প্রাগজ্যোতিষ পুর (Pragjyotish Pur)। খুব খুব প্রাচীন এক রাজ্য। সেই মহাভারতের আগে থেকে ছিল। সেই রাজ্য পরবর্তী কালে কামরূপ নামে হয় সুপরিচিত।
এই কামরূপ রাজ্যের আবার চার ভাগ ছিল – কামপীঠ, রত্ন পীঠ, সুবর্ন পীঠ , সৌমর পীঠ। কোচবিহার তার রাজবংশকে পাবার পূর্ব অব্দি এটি কামরূপের অধীনে ছিল। নরকের পুত্র ভগদত্ত কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে যোগদান করেন কুরু পক্ষে। কে ভালো কে মন্দ তার বিচারে আমরা যাব না। যাক, তো , রাজা ভগদত্ত অর্জুনের হাতে পরাজিত ও নিহত হন।
ভগদত্ত শরীরে শক্তি কবচ ধারণ করতেন। কথিত আছে এই শক্তি কবচ দেবী গোসানমারী রূপে আজও পূজিতা। যদিও ১৩৬৩ বঙ্গাব্দ এ এটি চুরি যায় কিন্তু সেই কবচ সিংহাসন ও কবচ কৌট আজও দেবী হিসাবে পূজিতা হন।
পাল বংশের রাজত্বের শেষে এই অঞ্চলে খেন বংশের রাজত্ব শুরু হয়। খেন বংশের পরাক্রম শালী তিন রাজা ছিলেন – নীলধ্বজ , চক্রধ্বজ ও নীলাম্বর । এনারা ১৪৪০ থেকে ১৪৯৮ খ্রি অবধি রাজত্ব করেন। কামতাপুর ছিল রাজধানী। কিন্তু সেই করাল গ্রাস এল…হুসেন শা খেন রাজ্য আক্রমন করে ও প্রবল যুদ্ধ করেও নীলাম্বর পরাজিত ও নিহত হন।
সেই আক্রমণের পর সমগ্র এলাকায় মাৎসন্যায় সূচিত হয়। ভূঁইয়ারা যেমন স্বাধীন ভাবে প্রভুক্ত হল তেমনি একে অপরকে গ্রাস করল।
এই সময় কোচ জাতি শক্তি শালী হয়ে উঠছিল। তুরকা কোতোয়াল নামে এক দলপতি চিকনা পর্বতের নিচে অষ্ট গ্রামে অধিপতি ছিল। ঐদিকে চিকনা গ্রামে বাস ছিল হরিদাস মন্ডল নামে এক মেচ দলপতি বাস করতেন। তার সঙ্গে বিবাহ হয় এক কোচ ভূঁইয়ার দুই কন্যা জিরা ও হীরার।
জিরার সন্তান হলেন চন্দন ও মদন । হীরার সন্তান হলেন শিষ্য ও বিশ্ব। চারভাই প্রত্যেকেই খুব বলবান ছিলেন কিন্তু বিশ্ব বলের সঙ্গে বুদ্ধিও রাখতেন।
শৈশবের দিন গুলোয় গ্রামের ছেলেদের নানা রকম খেলা হত। একদিন তারা মা কালীর সামনে পুজো ও বলি বলি খেলা করছিল।
লৌকিক ভাবে কথিত আছে , বিশ্ব খেলার চলে কাঁঠাল পাতা দিয়ে বলি দিচ্ছিল তারই কোনো এক খেলার সাথীকে। কিন্তু কোন দৈব ক্রমে সত্যি বলি হলে যায় ।
অল্প সময়ের মধ্যেই চারিদিকে খবর ছড়িয়ে পরে। তুরকা কোতোয়াল তাদের ধরার জন্য সেনা পাঠালে চার ভাই জঙ্গলে চলে যায়। এর বেশ কিছু দিন পরে চার ভাই শক্তি ও লোক সংগ্রহ করে তুরকার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। এই যুদ্ধে মদন মারা গেলেও তুরকা পরাজিত ও নিহত হন।
