১২২৭ বঙ্গাব্দের ১২ই আশ্বিন (১৮২০ খ্রিস্টাব্দের ২৬শে সেপ্টেম্বর) হুগলী জেলার অন্তর্গত বীরসিংহ গ্রামে (পরবর্তীকালে মেদিনীপুর) ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতৃ দেব ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, মাতৃদেবী ভগবতী দেবী অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ ও ধর্মপ্রাণা ছিলেন। তাঁর ঠাকুর্দা রামজয় তর্কভূষণ যথেষ্ট খ্যাতিসম্পন্ন ছিলেন। কিন্তু দারিদ্র্যের মধ্য দিয়ে কালাতিপাত করতেন। পিতা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় আর্থিক অসচ্ছলতার জন্য। বীরসিংহগ্রাম পরিত্যাগ করে অর্থোপার্জনের জন্য কলকাতায় চলে আসেন। পিতার সঙ্গে কলকাতা আসার পথে ঈশ্বরচন্দ্র ইংরেজি লেখা মাইলস্টোন দেখতে দেখতে আসছিলেন। কলকাতায় এসে পিতাকে বললেন—আমি ইংরেজি সংখ্যা শিখে ফেলেছি। পিতা বললেন—তুমি তো ইংরেজি পড়োনি। পুত্র বলল, আমি রাস্তার পাশে লেখা দেখে শিখে ফেলেছি। তার। মেধাশক্তির পরিচয় এমনই অদ্ভুত ছিল।
ঈশ্বরচন্দ্রের বাল্য ও কৈশোরকাল অতীব দারিদ্র্যের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হলেও অধ্যবসায় ও নিষ্ঠার সঙ্গে অধ্যয়নকার্যে কৃতিত্বের পরিচয় প্রদান করেন। সংস্কৃত কলেজে ব্যাকরণের তৃতীয় শ্রেণীতে বার্ষিক পরীক্ষায় বিশেষ সাফল্যের জন্য মাসিক পাঁচ টাকার বৃত্তি লাভ করেন। ব্যাকরণ শ্রেণীর। পাঠান্তে ইংরেজি শ্রেণীর অধ্যয়ন আরম্ভ করেন। ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দ হতে ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি সাহিত্য শ্রেণীতে বিশিষ্ট শিক্ষক জয়গোপাল তর্কালংকারের নিকট শিক্ষা অর্জন করেন। সংস্কৃত কলেজে তিনি বারো বছর অধ্যয়ন করেন এবং বার্ষিক পরীক্ষায় প্রথম স্থান লাভ করেন আর কৃতিত্বের জন্য পুরস্কৃত হন। ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে কৃতী অধ্যাপক প্রেমাদ তর্কবাগীশের অলংকার শ্রেণীতে অধ্যয়ন্তে বার্ষিক পরীক্ষায় প্রথম স্থান লাভ করেন। তারপর বেদান্ত শ্রেণী এবং স্মৃতি শ্রেণীতে পাঠাভ্যাস সময়ে প্রখ্যাত পণ্ডিত হরনাথ তর্কভূষণ এবং শম্ভুচন্দ্র বাচস্পতির সহায়তায় অভাবনীয় কৃতিত্বের পরিচয় দিয়ে তিনি বিদ্যাসাগর’ উপাধি প্রাপ্ত হন। সেইসঙ্গে পুরস্কার স্বরূপ ৮০টাকা অর্জন করেন। তৎপর ১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি হিন্দু ল কমিটি’র পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন। তিনি কাব্য, অলংকার, বেদান্ত, স্মৃতি, জ্যোতিষ এবং ন্যায়শাস্ত্রে অর্জন করেন অগাধ পাণ্ডিত্য।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ক্ষীরপাইয়ের শত্রুঘ্ন ভট্টাচার্যের কন্যা দিনময়ী দেবীকে বিবাহ করেন। শত্রুঘ্ন ভট্টাচার্য ও খ্যাতিমান-শ্রদ্ধাবান প্রিয়ভাজন ছিলেন ওই অঞ্চলের জনসাধারণের নিকট।
