পৃথিবীর একটি নিকৃষ্ট জীবের নাম বলুন , মানে যাদের জন্য কোনো হিউম্যান রাইটস নেই ? হ্যাঁ , সঠিক , বাঙ্গালী হিন্দু, বাংলাদেশ নামক ইসলামিক দেশে থাকা সংখ্যালঘু বাঙ্গালী হিন্দু। যাঁরা দেশ ভাগের ঠিক পরের মুহুর্ত থেকে অত্যাচারিত, নিপীড়িত , ভয়ার্ত জীবন যাপন করছে। যাঁরা উদ্বাস্তু জীবনের নারকীয়তা ভোগ করেছেন। যাঁরা রাতের আঁধারে নগ্ন হয়ে, কচুরী পানায় লুকিয়ে নিজের ভূমি ত্যাগ করেছে কেবল নিজেদের সনাতন ধর্ম ও ইজ্জত রক্ষার জন্য।
১৯৪১ সালের জনগণনা অনুযাই সংখায় যুক্ত বাংলায় (বর্তমান বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ) মুসলমানরা ছিল ৫৬% আর হিন্দুরা ৪৪%। ১৯৩৭ সালে যখন থেকে সীমিত হলেও ভারতে ও যুক্ত বাংলায় সংসদীয় প্রথা চালু হল তখন থেকেই হিন্দু বাঙালি বুঝে গিয়েছিল যে যুক্ত বাংলায় তাঁদের ভবিষ্যত খুব একটা সুবিধার হবে না। পৃথিবীর ইতিহাসে কোন দেশে মুসলমান জনসংখা ৪০ শতাংশ হলেই সে দেশের ইসলামি পথে চলা ছাড়া গতি নেই। লেবানন, মালয়েশিয়া, বসনিয়া এর সাম্প্রতিক উদাহরণ। বঙ্গীয় আইনসভায় হিন্দু আসনের এক তৃতীয়াংশ তফসিলি হিন্দুদের জন্য সংরক্ষিত ছিল। তফসিলি হিন্দু ও মুসলমানের জোটের উপর অনেক প্রচার সত্বেও পাকিস্তান প্রশ্নে বঙ্গীয় আইনসভায় প্রায় সব তফসিলি হিন্দু প্রতিনিধিরা ভারতে অর্ন্তভুক্তির পক্ষেই ছিলেন। মনে রাখতে হবে শত হিন্দু বিরোধিতা সত্বেও আম্বেদকার মুসলমানদের সঙ্গে কখনও কোন সংহতি প্রকাশ করেন নি বরং তার বক্তৃতা ও রচনায় ভারতে মুসলমান শাসনের নির্মম অত্যাচারের বর্ণনা অনেকবার করেছেন। সুভাষচন্দ্রের দাদা শরৎচন্দ্র বসুর কলকাতা গণহত্যার নায়ক শহীদ সুরাবর্দির সঙ্গে যুক্ত বাংলা স্থাপনের ভয়ংকর আত্মঘাতী ভাবনাকে হিন্দু বাঙ্গালী নূন্যতম গুরুত্ব দেয় নি।
পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভয়ে পালিয়ে এসে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় গ্রহণ করেও অশোক মিত্রর মতন গুটিকয়েক মানুষ, এখন ও সেই দুঃস্বপ্নের যুক্ত বাংলার জন্য হাহুতাশ করেন। ১৯৪৭ সালের ২০শে জুন বঙ্গীয় আইনসভা ভেঙে তৈরী হল পূর্ববঙ্গ আইনসভা ও পশ্চিমবঙ্গ আইনসভা। দুই আইনসভাতেই অমুসলিম সদস্যরা বাংলাভাগের পক্ষে ও পাকিস্তানে যোগদানের বিপক্ষে ভোট দিয়ে পশ্চিমবঙ্গ গঠন সুনিশ্চিত করেন। হিন্দু বাঙ্গালী তাঁর নিজের অস্তিত্বের স্বার্থে পশ্চিমবঙ্গ স্থাপন করেছে।