বিশ্ব রাজা না হয়ে অগ্রজ চন্দন কে রাজা করে এবং এই তিন ভাই নিহত তুরকার তিন কন্যা কে বিবাহ করেন। এই ভাবেই একটি নতুন অধ্যায় সূচিত হয়। এই চন্দনই হলেন কোচ রাজবংশের আদি রাজা ও বিশ্বসিংহ হলেন আদি পুরুষ।
কথিত আছে এই আদিপুরুষ প্রথম শ্রেষ্ঠ নৃপতি বিশ্বসিংহ শিবের বরপুত্র ছিলেন। হিমালয় পর্বতমালার নিকটবর্তী অঞ্চল হবার জন্য দৈবিক এবং লৌকিক উভয় রূপেই উত্তরবঙ্গ শিবময় হয়ে রয়েছে এক সুপ্রাচীন কাল থেকে ।তাই এখানে র লৌকিক দেবদেবীরা অধিকাংশই শৈব সম্পর্ক যুক্ত।আর এই বংশেরই বহু বিখ্যাত রাজা বা ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম হলেন চিলারায় (Chilaras)।
এ হেন কোচবিহারে রয়েছে অজস্র পুরাকীর্তি এবং নানাবিধ প্রাকৃতিক ও রাজনৈতিক কারণে বহু বহু পুরাকীর্তি নষ্ট হয়ে গেছে বা যাচ্ছে। যে সব পুরাবস্তু বা পুরাকীর্তি এখনো কোচবিহারে পাওয়া যায় তা প্রায় পাল যুগের সমসাময়িক। প্রাক পাল যুগের পাথরে খোদিত যেসব দেবদেবীমূর্তি পাওয়া গেছে তাদের মধ্যে বিষ্ণু , সূর্য, উমা- মহেশ্বর ও নবগ্রহ বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য। প্রত্নতাত্ত্বিক এবং মূর্তি শিল্পের বিচারে এগুলি প্রাধানত পাল যুগের থেকে সেন যুগের সময়কালের মধ্যে বলে অনুমান করা যায়। মূর্তি গুলি কিছু পূজা এবং কিছু অলংকরনের জন্য খোদিত হয়েছিল বলে মনে করা হয়।সুপ্রাচীন কোচবিহার অবশ্যই সনাতনী এবং যুগ থেকে যুগান্তে এখানে সনাতনের অনুসারী মানুষজন ও রাজ বৃন্দ বসবাস ও রাজত্ব করে এসেছেন।
কোচবিহারের (Kochbihar) বহু জলাশয় এবং নদী থেকে বহু দেবদেবীরমূর্তি, প্রাচীন মুদ্রা এবং বিবিধ পুরাবস্তু পাওয়া গেছে। মুদ্রা এবং অন্যান্য পুরাবস্তু গুলি অবশ্য খ্রিস্টীয় পঞ্চদশ শতকের পূর্ববর্তী বলা চলে না। খেনরাজাদের রাজধানী কামতাপুর থেকে অনেক পাথরের মূর্তি , পুরাবস্তু ও অন্যান্য পুরাকীর্তির ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে। এগুলি পঞ্চদশ শতকের মধ্যভাগে নির্মিত বলে মনে হয়। খেন ও খেন পরবর্তী যুগে খেন এবং কোচ বংশীয় রাজারা এখানে বহু মাটির , ইঁটের এবং পাথরের দুর্গ বা গড় নির্মাণ করেছিলেন। বর্তমানে সেসব নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে এবং অনেকগুলিই জলপাইগুড়ি জেলা, আসাম রাজ্য, ভুটান ও বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
