শিরোনামের বাঙ্গালী বানানটা পূর্ববঙ্গের উচ্চারণ লিখলাম। কারণ, এই লেখাটা ওপার বাংলার মানুষদের নিয়ে। যাদের নিয়ে ঋত্বিক ঘটক ফিল্ম তৈরি করেছেন, প্রফুল্ল রায় উপন্যাস লিখেছেন, নিবেদিতা দেবী এক প্রবন্ধে লিখেছিলেন, ‘বাঙ্গালী মেয়েরা দেশের স্বাধীনতা পেল নিজেদের ইজ্জত আর স্বামী-পুত্রের প্রাণের বিনিময়ে।’ আজকের বাঙালি এইসব দেখেছেন, পড়াশোনা করেছেন, বক্তৃতা দিয়ে টেবিল ফাটিয়ে ফেলেছেন থাপ্পড় মেরে। টিভিতে গিয়ে ঘণ্টাখানেক গভীর তাত্ত্বিক আলোচনা করেছেন–কিন্তু ধর্ষিতা, অত্যাচারিতা, লুণ্ঠিতা পূর্ববঙ্গ এদের হৃদয়কে স্পর্শ করেনি। আমরা নিজেদের ক্ষুদ্র চাওয়া-পাওয়ার বৃত্তের বাইরে বের হয়ে ওই সব হারানো মানুষগুলোর সহমর্মী হতে পারিনি। গত সত্তর দশকের বেশি সময় ধরে আমার রক্ত, আমার ভাই অত্যাচারিত হয়েছে। স্বাধীনতার এত বছর পরে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের মধ্যে দিয়ে আমার পরমাত্মীয়রা নিজেদের অধিকার পাচ্ছেন। এমন ঐতিহাসিক মুহূর্তে আমি যদি আমার প্রকৃত ভূমিকা পালন না করি তবে ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না।
আজ পশ্চিমবঙ্গে বড় বড় রাজনৈতিক দলের নেতা-নেত্রীরা নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে সাম্প্রদায়িক বক্তব্য রাখছেন। পরিকল্পিত রাজনৈতিক মদতে কলকাতার বিশেষ বিশেষ স্থানে একটি ধর্ম সম্প্রদায়ের মানুষকে খেপিয়ে বড় বড় মিছিল করানো হচ্ছে। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালানো হয়েছে। ট্রেন, বাস বন্ধ করা হয়েছে। রাজনীতির ওইসব ব্যবসায়ীরা বলছেন যে, ‘কেন কেবলমাত্র পূর্ববঙ্গের অত্যাচারিত হিন্দুরা নাগরিকত্ব পাবেন?’ স্বাভাবিক। কারণ ২০০১ সালে যেদিন উল্লাপাড়ায় ১৩ বছরের পূর্ণিমা শীলকে ১৩ জন মিলে সারারাত গণধর্ষণ করল সেদিনও তিনি পশ্চিমবঙ্গে রাজনীতি করতেন। সেই বছরই চট্টগ্রামের নাজিরহাটে কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক গোপাল মুহুরিকে প্রকাশ্যে নির্মম নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হল। সেদিনও আপনারা সবাই পশ্চিমবঙ্গে রাজনীতি করতেন। সেদিন ওপার বাংলার মানুষ যখন প্রাণ বাঁচানোর আর্তচিৎকার করছিলেন ঠিক সেই সময় আপনারা ক্ষুদ্র রাজনৈতিক স্বার্থের পিছনে কলকাতা থেকে দিল্লি ছুটছিলেন। তাই পূর্ণিমার কণ্ঠ, অধ্যাপক মুহুরির হত্যা আপনাদের স্পর্শ করেনি। ২০০১ সালেও করেনি ২০১৯ সালেও করবে না।
