দৈনিক সংক্রমণ: মধ্য এপ্রিল ৯৯৩১, মে-র প্রথম ১৭১৭, কী জাদু করল মুম্বই!

(বৃহন্মুম্বই মিউনিসিপাল কর্পোরেশন (বিএমসি)-এর ২৪টি ওয়ার্ড মিলিয়ে মুম্বই মহানগরের জনসংখ্যা প্রায় ১ কোটি ২৯ লক্ষ। আর দেশের রাজধানী দিল্লি শহরের জনসংখ্যা কমবেশি ১ কোটি ৭৭ লক্ষ। কী ভাবে এই দুই বৃহৎ মহানগর চলতি বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি থেকে ৯ মে পর্যন্ত সময় পর্বে কোভিড-১৯-এর দ্বিতীয় তরঙ্গের মোকাবিলা করেছে, তার একটা সন্ধান এই নিবন্ধের উদ্দেশ্য।)

আপাতদৃষ্টিতে দেখলে, যদিও ২ মহানগরেই কোভিডের সাম্প্রতিক ঢেউ যথেষ্ট বেশি, তবু মুম্বইয়ের ক্ষেত্রে নথিভুক্ত কোভিড পজিটিভের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য ভাবে কম— ৪ এপ্রিল ১১,২০৬টি সংক্রমণের ঘটনা নথিভুক্ত হয়। কিন্তু তুলনায়, দিল্লিতে সংক্রমিতের সংখ্যা বিপুল এবং ২০ এপ্রিলে তা ২৮,৩৯৫-এ পৌঁছয়, ৩০ এপ্রিল তা দাঁড়ায় ২৭,০৪৭-এ। তার পরে তা খানিক কমতে শুরু করে।

একই ভাবে ২০২১-এর ১ মে মুম্বইতে কোভিড-সংক্রান্ত মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ৯০। সাধারণ ভাবে বহমান মৃত্যু সংখ্যার থেকে যা লক্ষণীয় রকমের কম। কিন্তু দিল্লির দিকে তাকালে দেখা যাবে, ৩ মে, ২০২১-এ সেখানে কোভিডে মৃতের সংখ্যা ছিল ৪৪৮।

প্রশ্ন এখানেই যে, মুম্বই কী করে কোভিড সংক্রমণে মৃত্যুর হারকে কমাতে সমর্থ হল, যা দিল্লি পারেনি? এবং সেই সঙ্গে প্রশ্ন এখানেও যে, দিনের পরে যে ভাবে অবধারিত ভাবে রাত আসে, সেই সত্য মেনে নিয়ে এই অতিমারির তৃতীয় তরঙ্গের নিশ্চিত আগমনের বিপরীতে কী ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া যেতে পারে?মুম্বই কী করে কোভিড সংক্রমণে মৃত্যুর হারকে কমাতে সমর্থ হল, যা দিল্লি পারেনি?

মুম্বই কী করে কোভিড সংক্রমণে মৃত্যুর হারকে কমাতে সমর্থ হল, যা দিল্লি পারেনি?
ছবি: পিটিআই।


মুম্বই এবং দিল্লি, ২ শহরের বাসিন্দারা সর্বসম্মত ভাবেই স্বীকার করেন, এই ২ মহাগরের যাপনছন্দে কিছু ভিত্তিগত পার্থক্য রয়েছে। মুম্বইয়ের বাসিন্দারা যে কোনও কাজের ক্ষেত্রেই অনেক বেশি মাত্রায় পেশাদার ও শৃঙ্খলাপরায়ণ। আমি শুধুমাত্র কর্পোরেট ধাঁচার কথা বলছি না। ‘বাই’, মানে যাঁরা প্রতি দিন যে সব মহিলা মুম্বইয়ের বাড়িগুলিতে গৃহপরিচারিকার কাজ করতে আসেন, তাঁরাও অসম্ভব নিয়মানুগ। বাড়িতে কেউ থাকুক বা না-থাকুক তাঁরা নির্ধারিত সময়েই পৌঁছে যান, ঘড়ির কাঁটার মতো নিয়ম মেনেই যাবতীয় কাজ সারেন এবং পরবর্তী বাড়ির দিকে যাত্রা করেন। এক জন ‘বাই’ প্রতিদিন ৫-৭টি বাড়িতে কাজ করেন। এবং সেই কাজ সুচারু ভাবেই করেন।

