চতুর্থ দফা ভোটের দিন দুপুরে টিভিতে দেখেছিলাম, একটা বুথের কাছে রিপোর্টারের সামনে দাঁড়িয়ে হাউমাউ করছেন এক ভদ্রলোক। কথায় কথায় বোঝা গেল, তিনি কোনও বিরোধী পার্টির এজেন্ট, সম্ভবত কংগ্রেসের। দেখুন দাদা কী করে যাচ্ছে। আমায় টেনে হিচড়ে উঠিয়ে দিল, বুধ থেকে বের করে দিয়েছে। লোকজন নিয়ে ছাপ্পা মেরে যাচ্ছে সেই দশটা থেকে।
—কে করছে, কোন লোকটা? প্রশ্ন করলেন রিপোর্টার।
—ওই যে, বড়ো গাছটার তলায় দাঁড়ায়ে আছে। আপনাদের দেখে উখানে চলে গেছে, যেন কিছু জানে না !
—কোন পার্টির লোক?
—কোন পার্টি আবার, টি এমসি। কমিশনের বাবুরা ওকে বারণ করে দিচ্ছে বুথে ঢুকতে। ও কোনও কথা শুনে না, কারুর না।
রিপোর্টার ছেলেটি বেশ সাহসী। বললেন : চলুন তো দেখি একটু কথা বলি। আসুন, আপনার সঙ্গেও কথা বলিয়ে দিই। আরে ভোটটা তো করতে হবে।
গাছতলায় দাঁড়িয়ে আছে যেন ভিজে বেড়াল।—আরে আপনি এখানে কী করছেন, আপনাকে তো আসতেই বারণ করেছে কমিশন— বুম বাগিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন রিপোর্টার।
—কই কিছু করছি না তো। আমার পরিবারের লোকেরা গেছে ভোট দিতে। ওদের নিয়ে বাসায় ফিরব।
—মিথ্যা কথা বলছে। এই দেখুন স্যার, আমি ছবি তুলেছি, এই দেখুন ঘরের ভিতর ভোটবাবুদের পাশে, ভোটারদের লিস্ট দেখছে। ওর চারপাশে সব ওদেরই লোক।
—ওর ছবি মিথ্যা। বাজে ছবি তুলেছে দাদা। আমি বুথে ঢুকিনি। এখানে ছিলামও না। বাড়ির লোকদের ভোট দেওয়াতে নিয়ে এসেছি। হয়ে গেলে চলে যাব।
রিপোর্টার হেসে বললেন : কী বলছেন আপনি! ছবি কি কখনও মিথ্যা হয়!
আরও খানিক বোঝাবার চেষ্টা করল সেই ছাপ্পা-ম্যানেজার। শেষে হাল ছেড়ে দিয়ে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইল।
সত্যি বলতে, কিছুটা অবাক হয়ে গিয়েছিলাম সেদিন। তাহলে কি মিডিয়ার অবলুপ্ত শিরদাঁড়া নতুন করে গজিয়ে উঠছে? তৃণমূল নামক অদ্ভুতুড়ে পার্টিটা ক্ষমতায় আসার পর থেকে যেভাবে ওরা সবকিছু গ্রাস করার অভিযানে নেমেছে, তাতে ভোটের সময়ে এমন সাহসী রিপোর্টিং ধাঁধা লাগায় বইকি। মুখ্যমন্ত্রীর পেয়ারের কেষ্ট ওরফে বীরভূমের অনুব্রত মণ্ডলকে রিপোর্টার জিজ্ঞেস করছেন, ভোট তো শেষ হয়ে এল। আপনি তাহলে কী বলবেন, কার জয় হলো? আধা সেনা, না নকুলদানা? এক গাল হেসে মুণ্ডিত-মস্তক কেষ্টবাবু বলে দিলেন— নকুলদানার জয়।
