“সব খেলার সেরা বাঙ্গালীর তুমি ফুটবল… “। সেই ফুটবলের আবেগ শুরু ১৯১১ সালে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে খালি পায়ে ফুটবল খেলে মোহনবাগানের উৎপত্তি দিয়ে। তারপর ১৯২০ সাল, শৈলেশ বসু সব পূর্ববঙ্গের ফুটবলারকে এক করবেন বলে ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের জন্ম দিলেন। সেখানে কিন্তু কেবল ফুটবল ই ছিল। ঘটি বাঙাল লড়াই ছিল। কিন্তু দেশদ্রাহিতা ছিলনা।

তারপর গঙ্গা আর পদ্মা দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে দেশ ভাগ, পূর্ব পাকিস্তান তৈরি , বাঙ্গালী হিন্দুর উপর অত্যাচার, উদ্বাস্তু জীবন….হিন্দু হবার অপরাধে ধর্ষণ, খুন, লাঞ্ছনা…সে এক নরকের দক্ষিণ দুয়ারের কাল বেলা ,যার এখনো অন্ত হয় নি।

এই উদ্বাস্তু বাঙ্গালী হিন্দুর এক ও একমাত্র অধিকার হল নাগরিক সংশোধনী আইন। তাঁদের বাঁচার অধিকার। সেই অধিকার যখন তাঁরা পাচ্ছেন তখন এক দল লোক কেবলমাত্র তাদের রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করবার জন্য বিভিন্ন ক্যামোফ্লেজে মানুষকে ভুল বুঝিয়ে চলেছেন। তেমনি একটি ঘটনা কাল ডার্বি-র খেলায় দেখা গেল। ফুটবলের মাঠে নিজেদের নোংরা রাজনীতিকে এনেছে এক গোষ্ঠী। এনে তারা কলুষিত করেছে কালকের মরসুমের প্রথম ডার্বি ম্যাচকে, উদ্বাস্তু হিন্দুর অধিকার কে, তাঁদের লড়াইকে এবং ফুটবল কে… অ্যামেজিং স্পাইডার-ম্যান-সিনেমার ব্ল্যাক স্পাইডার ম্যানের মতো ‘বাঁটুল দ্য গ্রেট’ ‘টিফো’-র আড়ালে এ কোন দৈত্য?

এসএফআই-এর পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সদস্য শুভজিৎ সরকার বলেন, ‘‘সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন তা আরও দৃঢ় করতে এসএফআই সমর্থকেরা এ দিনের ম্যাচে পোস্টার লিখে নিয়ে গিয়েছেন। এতে অসংখ্য দৃষ্টি আকর্ষণ করা গেল।’’

ডক্টর ব্রজেশ পাকড়াশী-কে মনে পড়ে? যিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইও অঙ্গরাজ্যে ক্লিভল্যান্ডের একজন বিখ্যাত হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ছিলেন। সময়টা 1950 সাল, তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে পাঠরত । ভয়ঙ্কর দাঙ্গা শুরু হয়েছে। প্রেসিডেন্সির ছেলেরা ঠিক করল পলায়মান উদ্বাস্তুদের সেবা শুশ্রূষা করবে।

ডক্টর পাকরাশীর সেই স্মৃতি চারণা করতে গিয়ে বলেছেন ” একদিন আমরা শিয়ালদহ স্টেশনের প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছি । প্ল্যাটফর্ম লোকে লোকারণ্য। এর মধ্যে একটা ট্রেন এসে দাঁড়ালো। সেই ট্রেন যেন নরকের পেটের ভিতর থেকে বেরিয়ে এল। পুরো ট্রেনটা অত্যাচারিত, জর্জরিত মানুষের ভিড় উপচে পড়ছে ।

এমন অবস্থা , অবিশ্বাস্য দৃশ্য , হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে এক বিশাল জনস্রোত নামছে। এক যুবতী মেয়েকে দেখে মনে হল পুরোপুরি প্রকৃতস্থ নয় । সেই মেয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে নিজের ব্লাউজ খুলে ফেলে চিৎকার করে বললো , ‘দেখেন দেখেন আমারে কি করসে….’