পশ্চিমবঙ্গ তৈরী হলো ১৯৪৭ সালে। ’৪৬-এর দাঙ্গা, ১৯৫০-এর দাঙ্গা কাটিয়ে ১৯৫১-এর পশ্চিমবঙ্গ সবে দুপায়ে দাঁড়াতে শুরু করেছে। ১৯৫১-এর জনগণনায় জানা গেল পশ্চিমবঙ্গের ১০ শতাংশ হিন্দু উদ্বাস্তু ও ১৯ শতাংশ মুসলমান। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে উদ্বাস্তু আসা বন্ধ হলো না। ১৯৫০ সালে নেহেরু লিয়াকত চুক্তিতে বলা হল যে উদ্বাস্তুরা যে যার দেশে ফিরে যেতে পারবেন। এর প্রতিবাদে পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় কেন্দ্রীয় মন্ত্রীত্ব ত্যাগ করলেন। উনি বললেন এর ফলে মুসলমানরা পশ্চিমবঙ্গে ফিরবে কিন্তু কোন হিন্দু আর মুসলমান রাজত্বে ফিরে যাবে না। ১৯৫০ সালের ১৪ই এপ্রিল সংসদে তিনি বলেন, – ‘দুই দেশের মধ্যে চুক্তি হওয়া সত্বেও বাস্তবে দেখা যাচ্ছে ১৬ থেকে ২০ লক্ষ হিন্দুকে পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতে পাঠানো হয়েছে। সিন্ধু প্রদেশ থেকেও প্রায় ১০ লক্ষ ছিন্নমূল হিন্দু চলে এসেছে।
অর্থনৈতিক কারণে এই সময়ের মধ্যে প্রচুর মুসলমানও পাকিস্তান থেকে চলে এসেছে। এর ফলে পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতিতে যে চরম আঘাত এল, অসহায় দৃষ্টিতে সেই ভয়ঙ্কর ছবি দেখা ছাড়া আর কিছুই করার নেই। …. ব্যাপক সংখ্যায় হিন্দুরা আসতেই থাকবেন, আর যারা তাঁরা ফিরে যাওয়ার কথা ভাবতেই পারেন না। অন্যদিকে যে সমস্ত মুসলমান চলে গিয়েছিল তাঁরা ফিরে আসবেন এবং আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস চুক্তিটির একতরফা রূপায়ণে মুসলমানেরা ভারত ছেড়ে যাবেন না।
আমাদের অর্থনীতি বিধবস্ত হয়ে যাবে এবং আমাদের দেশের মধ্যেকার সংঘাত আরো বেড়ে যাবে’। বি আর আম্বেদকার দেশভাগের অনেক আগে ১৯৪০ সালেই সুনির্দিষ্ট ভাবে বলেছিলেন যে ‘সংখ্যালঘু বিনিময়ই নিঃসন্দেহে সাম্প্রদায়িক সমস্যার স্থায়ী সমাধান’। মুসলমান জনসংখ্যা প্রসঙ্গে আম্বেদকারের মতামত- ‘মুসলমান জনসংখ্যা ও সাম্প্রদায়িক সমস্যার ক্ষেত্রে এর অর্থ যে পাকিস্তান না হলে ভারতের সাম্প্রদায়িক সমস্যায় যুক্ত থাকবে সাড়ে ৬ কোটি মুসলমান আর পাকিস্তান হলে তাতে যুক্ত থাকবে ২ কোটি মুসলমান। এটা কি শান্তিকামী হিন্দুরা ভেবে দেখছেন না? আমার মতে পাকিস্তানের সৃষ্টি হিন্দুস্তানের অভ্যন্তরের সাম্প্রদায়িক সমস্যার সমাধান করবে না, কিন্তু এর প্রভাবকে যথেষ্ট হ্রাস করবে …’।
৫০-এর দশকের উদ্বাস্তুদের বেশীর ভাগই তথাকথিত উচ্চবর্ণের হিন্দু। তাঁরা জানতেন পাকিস্তানে তাঁদের কোনও ভবিষ্যৎ নেই, তাঁরা একেবারেই দেশত্যাগ করলেন। নিজেদের বড় বাড়িঘর জমিজমা ছেড়ে স্রেফ প্রাণ ও সম্মান বাঁচানোর জন্য শিয়ালদহ স্টেশনের রেললাইনের ধার বা বিজয়গড়ের ডোবার উপর কুঁড়েঘরে থাকা তাঁদের শ্রেয় মনে হল। নতুন দেশে ভাল ভাবে জীবনযাপন করার মরিয়া ভাব উদ্বাস্তুদের আন্দোলনকে ধীরে ধীরে মারমুখী করে তোলে। কম্যুনিস্টরা এই ক্ষোভকে ব্যবহার করে আন্দোলনকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। ঐতিহাসিক প্রফুল্ল চক্রবর্তীর লেখায় এর বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যায়। বামপন্থী নেতারা পূর্ব পাকিস্তানে ইসলামিক শাসনের বিভীষিকার বিরুদ্ধে না গিয়ে এই আন্দোলনকে নিজেদের লাইন অনুযায়ী সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনের রূপ দিলেন।
