বিদ্যাসাগরের মূর্তি যারা ভেঙেছে সেই সব কৃমিকীটদের মানুষ বলতে আমার ঘেন্না হয়। তারা জননীর জঠরের লজ্জা। তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি কী দেওয়া যায়, আমি জানি না কিন্তু তারা যে মানুষের ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়ায়, এটাই অন্যান্যদের জন্য এক বিরাট শাস্তি। আইনানুগ পথে তাদের বিচার হোক। কিন্তু যে সাজাই তারা পাক না কেন, সেই শাস্তি তাদের করা পাপের তুলনায় কমই হবে। এর বেশি এই ন্যক্কারজনক ঘটনা নিয়ে কিছুই বলার নেই। যে বাংলাকে মানুষের বাসযোগ্য করে তোলার পিছনে বিদ্যাসাগরের অবদান অসীম, সেই বাংলার রাজধানী কলকাতা ছেড়েই তিনি কার্মাটাড়ে চলে গিয়েছিলেন, সে আমাদের সকলের কাছেই এক মস্ত বেদনার বিন্দু। কিন্তু তার জীবনাবসানের পরও কলকাতা সেই মহাপুরুষকে প্রাপ্য সম্মান দিতে পারেনি। সত্তরের দশকের সেই উত্তাল দিনগুলোতে বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙা হয়েছিল, আজ আবার প্রায় পঞ্চাশ বছর পর, ভিন্ন পরিস্থিতিতে সেই জঘন্য ঘটনার পুনরাবৃত্তি হল।
সেই সময় নকশালরা ভেঙেছিল নাকি কংশাল, আজ কারা ভেঙেছে, তাই নিয়ে সমস্ত তরজা একটা শূন্যগর্ভ আলোচনায় পর্যবসিত হতে বাধ্য। তৃণমূল বলছে, বিজেপি আশ্রিত গুণ্ডারা ভেঙেছে; বিজেপি পালটা বলছে, শাসক দল আশ্রিত লুম্পেনরাই এই কাজের পিছনে। এই কথার খেই ধরে, মূর্তি ভাঙার সংস্কৃতি কার এবং কার নয়, আগে যারা বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভেঙেছিল বলে অভিযোগ তারা এখন কোন শিবিরে, সেই সমস্ত কথা চলে আসবে। কথার তুবড়ি ছুটবে, আক্রমণ– প্রতি আক্রমণে আকাশ কালো হয়ে উঠবে।
তাই যা প্রয়োজন তা হল, এই জঘন্য কাজ যারা করেছে, তাদের খুঁজে বের করা। আর তারা যে দলের জার্সি গায়েই থাকুক না কেন, তাদের শাস্তি দেওয়া। কিন্তু অভিযোগ করলেই কেউ যেহেতু দোষী হয়ে যায় না তাই মনে রাখতেই হবে, রাইখস্ট্যাগে আগুন লাগার পর বলে দেওয়া হয়েছিল, কারা আগুন লাগিয়েছে কিন্তু আসলে তারা আগুন লাগায়নি। জননেতা হেমন্ত বসুর হত্যার পর বলে দেওয়া হয়েছিল, কারা খুন করেছে, পরে প্রমাণ হয়েছিল যে তারা খুন করেনি। আরও অনেক ক্ষেত্রেই প্রাথমিকভাবে কাউকে দোষী সাব্যস্ত করার পর ঘটনা অন্যদিকে বাঁক নিয়েছে। তাই আগেই এরাই দায়ী ধরে না নিয়ে প্রকৃত তদন্ত হোক। সেই তদন্তে যে সত্য উঠে আসবে তার ভিত্তিতে দোষীকে চিহ্নিত করা হোক।
বিরোধীকে ‘স্পেস’ দেওয়া গণতন্ত্রের আবশ্যিক শর্ত। আবার বিরোধীরও নিজের লক্ষণরেখা পেরিয়ে যাওয়া উচিত নয়। বিগত বেশ কিছুদিন যাবত পশ্চিমবাংলা জুড়ে যে ভয়ঙ্কর হিংসার আবহ তৈরি হয়েছে, তা বন্ধ হোক– দলমত নির্বিশেষে সমস্ত সাধারণ মানুষের তাই প্রার্থনা। তার জন্য নির্বাচনে যাঁরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন, সেই সমস্ত রাজনৈতিক দল একত্রে বসুন। আলোচনা করুন। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাক কিন্তু বিশ্বের কাছে বাংলার মাথা নীচু করে দেওয়ার মতো হিংসা যেন না ঘটে।
আর পুলিশকে বলব,মোবাইল ক্যামেরা চলে আসার ফলে এখন তো সমস্ত ঘটনার উৎসে পৌঁছনো অনেক সহজ। কোনও পক্ষপাত দ্বারা চালিত না হয়ে, প্রকৃত দোষীদের খুঁজে বের করুন, কোনও না কোনও মোবাইলে ছবি পাওয়া যাবেই। কোনও দলেরই সাধারণ সমর্থক এই ধরনের জঘন্য কাজ সমর্থন করতে পারে না।
চালের ভিতর যে কাঁকর থাকে, সমর্থকদের ভিতরে যে গুণ্ডারা থাকে তাদের চিহ্নিত করুন, শাস্তি দিন। আর একটা কথা, সেই গুণ্ডা ধরা পড়ার আগে একে ওকে তাকে দাগিয়ে দেওয়ার অন্তহীন হিংসা বন্ধ থাক।
ইতিমধ্যে আমরা মনে মনে বিদ্যাসাগরের পা ছুঁয়ে, আরও একবার ক্ষমা চেয়ে নিই। আমরা মানে, আমরা সবাই।
আমরা যারা অন্যকে “তুমি কোন দলে” জিজ্ঞেস করতে করতে, ভুলে গেছি, দলের উর্ধে মানুষ। আর মানুষের মাথার উপর সেই মহামানব, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।
বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়
সৌজন্যে দ্য ওয়াল