সঙ্গীতকবি ও নাট্যকার ডি. এল. রায় যে একজন কৃষি-বিশেষজ্ঞ ছিলেন এই তথ্য হয়তো-বা আমাদের অনেকের জানা নেই। বাঙ্গলা তথা ভারতের কৃষি বিজ্ঞানী, অধ্যাপক, কৃষি আধিকারিক, কৃষি বিজ্ঞানের ছাত্র-গবেষক ও সম্প্রসারণ কর্মীদের কাছে তাঁর কৃষি নিয়ে পঠন-পাঠন ও গবেষণার তথ্য তুলে ধরতেই প্রস্তুত প্রবন্ধ।

১৯০৬ সালে প্রকাশিত হয় এই গ্রন্থ, The Crops of Bengal, প্রকাশক Messrs. Thacker, Spink & Co., পুস্তক-মূল্য ২ টাকা। বইটিতে ডি. এল. রায়ের পাশে তাঁর শিক্ষাগত যোগ্যতা ও পরিচয় হিসাবে উল্লেখ আছে — D. L. Roy, M.A., M.R.A.C., M.R.A.S.E. (London) ( Late Assistant to Director of Land Records and Agriculture, Bengal). বইটি কলকাতাতেই ছাপা হয়েছিল, মুদ্রক হিসাবে উল্লেখ রয়েছে আর. দত্ত, হেয়ার প্রেস, ৪৬, বেচু চ্যাটার্জী স্ট্রিট।

দ্বিজেন্দ্রলাল সরকারি বৃত্তি নিয়ে কৃষিবিদ্যা পড়তে গিয়েছিলেন ইংল্যান্ডের সিসিটার কলেজে। ১৮৮৪ সালের এপ্রিল মাসে গিয়ে শিক্ষা সম্পূর্ণ করে ১৮৮৬ সালের ডিসেম্বরে ফিরে আসেন। তিনি F.R.A.S. উপাধি লাভ করলেন, সেই সঙ্গে রয়্যাল এগ্রিকালচার কলেজ ও রয়্যাল এগ্রিকালচার সোসাইটি, লন্ডনের সভ্য নির্বাচিত হয়ে লাভ করলেন  M.R.A.C. এবং M.R.S.A.E. বিলাতে তাঁর সঙ্গেই সিসিটার কলেজে পড়তে গিয়েছিলেন নৃত্যগোপাল মুখোপাধ্যায়, অতুলকৃষ্ণ রায়, ভূপালচন্দ্র বসু, গিরীশচন্দ্র বসু। এদের মধ্যে ভূপালচন্দ্র বসু পরবর্তী কালে হয়ে উঠলেন রায়বাহাদুর বি. সি. বোস এবং ডেপুটি ডাইরেক্টর অফ এগ্রিকালচার। নিত্যগোপাল মুখার্জীই হলেন ব্রিটিশ সরকারের কৃষিবিদ তথা পরবর্তীকালে কৃষি বিজ্ঞানের অধ্যাপক এন. জি. মুখার্জী, যিনি ‘Hand Book of Indian Agriculture” গ্রন্থটি লিখেছিলেন।

