এ-শহরের মিছিলওয়ালাদের বিবেক বেছে বেছে জাগ্রত হয়

এই নভেম্বরের এক অপরাহ্ণে কলকাতা শহর দেখল এক মহামিছিল। অতিমারির আশঙ্কাকে সরিয়ে রেখে পথে নেমেছিলেন কলকাতার অনেক মানুষ এক জন অভিনেতার শেষযাত্রায়। কলকাতা থেকে অনেক দূরে বসে দূরদর্শনের পর্দায় তা দেখে অভিভূত এক সাহিত্যিক কবি তসলিমা নাসরিন। তাঁর ফেসবুকে লিখলেন: “কবিতা পড়ে, গান গেয়ে, ফুলে ফুলে সাজিয়ে, চোখের জলে ভিজিয়ে প্রিয় শিল্পীকে যেভাবে বিদায় দিল কলকাতা— তার তুলনা হয় না।’’ আরও অনেক প্রশংসা। সত্যিই তো, এই মহানগরে, এই রাজ্যে, শিল্পীর, সংস্কৃতির এত সম্মান, তা ঢাক বাজিয়ে, বুক ফুলিয়ে আমরা প্রায়শই বলেও থাকি। কিন্তু কেউ যদি প্রশ্ন করেন: তসলিমা, আপনি কেন মিছিলে ছিলেন না, কেন আপনি নির্বাসিতা ধূসর দিল্লিতে?

তেরো বছর আগে, ২০০৭-এর এ-রকমই এক নভেম্বরের দিনে (২২ নভেম্বর), আপনাকে একবস্ত্রে কলকাতা ছাড়া করেছিল এই মিছিলের অনেক মানুষই। আপনি দ্বিজ, এক বার ঢাকা থেকে, তার পর কলকাতা, মৃত্যুর গ্রাস থেকে বেরিয়ে এসে আবার সজীব হয়েছেন। তবু আপনার ফেসবুকে আপনি এই শহরের প্রতি এখনও মমতাময়ী। কিন্তু আমরা যারা এক বার উদ্বাস্তু হয়ে এই শহরের জলাজঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছিলাম, সেই অতিসাধারণদের— তেরো বছর আগের নভেম্বর থেকে আবার উদ্বাস্তু হওয়ার দুঃস্বপ্ন আমাদের নিদ্রায় অনুপ্রবেশ করেছে।

মিছিলেই ফিরে আসি। একেবারে সর্বপ্রথমে আছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যিনি সেই ২০০৭ সালেই, তখন তিনি বিরোধী নেত্রী, মাদ্রাসা ছাত্রদের সভায় গিয়ে আপনাকে বিতাড়নের মৌলবাদী দাবি সমর্থন করেছিলেন। আপনি নিজেই সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন আপনার প্রতি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরূপতার কথা। ২০০৭, ২১ নভেম্বর মধ্য কলকাতার মৌলবাদী হাঙ্গামার অন্যতম নায়ক জামাতের সিদ্দিকুল্লা চৌধুরী এখন মমতা মন্ত্রিসভার মন্ত্রী। মিছিলে মুখ্যমন্ত্রীর পিছনেই রয়েছেন সেই ২০০৭ সালের পশ্চিমবঙ্গের সর্বশক্তিমান বাম নেতা কমরেড বিমান বসু। তিনি সেই ২১ নভেম্বরে দাঙ্গাকারী মৌলবাদীদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে সংবাদমাধ্যমেই ফতোয়া দিলেন— তসলিমা নাসরিনকে রাজ্য ছাড়তে হবে। মিছিলের আর কারও নামের প্রসঙ্গে আসব না, তবে আপনার প্রশংসিত মিছিলের সংগঠকরা, নামী-জনেরা কেউ আপনার পাশে দাঁড়াননি। দু’এক জন নাকি কান্না কেঁদেও তার পর আশ্রয় নিয়েছেন মমতা বা বিমানের ছায়ায়। হে দ্বিজ,