কিন্তু আমরা তো পারলাম না। গড়িয়া থেকে বনগাঁ, রানাঘাট থেকে বারাসত, শিলিগুড়ি থেকে মালদার ইংরেজবাজার, সোদপুর থেকে বালিতে দেড় কোটি মানুষ রাস্তায় নেমে এসে যদি বলতেন, ‘দিদি, আপনি বুঝতে পারবেন না, কেন আমাদের নাগরিকত্ব দেওয়া প্রয়োজন। কারণ পূর্ণিমা শীল আপনার কেউ হতেন না। পূর্ণিমা আমার বোন, আমাদের শরীরে এক রক্ত বইছে। ওই পূর্ণিমা, পূর্ণিমার সঙ্গে আরও নাম প্রকাশিত না-হওয়া হাজার হাজার ধর্ষিতা, ওদের দেখে ভয়ে ভারতে পালিয়ে আসা লক্ষ লক্ষ হতভাগিনী আমার পরমাত্মীয়। এই যে দাদা শুনুন, আমরা সকলে ২০০১ সাল থেকে মহালয়ার দিন অধ্যাপক গোপালকৃষঃ মুহুরির নামে পিতৃতর্পণ করি। কেন আমরা এখানে এসেছি? কেন কোনও রকম টালবাহানা না করে আমাদের ভারতবর্ষের নাগরিকত্ব দেওয়া উচিত তা যদি বুঝতে না পারেন তবে একমুহূর্তের জন্যও আপনাদের পশ্চিমবঙ্গে রাজনীতি করা উচিত নয়!
এই ঐতিহাসিক সময়ে কলকাতার সংবাদ মাধ্যমের ভূমিকাও ভবিষ্যতে কালো অক্ষরে লেখা থাকবে। দেশভাগ, তার করুণ পরিণাম, উদ্বাস্তু যন্ত্রণা, শরণার্থী আন্দোলন এ রাজ্যে আদৌ কখনও হয়েছিল তা যেন এইসব বড় বড় এগিয়ে থাকা কাগজের মালিক, সম্পাদক, ব্যুরো চিপরা জানেনই না। তাদের এক প্রশ্ন পূর্ববঙ্গ থেকে আসা হিন্দু, বৌদ্ধ খ্রিস্টানরাই কেন নাগরিকত্ব পাবেন? তারা অত্যাচারিত, তারা অর্থনৈতিক কারণে নয় নিতান্ত প্রাণ বাঁচাতে আসছে, আর ভারতে স্থান না দিলে ওই হতভাগ্যদের বঙ্গোপসাগরে গিয়ে ডুবে মরা ছাড়া অন্য কোনও উপায় থাকবে না, এই সহজ কথাটা কোটি কোটি টাকা বিজ্ঞাপন পাওয়া বাংলা কাগজের মালিক বা দেড় পাতা ইংরেজিতে উত্তর সম্পাদকীয় লেখা মহাপণ্ডিত সম্পাদক বোঝেন না। এই ২০১৬ সালেও ঢাকার কাছে বাইসারীতে বৌদ্ধ ভিক্ষু মঙ্ক স্যু উ ঢাককে নির্মমভাবে মৌলবাদীরা হত্যা করেছিল।
সেদিন এইসব মিডিয়া-মাফিয়ারা অত্যাচারিত বৌদ্ধ বাঙালিদের জন্য একটি লাইনও লেখেননি। এই মিডিয়ার মালিক সম্পাদকরা তো এতগুলো বছর পূর্ববঙ্গে কোনও অত্যাচার দেখতেই পাননি। তাই অত্যাচারিতের জন্য বিশেষ নাগরিকত্ব এরা বোঝেনই না। আজকের আত্মঘাতী বাঙালি এই মিডিয়া প্রভুরই তো দাসানুদাস।
আত্মঘাতি বাঙালির একটা অংশ তথাকথিত বিদূষক। এই বিদূষকেরা গান করেন, লেখেন, পাঠ করেন, সুন্দর সুন্দর কথা বলেন, ক্ষমতাবান লোকেদের হ্যাঁ-তে হ্যা, না-তে না করেন। অনেকটা হীরকরাজসভার পার্ষদদের মতোই ‘ঠিক ঠিক’ বলেন। তারাও অবাক! বাংলাদেশ থেকে, পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা কেবল হিন্দু, বৌদ্ধ খ্রিস্টানরাই ভারতের নাগরিকত্ব কেন পাবে? ১৯৬৪ সালে নারায়ণগঞ্জে হিন্দুদের উপর