পোল স্ট্র্যাটেজিস্ট, বাংলায় যাকে বলে নির্বাচন কৌশলবিদ প্রশান্ত কিশোর মহা ফাঁপরে পড়েছেন। সেই প্রশান্ত কিশোর যিনি ‘বাঘা বিনাশ পুরুষ’ নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদীকে তার নির্বাচনী প্রচার কৌশলে রাতারাতি ‘জাতীয়তাবাদী বিকাশ পুরুষ’-এ পরিণত করেছিলেন। সেই প্রশান্ত কিশোর যিনি বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারকে প্রায় সর্বস্ব হারানো গুপ্তধন খুঁজে দেবার মতো করে বিহার প্রশাসনের সর্বোচ্চ চেয়ারটি হাতে করে তুলে দিয়েছেন। যিনি পঞ্জাব, উত্তরপ্রদেশ এবং অন্ধ্রপ্রদেশের রাজনৈতিক দাবার বোর্ডে বোড়ে দিয়েই কিস্তিমাত করেছেন স্বচ্ছন্দে। যার সংস্থা ইন্ডিয়ান পলিটিক্যাল অ্যাকশন কমিটির বার্ষিক টার্নওভার কয়েক হাজার কোটি টাকা। যে সংস্থায় কর্মরত কর্মীদের মাসিক মাহিনার অঙ্ক শুনলে চোখ কপালে ওঠে এবং যে সংস্থার অফিস ছড়িয়ে প্রায় গোটা ভারতবর্ষ জুড়ে। তিনিই এখন পশ্চিমবঙ্গে এসে ‘চাচা আপন প্রাণ বাঁচা’ বলে পরিত্রাহী চীৎকার করছেন বলে তারই ঘনিষ্ঠমহল সূত্রে জানা যাচ্ছে। কারণটা কী? কারণ একটাই। পশ্চিমবঙ্গে মা-মাটি-মানুষের রাজত্বে নাকি তার আবিষ্কৃত কোনও কৌশলই কাজে লাগছে না। দিদির গত আট বছরের মহিমান্বিত প্রশাসনিক এবং সামাজিক ভূমিকার ফলশ্রুতি হিসেবে সব কৌশলই বুমেরাং হয়ে ফিরে আসছে তৃণমূলের আখড়ায়। কারণ পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ মানুষের কাছে প্রশান্ত কিশোরের বহু-চিন্তিত সব কৌশলই ‘শুধুই চমক এবং শুধুই সস্তার রাজনীতি’ছাড়া আর কিছুই বলে প্রতিভাত হচ্ছে না।
২০১১ সালে ৩৪ বছরের প্রবল প্রতাপান্বিত বামফ্রন্টকে কবরে পাঠিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একক ক্যারিশমায় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী পদে বসার ২-৪ সপ্তাহের মধ্যেই বোঝা গিয়েছিল— রাজ্যে সরকারের কাজ শুরু হয়েছে বেশ জমজমাট একটা নাটক দিয়ে। যেমন সাতসকালেই হাসপাতালে হাসপাতালে দিদির হাজিরা। দু’চার দিন স্বস্তির হাওয়া। তারপর যে কে সেই। জেলায় জেলায় প্রশাসনিক সভা। কোটি কোটি টাকা খরচ করে হম্বিতম্বি। কিন্তু সিন্ডিকেট রাজ, তৃণমূলি মস্তানি, দাঙ্গা, দিনেদুপুরে সাধারণ মানুষের ঘরে লুটপাট, ধর্ষণ বন্ধ হয়নি কিছুই। যাদবপুরের অধ্যাপক অম্বিকেশ মহাপাত্রকে খুনের চেষ্টার অভিযোগে জেলে ভরে, কামদুনির টুম্পা কয়ালদের ‘নকশাল’ বলে, ঝাড়গ্রামের শিলাদিত্যকে ‘মাওবাদী’ বলে পুলিশের হাতে তুলে দিয়ে, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বুদ্ধিদীপ্ত ছাত্রীকে ‘মাওয়িস্ট’ বলে তার চোখের জল ঝরিয়ে দিদি যখন ফুলন-রানির মতো সাম্রাজ্য পেতে বসেছেন, মানুষ ততদিনে বুঝে গেছে—পশ্চিমবঙ্গবাসীর কপাল পুড়েছে। মুখ নয়, মুখোশে ভরে গেছে। মা-মাটি-মানুষের বাঙ্গলা। এও বাহ্য। দিদির সবচেয়ে বড়ো নাটকের পর্দাটা ফাঁস হয়ে গেল ২০১৮-র পঞ্চায়েত নির্বাচনে যখন প্রকাশ্যেই তিনি ঘোষণা করে ছিলেনবাঙ্গলা হবে বিরোধীমুক্ত। নির্বিচারে রাজনৈতিক আক্রমণ, নির্বিচারে নির্বাচন পদপ্রার্থীদের হত্যা, হুমকি, শাসানির যে পরিবর্তিত অধ্যায় মানুষ প্রত্যক্ষ করল, তাতে পরিষ্কার হয়ে গেল রাজ্যে প্রশাসনটা নেই। আছে যা তা শুধু সংকীর্ণ রাজনীতি। ফলটা হাতেনাতে পেল তৃণমূল ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে। টনক নড়ল দিদির। ডাক পড়ল সেই প্রশান্ত কিশোরের। পিসি-ভাইপো মিলে দরজা বন্ধ করে প্রশান্ত কিশোরের হাতে নাকি ৫০০ কোটি টাকা গুজে দিয়ে প্রশান্তভাই বাঁচাও’ বলে কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছিলেন।