সেজন্য UCRC (United Central Refugee Council)-র মিছিলে স্লোগান উঠলো করিয়া থেকে সাম্রাজ্যবাদী হাত ওঠাও বা বৃটিশ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক, যে স্লোগানের সাথে উদ্বাস্তু সমস্যার কোন যোগাযোগই নেই। শুধু তাই নয় ১৯৫২ সালে UCRC-র এক কনভেনশনে যে সমস্ত প্রস্তাব নেওয়া হয়েছিল, তার মধ্যে ছিল ১) বিদেশী শক্তির দ্বারা শোষণ ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে রাশিয়া ও চীনের বিরুদ্ধে চক্রান্তের অবসান। ২) দেশীয় ভারী শিল্পে কেবল মাত্র রাশিয়ার যন্ত্রাংশই আমদানী করতে হবে।
বামপন্থী প্রভাবিত উদ্বাস্তু আন্দোলন শুধু পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দুদের উপর অত্যাচারের খবর চেপেই গেল না, এক পা এগিয়ে পাকিস্তানকে সমর্থন করতে লাগলো। ১৯৫২ সালের ১৮ই অক্টোবর ওয়েলিংটন স্কয়ারে UCRC মিটিং- এ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীকে ধিক্কার জানানো হয়। ১৯৫৩ সালের ৭ এপ্রিল এক বিরাট সমাবেশ করে UCRC পশ্চিমবঙ্গ আইনসভায় তাদের একগুচ্ছ দাবী-দাওয়া পেশ করে। তাদের দাবীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি হল ‘বাস্তুহারা মুসলমানদের পুর্নবাসন ও তাদের জন্য অর্ন্তবর্তী ত্রাণভাতা’। কি আশ্চর্য! যারা বাস্তুচ্যুত মুসলমানদের ফিরিয়ে আনতে গলা ফাটাচ্ছেন, ভুলেও তাঁরা নেহেরু-লিয়াকত চুক্তি অনুযায়ী নিজেদের নিরাপদে পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে যাওয়ার কথা বলেছেন না! নিজেদের লোকেদের প্রতি উচ্চবর্ণের বিশ্বাসঘাতকতা পূর্ব পাকিস্তান থেকে পাকাপাকি ভাবে বেআইনি দেশত্যাগের ধারাকে নিশ্চিত করলো। উদ্বাস্তুদের অবিরাম দেশত্যাগ আজও চলেছে। ১৯৭৫- পরবর্তী এই উদ্বাস্তুদের বেশীর ভাগই ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ী তপশিলী হিন্দু।
কেন লক্ষ লক্ষ হিন্দু উদ্বাস্তু দিনের পর দিন বছরের পর বছর চলে আসতে থাকল তা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু বাঙালি ঐতিহাসিক, সাহিত্যিক, চলচিত্রকার, সংখ্যাতাত্বিক – সবাই নীরব থেকেছেন। এর একটা বড় কারণ বামপন্থী প্রভাবে ধর্মনিরপেক্ষতায় হিন্দু বাঙালির দীক্ষা যার অন্যতম শর্ত যে মুসলমান বা ইসলাম নিয়ে কোন সমালোচনা করা যাবে না। সাহিত্যসমালোচক অশ্রকুমার শিকদার লিখেছেন – ‘দেশভাগ-দেশত্যাগ নিয়ে লিখলে পাছে সাম্প্রদায়িকতা প্রশ্রয় পেয়ে যায়, সেই ভয়ে বাংলা সাহিত্য যেন শিটিয়ে ছিল। অথবা সব কথা বলা যায় না বলেই সংকুচিত ছিল।