দাঙ্গা হচ্ছে। হাজার হাজার নীরিহ মানুষকে হত্যা করা হচ্ছিল, শত শত মহিলা ধর্ষিতা হচ্ছিলেন প্রতিদিন। ঢাকার নোটরডম কলেজের ফাদার রিচার্ড নোডাক গিয়েছিলেন আর্ত মানুষের খোঁজ নিতে। সেই অপরাধে খুন হতে হয়েছিল ফাদারকে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের কোনও বিদূষক তো এই ভয়ানক ঘটনার উপরে কোনও কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক বা প্রবন্ধ লেখেননি। কারণ গত ৫০ বছরে এরাজ্যে বিদূষকদের অঘোষিত নিয়ম ছিল যে পূর্ববাংলার অত্যাচার অমানবিক নির্যাতনের কথা বলতে নেই। ইজরায়েল গাজা ভূখণ্ডে কি অত্যাচার করছে, আমেরিকা ইরাকের উপর কি মানবাধিকার লঙঘন করছে সেটা দেখো।
কিন্তু পূর্ববঙ্গে হিন্দু, বৌদ্ধ বা খ্রিস্টানদের উপরে অত্যাচারের কথা ভুলেও প্রকাশ করতে নেই। তাই তারা অবাক, পূর্ববঙ্গের অত্যাচারিত মানুষ আবার আলাদা করে নাগরিকত্ব কি পাবে?
খাগড়াগড়ের বিস্ফোরণের মূল নায়ক ছিল বাংলাদেশের অবৈধ অনুপ্রবেশকারী শাকিল আহমেদ। শাকিল নদিয়ার করিমপুরে এসে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় ভোটার কার্ড তৈরি করে। তারপর কয়েকজন ভারতীয় পুরুষ-মহিলাকে জোগাড় করে শিমুলিয়ার মতো মাদ্রাসার মাধ্যমে এক একটি জেহাদি উগ্রপন্থী ‘স্লিপার সেল’ তৈরি করেছিল। তারা ভয়ানক বিস্ফোরক বানাত আর বাংলাদেশে চালান দিত। এরপরের ঘটনা মানে বর্ধমান বিস্ফোরণের কথা তো আমরা সবাই জানি।
যেসব রাজনীতির ব্যবসায়ী রাজ্যের বিভিন্ন অংশে সাম্প্রদায়িক উস্কানি দিয়েছেন, তাঁরা এক বিশেষ সম্প্রদায়ের মানুষকে বুঝিয়েছেন যে, পূর্ণিমা শীল, অধ্যাপক গোপালকৃষ্ণ মুহুরি, মহাস্থবির মঙ্ক স্যু বা ফাদার রিচার্ড নোডকের মতো অত্যাচারিত পূর্ববঙ্গের মানুষকে ততদিন নাগরিকত্ব দেওয়া হবে না। যতদিন না শাকিল আহমদরাও নাগরিকত্ব পাবেন। কতিপয় মানুষ এই নেতাদের কথা শুনেছেন, আর স্টেশনে স্টেশনে, গ্রামে গ্রামে আগুন লাগিয়েছেন, উদ্বাস্তু হতভাগ্য হিন্দুদের উপর আক্রমণ করেছেন।
প্রকৃতপক্ষে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) এ রাজ্যের মুসলমান সম্প্রদায়ের বা কারও কোনও অধিকারকে খর্ব করেনি। কেবল অত্যাচারিত মানুষদের ভারতে থাকার ব্যবস্থা করেছে। উদ্বাস্তু হিন্দু, বৌদ্ধ বা খ্রিষ্টানদের কেউই গিয়ে মুসলমান সম্প্রদায়ের জমি দখল করবেন না। তাই এ রাজ্যে সাম্প্রদায়িক উস্কানি বিনা কারণে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে করা হয়েছে। রাষ্ট্রপুঞ্জের যে সংস্থাটি উদ্বাস্তু সংক্রান্ত