১৮৪১ খ্রিস্টাব্দের ২৯শে ডিসেম্বর কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের হেডপণ্ডিত (প্রধান অধ্যাপকের) পদে নিযুক্ত হন। জি. টি. মার্শাল সাহেব সেক্রেটারি ছিলেন ওই কলেজের। অল্পবয়সি বিদ্যাসাগর পাঁচ বছর ওই কলেজে দক্ষতার পরিচয় প্রদান করেন এবং ভূয়সী প্রশংসা লাভ করেন। ১৮৪৬ খ্রিস্টাব্দে বিদ্যাসাগর মাসিক ৫০ টাকা পারিশ্রমিকে সহকারী সম্পাদকের পদে অভিষিক্ত হন। জি. টিমার্শাল সাহেব বিদ্যাসাগরের ভূয়সী প্রশংসা করলেও বিদ্যাসাগর ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে ওই পদ হতে পদত্যাগ করেন।
মার্শাল সাহেব বিদ্যাসাগরের পদত্যাগের সংবাদে বিদ্যাসাগরকে তার কলেজের করণিকের পদে নিযুক্ত করেন। বিদ্যাসাগর ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে সংস্কৃত কলেজে সাহিত্যের অধ্যাপক পদে আসীন হন। ১৮৫১ খ্রিস্টাব্দে অধ্যক্ষের পদ শূন্য হলে ২২শে জানুয়ারি ১৫০ টাকা মাসিক বেতনে ওই পদে নিযুক্ত হন। কলেজের কর্তৃপক্ষ তার অধ্যবসায়, কর্মনিষ্ঠা ও তৎপরতায় বিমুগ্ধ হয়ে তার বেতন ৩০০ করে দেন। ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ তুলে দেওয়া হয়। সেখানে স্থাপিত হয় বোর্ড অব এগজামিনার্স। বিদ্যাসাগরকে বোর্ডের সক্রিয় সদস্যরূপে নিযুক্ত করে বিদ্যালয় সমূহের সহকারী পরিদর্শকের পদে নিযুক্ত করা হয়। উচ্চ বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় স্থাপন এবং ক্যালকাটা ট্রেনিং স্কুল’ নামে একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলো। বিদ্যাসাগর ওই প্রতিষ্ঠানের পরিচালক সমিতির সদস্য মনোনীত হলেন। তিনি পরে প্রতিষ্ঠানটির সম্পাদকের পদ লাভ করেন। ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে বিদ্যালয়টির নাম পরিবর্তন করে নূতন নামকরণ করা হয় “হিন্দু মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশন। পরবর্তী সময়ে এখানেই গড়ে ওঠে ‘বিদ্যাসাগর মহাবিদ্যালয়। তিনি সাঁওতালদের জন্যও বিদ্যালয় স্থাপন করেন। নারীশিক্ষার তিনিই পথিকৃৎ।
