২ : দক্ষিণেশ্বর ও একটি মামলা

#দ্বিতীয়ার্ধ : #বিধিরবাঁধন

দেওঘরে বোমা বিস্ফোরণের সাফল্যের খবর ছড়িয়ে পড়ল বিপ্লবীদের মধ্যে। খবর গেল বিভিন্ন প্রবীণ বিপ্লবীদের নিকট। মলঙ্গা লেনের অনুকূল মুখার্জি এবং বরানগরের খগেন চ্যাটার্জি নগেন্দ্রনাথ সেনের মাধ্যমে হরিনারায়ন চন্দ্রকে ডেকে পাঠালেন। উল্লাসকরের পর হরিনারায়ন বোমা বানানোয় খ্যাতি করেছেন। উচ্চমানের বোমা বানানোর জন্য আবেদন এল প্রবীণদের নিকট হতে। যদি ভালো বোমা পাওয়া যায় তাহলে পুনশ্চ নব উদ্যমে কাজ সূচিত হবে।রাজি হয়ে গেলেন হরিনারায়ন চন্দ্র।
কিন্তু বোমা মত একটি সংবেদনশীল বস্তু তো আর লোকালয় বানানো যায় না। তায় ব্রিটিশ সরকারের ফোঁড়ের দল কুকুরের মত ঘুরছে গন্ধ শুঁকে। একটা নির্জন স্থান খুব দরকার ….এত দিন বোমা অল্প স্বল্প তৈরি হয়েছে এর তার বাড়ি, সুযোগ সুবিধা মত।  চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে সেসব করে বোমা বানানোর কাজ চলে না। কেবলমাত্র বোমা তৈরি করলেই হবে না, শিক্ষাও দান করতে হবে বোমা তৈরির। বিভিন্ন স্থান থেকে বিপ্লবীরা বোমা তৈরির নিমিত্ত আবেদন করতের শুরু করেছিল। তাঁরা দূর দুরান্ত হতে আসবেন বোমা তৈরি র শিক্ষানবীশ হিসাবে।তাদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা দরকার….


তাই প্রয়োজন পড়ল একটি বড় বাড়ির। যেটি হবে বোমা ও বিপ্লবীদের একটি গুপ্ত ঠিকানা। সত্যি বলতে কি এর পূর্বে বিপ্লবীদের পরস্পর দেখাশোনা এবং পরামর্শের গোপন স্থান ছিল….না না যে জায়গার নাম বলব অবাক হবেন না …সেই স্থান ছিল দক্ষিনেশ্বর মন্দিরের #পঞ্চবটী_বন। হ্যাঁ মা দয়াময়ী , শ্রী রামকৃষ্ণ দেবের পদধূলি ধন্য দক্ষিণেশ্বর মন্দির … এই খানেই ১৯১৪ সালে রডা কোম্পানির পিস্তল লুঠের সময় খগেন চ্যাটার্জি , এম এন রায়, বিপিনবিহারী গাঙ্গুলীরা গুপ্ত পরামর্শ করেছিলেন। যিনিই ব্রহ্মময়ী তিনিই দেশ মাতৃকা। তাঁর জন্য লড়াই । তাঁর আশীর্বাদ তো আস্তিক নাস্তিক সব সন্তানের প্রতি।
যা হোক, দক্ষিণেশ্বরে স্থানীয় বিপ্লবীদের বাড়ি খোঁজার দায়িত্ব দেওয়া হলো । বলা হল দক্ষিণেশ্বর এলাকার মধ্যেই বাড়ি পেলে ভালো হয় ।কিছুদিনের মধ্যে একটি নির্জন বাড়ির সন্ধান এনে দিলেন এক বিপ্লবী…..
 দক্ষিণেশ্বর মায়ের মন্দির থেকে বাড়ির অবস্থান ছিল কিছুটা উত্তরে , আড়িয়াদহের বাচস্পতি পাড়ায় । খুব প্রাচীন বাড়ি, ভাড়া অত্যন্ত কম।  চারিদিকে জঙ্গল পুকুর । কাছাকাছি লোক বসতিও কম , মাত্র কয়েকঘর গরিব কৃষক মানুষের বাস, লোক চলাচলও খুব কম।  পুলিশের সন্দেহ বা সন্ধান দুটিই পাওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। সকলের বাড়ি দেখে পছন্দ হল। ভাড়া নেওয়া হলো সেই বাড়ি।