আমরা তাকিয়ে দেখলাম তার স্তনের উপরে আরবি ভাষায় চামড়া পুড়িয়ে কিছু লিখে দেওয়া হয়েছে।”

কলকাতা হাই কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য আশুতোষ কলেজে পড়তেন। তাঁরাও সেবার ব্রত নিয়ে সীমান্তে নদীয়া জেলা বানপুর চলে গেলেন । সেখানে তাবু গেড়ে থাকতে শুরু করলেন। ওই অঞ্চলে বহু হিন্দু সীমান্ত ছেড়ে হেঁটে হেঁটে আসছিল। তাদের বিশেষ করে মেয়েদের অবস্থা ছিল অবর্ণনীয় । অনেকে ধর্ষিতা এমনভাবে হয়েছে যে ভালো করে হাঁটতেই পারে না ।বহু মেয়ের সারা গায়ে আঁচড় কামড়ের দাগ ,গণধর্ষণের দগদগে ঘা । এক মহিলাকে তাঁরা দেখলেন, তার পেটে ছুরি মারা হয়েছে , তার আত্মীয়রা তাকে ধরে ধরে নিয়ে আসছে। তারা এদের তাঁবুতে জায়গা করে দিয়ে পালা করে বাইরের থাকতে লাগল। সীমান্তের ওপার থেকে একবার আনসাররা সীমান্ত পার হয়ে তাদের আক্রমণও করেছিল।

পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশ থেকে হিন্দু উৎখাতের ব্যাপারে সঠিক জনসংখ্যা পাওয়া সবসময়ই খুব কঠিন ব্যাপার। কারণ প্রথমত এই উৎখাত বিভিন্ন সময় পুরো সীমান্ত ধরে ঘটেছিল। এবং দ্বিতীয়, ” নেহেরু লিয়াকত “চুক্তির পরে কোন উৎখাত হচ্ছে সে কথা সরকার মানতে চায়নি। শুধু তাই নয় উৎখাত হয়ে হিন্দুরা পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও বিপুল একটা সংখ্যায় ত্রিপুরা, আসামে ঢুকে গিয়েছিল এবং সব উৎখাত হওয়া হিন্দু সরকারি সাহায্য বা পুনর্বাসন চায়নি ।

বিশেষত হিন্দুরা অথবা যাদের ভারতে সম্পন্ন আত্মীয়-স্বজন ছিলেন তারা নিজেদের ব্যবস্থা নিজেরাই করে নিতে পেরেছিলেন। সংখ্যার ব্যাপারে দুটি অমূল্য সূত্র হিরন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায় ও সমর গুহের লেখা থেকে পাই। আর একটি অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য সূত্র আমরা পেয়ে থাকি যোগেন মন্ডলের পদত্যাগ পত্রে।

শহুরে এবং আর্থিকভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত হিন্দুরা এই বিতাড়ণ প্রক্রিয়া থেকে বাদ যায়নি । যদিও তাদের ক্ষেত্রে বিশেষ করে শহরবাসী হিন্দুদের ক্ষেত্রে প্রক্রিয়াটা একটু অন্যরকম ছিল । তবে যারা চিরাচরিত বামপন্থী ছাঁচে ফেলে এই হিন্দু বিতাড়ণ প্রক্রিয়াকে অর্থনৈতিক লড়াই হিসেবে দেখবার চেষ্টা করে থাকেন, তারা অর্থনৈতিকভাবে উচ্চতম থেকে নিম্নতম পর্যন্ত সমস্ত হিন্দুর উপরে কেন ইসলাম সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসন নেমে এসেছিল তার কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারেন না ।

মুসলমান জমিদার মুসলমান রাজপুরুষ থেকে আরম্ভ করে মুসলমান চাষী ,মুসলমান ক্ষেতমজুর পর্যন্ত সবাই মিলে – হিন্দু জমিদার থেকে আরম্ভ করে হিন্দু জেলে-তাঁতী পর্যন্ত সকল কে তাড়িয়ে দিয়েছে। অর্থনৈতিক নয় ধর্ম ছিল বিতাড়ণের কারণ। একটি বৈদেশিক সাম্রাজ্যবাদী ধর্ম নির্যাতন ,ধর্ষণ, লুটপাট হত্যার চালিকাশক্তি হয়েছিল।

আজ পশ্চিমবঙ্গের ভন্ড সেকুলাররা যদি এটা জোর করে অস্বীকার করে, এমন কি বাটুল দি গ্রেট এর মত শিশুপাঠ্য সুপারহিরোকেও কালিমালিপ্ত করতে পিছপা না হয় – তবে তারা নিজেদের বিপদ নিজেরাই ডেকে আনছে। থুড়ি , আনছে কি ? বিপদ তো এখন শিয়রে এসে দাঁড়িয়েছে…..এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হবে না হিন্দু বাঙ্গালী?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.