আমবাগানের মাঝখানে মালদা শহর থেকে আট কিলোমিটার দূরে জঙ্গলের মধ্যে জহুরা কালীমন্দির। সবুজ ক্ষেত এবং আমবাগানে ঘেরা মন্দিরটি বাংলাদেশের সীমান্তের খুব কাছে। অবস্থিত। মায়ের নাম অনুসারেই স্থানটির নাম জহুরাতলা। গোবিন্দপুর মৌজায়। মন্দিরের আশেপাশে বসতি নেই বললেই হয়। কথিত আছে মূল মন্দিরটি রাজা বল্লাল সেন (১১৫৯-১১৭৯) তৈরি করেছিলেন। বল্লাল ও লক্ষ্মণ সেন হিন্দুধর্ম ও সংস্কৃতি পুনর্জাগরণের যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন তার পরিপ্রেক্ষিতে নগর রক্ষার মহাশক্তির সহায়তা কামনায় এই কালীমন্দির স্থাপন করা খুবই সম্ভব। তাহলে এটি অন্তত সাড়ে সাতশো বছরের প্রাচীন মন্দির। যদিও এর সমর্থনে কোনো ঐতিহাসিক প্রমাণ পাওয়া যায় না।
মালদহের ভাটিয়া পরগনার অন্তর্গত গোবিন্দপুর গ্রামের বাসকারী সাধক মা চণ্ডীকে কল্পনা করে একটি বেদি তৈরি করে পূজা শুরু করেছিলেন। এই সাধক তেওয়ারী বংশের চতুর্থ পুরুষ পরম সাধক হীরালাল এক রাত্রে স্বপ্নে দেখেন যে মা বিকট মুর্তি ধারণ করে তার সম্মুখে আবির্ভূত হয়েছেন। মা বিকটরূপিণী, করুণার চিহ্নবিহীন, মুখমণ্ডল রক্তবর্ণ, রক্তজিহ্বা নির্গত, ত্রিনেত্র বিস্ফারিতা,দন্তরাজিবিকশিত, দুপাশেদুটি বরাহদন্ত। চণ্ডীমূর্তির কায়া সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। চণ্ডী দেবীর মহাকালীর এমন বিকট মূর্তি সারা বঙ্গে এমনকী ভারতেও আর কোথাও আছে বলে জানা যায় না। এটি আসলে মায়ের মূর্তি না বলে মুখোশ বলাই সমীচীন। রক্তবর্ণ সিন্দুরে চর্চিত, উঁচু ঢিপি বা বেদির উপর মায়ের একটি বড়ো মুখোশ। এর নীচে দুপাশে আরও দুটি। মুখোশ অপেক্ষাকৃত ছোটো আকারের। দক্ষিণদিকে রয়েছে মহাদেবের দুটি মুখোশ ও একটি শিবলিঙ্গ। তেওয়ারীর পঞ্চম প্রজন্মের বংশধর মুকুল তেওয়ারী বলেছিলেন যেহেতু শক্তি ও শিবের একত্র অবস্থান তাই গর্ভগৃহের ভিতরে একটি শিবলিঙ্গ স্থাপন করা হয়েছিল। এক সময়ে গভীর জঙ্গলে আবৃত জহুরা দেবী ছিলেন দুর্ধর্ষ ডাকাত দলের আরাধ্য দেবী। ডাকাতদল পূজা দিয়ে মায়ের কাছে সাফল্য কামনা করে ডাকাতি করতে বেরিয়ে যেত। এদের মধ্যে কেউ কেউ প্রভূত ধনসম্পত্তির অধিকারী হয়েছিল।
এক সময় রাঢ়বঙ্গ ও বরেন্দ্রভূমিতে বহু বছর ধরে মাৎস্যন্যায় চলেছিল। সে সময়ে বর্তমান মালদহ থেকে রাজশাহী রংপুর অঞ্চলে ঠাঙাড়েও ডাকাতদের উৎপাত ছিল খুব বেশি। ঠাঙাড়েরা যেমন সড়কপথে পথিকদের সর্বস্বান্ত করত তেমনি জলপথে বড়োবড়ো নৌকা দিয়ে ডাকাতি করে ফিরত। বঙ্গিমচন্দ্রের দেবী চৌধুরাণী উপন্যাসে তার পরিচয় পাওয়া যায়। এই সব ডাকাত দলের প্রায় সবাই ছিল শক্তিসাধক। গভীর অরণ্যের মধ্যে মন্দির স্থাপন করে বা পরিত্যক্ত মন্দির সংস্কার করে কালীমূর্তি প্রতিষ্ঠা করে কঠোর নিয়মে মায়ের আরাধনা করত। বঙ্গদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এইরকম পরিত্যক্ত মন্দির এখনও কিছু কিছু দেখা যায়। মালদহের জহুরা মন্দির তেমনই এক নিদর্শন। মা কালী কালক্রমে কীভাবে জহুরা কালীতে রূপান্তরিত হলেন সে রহস্য অনুদঘাটিত থেকে গেছে। এ সম্বন্ধে যে সব কাহিনি প্রচলিত আছে তা সবই আনুমানিক।
প্রচলিত কাহিনির একটিতে বলা হয়েছে রাজা হোসেন শাহের আমলে এক প্রবল প্রতাপশালী রাজপুরুষ মন্দিরটি ধ্বংস করতে এসে মায়ের অলৌকিক শক্তি অনুভব করে ফিরে যাবার সময় বলেন ‘ইসমে জহরত হ্যায়’। এই উক্তি থেকে লোকমুখে মায়ের নতুন নাম প্রচারিত হয় ‘জহুরা দেবী। মালদহের মন্দিরে ‘শ্রীশ্রী জহুরা মন্দির’নামই লেখা আছে। দ্বিতীয় কাহিনির সঙ্গে জড়িয়ে আছে কালাপাহাড়ের নাম। কালাপহাড় হিন্দুমন্দির ধ্বংস করতে করতে গৌড়বঙ্গে আসে। ভীতসন্ত্রস্ত গ্রামবাসীরা পরামর্শ করে মন্দিরের মধ্যে গর্ত করে মূর্তিটি সেখানে রেখে মাটি চাপা দিয়ে দেন। কালাপাহাড় মন্দিরে মূর্তি নেই দেখে ফিরে যায়। আজ পর্যন্ত মাটি খুঁড়ে মূর্তিটি বের করার সাহস কেউ দেখায়নি।
প্রতি শনিবার ও মঙ্গলবার মায়ের পূজা হয়। পূজা দিনের বেলাতেই সম্পন্ন হয়। রাত্রে মন্দির বন্ধ থাকে। জহুরা দেবীর প্রধান উৎসব বৈশাখ মাসে। দূরদূরান্ত থেকে বহুলোক আসেন প্রধানত রোগ নিরাময় কামনায়। তখন বেশ বড়ো মেলা বসে। মন্দিরের চিরাচরিত নিয়মানুসারে বৈশাখের প্রথম ও শেষশনিবার অথবা মঙ্গলবার পাঁঠা বলি দেওয়া হয়। জহুরা মায়ের নাম সর্বত্র রোগমুক্তিকারী হিসেবে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণকরা হয়। বহু রাজ্যের বহু লোক মায়ের কাছে মানত করে কঠিন রোগ থেকে আরোগ্য লাভ করেছে বলে জনশ্রুতি আছে। এদের মধ্যে সুদূর কেরল, কর্ণাটক ও মহারাষ্ট্রের লোকও আছেন।
স্বপন দাশগুপ্ত
2019-11-02