এর বেশ কিছুদিনের মধ্যে উত্তর কলকাতার ,#শোভাবাজার_৪_নম্বর_স্ট্রিট এই ঠিকানায় আরও একটি ঘর ভাড়া নেওয়া হয়েছিল। চিৎপুর শোভাবাজার মোড় থেকে পশ্চিমে মিনিট দশেক হাঁটাপথে গঙ্গার কাছাকাছি বাঁ হাতে আজও দাঁড়িয়ে রয়েছে প্রায় দেড় শতাব্দি প্রাচীন ঐতিহাসিক বাড়িটি।বিশাল দোতলা , তিন মহিলা বাড়ি। এখন বাড়িটি বিক্রি হয়ে গেলেও , অনেক বাই নম্বর পেলেও বাড়ির ঠিকানা একই রয়ে গেছে । গোলক ধাঁধার মত বাড়ি।একটু পর পর বাঁ হাতে ডান হাতে দোতলায় ওঠার সিঁড়ি।শতাধিক ভাড়াটের বসবাস । বিপ্লবীদের লুকিয়ে থাকার আদর্শ স্থান।

 বাচস্পতি পাড়ায় বাড়ি ভাড়া নেওয়ার পর বাংলার বিভিন্ন প্রান্ত এমনকি বাংলার বাইরে থেকেও একে একে বিপ্লবীরা আসতে শুরু করলেন। সুদূর চট্টগ্রাম থেকে এলেন বিপ্লবীরা। ওই বাড়িতে গড়ে উঠল একটি বোমা তৈরীর কারখানা । বাংলার তৈরি বোমার চাহিদা তখন সমগ্র ভারতবর্ষজুড়ে। অন্য প্রদেশের বিপ্লবীরা তখনও উন্নত মানের বোমা তৈরি করতে শেখেন নি । ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলাই ছিল প্রথম রাজ্য যেখানকার বিপ্লবীরা প্রথম উন্নত মানের বোমা তৈরি করতে শিখেছিলেন এবং অন্য প্রদেশের বিপ্লবীদের বোমা তৈরি করতে শিখিয়েছিলেন । #দক্ষিণেশ্বরে_বোমা_তৈরীর_কারখানায় বোমা তৈরি করতে শেখাতে শুরু করলেন বিপ্লবী হরিনারায়ন চন্দ্র।

তবে এখানে একটা টুইস্ট ছিল।  হরিনারায়ন চন্দ্র কিন্তু পুরনো ফর্মুলায় বোমা তৈরি শেখাতেন না । তিনি শেখাতেন  #টিএনটি_বোমা… যার উন্নত সংস্করণ আমেরিকা ব্যবহার করেছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। বিভিন্ন কেন্দ্রের বিপ্লবীরা এখানে বোমা তৈরি করতে আসতেন । হরিনারায়ন চন্দ্রের নিকট এখানেই বোমা তৈরি শিখেছিলেন যতীন দাস, শচীন সান্যাল এবং রাজেন লাহিড়ী। 
দক্ষিণেশ্বর বাচস্পতি পাড়ার নির্জন বাড়িতে বোমা তৈরি হচ্ছে আর তা চলে যাচ্ছে চট্টগ্রাম থেকে লাহোরে। কিন্তু সব থেকে উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল যে, বোমা কিন্তু কারো কাছে বিক্রি করা হতো না অর্থাৎ লাভ করবে বা লভ্যাংশ নিমিত্ত বোমা তৈরি করে বোমা আবার নিজেদের সহযোদ্ধাদেরই  বিক্রি করবে , দেশের কাজে এরম চিন্তা ধারা কিন্তু তখনও বিপ্লবীদের মধ্যে তৈরি হয়নি।