বিষয়ের নিয়ামক সেটি হল ইউনাইটেড নেশনস হাই কমিশন ফর রিফিউজিস। এই সংস্থা তার ১৯৫১ সালের জেনেভা কনভেনশন আর ১৯৬৯ সালের উরুগুয়ে প্রোটোকল হিসাবে শরণার্থী উদ্বাস্তুর সংজ্ঞা তৈরি করেছে। সেই সংজ্ঞা অনুসারে, কোনও মানুষ যদি ধর্মীয় কারণে গোষ্ঠী জাতি রাজনৈতিক মতবাদ বা কোনও সামাজিক সংগঠনের সদস্য হওয়ার জন্য নিজের দেশে অত্যাচারিত হয়ে অন্য দেশে পালিয়ে আসেন এবং গভীর ভয়ের জন্য আর ফিরে যেতে না চান তবে ওই ব্যক্তি দ্বিতীয় দেশে শরণার্থী। তাই সিটিজেনশিপ অ্যামেন্টমেন্ট অ্যাক্ট হিসাবে পাকিস্তান বাংলাদেশ ও আফগানিস্তান থেকে ধর্মীয় কারণে অত্যাচারিত হয়ে আসা হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, শিখ, খ্রিস্টান ও পার্সিদের নাগরিকত্ব প্রদান সম্পন্ন আন্তর্জাতিক আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
ভারতবর্ষের সংবিধান সব ধর্মীয় সম্প্রদায়ের নাগরিকদের সমান অধিকার দিতে অঙ্গীকারবদ্ধ। কিন্তু সেটা তো ভারতীয় নাগরিকদের জন্যই প্রযোজ্য। শাকিল আহমেদ তো দেশের নাগরিক নয়। অত্যাচারিতা পূর্ণিমা শীলকে, নৃশংসভাবে খুন হওয়া গোপালকুঞ্জ মুহুরির পরিবার বা মঙ্ক স্যুর অনুগামীদের মানবিকতার খাতিরেই নাগরিকত্ব দেওয়া যায়।
পূর্ববঙ্গের একজন উদ্বাস্তু হিসাবে ওই রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীর কাছে আমার সহজ প্রশ্ন, রাজনীতির জন্য কতটা অমানবিক হওয়া সম্ভব? আপনারা নোয়াখালির দাঙ্গার কথা জানেন না? । ১৯৭০-৭১ সালে হিন্দু উদ্বাস্তুদের । দেখেননি? দণ্ডকারণ্য-মানাক্যাম্প-কান্দামাল-মরিচঝাপিতে আমাদের কষ্ট আপনাদের হৃদয়কে স্পর্শ করেনি। এত কষ্টের পরে আমাদের পরিবারগুলি ন্যায্য অধিকার পাবে আজ। আর আপনাদের মিথ্যা কথা বলে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়িয়েছেন। প্রচার মাধ্যমের মালিক-সম্পাদকরা পূর্ববঙ্গের হিন্দুদের উপর অত্যাচার দেখতে পান না, না? আর ওই কর্তাভজা বিদূষকের দল! আপনারা আমাদের মতো পূর্ববঙ্গের নিপীড়িত উদ্বাস্তুদের সঙ্গে যে নিষ্ঠুর আচরণ করলেন তা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। সুন্দরবনের নদীগুলির নীচে যত পাঁক আছে পূর্ববঙ্গের অত্যাচারিত হতভাগ্য উদ্বাস্তুরা যদি তার সমস্তটা আপনাদের দিকে ছুঁড়ে দিতে পারত তাতেও আপনাদের পাপের প্রায়শ্চিও হত না। বিগত কয়েকটি দিনের কথা ‘আত্মঘাতী বাঙ্গালীর’ ইতিহাসে কলঙ্কময় দিন হিসাবে লেখা থাকবে।

জিষ্ণু বসু

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.