IMCT পশ্চিমবঙ্গ (West Bengal) সরকারের মুখ্যসচিবকে কড়া চিঠি দিয়ে রাজ্য ছাড়ার পর, মুখ্য সচিব সাংবাদিক বৈঠক করে জানিয়েছেন যে পশ্চিমবঙ্গের কোভিড রুগীর ডেটাবেস ম্যানেজমেন্ট এবং গণনার পদ্ধতি ছিল ভুল ও জটিল। সেইজন্যই রুগীর সংখ্যা ও মৃতের সংখ্যার ডেটা উপস্থাপনে ভুল তাঁদের হয়ে গিয়েছিল এবং সে ভুল ইচ্ছাকৃত নয়। যদিও এতবড় ভুল ধরতে পশ্চিমবঙ্গের আমলাদের দেড় মাস লেগে গেল কেন সে প্রশ্ন উঠেছে। পশ্চিমবঙ্গের (West Bengal) মত সর্বাধিক জনঘনত্বপূর্ণ রাজ্য এ হেন অযোগ্য, অপদার্থ আমলাদের দিয়ে চলবে কেমন করে, কেমন করে অদূর ভবিষ্যতে রাজ্যে কোভিডের দ্রুততর প্রসার তাঁরা সামলাতে পারবেন, বা আদৌ পারবেন কিনা সে প্রশ্নও জোরালোভাবে তোলা দরকার। পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান আমলাদের সরিয়ে দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার নিরিখে যোগ্যতর আমলাদের এ রাজ্যে নিয়ে আসার দাবী পশ্চিমবঙ্গের জনগণের বোধ করি তোলা উচিত।
তবে ভুল স্বীকারের পরে পশ্চিমবঙ্গ সরকার নতুনভাবে তাদের কোভিড ডেটাবেস পাবলিক ডোমেইনে রেখেছে। নতুন ডেটা উপস্থাপনে পশ্চিমবঙ্গ সরকার কোনো ভুল করে নি, এমন আশা নিয়ে ৪ঠা মে’র ডেটাগুলি দেখতে শুরু করলে নজরে পড়ছে যে পশ্চিমবঙ্গের এই নতুন ডেটা উপস্থাপনেও কিছু ভুল রয়েছে।
১ম পর্যবেক্ষণ:
সরকারের বর্তমান বুলেটিনের ডেটা ফরম্যাটে মোট ১১টি ডেটা টেবিল আছে। তার মধ্যে ৪ঠা মে তারিখের বুলেটিনে District Snapshots নামক VI নম্বর টেবিলে দেখা যাচ্ছে যে কালিম্পং জেলার ক্ষেত্রে লাস্ট রিপোর্টেড কেস ২রা মে। অথচ সেই জেলার অ্যাকটিভ কেসের সংখ্যা শূন্য। তার মানে, ২রা মে তারিখে যে কেসটি/কেসগুলো রিপোর্টেড হয়েছে তাদের সবাই হয় ডিসচার্জড হয়ে গিয়েছে অথবা মারা গিয়েছে। এবার VI নং টেবিল থেকে আরও দেখা যাচ্ছে কালিম্পং জেলায় মোট মৃতের সংখ্যা ১. আমরা ইতিপূর্বেই জানি যে কালিম্পং এর একজন পেশেন্ট যাঁর করোনা ধরা পড়েছিল ২৮শে মার্চ তিনি মারা গিয়েছেন। তাহলে ধরে নেওয়া যেতে পারে যে কালিম্পং জেলার কোভিডে মৃত একমাত্র পেশেন্ট তিনিই? তাহলে ২রা মে তারিখে যে কেসটি(গুলো) রিপোর্টেড হল, তারা কি সকলেই একদিনের মধ্যেই কোভিড সংক্রমণমুক্ত হয়ে ছাড়া পেয়ে গেলেন?