১৯৭১ সালে ৯ মাস ব্যাপী এক দীর্ঘ রক্তাক্ষয়ী, সর্বনাশা সংগ্রামের পর সৃষ্ট হয়েছিল পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামক এক স্বাধীন ভূখণ্ড। পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এক আগ্নেয় বিশ্বাস, আত্ম-মর্যাদার প্রতি আস্থাবান এবং অসাম্প্রদায়িকতার প্রত্যয়কে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো সক্ষম এক জাতির। যদিও বর্তমানে এক পক্ষের চিৎকার বারংবার প্রমাণ করার চেষ্টা করে যে ভারতের অবদান সামান্যই। উঠে আসে বিভিন্ন প্রসঙ্গ – স্বাধীনতার পরই নাকি ভারতীয় সেনাবাহিনী সদ্য জন্ম নেওয়া বাংলাদেশে অমানুষিক অত্যাচার সহ লুন্ঠন চালিয়েছিল; জেনারেল ওসমান গণিকে তাঁর প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল দিল্লীর নির্দেশে – ইত্যাদি অনেক কিছু। যদিও ন্যায় ও ইতিহাসের প্রমাণের কষ্টিপাথরে তা কখনোই স্থায়ী হয়না, অভিযোগ চলতেও থাকে, থাকবেও। আজ এসে তাই প্রশ্ন ওঠে – এই সহযোগিতা, আত্মিক সমর্থন প্রকাশের মাধ্যমে ভারতবর্ষ কি পেল? তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বসবাসকারী হিন্দু জাতি, জিহাদের নেশায় উন্মত্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অত্যাচারে তো এক ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছিল। বর্তমান কালের হিন্দুরা কি জানেন যে সেই সময়ে মোট কটি গণহত্যা (হিন্দুদেরই বিশেষ করে) হয়েছিল? তাঁরা কখনো আদৌ শুনেছেন শাঁখারীবাজার, শাঁখারীপাড়া, রমনা, সুত্রপুর, চুকনগর, জিঞ্জিরা, শ্রীঅঙ্গন, শতনিখিল, ডেমরা, গোলাঘাট, আদিত্যপুর, কৃষ্ণপুর, বাগবাটি, বরগুনা প্রভৃতি অসংখ্য হিন্দু গণহত্যার কথা? গণহত্যাগুলির ক্ষেত্রে পাকিস্তান সৈন্যবাহিনীর সহায়ক (local collaborators) হিসেবে যাঁরা কাজ করেছিলেন সেই রাজাকারদের প্রায় সবাই কিন্তু বাংলা ভাষায় কথা বলতেন। একই বাংলা ভাষায় কথা বলা হিন্দুদের প্রতি তাঁদের মধ্যে কোন অনুকম্পা কিন্তু জাগেনি। অথচ আজ শুনতে হয় যে বাঙ্গালীর একটিই মাত্র পরিচয় যে সে বাংলা ভাষায় কথা বলে!
শোনা যায়, ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চে পাকিস্তানি বাহিনী ও তার দোসর পুরান ঢাকার কুখ্যাত স্বাধীনতাবিরোধী খাজা খয়েরউদ্দিনের নেতৃত্বে ধ্বংস হওয়া রমনা কালী মন্দির ও সংলগ্ন মা আনন্দময়ী আশ্রমের পুনর্নির্মাণের কাতর প্রার্থনা নিয়ে মৃত্যুঞ্জয়ী সাধক শ্রী শ্রী পরমানন্দ গিরির বিধবা স্ত্রী শ্রীমতী সুচেতা গিরি ও আশ্রমের সন্ন্যাসিনী জটালী মা শাহবাজ মসজিদের ইমাম জনাব আবদুল আলী ফকিরের নেতৃত্বে দেখা করতে যান শেখ মুজিবের সাথে। কিন্তু তাঁদের রূঢ় ভাষায় ঘর থেকে বের করে দেওয়া হয়। আশ্চর্য!! এই তিন ব্যক্তির মাতৃভাষাও তো বাংলাই ছিল!!
