২০১৯-এর লােকসভা নির্বাচন শেষ এবং ফলও প্রকাশ হয়ে গিয়েছে। বিজেপি বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে এই ভােটে জয়লাভ করেছে। দেশের অন্যান্য রাজ্যের। সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গেও বিজেপি অভূতপূর্ব সাফল্য লাভ করেছে। সারা দেশে এনডিএ পেয়েছে ৩৫০, ইউপিএ ৯০, অন্যান্য পেয়েছে ১০২টি আসন। এরাজ্যে বিজেপি ১৮, তৃণমূল ২২ ও কংগ্রেস ২টি। ভােটের আগে থেকে রাজ্যের শাসকদলের স্লোগান ছিল ‘দু’হাজার উনিশ, বিজেপি ফিনিশ। এছাড়া বলা হতাে ‘বিয়াল্লিশে বিয়াল্লিশ। কিন্তু ফল প্রকাশের পর দেখা গেল বিয়াল্লিশে বিয়াল্লিশ তাে নয়ই, বরং বাইশ। আর বিজেপি ফিনিশ তাে নয়ই, বরং তৃণমূলের ঘাড়ের উপর গরম নিঃশ্বাস ফেলছে।
কিন্তু হঠাৎ কী এমন হলাে যে—চৌত্রিশ বছরের বাম শাসনের জগদ্দল পাথরকে বাঙ্গলা থেকে সরানাের জন্য মানুষ যার হাত ধরে বাঙ্গলায় পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখেছিলেন, এখন সেই হাত ছেড়ে বাঙ্গলার মানুষ বাঁচতে চাইছেন কেন? মানুষ তৃণমূলের প্রতি এত ক্ষিপ্তই বা হয়ে উঠছে কেন?
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় এই রাজ্যে রিগিং শব্দটি সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের আমলে ভােট রাজনীতিতে প্রবেশ করে। এর উপর ১৯৭৭ সালের লােকসভা নির্বাচনে মানুষের ক্ষোভের প্রধান কারণ ছিল গণতন্ত্র ও ব্যক্তিস্বাধীনতার উপর তৎকালীন শাসক কংগ্রেস দলের ন্যাক্কারজনক আক্রমণ। সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠরােধ, মিসা, ডিআইআর-সহ কালা কানুনে নির্বিচারে গ্রেপ্তার পরিস্থিতিকে দুর্বিষহ করে তুলেছিল। সেসময় বামেরা ক্ষমতায় এসে অভিনব বৈজ্ঞানিক রিগিং প্রয়ােগ করে নিজেদের আধিপত্যকে কায়েম রেখেছিল। বামেদের আমলেই বিরােধী দলের এজেন্টদের উপর হামলা শুরু হয়। বিরােধী দলের কোনও এজেন্ট ভােটের দিনে বুথে থাকবে না, এটাই ছিল বামেদের নির্বাচনে জেতার কৌশল।
২০১১ সালে বিপুল জনসমর্থন নিয়ে যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলেন, তখন থেকে ২০১৬ সালের মধ্যেই তৃণমূলের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ পুঞ্জিভূত হতে থাকে। কিন্তু উপযুক্ত বিরােধী দল না পাওয়ায় মানুষ তা সম্পূর্ণ প্রকাশ করতে পারেননি। কিন্তু শেষ দু’বছরে বাঙ্গলার রাজনৈতিক চালচিত্রে অনেক পরিবর্তন এসেছে। রাজ্যের শাসকদলের বিরুদ্ধে মানুষের অসন্তোষ তীব্রভাবে ব্যক্ত হতে শুরু করে। গ্রাম থেকে শহর সর্বত্রই চিত্র প্রায় একই রকম। তৃণমূলের রাজত্বে মানুষ বড় অসহায়। কাজ নেই, শিল্প নেই, নিরাপত্তা নেই, হাসপাতালে চিকিৎসক নেই, আইনের শাসন নেই, নিরাপত্তা নেই, আক্রান্ত ও অত্যাচারিতদের বিচার পাওয়ার কোনও ব্যবস্থা নেই। উপরন্তু দেশি-বিদেশি সন্ত্রাসীদের বাড়বাড়ন্ত। তারা রাজ্যে নিশ্চিন্তে সন্ত্রাস চালালেও সরকারের মদত পায়। দলের তরফ থেকে শুধুই জুলুম, তােলাবাজি, লুঠ এবং প্রতারণার অভিযােগে ফুঁসছে সাধারণ মানুষ।
