হিন্দু মহাসভার অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতা এবং জনসংঘ দলের প্রতিষ্ঠাতা হিন্দু নেতা ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির মৃত্যু হয়েছিল কাশ্মীরে প্রায় লোকচক্ষুর অন্তরালে। সরকারি তথ্যে আজও লেখা আছে মৃত্যুর কারণ হৃদরোগ বা হার্ট অ্যাটাক। যে কোনো মানুষের মৃত্যুর সহজ এবং সরলীকৃত কারণ হিসেবে। চিকিৎসকরা এটা লিখতেই বেশি পছন্দ করেন। যেমনটি করা হয়েছিল প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রীর মৃত্যুর সময়ও। তিনিও মারা গিয়েছিলেন ভারতবর্ষ থেকে বহুদূরে সোভিয়েত ইউনিয়নের তাসখন্দে। সরকারিভাবে মৃত্যুর কারণ হার্ট অ্যাটাক। কিন্তু গোটা শরীরটা কেন নীলাভ হয়ে গিয়েছিল—লালবাহাদুর শাস্ত্রীর স্ত্রী ললিতা দেবীর সে প্রশ্নের উত্তর আজও মেলেনি। যেমন মেলেনি শেষবার যে ফ্লাস্কের জল তিনি খেয়েছিলেন সেই ফ্লাস্কটিও। লালবাহাদুর শাস্ত্রীর মৃত্যু ১৯৬৫ সালে। তার একযুগ আগে একইরকম রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছিল ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের, ১৯৫৩ সালে। এক্ষেত্রেও খুঁজে পাওয়া যায়নি তার লেখা রোজকার রোজনামচা আর বেশ কিছু চিঠিপত্র যা তিনি পাঠিয়েছিলেন তাঁর দলীয় কর্মীদের কাছে বা নিজের পরিবারের কাছে। আরও বিস্ময়কর হলো–আচমকাই কাশ্মীরের শ্রীনগর শহরের ভাড়াবাড়ি ছেড়ে নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিলেন সেই নার্স রাজদুলারি টিকু, যিনি ডাক্তারের নির্দেশমতো ইনজেকশনটি দেওয়ার পরই—“জ্বলে গেল, পুড়ে গেল, আমি জ্বলে যাচ্ছি’ বলে চিৎকার করে ওঠেন এবং তারপরই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। ভারতমাতার মহান সন্তান শ্যামাপ্রসাদ। শ্যামাপ্রসাদের মৃত্যুর পর কাশ্মীরে গিয়ে রাজদুলারির সঙ্গে দেখা করেছিলেন। শ্যামাপ্রসাদের কন্যা সবিতা এবং তাঁর স্বামী নিশীথ। পরিচয় গোপন করেই তারা দেখে এসেছিলেন পাহাড়ি জঙ্গলের মধ্যে অবস্থিত সেই কুটির যেখানে বন্দি করে রাখা হয়েছিল শ্যামাপ্রসাদ আর তার দুই সঙ্গীকে। তারপর অনেক অনুসন্ধান করে পৌঁছেছিলেন রাজদুলারীর কাছে। রাজদুলারী সব সত্য ফাঁস করে দিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠেছিলেন। বলেছিলেন—“আমি পাপ করেছি। মহাপাপ।”
ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় এবং তার দুই সঙ্গী যুবক দিল্লি জনসংঘ শাখার সভাপতি, আয়ুর্বেদ বিশেষজ্ঞ এবং লেখক গুরুদত্ত বেদ ও দেরাদুনের দলীয় কর্মী টেকাদকে কাশ্মীর পুলিশ গ্রেপ্তার করেছিল মাধোপুর চেকপোস্ট থেকে অনতিদূরেই রাভি নদীর ওপর সেতুর মধ্যভাগে। তার অপরাধ ছিল, প্রধানমন্ত্রী নেহরু এবং অনৈতিকভাবে নির্বাচিত কাশ্মীরের প্রধান শাসক শেখ আবদুল্লার প্রবর্তিত অনুমতি পত্র ছাড়াই তিনি কাশ্মীরে প্রবেশ করেছিলেন। যদিও একথা পরে প্রমাণ হয়েছিল যে ভারত সরকার বিনা অনুমতিতে কাশ্মীর প্রবেশের জন্য গ্রেপ্তার করেনি। আসলে প্রধানমন্ত্রী নেহরু ভয় পেয়েছিলেন। যদি মুক্ত পুরুষ হিসেবে তাঁর সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী কাশ্মীরে ঢুকে জনসাধারণের কাছে প্রকৃত সত্যটা তুলে। ধরেন, তাহলে চরম বিপদ। বিশেষ করে জনরোষের কবলে পড়বেন তিনি। অতএব তাঁরই নির্দেশে কাশ্মীর সরকার শ্যামাপ্রসাদকে গ্রেপ্তার করলেন জন নিরাপত্তা আইনে। শ্যামাপ্রসাদের অপরাধ, তিনি কাশ্মীরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে জানতে চেয়েছিলেন, কাশ্মীরবাসীরা কী চান, কাশ্মীরবাসীরা কেমন আছেন। প্রয়োজনে তাদের সঙ্গে নিয়েই শুরু করবেন জন আন্দোলন।