৪ঠা মে-র বুলেটিনের এই ভুলটিকে অবশ্য পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাদের পরেরদিনের অর্থাৎ ৫ই মে-র বুলেটিনে স্বীকার করে নিয়ে সংশোধন করে নিয়েছে। কিন্তু এই ঘটনা প্রমাণ করে দিল যে সংশোধিত রিপোর্ট বলে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার যে বুলেটিন বর্তমানে পেশ করছে তা-ও ত্রুটিমুক্ত নয় এবং আরো সংশোধনের অপেক্ষা রাখে।
অবশ্য ৫ই মে তারিখের এই ভুল স্বীকার এবং সংশোধনও আবার আর একটি নতুন প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। ৫ই মে’র বুলেটিন অনুসারে যদি কালিম্পং জেলার লাস্ট রিপোর্টেড কেস ২রা মে না হয়ে ২রা এপ্রিল হয়, তাহলে তার এক মাস তিন দিন পরেও কালিম্পং জেলা গ্রীন জোনে না থেকে এখনও রেড জোনে কেন। তবে, ৪ঠা মে-র বুলেটিনের যে এইটিই একমাত্র ত্রুটি নয়, বরং এখনো স্বীকার করা হয়নি বা সংশোধিত হয়নি এইরকম আরও অন্ততঃ দু’টি ত্রুটি যে আছে তার প্রমাণ পাওয়া যাবে এর পরের দু’টি পর্যবেক্ষণ থেকে।
২য় পর্যবেক্ষণ:
৪ঠা মে-র বুলেটিনের প্রথম টেবিলে (Table I : COVID 19 STATUS) দেখা যাচ্ছে যে ৩রা মে পর্যন্ত মোট কেস ১১৯৮ এবং ৪ঠা মে নতুন কেস রিপোর্টেড হয়েছে ৬১টি। অথচ, সেই একই বুলেটিনের ষষ্ঠ টেবিলে (Table VI : DISTRICT SNAPSHOTS) ৪ঠা মে নতুন কোনো কেসের কথা বলা নেই। সেখানে, অর্থাৎ ষষ্ঠ টেবিলের সপ্তম কলামে লেটেস্ট যে তারিখে কেস রিপোর্টেড হয়েছে, তা হল ৩রা মে। এবারে, যদি ধরে নিই যে এই ষষ্ঠ টেবিলের সপ্তম কলামে দেখানো “Last reported case”-এর তারিখগুলো সঠিক, তাহলে ৪ঠা মে’র ৬১টি কেস নিশ্চয়ই এই ষষ্ঠ টেবিলে নেই? তাহলে আবার প্রশ্ন ওঠে যে সেক্ষেত্রে ষষ্ঠ টেবিলের মোট সংখ্যাটি ১১৯৮ না হয়ে ১২৫৯ হল কি করে? আবার যদি ধরে নিই যে এই ষষ্ঠ টেবিলের মোট সংখ্যাটি ৪ঠা মে’র ৬১ জনকে ধরেই হিসেব করা হয়েছে, তাহলে লাস্ট রিপোর্টেড কেসের তারিখ কেন কোন জেলার ক্ষেত্রেই ৩রা মে’র পর দেখা যাচ্ছে না?