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ছিলেন বাংলা গদ্যসাহিত্যের জনক। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে বাংলা গদ্যসাহিত্যের প্রথম। যথার্থ শিল্পী হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তিনি প্রধানত সংস্কৃত, হিন্দি, ইংরেজি গ্রন্থ থেকে অনেক গ্রন্থ বঙ্গভাষায় অনুবাদ করেন। তাঁর অনুদিত গ্রন্থের মধ্যে সীতার বনবাস’, ‘ভ্রান্তিবিলাস’ এবং বেতাল পঞ্চবিংশতি’ অতি উল্লেখযোগ্য। এছাড়া ‘বর্ণপরিচয়, ‘ক থামালা’, ‘বোধোদয় এবং ‘আখ্যানমঞ্জরী’, ‘সমগ্র সংস্কৃত ব্যাকরণ কৌমুদী’ গ্রন্থসমূহ ছাত্র-ছাত্রীর শিক্ষার অপরিহার্য সহায়ক বলে পরিগণিত হয়ে আসছে। তিনি সমাজসংস্কারক ছিলেন। বাল্যবিধবা, বহু বিবাহ ও বিধবা বিবাহ প্রভৃতি নারীজাতির নিপীড়ন দুরাচার-দুর্গতির মোচন করাকে জীবনের অন্যতম ব্রত হিসাবে গ্রহণ করেন। তারই অক্লান্ত পরিশ্রমে ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দের ২৬শে জুলাই বিধবা-বিবাহ আইন বিধিবদ্ধ হয়। এই দুর্নিবার কার্য সম্পাদন করার জন্য সমাজের রক্ষণশীল সম্প্রদায়ের সঙ্গে ভীষণ সংগ্রাম করতে হয়েছে। শ্রুতি-স্মৃতিশাস্ত্রের বিধিবদ্ধ বিধানে সমূহদ্বারাই যুদ্ধ করে রক্ষণশীলদের পরাভূত করেছেন। প্রত্যক্ষভাবে তাদের বিরুদ্ধে শত্রুতাচরণ করতেও দ্বিধাহীন ছিলেন। সমাজের অপসংস্কৃতি, নারী নির্যাতন দূরীকরণের দৃষ্টান স্থাপন করেছেন। বিধবার সঙ্গে আপন পুত্রের বিবাহদানে তিনি এই আইনের বাস্তব প্রয়াসের নজির স্থাপন করেন।
প্রচলিত ধারণা অষ্টম বর্ষীয়া কন্যা দান করলে পিতা-মাতার গৌরীদানজনিত পুণ্যোদয় হয়। নবম বর্ষীয়া কন্যাদানে পৃথ্বীদানের ফল লাভ হয়। দশমবর্ষীয়া কন্যাকে পাত্রস্থ করলে পরম পূতঃ লোক প্রাপ্তি হয় প্রভৃতি স্মৃতিশাস্ত্র প্রতিপাদিত কল্পিত ব্যাখ্যায় মুগ্ধ হয়ে পরিণাম বিবেচনা না করে বাল্যবিবাহের প্রথা প্রচলিত ছিল। তজ্জন্য নিদারুণ অনর্থ সঙ্টন হয়েছে, তা সর্বজনবিদিত। এরূপে লোকাচার ও শাস্ত্র পাশে বদ্ধ হয়ে দুর্ভাগ্যবশত বাল্যবিবাহ অশেষ ক্লেশ ও দূরপনেয় দুর্দশা ভোগ করায়। এ অবস্থার তীব্র যন্ত্রণা, তা দূরীকরণেই তার বিরুদ্ধে বিদ্যাসাগরের চরম সংগ্রাম। বাল্যবিবাহ অতিশয় নির্দয় ও নৃশংস কর্ম। বিদ্যাসাগর বাল্যবিবাহিতার মর্মবেদনা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করে তা অপসারণে মহতীপ্রয়াস চালিয়ে সফলকাম হয়েছেন।
বিধবা বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা, বিদ্যাসাগরের অভিমত ও ‘শ্রুতি ও স্মৃতি’ গ্রন্থগুলিতে পক্ষে ও বিপক্ষে নানাবিধ তত্ত্ব ও তথ্য পরিবেশিত। মনু-অত্রি – ভৃগু-পরাশর আদি স্মৃতিতে স্ত্রীলোকের পতি বিয়োগের পর ব্রহ্মচর্য ও পুনর্বিবাহ বিধবাগণের ধর্ম বলেও বিহিত বিদ্যমান আছে। “মৃতে ভত্তরি ব্রহ্মচর্যং তদন্বারোহণংবা / শুদ্ধিতত্ত্বপ্রভৃতিধৃত বিষ্ণুবচন।” অর্থাৎ বিধবারা স্বেচ্ছাক্রমে বিবাহ করতে পারেন। কিন্তু জোরপূর্বক বাল্যবিধবা কন্যাদের নির্মম কৃচ্ছসাধনাদি কার্যে বাধ্য করা যাবে না। তৎজন্য বিদ্যাসাগর সদ্য বিধবাদের বিবাহে কেবল উৎসাহিত করেননি, তাদের পুনঃ পতিগ্রহণের ব্যবস্থা করেছেন। যেকোনো হিন্দু সমাজের পাত্র গ্রহণ করতে পারেন, অনুলোম-প্রতিলোমের নিষ্ঠুর বেড়াজালের উধের্ব অভিমত পোষণ করেছেন বিধবাগণের পক্ষে।
