তিনি লন্ডনের বাসিন্দা, কিন্তু আদ্যপান্ত বাঙালি এই চিকিৎসক। তিনি অনির্বাণ ঘোষ, গত ২২ ডিসেম্বর ফাইজারের করোনা টিকাটি নিয়েছেন। যেহেতু এই মুহূর্তে করোনার মতা স্ট্রেন নিয়ে নয়া চিন্তা শুরু করেছে ভারত তথা কলকাতা এবং একইসঙ্গে ভারতে তৈরি ভ্যাক্সিন দেশের মানুষকে দেওয়ার কাজ দ্রুত শুরুর করার খবর মিলছে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রক সূত্রে। তাই কোথাও যেন লন্ডননিবাসী চিকিৎসকের সোশ্যাল মাধ্যমে লেখা ভ্যাক্সিন চর্চা যেন অন্য মাত্রা দিয়েছে। সেটি আবার নিজের সোশ্যাল মাধ্যমেই শেয়ার করেছেন বিখ্যাত লেখিকা দেবারতি মুখোপাধ্যায়। তাঁরই বন্ধু চিকিৎসক অনির্বাণ ঘোষ। তাঁর মতে নয়া স্ট্রেন দ্রুত ছড়ালেও আগের মত ভয়ঙ্কর নয়।
সম্ভবত সেই জন্যই হয়তো ভারতের ভ্যাক্সিন তৈরি করা বিজ্ঞানীরা দাবী করছেন নতুন স্ট্রেনকে মারতে সক্ষম দেশি ভ্যাক্সিন। কিন্তু কেন নয়া স্ট্রেন নিয়ে অকারণ বেশি ভয় পেতে বারন করছেন লন্ডন নিবাসী চিকিৎসক। তিনি বলছেন, ‘নয়া স্ট্রেনকে ভ্যাকসিন কভার করবে কী না তা এখনই বলা সম্ভব নয়। তবে ভাইরাসের মিউটেড করাটা খুব স্বাভাবিক একটা ঘটনা। কোভিড-১৯ ও বহুবার মিউটেড করেছে। এই নতুন দুটো স্ট্রেইন আগের থেকে দ্রুত ছড়াচ্ছে,কিন্তু এদের মারণক্ষমতা আগের স্ট্রেইনগুলোর থেকে বেশি নয়।’
এবার তিনি তুলনা করেছেন ফাইজার ও অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাক্সিন নিয়ে। সেখানে তিনি এগিয়ে রেখেছেন অ্যাস্ট্রাজেনেকাকেই। আর এখানেই নতুন স্ট্রেন নিয়ে চিন্তা থাকলেও এই মুহূর্তে একটু স্বস্তির শ্বাস নিতে পারে ভারতবাসী। এই প্রসঙ্গে তাঁর যুক্তি কী ? তিনি জানাচ্ছেন , গত সপ্তাহে আমি ফাইজার ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজটি পেয়েছি। ১৫ই জানুয়ারি পরের ডোজ পাব। শোনা যাচ্ছে, জানুয়ারি মাস থেকেই দেশের মানুষও ভ্যাকসিন পাওয়া শুরু করবে। ফাইজারের ভ্যাকসিন পাওয়ার সম্ভাবনা কম, কারণ ফাইজার ইউরোপ আমেরিকাকে সাপ্লাই করে আরো বেশি ভ্যাকসিন বানিয়ে উঠতে পারছে না এত তাড়াতাড়ি। তবে ইংল্যান্ডে অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিনকে (অক্সফোর্ড ভ্যাকসিন) অ্যাপ্রুভ করা হয়েছে। এটা একটা বিরাট বড় খবর! কারণ ভারতে সিরাম ইন্সটিটিউট অ্যাস্ট্রাজেনেকার সঙ্গে মিলে ভ্যাকসিন বানাবে! আর অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিনকে সাধারণ ফ্রিজেই স্টোর করা যায়, ফাইজারের ভ্যাকসিনের মতো -৭০° তে স্টোর করতে হবে না।’ প্রথমেই এখানেই অ্যাস্ট্রাজেনেকাকে এগিয়ে দিয়েছেন চিকিৎসক।
চিকিৎসক তথ্য দিচ্ছেন ফাইজার ভ্যাকসিনের ডোজ কটা? উত্তর দুটো। প্রথম ডোজের ২১ থেকে ২৮ দিন পরে দ্বিতীয়টা নিতে হবে। অ্যাস্ট্রাজেনেকারও দুটো, প্রথম ডোজের চার থেকে ১২ সপ্তাহ পরে দ্বিতীয়টা নিতে হবে। দুটো ভ্যাকসিনই ইন্ট্রামাস্কুলার ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে দেওয়া হবে। টিটেনাস ভ্যাকসিনের মতো।
