নির্বাচন কমিশনের কাছে। সেই দাবীর ভিত্তিতেই ২০১৯ সালের পর এখন ২০২১ সালেও সেই একইভাবে নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে আধা সামরিক বাহিনী প্রয়োগ করা হচ্ছে।
নির্বাচন কমিশনের কাছে চ্যালেঞ্জ ছিল যে, শান্তিপূর্ণভাবে ভোট করতে হবে। পূর্বের অভিজ্ঞতা কেমন ছিল? সেখানে প্রশাসনের একটা তীব্র রাজনীতিকরণ ছিল, যা বাম আমলে আরও তীব্র আকার নিয়েছিল। তার ফলে ভোটের সময় নানা সমস্যা দেখা দিত। এখন তৃণমূল আমলে দল এবং সরকারের মধ্যেও যে তফাত দেখতে পাওয়া যায়, সেটা সিপিএম জমানাতেও ছিল না এবং তৃণমূল জমানাতেও সরকার এবং দল কার্যত একইরকম ভূমিকায় অবতীর্ণ হত।
এই একত্রিত হয়ে যাওয়ায় অনেকসময় ভোটের সময় অসুবিধা হয়। ভোটের কাজে কেন্দ্রীয় বাহিনীকে এনে পুলিশ তাদেরকে বসিয়ে রাখছে। -এই অভিযোগ ২০১৯ সালেও বিজেপি করেছিল। এইবারে যাতে তাদের বসিয়ে না রাখে, তার জন্য তাদেরকে আগাম পাঠানো হয়েছে, ফ্ল্যাগমার্চ হচ্ছে। অতীতে বিশেষ পর্যবেক্ষক থেকে, মাইক্রো অবজার্ভারদের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছিল। এবারে সেখানেও নির্বাচন কমিশন গুরুত্ব দিয়ে দেখছে যাতে সেটা না হয়।
ওয়েব ক্যাম্প থেকে বুথের বাইরে ‘কুইক রিয়েকশন টিম’-এর কার্যকারিতা নিয়েও অতীতে প্রশ্ন উঠেছিল। এখন এই নির্বাচনেও এইসব অভিযোগগুলো কিন্তু বিজেপি তুলছে। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে পাঁচ দফায় ব্যাপক হিংসা হয়েছিল, ২০১৬-র বিধানসভা নির্বাচনেও তা হয়েছিল, ২০১৮-র পঞ্চায়েত নির্বাচনেও হয়েছিল। সেই করণে এবারে আট দফায় ভোট হচ্ছে, যাতে কোনওরকম ভাবেই ভোটে রিগিং না হতে পারে।