অথবা যদি ট্রাফিক পুলিশদের কথাই ধরেন, দেখা যাবে তাঁরা ট্রাফিক সিগন্যাল অমান্য করার জন্য অথবা শিরস্ত্রাণ না পরার জন্য দু’এক জনকে ধরার বাইরে খুব একটা কাজ করছেন না। যদি মুম্বই যান, তো টের পাবেন কী মসৃণ ভাবে তাঁরা নীরবে পারস্পরিক সহযোগিতায় দক্ষিণে নরিম্যান পয়েন্ট থেকে উত্তরে বরিভলি ও মুলুণ্ড পর্যন্ত সদা বহমান ট্রাফিক-স্রোতকে সামলে চলেছেন।

পরিকাঠামোগত বহু দুর্বলতা সত্ত্বেও মুম্বই কাজ করে চলে, কারণ ‘মুম্বইকর’রা কাজ করেন।

এই রকমের পেশাদার কর্মসংস্কৃতির একেবারে বিপরীত মেরুতে দিল্লির অবস্থান। মুম্বইয়ে বাসে ওঠার জন্য কেউ লাইন ভাঙেন না। কিন্তু দিল্লিতে একে অপরকে টপকে বাসে ওঠাটা নৈমিত্তিক ব্যাপার। কোনও কাজে এগিয়ে যেতে ব্যক্তিগত যোগাযোগ ব্যবহার করাটা দিল্লিতে কোনও ব্যাপারই নয়। ‘গুরুত্বপূর্ণ’ ব্যক্তিদের নাম আওড়ানো, ব্যক্তিগত লাভের জন্য কোনও কিছু ‘সালটে’ দেওয়া অথবা নির্ধারিত তারিখের মধ্যে কোনও কাজ করতে না পারা— এ সব দিল্লিতে জলভাত। দিল্লিকে আইন বহির্ভূত কাজকর্ম অথবা ‘জুগাড়’ বা ‘ম্যানেজ’ করার ব্যাপারেও ভারতের রাজধানীই বলা যায়।বহু দুর্বলতা সত্ত্বেও মুম্বই কাজ করে চলে, কারণ ‘মুম্বইকর’রা কাজ করেন।

বহু দুর্বলতা সত্ত্বেও মুম্বই কাজ করে চলে, কারণ ‘মুম্বইকর’রা কাজ করেন।
ছবি: পিটিআই।


কিন্তু কোভিডের মোকাবিলায় মুম্বই কী করল? এ বিষয়ে আপনাদের কাছে আমি সুচেতা দালালের লেখা একটি নিবন্ধের কথা (২০২১-এর ৭ মে ‘মানিলাইফ’-এ প্রকাশিত) তুলে ধরতে চাই, সেই সঙ্গে তুলে ধরতে চাই বৃহন্মুম্বই মিউনিসিপাল কর্পোরেশনের কমিশনার ইকবাল সিংহ চাহালের একটি সাক্ষাৎকার (২০২১-এর ১০ মে, ‘ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’-এ প্রকাশিত)।

এই সাক্ষাৎকারে চাহাল জানিয়েছেন, তিনি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী উদ্ধব ঠাকরের কাছ থেকে পূর্ণ ও অকুণ্ঠ সহযোগিতা পেয়েছেন। তাঁর বস কী ভাবছেন, তা নিয়ে চিন্তা করে সময় নষ্ট তাঁকে করতে হয়নি। বদলে তিনি সবার আগে জোর দিয়েছেন আতঙ্ককে রোখার উপর, কত কম সময়ে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় ‘ওয়ার রুম’ তৈরি করে বিকেন্দ্রীভূত ভাবে কাজ করা যায়, তার উপর এবং পরিস্থিতি মোকাবিলার যথাযোগ্য পরিকাঠামো নির্মাণের উপর।

সুচেতা তাঁর নিবন্ধে জানাচ্ছেন, সাধারণত সংক্রমিতদের কোভিড পরীক্ষার ফল সেই দিন বিকেলের মধ্যেই জানিয়ে দেওয়া হয়। এর ফলে হাসপাতালগুলিতে শয্যা পাওয়া নিয়ে উৎকণ্ঠা বাড়ে, গন্ডগোল শুরু হয় এবং সব মিলিয়ে আতঙ্ক বিপুল ভাবে বাড়তে থাকে। চাহাল এর মধ্যে এক বিতর্কিত কাজ করেন। তিনি পরীক্ষাগারগুলিকে নির্দেশ দেন, কোভিড পরীক্ষার ফল সরাসরি সংক্রমিতদের হাতে না দিয়ে তা আগে বিএমসি-র কাছে পাঠাতে।