স্বাভাবিকভাবেই  দেখা দিল অর্থাভাব । অর্থের জন্য বোমা তৈরি বন্ধ হয়ে যাবে ? অর্থের কাছে স্বাধীনতার যুদ্ধ হারবে? টাকা চাই টাকা ….. আলোচনা বসল …আলোচনায় ঠিক করা হল ডাকাতি করা হবে। টাকা জোগাড় করার জন্য ঐটাই একমাত্র পথ।কিন্তু সাধারণ মানুষকে তাঁরা লুটবে না, কারন তাঁরা  আপনজন, তাঁদের মুক্তির জন্যই এই লড়াই।

 ঠিক হল, ব্রিটিশ সরকারকে  লুঠ করবেন। ব্রিটিশ সরকারি টাকাই হবে বোমা তৈরী মূলধন। তবে মন থেকে ডাকাতির বিষয়টা সবাই সায় দিতে পারলেন না। অনেকেই এক্ষেত্রে মত পোষণ করলেন যে , ডাকাতির আগে উচিত  নিজে নিজে ঘরে যেটুকু আছে সেখান থেকে কে কত টাকা বিপ্লব এর কাছে উৎসর্গ করতে পারে তা চেষ্টা করা…. এ কথাটা প্রত্যেকেরই পছন্দ হয়েছিল এবং মেনে নিয়েছিলেন।
 এই কার্যে প্রথম এগিয়ে এসেছিলেন তরুণ বিপ্লবী ধ্রুবেশ  চট্টোপাধ্যায়।  নিজের জমানো টাকা তো বটেই,  সেই সঙ্গে নিজের ভদ্রাসন টুকুও বিক্রি করে ১১ হাজার টাকা এনে তুলে দিয়েছিলেন বোমা তৈরির কাজের জন্য. আবার শুরু হলো বোমা তৈরীর কাজ …অর্থমূল্য বিচার করলে ১০০ বছর আগে ১১ হাজার টাকার মূল্য আজকের দিনে যে কত তা অনুমান সাপেক্ষ…. 

কিন্তু ভাবলে বিস্মিত হতে হয় যে নিজের এবং পরিবারের সকলের ভবিষ্যতের কথা বিন্দুমাত্র চিন্তা না করে শুধু স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায় কেউ এভাবে নিজের সঞ্চয় এবং বসতবাটি বিক্রি করে দেশের কাজে টাকা দিতে পারেন তা বোধহয় আজকের দিনে কল্পনার বাইরে। টাকা হাতে আসার পর নতুন উদ্যমে বোমা তৈরির কাজ শুরু হলো। কিন্তু এটাকা কতদিন? তাদের কিছুদিন পরে পুনরায় টাকার অভাব দেখা দিল। কিন্তু এবার কেউ কেউ বললেন ,আবার ডাকাতি করার কথা… আর যে কোন উপায় নেই !কিন্তু একা কেন ধ্রুবেশ নিজের সম্বল খুইয়ে টাকা দেবে ?অন্যরা কেন কেউ নয়? 
 তারপর কি হল?

বিধির বাঁধন কাটবে তুমি এমন শক্তিমান–
তুমি কি   এমন শক্তিমান!
আমাদের   ভাঙাগড়া তোমার হাতে
এমন অভিমান– তোমাদের   এমনি অভিমান ॥ 
চিরদিন টানবে পিছে,   চিরদিন   রাখবে নীচে– 
এত বল   নাই রে তোমার,   সবে না সেই টান ॥

ক্রমশঃ
#দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ ১. কাকোরি ষড়যন্ত্র মামলা   ২. ভারতের সশস্ত্র বিপ্লব    ৩. দক্ষিণেশ্বর বোমা মামলা থেকে কাকোরি ট্রেন ডাকাতি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.