এই ধরনের কথাবার্তা—সাংবাদিক খোঁচা মারছেন, হেসে হেসে সেই খোঁচা হজম করছেন শাসকদলের দোর্দণ্ড প্রচাপ জেলা নেতা—এমন দৃশ্য যে কতকাল দেখিনি! সেই ছোটোবেলা থেকে শুনে আসছি মিডিয়া নাকি গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ। কী জানি বাবা অত বুঝি না। তবে কয়েক বছর আগে অবধি বাংলা কাগজ আর টিভি চ্যানেলগুলো যেসব রিপোর্টিং করত, ছবিটবি দেখাত, মানুষ সেগুলো দেখতে আর পড়তে চাইত বলেই মনে হয়। বামফ্রন্টের জমানায় সবক’টা বড়ো কাগজে রাইটার্সের হাঁড়ির খবর টেনে বের করার স্পেশাল রিপোর্টার ছিল বলে শুনেছি। তাদের কাজ ছিল, সরকারের কাজকর্মের ছ্যাঁদাগুলো খুঁজে খুঁজে বের করা আর হাটে হাঁড়িভাঙা। বেজায় চটে যেতেন সিপিএম আর বামফ্রন্টের কেষ্টবিষ্টরা। খবরের কাগজ আর চ্যানেলের মালিকপক্ষের কাছে নালিশও যেত। মালিকরা রিপোর্টারকে ডেকে একটু বকে-টকে দিতেন। তারপর আবার যে কে সেই। বামফ্রন্টের আমলে সিটুর অত্যাচারে একের পর এক কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। সেইসব প্রতিবেদন হাত খুলে রিপোর্টাররা লিখতেন। আর পেল্লায় সাইজের হেডিং দিয়ে ছাপতেন নিউজ এডিটররা। দু-একটা স্পেশাল কেস ছাড়া ওইসব তদন্তমূলক রিপোর্টিংয়ে মালিকরা হস্তক্ষেপ করতেন বলে শুনিনি। চন্দন বসুর ব্যবসা বাড়াতে বেঙ্গল ল্যাম্পের বাল্ক অর্ডার নিয়ে জ্যোতি বসু আর যতীন চক্রবর্তীর সেই ঐতিহাসিক মল্লযুদ্ধ— সেও তো বাঙ্গালি জেনেছিল খবরের কাগজের কল্যাণেই। বামফ্রন্টের অনেক দোষ ছিল। কিন্তু নিজেদের আর পার্টির স্বার্থে মিডিয়াকে গলা টিপে খুন করো– এমন জাতের ফ্যাসিজম তারাও দেখাতে সাহস পাননি। অথচ কী অনায়াসে সেটা করলেন বাঙ্গলার স্বঘোষিত জনগণমন অধিনায়িকা! কখনও ধমকে, কখনও চমকে, কখনও সরকারি বিজ্ঞাপন বন্ধ করে, বিভিন্ন হাউসে আঁচল ধরা কিছু লোককে শীর্ষে বসানোর অপারেশন চালিয়ে এই আট বছরে বাংলা সাংবাদিকতাকে যে স্তরে নামিয়ে আনা হলো, স্বাধীনতার পর থেকে মিডিয়ার এই ধরনের অসম্মান ভারতবর্ষ দেখেনি। শুনতে পাই, পরপর দু’বার কলকাতা প্রেস ক্লাবের বার্ষিক ইলেকশনও কার্যত লাটে তুলে দিয়েছেন দিদি আর তার দলবল। সেখানে এখন রাজত্ব করছে জননেত্রীর পা-ধোয়া জল খাওয়া এমন কিছু লোক, মিডিয়া জগতে যাঁদের ট্র্যাক রেকর্ড আর কন্ট্রিবিউশনের বহর নিয়ে সকলে হাসাহাসি করে।
অর্থাৎ স্বাধনিভাবে চিন্তা করার কোনও অধিকারই কারও যেন না থাকে। কেউ যদি কোনও অপ্রিয় প্রশ্ন তোলে, তাকে বলা হবে মাওবাদী। তার হাউসের কর্তাদের ওপর চাপ সৃষ্টিকরা হবে, যাতে তাকে অকিঞ্চিৎকর কাজ দেওয়া হয় অথবা একেবারে সরিয়ে দেওয়া হয়। স্বাধীনচেতা সরকারি অফিসারদের হাতে ধরানো হচ্ছে কম্পালসারি ওয়েটিংয়ের মতো বকচ্ছপ; কেড়ে নেওয়া হচ্ছে কাজের অধিকার, যদিও প্রতিদিনই তাকে আসতে হবে। অফিসে, বসে থাকতে হবে বিকেল অবধি, তারপর পাহাড়প্রমাণ অপমান আর গ্লানি মাথায় করে বাড়ি ফেরা। সে তো তবু সরকারি চাকরি। বেসরকারি মিডিয়া হাউসগুলোয় কী করে হাত বাড়ান মাননীয়া দিদি? কী করে সেখানে টার্ম ডিকটেট করেন?