কী হয়েছে আপনার চলে যাওয়াতে? আপনার প্রস্থান ইঙ্গিত দিল এই শহরের শিল্প-সংস্কৃতির নতুন নিয়ন্ত্রকদের। সুতরাং, ৬ থেকে ৮ ফেব্রুয়ারি  ২০০৯-এ তিন দিন ধরে মহানগরের কেন্দ্রে উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন ইংরেজি সংবাদপত্রের অফিস ঘিরে চলল মৌলবাদী তাণ্ডব। ওই পত্রিকায় প্রকাশিত একটি লেখার মৌলবাদী বিরোধিতাকে শান্ত করতে তার সম্পাদককে গ্রেফতার করা হয়। এই মহানগর এই খবর প্রায় জানতেই পারেনি, নীরব ছিল আপনার প্রশংসিত মিছিলের সবাই। ৬ মে ২০১১’তে পৃথিবীর কুখ্যাততম ইসলামি সন্ত্রাসবাদী ওসামা বিন লাদেনের মৃত্যুতে কলকাতার টিপু সুলতান মসজিদে প্রার্থনা করলেন তৃণমূল কংগ্রেসের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ইমাম বরকতি সাহেব এবং আপনাকে বিতাড়নের অন্যতম নায়ক ও পরে তৃণমূল বিধায়ক ইদ্রিশ আলি। এঁরাই আপনার ছেড়ে যাওয়া কলকাতার বিশিষ্ট নাগরিক।

আপনার স্বদেশ বাংলাদেশের ছাত্র-যুবরা এই মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে ৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৩’তে ঢাকার শাহবাগে শুরু করল এক ঐতিহাসিক আন্দোলন, যার মূল দাবি: ১৯৭১-এর গণহত্যাকারী নেতাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে হবে। এই গণহত্যা আদতে বাঙালি হিন্দু গণহত্যা। কয়েক লক্ষ নিহতের ৯০ শতাংশ ছিলেন হিন্দু। নিহত মুসলমানরা ছিলেন মূলত আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত, যাঁদের নিধনকে রাজনৈতিক হত্যা বলা যায়। এ প্রসঙ্গে পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি হামুদুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত কমিশনের রিপোর্টে প্রকাশ পেয়েছে হিন্দুদের হত্যা করার লিখিত নির্দেশ। কমিশনের ভাষায়, “সারা দেশ জুড়ে গণহত্যার ধরনটাই ছিল এই রকম। হিন্দুদের শনাক্ত করে ঘটনাস্থলে হত্যা করা। এ জন্য সৈন্যরা পুরুষদের পরীক্ষা করে দেখত ‘ছুন্নত’ করা আছে কি না। থাকলে মুক্তি, না থাকলে নিশ্চিত মৃত্যু।” আগ্রহীরা এই বিষয়ে বাংলাদেশের প্রণম্য ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুনের নেতৃত্বে ১৯৭১ গণহত্যা নির্যাতন আর্কাইভ ও যাদুঘর ট্রাস্ট-এর প্রকাশিত গণহত্যা গ্রন্থমালার বইগুলি দেখে নিতে পারেন। সম্ভবত হিন্দু গণহত্যা বলেই এই গণহত্যা ও তার বিচার নিয়ে মিছিলের পশ্চিমবঙ্গ আশ্চর্য রকম নিঃস্পৃহ। ন্যুরেমবার্গ বিচারের মতনই এই যুদ্ধকালীন গণহত্যার বিচার— ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস ট্রাইবুনাল (বাংলাদেশ) সারা পৃথিবীতে আলোচিত, এমনকি আইনি বিষয়ে আলোচনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। অথচ, পশ্চিমবঙ্গের সংবাদমাধ্যমে এ নিয়ে কোনও আলোচনাই হয়নি। এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মামলার এগারো জন শীর্ষ সরকারি আইনজীবীর মধ্যে একমাত্র হিন্দু আইনজীবী ছিলেন রানা দাশগুপ্ত। বাংলাদেশের প্রথম সারির বরেণ্য হিন্দুদের অন্যতম, সুপ্রিম কোর্টের বরিষ্ঠ আইনজীবী রানা দাশগুপ্ত বামপন্থী আন্দোলনের পথ বেয়ে এখন বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টানদের প্রধান আশ্রয়। বীরাঙ্গনা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার-এর বাড়ির সন্তান রানা দাশগুপ্ত কলকাতায় এসেছেন অনেক বার, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের সংবাদমাধ্যম তাঁকে চেনেনি। 