বিশেষ করে গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে ব্যাপকভাবে মনােনয়নে বাধা, ভােটের দিন বুথ দখল ও ছাপ্পাভােট এবং গণনা কেন্দ্রে গুন্ডামি ও জালিয়াতি এই ক্ষোভ ও ঘৃণার প্রধান কারণ।
সারাদেশে সাত দফায় নির্বাচন হয়েছে। প্রায় ১০০ কোটি মানুষ এই নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। কোথাও নির্বাচন ঘিরে কোনও অশান্তির খরব নেই দু একটি বুথ বাদ দিলে। অথচ পশ্চিমবঙ্গের প্রথম দফা থেকে সপ্তম দফা পর্যন্ত প্রতিটিতেই অশান্তি শুধু নয়, বিরােধীদের ওপর ব্যাপক আক্রমণ হয়েছে। এক কথায় রাজ্যের গণতান্ত্রিক কাঠামােকে বর্তমান সরকার ধ্বংস করে দিয়েছে।
পুলিশ সরাসরি এই ভােট জালিয়াতিতে অংশ নিয়েছে, ভােটকর্মীদের হুমকি দিয়েছে। এর আগে পঞ্চায়েত নির্বাচনে এক সৎ প্রিসাইডিং অফিসারকে অপহরণ করে হত্যা করেছে তৃণমূল আশ্রিত দুষ্কৃতীরা। শাসক দলের মস্তানদের নির্দেশ মতাে পুলিশকে কাজ করতে বাধ্য করেছে। এসবই ঘটেছে জনসমক্ষে। জনগণ ধরে নিয়েছেন যে তৃণমূল ক্ষমতায় থাকলে অবাধ ও সুষ্ঠ ভােটদান সম্ভব নয়। তাই তৃণমূলকে শাসন ক্ষমতা থেকে সরাতে হবে, নইলে ভােটের নামে এই প্রহসন বন্ধ হবে না। ভােট দেওয়ার অধিকার যেকোনও মূল্যে রক্ষা করতে হবে। তাই নিজের ভােট নিজে দেব এবং ভােট লুঠেরাদের রুখে দেব এই মনােভাব ক্রমেই জোরালাে হচ্ছিল। লােকসভা ভােটের আগে থেকেই রাজ্যের। বিভিন্ন প্রান্তে তা প্রতিফলিত হতে দেখা গেছে। আগামীদিনেও যদি রাজ্যের সাধারণ মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে গণতন্ত্র রক্ষার দাবিতে সরব হন তা হলে পশ্চিমবঙ্গের হৃতগৌরব আবার ফিরে আসবে, এ নিয়ে কোনও দ্বিমত নেই।
জনগণের আশীর্বাদে রাজ্যের বিরােধী দলের যে সমস্ত নেতা-নেত্রী সাংসদ নির্বাচিত হলেন তাদের দায়িত্ব কিন্তু বহুগুণে বেড়ে গেল। ভােটের দুঃখজনক স্মৃতি মুছে ফেলে সর্বশক্তি নিয়ে জনগণের পাশে না দাঁড়ালে তারা কিন্তু আগামীদিনে মুখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হবেন। তৃণমূলের যে সমস্ত সাংসদ নির্বাচিত হলেন তারা আগের মতাে যদি সম্প্রদায়িক বিভেদ ও হিংসা পরিত্যাগ না করেন তাহলে রাজ্যবাসী আগামীতে তাদের সমূলে উৎখাত করে ফেলবেন।
মনীন্দ্রনাথ সাহা
2019-05-31