করেন একটাই কারণে। দিদি ভালো করে বুঝে নিয়েছেন, তার সত্তার মধ্যে যে স্বৈরাচারী উপাদান আছে, ভালো করে জল-বাতাস লাগিয়ে তাকে সুপুষ্ট করতে গেলে সর্বাগ্রে চাই মিডিয়ার টোটাল কন্ট্রোল। একটাও বেসুরো প্রতিবেদন যেন সাধের রাজ্যপাটকে বিব্রত না করে। এই কাজ করতে গেলে সবার আগে দরকার খানকতক নিজের লোক, যাদের নানা কৌশলে বিভিন্ন হাউসের মাথার দিকে ঢুকিয়ে দিতে পারলে বাকিটা তারাই করে দেবে।
এই অবস্থা কি অনির্দিষ্টকাল চলতে পারে? মুশকিল আছে। চিটফান্ডের কাগজ আর চ্যানেলগুলো মাননীয়ার অনুপ্রেরণায় তাদের প্রোপাগান্ডা মেশিনারি একরকমভাবে চালাচ্ছিল। জনসাধারণকে বিস্তর ঠকানোর পর তারা যখন বেআইনি অর্থলগ্নির ব্যবসা আর সামলাতে পারছে না, পঞ্জি স্কিমের স্বাভাবিক নিয়মেই ভেঙে পড়ছে প্রতিষ্ঠানের কলকবজা, তখন রে-রে করে মাঠে নেমে পড়ল শাসক দল আর ধামাধরা সরকার। কোথায় গেল সারদা কোম্পানির কোটি কোটি টাকা? রাতের অন্ধকারে কারা আসা-যাওয়া করতেন মিডল্যান্ড পার্কের অফিসে? কী তাদের রাজনৈতিক পরিচয় ? দিদিমণির আঁকা পৃথিবী আলো করা ছবিগুলো কারা কোটি কোটি টাকায় কিনল—এসব প্রশ্ন হারিয়ে গেল মাটির নীচে এমন কোনও গোপন বাংকারে, যেখানে একবার ঢুকিয়ে ফেলতে পারলে সহজে আর বের করা যায় না।
যতদূর মনে পড়ছে, চিটফান্ড কাণ্ডের পর থেকেই এ রাজ্যের মিডিয়াকে ধামাধরা প্রজাতি বানাতে শাসকরা একেবারে উঠে পড়ে নেমে পড়ে। ছোটো-বড়ো-মাঝারি কাগজ বা চ্যানেল সম্রাজ্ঞীর নজর থেকে কেউ বাদ পড়ল না। তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসতে হবে সবাইকেই। আনন্দবাজার, বর্তমান, টেলিগ্রাফ, এই সময়, আজকাল, এবিপি আনন্দ, জি ২৪ ঘণ্টা কেউ বাকি রইল না। সকলের মুখেই এক রা— দিদির জয়ধ্বনি করো আর বিজেপিকে ইট মারো। অনবরত বলতে থাকো, তোমরা সংকীর্ণ তোমরা সাম্প্রদায়িক। দিন থেকে রাত, রাত থেকে দিন যদি একই সুরে এতগুলো হাউস মিথ্যে প্রচার চালিয়ে যায়, রাজ্যের মানুষ তবে কোথা থেকে পাবে সঠিক খবর ?
এত করেও মানুষকে বোকা বানানো যাচ্ছে কি? পিষে ফেলা যাচ্ছে কি মানুষের সত্যি জানার আগ্রহকে ? সাতদফা নির্বাচনের প্রায় প্রথম থেকে ভোটকর্মীরা জানিয়ে দিলেন, কেন্দ্রীয় বাহিনী না পেলে তারা কাজ করবেন না। কারণ, তৃণমূলের ধামাধরা পুলিশকে তারা বিশ্বাস করেন না। হয়তো তাদেরই পথরেখা ধরে এতকাল বাদে একটু একটু করে লুকনো বাংকার থেকে বেরিয়ে আসছেন মিডিয়ার বন্ধুরা, যাঁরা সক্রিয় না থাকলে গণতন্ত্র কথাটারই কোনও মানে নেই।
দেখা যাক, আড় ভেঙে ময়দানে নামার সদিচ্ছা আর সক্রিয়তা কতদিন অটুট থাকে। দিন তো বদলাবেই। দিদিমণি চান আর না চান।
অমর ভৌমিক
2019-05-10