এর আগে তিনি শহরের ২৪টি ওয়ার্ডের প্রত্যেকটিতে একটি করে ‘ওয়ার রুম’ তৈরি করেন। যেখানে ৩০টি করে টেলিফোন লাইন, ১০ জন করে টেলিফোন অপারেটর, ১০ জন করে চিকিৎসক, চিকিৎসা সহায়ক কর্মী এবং ১০টি করে অ্যাম্বুল্যান্স মজুত রাখা হয়। এই ব্যবস্থা প্রতি দিন ২৪ ঘণ্টা চালু থাকে। প্রত্যেক ‘ওয়ার রুম’-এ ১০টি করে ড্যাশবোর্ডে প্রতি ওয়ার্ডের হাসপাতালগুলিতে খালি শয্যার সংখ্যার খতিয়ান প্রতি মুহূর্তে দেওয়া হতে থাকে— সব মিলিয়ে গোটা মুম্বইয়ে ২৪০টি ড্যাশবোর্ড সদাজাগরুক থাকে।

পরের দিন ভোর ৬টায় যে সব সংক্রমিতের পরীক্ষার ফল পজিটিভ এসেছে, সেগুলিকে সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডগুলিতে বিএমসি থেকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সকাল ৮টার মধ্যে ওয়ার্ড দফতর তা সংক্রমিতদের কাছে পৌঁছে দিতে শুরু করে, সেই সঙ্গে চিকিৎসক ও চিকিৎসাকর্মীরাও পৌঁছে যেতে শুরু করেন। বিএমসি ৯০০ চিকিৎসক ও ৬০০ নার্সিং শিক্ষার্থীকে নিয়োগ করে। ৮০০টি এসইউভি গাড়িকে সাময়িক ভাবে অধিগ্রহণ করে রূপান্তরিত করে অ্যাম্বুল্যান্সে। বিএমসি ১৭২টি হাসপাতাল ও কোভিড চিকিৎসা কেন্দ্রের একটি কেন্দ্রীভূত ড্যাশবোর্ড বানায় এবং তার সঙ্গে প্রতি ওয়ার্ডে কর্মরত চিকিৎসকদের যুক্ত রাখা হয়, যাতে তাঁরা কোন হাসপাতালে খালি শয্যা রয়েছে তা জানতে পারেন এবং সংক্রমিতকে সেখানে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে পারেন। যে সব সংক্রমিতের অবস্থা ততটা সঙ্কটজনক নয়, তাঁদের বাড়িতেই নিভৃতবাসের পরামর্শ দেওয়া হয়।

এর পরে চাহাল মুম্বই আইআইটি-র সহায়তায় নগরীর ৪৭টি শ্মশানের একটি ড্যাশবোর্ড তৈরি করান। সেখান থেকেই মৃতদের সৎকারের জন্য নির্ধারিত ক্ষণ বলে দেওয়া হতে থাকে। এ ভাবেই শ্মশানগুলিকেও উপচে ওঠা ভিড় এবং অনিবার্য বিশৃঙ্খলা থেকে বাঁচানো সম্ভব হয়।

পরিশেষে, চাহাল অতিমারির তৃতীয় তরঙ্গের মোকাবিলার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছেন। নগরীর বুকে কোভিড মোকাবিলার জন্য যথেষ্ট পরিমাণ শয্যা এবং অক্সিজেনের জোগান রয়েছে বলে তিনি জানিয়েছেন। সত্যিই তিনি শহরের ৬টি জায়গায় জরুরিভিত্তিক সরবরাহের জন্য অক্সিজেন মজুত রেখেছেন এবং পূর্ণ গতিতে অতিরিক্ত অক্সিজেন উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপনের পথে এগোচ্ছেন।

এখন বোঝা যাচ্ছে, এক পেশাদারি মনোভাবাপন্ন শহরের প্রস্তুতি, ব্যবস্থাপনা এবং কর্ম সম্পাদনার চেহারা ঠিক কেমন হতে পারে। মনে রাখা দরকার, হাসপাতালগুলিতে অতিরিক্ত শয্যা বাড়ানো, অক্সিজেনের ভাঁড়ার নিশ্চিত রাখা, উন্মাদের মতো আচরণ না করে ঠান্ডা মাথায় কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত একটা ব্যবস্থাকে চালু করা— এ সবের কোনও পরিকল্পনাই দিল্লি করেনি। বদলে দিল্লি তার মুখ্যমন্ত্রীকে প্রতি দিন অক্সিজেনের অপ্রতুলতা নিয়ে হাহাকার করতে দেখেছে। একদা যে মানুষটি প্রতিবাদ জানাতে একটি গাড়ির নীচে শুয়ে পড়েছিলেন, তাঁর কাছ থেকে মানুষ এর বেশি আর কী-ই বা আশা করতে পারে?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.