কিন্তু এক আকাশে দুটি সূর্য? নেহরু তা মেনে নেবেন কী করে? অগত্যা শ্যামাপ্রসাদ ও তার দুই সঙ্গীকে একরাতের জন্য শ্রীনগর সেন্ট্রাল জেলে রাখলেও পরদিনই তাদের নিয়ে যাওয়া হল নিশাত বাগে। ডাল লেক তীরবর্তী পাহাড়ের খাড়াই চূড়ায় এক ছোট্ট কুটিরে। চারপাশে কোনো বসতি নেই। কোনও চিকিৎসালয় নেই। আছে মুক্ত আকাশ, সবুজ বনানী আর বন্য পশুর গর্জন। তিনটি ঘর তিন বন্দির জন্য। দরজা জানালাগুলো মোটেই সুরক্ষিত নয়। পালাবার পথও দুর্ভেদ্য।
ড. মুখোপাধ্যায়ের পায়ে স্নায়ুজনিত সমস্যা ছিলই। নিশাত বাগের অস্বস্তিকর পরিবেশে পায়ের যন্ত্রণা বেশ বাড়ল। তারিখটা ছিল ৩ জুন। তার সঙ্গে জ্বর এবং দূর্বলতা। অনেক টালবাহানার পর ২০ জুন ডা. আলি মহম্মদ এবং অমরনাথ রায়না পৌঁছলেন নিশাত বাগের সেই ‘নৈসর্গিক ভিলায়’। ডাক্তাররা জানালেন, শ্যামাপ্রসাদ ভুগছেন প্লুরিসি রোগে এবং এজন্য স্ট্রেপটোমাইসিন ইনজেকশন দেওয়া দরকার। শ্যামাপ্রসাদ আপত্তি করেছিলেন। কারণ স্ট্রেপটোমাইসিন তাঁর পক্ষে নিষিদ্ধ ওষুধ। কিন্তু ডা. আলি বললেন—‘এখন স্ট্রেপটোমাইসিন অনেক উন্নত ওষুধ। ভয় নেই। নিয়ে নিন। বিকাল সাড়ে তিনটের সময় ইনজেকশানটা দেওয়া হল এবং যন্ত্রণা নিরোধক কিছু পাউডারও মেশানো হল ইনজেকশনে। কিন্তু কোনও প্রেসক্রিপশন লেখা হলো না। শ্যামাপ্রসাদকে শ্রীনগর জেলার হাসপাতালে আনা হল। পরদিনও দেওয়া হলো একটি ওষুধ। ওষুধ চলছে—জ্বরও বাড়ছে—যন্ত্রণাও বাড়ছে। পরদিন ২২ জুন, ভোর পাঁচটার আগেই শ্যামাপ্রসাদ ডেকে পাঠালেন জেলসঙ্গী বেদকে। বেদ এসে দেখলেন জ্বর কমে গেছে। কিন্তু নাড়ির স্পন্দন বেশ দুর্বল। খবর পেয়ে সকাল সাড়ে সাতটায় এলেন ডাঃ আলি মহম্মদ। তিনি পরামর্শ দিলেন —ড. মুখোপাধ্যায়কে কোনো নার্সিং হোমে ভর্তি করার জন্য। বেলা ১০টা নাগাদ বেশ সুস্থ হয়ে উঠলেন শ্যামাপ্রসাদ। বেলা সাড়ে এগারটা নাগাদ একটা ট্যাক্সিতে করে তাকে নিয়ে যাওয়া হল শ্রীনগরের সরকারি হাসপাতালের মহিলা রোগের চিকিৎসা বিভাগ বা গায়নোকোলজিক্যাল বিভাগে। বিকেলে তার সঙ্গে দেখা করতে এলেন ব্যারিস্টার ত্রিবেদী যিনি শ্যামাপ্রসাদের বিরুদ্ধে হেবিয়াস কার্পাস মামলার দায়িত্বে ছিলেন। সুখবর এনেছিলেন— মামলায় জয় সুনিশ্চিত। ২৩ জুন সকালেও ব্যারিস্টার ত্রিবেদী মোটামুটি সুস্থই দেখে গেলেন শ্যামাপ্রসাদকে। সকালে এক্সরে হল। বলা হলো, দু-একদিনের মধ্যেই হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে যাবেন। ঐদিনই ভোর পৌনে চারটের সময় ব্যারিস্টার ত্রিবেদীকে খবর দেওয়া হল শ্যামাপ্রসাদের অবস্থা ভালো নয়। গুরু দত্ত বেদ, টেকচঁাদ, পন্ডিত প্রেমনাথ ডোগরা প্রমুখকে সঙ্গে নিয়ে ব্যারিস্টার ত্রিবেদী যখন হাসপাতালে পৌঁছলেন, ততক্ষণে সব শেষ। হাসপাতালের বক্তব্য ৩.৪০ মিনিটেই মারা গেছেন শ্যামাপ্রসাদ।
কিন্তু কীভাবে? কেন?