সুতরাং, হয় ষষ্ঠ টেবিলের সপ্তম কলামে লাস্ট রিপোর্টেড কেসের তারিখ ভুল দেওয়া আছে (যে সাতটি জেলার ক্ষেত্রে লাস্ট রিপোর্টেড কেসের তারিখ ৩রা মে লেখা হয়েছে, সেগুলি আদতে ৪ঠা মে হবে) অথবা প্রথম টেবিলে যে লেখা হয়েছে ৩রা মে পর্যন্ত মোট কেস ১১৯৮ এবং ৪ঠা মে নতুন কেস ৬১, সেই ঘোষণাটি ভুল। ঐ ৬১ টি কেসও আসলে ৩রা মে’র। হয় দুই’ই ভুল নয়ত দুই’য়ের মধ্যে অন্ততঃ একটি ভুল। ৩রা মে পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের মোট কোভিড কেসের সংখ্যা একই সঙ্গে কখনও ১১৯৮, কখনও ১২৫৯ হতে পারে না।
৪ঠা মে-র বুলেটিনের এই ভুলটির অবশ্য ৫ই মে-র বুলেটিনেও পুনরাবৃত্তি হয়েছে যেখানে প্রথম টেবিলে বলা হয়েছে যে ৮৫টি নতুন কেস রিপোর্টেড হয়েছে ৫ই মে তারিখে, অথচ ষষ্ঠ টেবিলে তার কোন উল্লেখ করা হয় নি। ফলে, একবার প্রথম টেবিলে ৪ঠা মে পর্যন্ত মোট কেসের সংখ্যা বলা হয়েছে ১২৫৯ আবার এক-ই রিপোর্টের ষষ্ঠ টেবিলে ৪ঠা মে পর্যন্ত মোট কেস বলা হয়েছে ১৩৪৪।
৩য় পর্যবেক্ষণ:
৪ঠা মে-র বুলেটিনের তৃতীয় টেবিলে (Table III : INFRASTRUCTURE DETAILS) বলা হয়েছে যে
মোট কোভিড বেড : ৮০৩৬
এবং% অকুপ্যান্সি : ১৩.০৩%
অর্থাৎ, অকুপায়েড বেড : ৮০৩৬ এর ১৩.০৩% = ১০৪৭ টি।
অথচ, সেই একই বুলেটিনে অ্যাকটিভ (চিকিৎসাধীন) পেশেন্টের সংখ্যা বলা হয়েছে ৯০৮ (Table I এবং Table VI দ্রষ্টব্য)। তাহলে, ৯০৮ জন অ্যাকটিভ পেশেন্ট ১০৪৭ টি কোভিড বেড অকুপাই করে আছেন কিভাবে? এক একজন অ্যাকটিভ পেশেন্ট কি একাধিক করে বেড অকুপাই করে আছেন, না কি ইতিমধ্যেই মৃত বা সুস্থ হয়ে ছাড়া পেয়ে যাওয়া পেশেন্টরা এখনও বেড দখল করে রেখেছেন? তৃতীয় আর একটি যে সম্ভাবনার কথা মনে হচ্ছে, তা হল, ৪ঠা মে তারিখে অ্যাকটিভ কেসের সংখ্যা কি আদৌ মাত্র ৯০৮ টি? নাকি আরও অনেক বেশি (অন্ততঃ ১০৪৭ টি তো বটেই)?
এই ভুলটিকেও পরেরদিনের অর্থাৎ ৫ই মে-র বুলেটিনে স্বীকার বা সংশোধন করা হয় নি। ৫ই মে’র সরকারি বুলেটিনের ডেটা অনুযায়ী অ্যাকটিভ কেসের সংখ্যা ৯০৮ থেকে বেড়ে ৯৪০ হয়েছে বটে, কিন্তু অকুপায়েড কোভিড বেডের সংখ্যা হিসেব করে পাওয়া যাচ্ছে সেই ১০৪৭ টিই(৮০৩৬ এর ১৩.০৪%)।
এই পর্যবেক্ষণগুলি থেকে প্রায় স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তরফ থেকে এখনও আরও অনেক ভুল স্বীকার করা বাকি আছে। ভবিষ্যতে চাপে পড়লে তাঁদের আবারও ভুল স্বীকার করে বিবৃতি দিতে হতে পারে। রাজ্যবাসী মহামারীর সত্যিকারের স্বচ্ছ ও সঠিক ডেটা কবে পাবে? বা আদৌ কোনোদিন পাবে কি?
দেবযানী ভট্টাচার্য্য (Debjani Bhattacharyya)