সমাজপতিরা নির্দিষ্ট তত্ত্বের অপব্যাখ্যা করে সমাজপতিগণ বিধবাদের প্রতি পুনবিবাহের তথা সুষ্ঠুপুনর্বিবাহকরণের প্রতি নির্মম আঘাত সৃষ্টি করে সমাজ কলুষিত ও নারী নির্যাতন করেছেন তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন বিধবা নারীর নির্যাতিত দশা উন্মোচন করেন তিনি। অতি দুঃস্থ পিতা-মাতারা বাধ্য হয়েই কন্যার জন্য অশীতিপর মৃত্যুপথগামী পতি গ্রহণে বাধ্য হতো। তারপর অত্যল্পকালমধ্য বৈধব্যদশা প্রাপ্ত বাল্যবিধবরা অবশিষ্ট জীবন রক্ষণশীল সমাজপতিগণের নির্দেশিত পথে নির্মমভাবে জীবযাপনে বাধ্য করা হয় আর তাদের লাঞ্ছিত জীবনের অবসান ঘটান, পুনর্বিবাহ প্রদানের জন্য যাবতীয় বাধা দূরীকরণে বিদ্যাসাগর বদ্ধপরিকর হন। তাতে তিনি সফলকাম হন। বহুবিবাহ বিষয়ে কুলীনগণের প্রতারণাবাক্য সমাজে নির্মম আঘাত হানে। পতিহীনা সুশ্রী কন্যাকে পর্যন্ত বাড়িথেকে বহিস্কৃত করেছে সমাজপতিরা। ফলে সমাজে ব্যাভিচাব. নেমে এসেছিল এক্ষেত্রেও ঈশ্বরচন্দ্রের অবদান অনবদ্য। অসহয়া বিধবাদের পুনর্বিবাহের প্রথা চালু করেছেন তিনি। বিধবারা সমাজে প্রতিষ্ঠিত, সুষ্ঠু দাম্পত্যজীবন যাপনে সমাজকে কলুষমুক্ত করেছেন বিদ্যাসাগর।
শিক্ষাক্ষেত্রে তার অবদান অসামান্য। স্বরবর্ণ ব্যঞ্জনবর্ণ, বর্ণযোজনা প্রভৃতি অ-কার, আ-কার, ই-কার,ঈ-কার, উ-কার, ঊ-কার, ঋ-কার, এ-কার, ঐ-কার, ও-কার, ঔ-কার সংযোগ। অনুস্বার, বিসর্গ, চন্দ্রবিন্দু যোগ। সংযোগ বর্ণ-য ফলা, র-ফলা, ব-ফলা, ণ-ফলা, এ-ফলা, ম-ফলা, রে, মিশ্ৰসংযোগ তিন অক্ষরে—ক, ষ, ণ = ক্ষ্ম। ঙ, ক, ষ = ক্ষ, ন, দ, র = ন্দ্র। ন, ন, য় = ন্য। ম, ভ, র = স্ত্র। র, ধ, ব = ধ্ব। র, শ, ব = র্শ। ষ, ট, র = ষ্ট্র।
১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি ইংল্যান্ডের রয়েল এশিয়াটিক সোসাইটির সভ্য নির্বাচিত হন। ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে ভারত সরকার তাকে ‘সি. আই. ই’ উপাধিতে সম্মানীত করলে। দেশবাসীর নিকট ভূয়সী প্রশংসিত হন তিনি।১২৯৮ বঙ্গাব্দের ১৩ই শ্রাবণ, ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দের ২৯শে জুলাই তিনি পরলোক যাত্রা করেন।
ডঃ অনিল চন্দ্র দাস
(ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের দ্বিশতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে প্রকাশিত)
2019-09-16