সে প্রশ্নের উত্তর আগেই দিয়েদিলেন। আচার্য জে বি কৃপালনীর সহধর্মিণী সুচেতা কৃপালনী। তিনি শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে বারবার বলেছিলেন কাশ্মীরে পা না রাখতে। কারণ ‘জওহরলাল নেহরু তাকে কিছুতেই নিরাপদে দেশে ফিরতে দেবেন না। আপনিই তাঁর প্রধান শত্রু। তিনি পথের কাঁটা হিসেবে আপনাকে সরিয়ে দিতে চাইবেনই এবং ওই মানুষটা সব পারেন।শ্যামাপ্রসাদ নিঃশঙ্কচিত্তে বলেছিলেন- আমি তো ব্যক্তিগতভাবে তাঁর শত্রু হতে পারি না। তাহলে আমার প্রতি কোনও প্রতিহিংসা কেন তিনি নেবেন?
আর আসল সত্যটা বেরোল অনেক পরে।
একজন জ্যোতিষী নাকি আগেই ব্যারিস্টার ত্রিবেদীকে বলে গিয়েছিলেন, যত শীঘ্ৰ পারেন শ্যামাপ্রসাদজীকে নিয়ে দেশে ফিরুন। নাহলে নিরাপদে দেশে ফেরার সমস্যা হবে। একজন পুলিশ অফিসারও গোপনে দেখা করে ব্যারিস্টার সাহেবকে বলে গিয়েছিলেন—পারলে আজ রাতেই ওর মুক্তির চেষ্টা করুন।
সবচেয়ে বড় সত্যটা জানিয়েছিলেন রাজদুলারী টিক্ক। সেই নার্স যিনি মাতৃসদনে একজন পুরুষ রোগীকে দেখে অবাকই হয়েছিলেন। এবার শোনা যাক রাজদুলারীর মুখেই ভারতের মহান সন্তানের শেষক্ষণটুকুর কাহিনি।—“উনি ঘুমোচ্ছিলেন, ইনজেকশনটা রেডি করে চলে গিয়েছিলেন ডাক্তার। নির্দেশ ছিল, ঘুম ভাঙলেই যেন ইনজেকশনটা দেওয়া হয়। শ্যামাপ্রসাদের ঘুম ভাঙতেই ইনজেকশনটা দিলাম। আর তারপরেই বিছানায় গড়াগড়ি খেতে শুরু করলেন উনি। চীৎকার করছেন—জ্বলে গেল, পুড়ে গেল। জ্বল যাতা হ্যায়। জ্বল রহা হ্যায়। আমি ডাক্তারকে ফোন করলাম। উনি বললেন, ঠিক হ্যায়। সব ঠিক হো যায়গা। তারপর আস্তে আস্তে স্থির হয়ে গেল ওঁর শরীরটা।”
বহু বছর চরম সত্যটা চেপে রেখেছিলেন চাকরি যাওয়ার ভয়ে। প্রাণ যাওয়ার ভয়ে। কিন্তু শ্যামাপ্রসাদের মেয়ে সবিতার চোখের জল তাকে সত্য বলতে বাধ্য করেছে। তারপরই তিনি নিখোঁজ। কারণ পরদিন সেই বাড়িতে গিয়ে সবিতাদেবী রাজদুলারীকে পাননি। হয়তো আজও তিনি নিখোঁজই। যেমন নিখোঁজ শ্যামাপ্রসাদের গুরুত্বপূর্ণ ডায়েরি, প্রেসক্রিপশন এবং সেই ইনজেকশনের অ্যাম্পুলটিও।
শুধু সরকারি সত্য হিসেবে বেঁচে রইল সেই তথ্য—হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের জীবনাবসান।
সুজিত রায়
2019-06-28