শাহবাগ আন্দোলন বাংলাদেশে এক ঝড় তোলে, এর বিপরীতে মৌলবাদীরা সক্রিয় হয়। এই সময় কাঁধে ঝোলা ক’জন নিরীহ লিটল ম্যাগাজিনওয়ালা কলকাতার রবীন্দ্র সদন চত্বর থেকে শাহবাগ আন্দোলনের পক্ষে একটি মিছিল বার করবার চেষ্টা করে। তৎপর তৃণমূলি পুলিশ তা শুরুই করতে দেয় না। এর ক’দিন বাদেই, ৩০ মার্চ ২০১৩’তে, বাঙালি হিন্দু গণহত্যাকারীদের পক্ষে কলকাতার শহিদ মিনার ময়দানে মুসলিম সংগঠনগুলির ডাকে পঁচিশ হাজার মানুষের জমায়েত হয়, বিরাট ব্যানার ঝোলে: শেখ হাসিনার ফাঁসি চাই। না, কলকাতার কেউ এ-সবের বিরুদ্ধে মিছিল করেননি, কিছু বলেননি। সেই বছরের শেষে, ১৯ ডিসেম্বর ২০১৩, তসলিমা নাসরিনের দুঃসহবাস উপন্যাসটির টিভি চ্যানেলে সম্প্রচার বন্ধ করে দিল রাজ্য সরকার। একই ভাবে অক্টোবর ২০১৬’তে সেন্সর বোর্ড অনুমোদিত চলচ্চিত্র জুলফিকার মুক্তি পেল বেআইনি ভাবে কিছু সংশোধনের পর— মৌলবাদী আপত্তির কারণে। না, কেউ বিরোধিতায় মিছিল করেনি।

সুতরাং, আপনার প্রশংসিত মিছিলে আপনার স্থান হবে না, আপনার ঘরে ফেরার জন্য এই মিছিল কোনও স্লোগান তো দূরের কথা, এক মুহূর্ত নীরবতা পালন করেও এক নির্বাসিতা কবিকে সম্মান জানাবে না। তবু, আপনাকে ফিরতেই হবে, যাতে আগামী দিনের কলকাতার শিল্পীদের সম্মাননার মিছিল হয় আরও বড়, আরও প্রসারিত।  যদিও “চোদ্দ বছর ক’দিনে হয়, জানি নে মা ঠিক”, তবু মনে আছে আপনার নির্বাসন এই সবে চোদ্দো বছরে পড়ল। চোদ্দো বছরের পরই রামের অযোধ্যায় প্রত্যাবর্তন। ২০২১— এই সেই চোদ্দো বছর। আমরা প্রতীক্ষায় সেই আরও উদার প্রসারিত মহামিছিলের। আর, যদি আপনার ও পশ্চিমবঙ্গের বনবাস শেষ না হয়, তবে  বাংলাদেশের কবি প্রয়াত নির্মলেন্দু গুণের বিশ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকব, যদিও তাঁর সেই বিশ্বাস তাঁর দেশে বার বার লঙ্ঘিত:  

এই চন্দ্রমুগ্ধের উল্লাস থেমে গেলে

একাত্তরের মতো আবারও আমরা

ফিরে আসবো আমাদের অগ্নিশুদ্ধ ঘরে।

তখন তিনিই ফিরিয়ে দেবেন তোর

শাঁখা-সিঁদুর, তোর প্রতিমার ছিন্নভিন্ন দেহ।

তোর ভগবান কি অথর্ব, অন্ধ নাকি?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.