তা প্রশান্তের প্রশান্তিতে অশান্ত দিদি একটু শান্ত হয়েছেন বটে। বড়ো বড়ো করে চোখ পাকিয়ে কথা বলছেন না। প্রধানমন্ত্রীকে তুইতোকারি করে গালাগাল দিচ্ছেন না। গ্রামেগঞ্জে গিয়ে মাটির দাওয়ায় বসে গ্রাম্যবধূদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছেন, কালো চায়ে চুমুক দিচ্ছেন, ডিব্বা ভর্তি লজেন্স বিলি করছেন, শিশুদের আদর করছেন, কোলে নিচ্ছেন। সবই ভালো কথা। কিন্তু, তাতেও চিড়ে ভিজবেনা। কারণ ওই কাটমানি রহস্য। প্রসঙ্গটা তুলে দিলেন দিদি নিজেই। দলের কর্মীদের বিরুদ্ধে। সরকারি অফিসার, কর্মচারীদের বিরুদ্ধে। ঘনিষ্ঠ দলীয় নেতা, বিধায়ক, সাংসদদের বিরুদ্ধে। ভেবেছিলেন— এসব চমক দিয়েই পশ্চিমবঙ্গের ক্ষুব্ধ মানুষের হৃদয়ের কাছাকাছি ফিরে যাবেন পুরনো ‘ঘরের মেয়ে’র পরিচয়ে। হয়নি। কারণ কাটমানি কত নেওয়া হয়েছিল, তা যেমন পরিস্ফুট হয়নি, কত ফেরত এল, তাও জানা যায়নি। সবচেয়ে বড়ো প্রশ্ন দিদির কথা মতোই কাটমানির ৭৫ ভাগ কোথায় জমা পড়ল, কার কোষাগারে, সেটাও ‘গুপ্তধন’ হয়েই রইল। প্রশান্ত কিশোরের কৌশল ডাহা ফেল করে গেল। ফের নতুন কৌশল ‘দিদিকে বলো। গোটা রাজ্য জুড়ে হাজার হাজার ফ্লেক্স- “দিদিকে বলো। সরাসরি ফোন দিদিকে। নম্বর ৯১৩৭০৯১৩৭০। প্রথম দিনেই ২৪ ঘণ্টায় ১ লাখ অভিযোগ। সার্ভার ডাউন। দ্বিতীয় দিন থেকে ফোন বেজে যায়। কেউ তোলে না। প্রায় একমাস কেটে গেছে। কত অভিযোগ জমা পড়ল? দিদি তার কতগুলোর সমাধান করলেন? না, হিসাব দেবার দায় কেউ নেয়নি। না সরকার। না দল। ফের ডাহা ফেল প্রশান্ত কিশোর।
এবার নতুন কৌশল। দলীয় নেতাদের নির্দেশ জনসংযোগ বাড়াও। গ্রামে গ্রামে যাও । গরিব মানুষের ঘরে রাত কাটাও। পাত পেড়ে খাও, মেঝেয় শুয়ে ঘুমোও। মাথায় হাত নেতাদের। এয়ার কন্ডিশনার চালিয়ে সুখশয্যায় ঘুমোনোর অভ্যাস যে! বাধ্য হয়ে কেউ কেউ গেলেন। গেঞ্জি লুঙি পরে ছবিও তোলালেন পোষ্য চিত্র সাংবাদিকদের দিয়ে। পোষ্য সংবাদপত্রে তা ঢালাও করে ছাপাও। হলো। কিন্তু মানুষ মুচকি হাসল। মুখ বেঁকিয়ে বলল—যত্ত সব ভড়ং! জনসংযোগ কর্মসূচি জলে। এখন স্বয়ং দিদিই নেমেছেন দলের হয়ে জনসংযোগ করতে। মুখ্যমন্ত্রী কাম দলনেত্রী-কাম- পাবলিক রিলেশনস। অফিসার। লোকের হাসি আর থামছে না। দিদির চমকের রাজনীতির চোটে গমকে গমকে উঠছে হাসির ঢেউ গোটা রাজ্য জুড়ে। জাতহীন, বর্ণহীন, ধর্মহীন সেই হাসির ঢেউ য়ে তোলপাড় বঙ্গ রাজনীতি, সমাজনীতিও। পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতিতে এত বড়ো রসসৃষ্টি কেউ করতে পারেননি। বোধহয় স্বয়ং শিব্রাম চকরবরতিও নয়।
একটা লাভ অবশ্য হয়েছে। হুঁকোমুখো হ্যাংলা’দের মুখে পশ্চিমবঙ্গের দিদি আর তার ভাই প্রশান্ত হাসি ফোটাতে পেরেছে। বামফ্রন্টের ৩৫ আর তৃণমূলের ৯ টানা ৪২ বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ বড়ো কষ্টে আছে। কষ্ট এতটাই যে মানুষ হাসতে ভুলে গিয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গের পরিবর্তিত রাজনীতিতেশাসকদলের এই হাস্যরসসমৃদ্ধ রাজনৈতিক নাট্যচর্চা মানুষের মুখে অন্তত একটু হাসি ফোটাতে পেরেছে। পেটে ভাত, হাতে কাজ থাকুক আর নাই থাকুক।
প্রশান্ত কিশোর— এবার আপনার কৌশল কী? থেমে গেলে তো চলবে না। ৫০০ কোটি! সে তো অনেক টাকা। এত ছেলে-মেয়েকে চাকরি দিলেন। সহজে তো তাড়াতেও পারবেন না। তাহলে এবার কী নয়া স্লোগান? “দিদিকে বলো তো ফেল! এবার বরং ফ্লেক্স ছাড়ুন—‘হরি বলো সঙ্গে চলো। ২০২১ তো আর বেশি দেরি নেই।
সুজিত রায়
2019-09-06