এবার করোনা ধ্বংসের কার্যক্ষমতা কোন ভ্যাক্সিনের কতটা ক্ষমতা তা একটি তুলনা ও তথ্যমাফিক বিশ্লেষণ করে নিজের কথা সোশ্যাল মাধ্যমে জানিয়েছেন চিকিৎসক। তাঁর কথায়, ‘ফাইজার ভ্যাকসিনের এফিকেসি শুনছি ৯৫%। এর মানে কী? এর মানে যদি ১০০ জনকে ভ্যাকসিন দেওয়া হয় আর তাদের সবার শরীরে সবাইকে যদি ভাইরাস ছড়িয়ে দেওয়া হয় তাহলে ৯৫ জনের কোভিড-১৯ হবে না। যে ৫ জনের হবে তাদেরও ভয়ানক ইনফেকশন হবে না। ট্রায়ালে বলেছে যে ভ্যাকসিনের পরেও যাদের কোভিড-১৯ হয়েছে তাদের হস্পিটালাইজড হওয়ার সম্ভাবনা অনেক কম।’ এবার অ্যাস্ট্রাজেনেকার এফিকেসি মাত্র ৭০%। তাহলে এই ভ্যাকসিন নিয়ে লাভটা কী? তিনি বলছেন , ‘অ্যাস্ট্রাজেনেকা নভেম্বর মাসে যে ডেটা পাবলিশ করেছিল তাতে এফিকেসি ছিল ৬২-৯০% এর মধ্যে৷ গড়ে ৭০% এর কাছাকাছি। তবে সাম্প্রতিক খবর অনুযায়ী অ্যাস্ট্রোজেনেকা ‘উইনিং ফর্মুলা’ পেয়ে গিয়েছে। ভ্যাকসিনের ডোজে সামান্য বদল এনে এফিকেসি ৯৫% এর কাছাকাছি চলে এসেছে। এই ডেটা এখনও পাবলিশ হয়নি তবে খবরটা অ্যাস্ট্রাজেনেকার সিইওর কাছ থেকে পাওয়া গিয়েছে, সুতরাং যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্য।’ চিকিৎসকের এই কথা অনুযায়ী আবারও ভারত এই সি ১৯ নিয়ে শত চিন্তার মাঝেও সামান্য স্বস্তি বোধ করতে পারে।
এবার তিনি বলছেন , দুটো ভ্যাকসিন নিলেই কী মানুষ কোভিডে ইমিউনড হয়ে যাবে ? তাঁর স্পষ্ট যুক্তি, ‘না, ভালো ইমিউনিটি শরীরে তৈরি হতে সময় লাগে। দুটো ডোজের ২-৪ সপ্তাহের মধ্যে ইমিউনিটি পুরোপুরি তৈরি হবে।’ তিনি নিজেই কয়েকটা প্রশ্নও তুলেছেন। উত্তরও দিয়েছেন। প্রশ্ন ১) ভ্যাকসিন নিয়ে অনেকে নাকি মারা যাচ্ছে, এটা সত্যি? তাঁর উত্তর, ‘সব ভ্যাকসিন থেকেই অ্যালার্জিক রিয়াকশন হতে পারে, এর সবচেয়ে খারাপ মাত্রাকে বলে অ্যানাফাইল্যাক্সিস, এতে কিছু মানুষ মারা যায়। তবে কোভিড-১৯ এর ভ্যাকসিনে অ্যানাফাইল্যাক্সিসের সম্ভাবনা বেশি এটা ভুল ধারণা।’
প্রশ্ন ২) ভ্যাকসিনের সাইড এফেক্ট আছে কিছু? উত্তর, অন্যান্য ভ্যাকসিনের মতো এরও সামান্য কিছু সাইডএফেক্ট আছে, যেমন- ভ্যাকসিন দেওয়ার জায়গায় ব্যথা, ক্লান্তি, সামান্য জ্বর, মাথা ব্যথা। এই সবই ১-২ দিনের মধ্যে ঠিক হয়ে যায়। আমার হাতে ব্যথা ছিল। তাই নিয়ে অপারেশন করতে কোনও অসুবিধা হয়নি। ২ দিনের মধ্যে ব্যথা একদম ঠিক হয়ে যায়।
প্রশ্ন ৩) ভ্যাকসিন নেওয়ার পরও কি কেউ এর বাহক হতে পারে? উত্তর , ভ্যাকসিন পাওয়ার পর আপনার কোভিড হওয়ার সম্ভাবনা অনেকটাই কমে যাবে, কিন্তু আপনি কোভিড ভাইরাসের কেরিয়ার হয়ে অন্যের মধ্যে তখনও ছড়াতে পারেন। তাই ভ্যাকসিন পাওয়ার পরেও যেগুলো করে যেতেই হবে – ১)মাস্ক পরা ২) সোস্যাল ডিস্টেন্সিং যতটা সম্ভব মেনে চলা ৩) হাত ধোয়া।
১৮ বছরের নীচে ভ্যাক্সিন দেওয়া নিয়েও তথ্য দিয়েছেন চিকিৎসক। তিনি জানাচ্ছেন , ফাইজার ১৬ বছর বয়সের উপরের বয়স হলে তিকা দিচ্ছে। অ্যাস্ট্রাজেনেকার ক্ষেত্রে তা ১৮ বছর। প্রশ্ন উঠছে মূলত টিন এজাররা কী ভ্যাকসিন পাবে না? চিকিৎসকের সাফ উত্তর ‘আপাতত না। ১২ থেকে ১৬ বছর বয়সীদের মধ্যে সদ্য ভ্যাকসিন ট্রায়াল শুরু হয়েছে। এর রেজাল্ট আসতে কয়েক মাস সময় তো লাগবেই।’