বইটির শিরোনামে এক ঝলকে যে পরিচয় রয়েছে তা এইরকম — Being a practical treatise on the agricultural methods adopted in the Lower Provinces of Bengal. বইটির শুরুতে দুই পাতার একটি Preface, তারপর ২১ পাতার একটি Introduction. Preface বা কথামুখে ডি. এল. রায় উল্লেখ করেছেন কোন কোন সরকারি পুস্তক আর রিপোর্ট থেকে তিনি নানান উদ্ধৃতি দিয়েছেন এবং তথ্য সংগ্রহ করেছেন। এর মধ্যে দেখা যায় তাঁর বিলেতের সহপাঠী যারা তখন সরকারের কৃষি বিভাগের নানান উচ্চপদে কর্মরত ছিলেন তাদের বই আর রিপোর্ট রয়েছে, যেমন — Mr. B. C. Basu’s (Rai Bahadur) Report on the Agriculture in the district of Ranchi, Mr. B. C. Basu’s Notes on Indian Agriculture,  Mr. N. G. Mookerjee’s Hand-book of Indian Agriculture ইত্যাদি। এছাড়া ব্যবহার করেছিলেন Dr. Voelcker’s Report on the Improvement of Agriculture in India, Agricultural Statistics published by the Bengal Government, Reports on the working of the Experimental Farms at Burdwan and Dumraon, Agricultural Leadgers and Bulletins, Wilson’s British Farming, Mr. A. C. Sen’s Report on the Agriculture in the districts of Dacca and Burdwan, Mr. N. N. Banerjee’s Report on the Agriculture in the district of Cuttacks.

কথামুখের শুরুতে ডি. এল. রায় লিখেছেন, The object of the present treatise is to give a succinct account of the agricultural practices prevailing in the Lower Provinces regarding the cultivation of some of the most important crops grown in these parts. সেখানে উল্লেখ করতে ভোলেন নি সমগ্র আলোচনার মধ্যে সমগ্র বাঙ্গলা জুড়ে তাঁর নিজস্ব কৃষি পর্যবেক্ষণের ফলাফলও যুক্ত রয়েছে। সেই সময় তিনি ব্রিটিশ ভারতের ল্যাণ্ড রেকর্ড অ্যাণ্ড এগ্রিকালচার ডিরেক্টরের সহকারী হিসাবে কর্মরত ছিলেন। বইটিতে তিনি আশা প্রকাশ করে লিখেছিলেন, যে কৃষিবিদ্যা তিনি অধ্যয়ন করেছিলেন, সরকারি চাকুরি থেকে অবসর নিয়ে সেই অধীত জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে তিনি একটি নিজস্ব কৃষি খামার গড়ে তুলতে চান, “I look forward to the time when I may take advantage of my agricultural education by starting a farm of my own, after I shall have retired from Government service, and laid by a small capital to devote to the practical study of this intensely interesting subject.” কিন্ত তাঁর অকাল প্রয়াণে লালিত ইচ্ছা পূরণ হয় নি। মাত্র পঞ্চাশ বছর বয়সে তিনি প্রয়াত হন (১৯ জুলাই, ১৮৬৩ — ১৭ মে, ১৯১৩)। এমনকী শারীরিক সমস্যার কারণে তিনি চাকুরি থেকে স্বেচ্ছায় অবসর নিতেও বাধ্য হন।

বই-এ যে ফসলগুলি সম্পর্কে আলোচনা রয়েছে তার মধ্যে ধানের উপর আলোচনা সবচেয়ে বেশি (৩০ পাতা), তারপর গমের বিষয়ে আলোচনা (১২ পাতা), বার্লি বা যব (৬ পাতা)। এছাড়া জই বা ওট্স্, ভুট্টা, নানান দানাশস্য বা মিলেট, ইতালীয় দানাশস্য, সাধারণ দানাশস্য বা কমন মিলেট, ছোলা, মটর, মুগ, মুসুরি, খেসারি, কলাই, অড়হর, ঘোড়ামুগ, গাইমুগ, তিসি, সরষে, গিঞ্জেল্লি, নাইজার তৈলবীজ, রেড়ি, বাদাম, কার্পাস তুলো, পাট, মেস্তা, ধইঞ্চা, আখ, আলু, তামাক, মিষ্টিআলু, খামালু, বেগুন, মূলো, পটল, করলা, উচ্ছে, মিষ্টিকুমড়ো, লাউ, ঝিঙ্গে, ঢ্যাঁড়শ, শসা, ফুটি, তরমুজ, কচু, আদা, হলুদ, কলা, আনারস, অ্যারারুট, পালং নিয়ে আলোচনা রয়েছে।

ড. কল্যাণ চক্রবর্তী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.