অন্যদিকে, বাংলাদেশ নামক এক অসাম্প্রদায়িক ভূখণ্ডের স্বপ্ন দেখা বাঙ্গালী হিন্দু জাতি গত প্রায় ৫০ বছরের মধ্যে সর্বনাশের শেষ সীমায় এসে উপস্থিত হয়েছে। ১৯৪৭-৪৮ র সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানের ২৯% বাঙ্গালী হিন্দু আজ মাত্র ৮.১% তে এসে গেছে। গত ১ লা ডিসেম্বর, বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু মহাজোটের মহাসচিব শ্রী গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিক রাজধানী ঢাকা শহরে জাতীয় প্রেস ক্লাবে সেখানে হিন্দুদের বর্তমান অবস্থা সংক্রান্ত একটি রিপোর্ট পেশ করেন। ৩০শে নভেম্বর পর্যন্ত সময়কে ও সংগঠনের জেলা এবং উপজিলা ইউনিটের দেওয়া তথ্যের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা এই প্রতিবেদনে বিস্তারিতভাবে প্রকাশিত হয়েছে হিন্দু জাতির ওপরের নারকীয় অত্যাচারের ও এক ভয়াবহ অবস্থার কথা। প্রতিবেদন অনুযায়ী – গত ১১ মাসে বাংলাদেশে ৮৮জন হিন্দু খুন, ৩৪৭ জন আহত এবং ২৯জন হিন্দু নারী ধর্ষিত হয়েছেন। তৎসহ ২৯ জন সংখ্যালঘু হিন্দুকে অপহরণ করা হয়েছে, যার মধ্যে শিশু, যুবক-যুবতীও আছে। মৌলবাদী মুসলিমদের দ্বারা ধর্ষিত ২৯ জন হিন্দু নারীর মধ্যে ৯ জন মহিলা গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন এবং ৪ জনকে ধর্ষণের পর নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে পরিষ্কার করে বলা হয়েছে, গত ১১ মাসে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ২,৭৩৪ একর জমি জোর করে দখল করে নেওয়া হয়েছে; ২১৭টি হিন্দু পরিবারকে ভিটে-মাটি থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে, ২২৩টি পরিবারকে দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার হুমকি দিয়েছে তাদেরই প্রতিবেশী মুসলমানরা। এছাড়াও ১০৮ টি হিন্দু পরিবারের ঘর-বাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে। হিন্দুদের ধর্মীয়স্থানগুলিও রেহাই পায়নি। গত ১১ মাসে ৩৭৯টি মন্দিরে হামলা চালিয়ে বিগ্রহ ভাঙচুর করা হয়েছে এবং ৯টি স্থানে মন্দিরের মূল্যবান বিগ্রহ চুরি হয়ে গিয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে পুলিস অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করলেও, পরে অভিযুক্ত মানসিকভাবে সুস্থ নয়, এই অজুহাতে ছাড়া পেয়ে গিয়েছে।
তাহলে প্রশ্ন ওঠে – দুই লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রম, ৩০ লক্ষ অসহায় মানুষের রক্ত, এক কোটি শরণার্থীর বুক ফাটা আর্তনাদ, ২০ হাজার ভারতীয় সৈন্যের আত্মবলিদান, ভারতের রাজ্ কোষাগার থেকে সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর অপরাহ্ন ৪ টা ১০ মিনিটে পাকিস্তানী সেনাদের আত্মসমর্পনের মাধ্যমে সৃষ্ট বাংলাদেশের মাধ্যমে ভারতবর্ষ ও ভারতবাসী কি পেল? দ্বিতীয় পাকিস্তানের অভ্যুদয় যার লক্ষ্য একমাত্র বাঙ্গালী হিন্দু তথা বৃহত্তর হিন্দু জাতির সর্বনাশ?
প্রতিবছরই ভারতে ১৬ই ডিসেম্বরের “বিজয় দিবস” কে কেন্দ্র করে আগ্রহ, প্রতিবেশী বাংলাদেশের প্রতি সপ্রেম চিন্তার এক আতিশয্য প্রবাহিত হয়।
কখনো কেউ প্রশ্ন করেছেন তর্জনী উঠিয়ে – কি পাওয়া গেল শেষ পর্যন্ত? এই প্রশ্ন করার ক্ষমতা কবে অর্জন করবে শতধা বিচ্ছিন্ন, কার্যত শিড়দাঁড়াহীন, রিপু আশ্রিত, শুধুমাত্র ব্যাক্তিগত লাভের আকাঙ্খায় মোহাবিষ্ট হিন্দু জাতি? কোনদিন কি সে শাস্ত্রার্থ অনুভব করবে যে অকিঞ্চনের স্বার্থত্যাগ, শস্ত্রহীনের শান্তিপ্রিয়তা ও ধ্বজভঙ্গের ব্রহ্মচর্য শুধু হাসিরই উদ্রেক করে? কবে সে বুঝবে যে স্বধর্ম বিচ্যুত হয়েছে বলেই সে আজ পরাভূত ও লাঞ্চিত, বাস্তবে অপাঙতেয় প্রত্যেক শক্তির কাছে? কবে সে জানবে যে ধর্ম শুধুই শুষ্ক মন্ত্রোচ্চারণ, মন্দিরের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় বরঞ্চ ধর্ম শব্দের মূল অর্থ হল কর্তব্য? বন্ধ হোক বিজয়ের এই ঢক্কানিনাদ।