খেন এবং কোচ রাজারা বহু জলাশয় , সেতু ও রাস্তাও নির্মাণ করেছিলেন। এসবের কোনো ধ্বংসাবশেষ বা চিন্হ আর নেই। সবই কালের নিয়মের কালের গহ্বরে অন্তর্লীন হয়েছে। খেনরাজাদের দ্বারা নির্মিত মন্দিরের কিছু কিছু ধ্বংসাবশেষ এখনো দেখা যায়। কোচ রাজাদের নির্মিত অনেক মন্দির কালের গ্রাসে চলে গেলেও পূর্বে তাদের সংখ্যা অধিক ছিল তাতে সন্দেহ নেই। কোচ রাজবংশের আদি রাজাদের মন্দির অবশ্য কোচবিহারে খুব একটা দেখা যায় না। যেগুলি এখনো বর্তমান আছে তার অধিকাংশই অধুনা আসামের কামরূপে অবস্থিত।
কোচবিহারের যেসব দুর্গের কথা বলা হয়েছে তার বেশিরভাগই সম্ভবত খ্রিস্টীয় পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতকে নির্মিত। এসব দুর্গ গুলির মধ্যে ফেঙ্গুয়াগড়, বৈদ্যের গড়, বিক্রমরাজার গড়, রওনাগড়, প্রতাপগড়, সাতপাড় গড়, পাঙ্গাগড়, রাজার গড়, কামতাপুর দুর্গ , কুমারীর কোট, গড় দলিপা, ময়নামতির কোট, পিঞ্জারির ঝাড় দুর্গ, আঠারকোঠা দুর্গ, বারো পাইকের গড়, বিশ্বসিংহের কেল্লা, মন্থনাকোট , হিঙ্গুলা কোট, চিলারায়ের কোট ও জালধোওয়া দুর্গ বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য।
বর্তমানে কোচবিহার জেলায় খেন অথবা প্রাকখেনযুগের মন্দির দেখা যায় না। তবে, খেন রাজত্বের সময় কামতাপুরের অন্তর্গত রাজপাটে পাথরের বা ইঁটের মন্দির মন্দির নির্মিত হয়েছিল। সেসব মন্দির এখন না থাকলেও রাজপাটের মাটির স্তূপের উপরে দেবদেবীপ্রভৃতির মূর্তি সংবলিত বহু প্রস্তরখন্ড পাওয়া গেছে । ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিকগনের মতে ওই স্থানে মন্দিরের নির্মাতা ছিলেন স্বয়ং খেন রাজ নীলাম্বর। কেবল কোচবিহারের রাজা মহারাজারায় নন তাঁদের মন্ত্রী, দেওয়ান প্রমুখারাও মন্দির নির্মাণে পিছিয়ে ছিলেন না।
কোচবিহারের বিভিন্ন মন্দির ও দুর্গ নিয়ে ভবিষ্যতে বিস্তারিত আলোচনা করার ইচ্ছা থাকল।আজ কোচবিহারে প্রাপ্ত কিছু পুর নিদর্শন নিয়ে আলোচনা করি।
কোচবিহার জেলায় প্রাপ্ত সবচেয়ে প্রাচীন পুরানিদর্শনের মধ্যেই পাল ও সেন যুগে নির্মিত কিছু কিছু দেবদেবীর মূর্তি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । খেন যুগের ধ্বংসাবশেষ এখনো এই জেলা নানা স্থানে দেখা যায়। কোচ রাজত্বের পুরাকীর্তিও অল্প বিদ্যমান। সবথেকে বেশি উল্লেখযোগ্য কোন রাজাদের প্রচলিত #নারায়নী_মুদ্রা, যা এখানে যথেষ্ট পরিমাণে পাওয়া গিয়েছে।
বর্তমান অধ্যায়ে সেই নারায়ণী মুদ্রা নিয়েই কিছু আলোচনা করব।
কোচবিহারে প্রচলিত মুদ্রা ঐতিহাসিক কালে সাধারণভাবে নারায়ণী মুদ্রা নামে পরিচিত ছিল। এই রাজ্যের সকল নৃপতির নামের শেষে নারায়ণ (Narayan) উল্লেখ থাকার জন্য তাঁদের বংশ নারায়ণ–বংশ ও টাকা বা মুদ্রা নারায়ণী মুদ্রা নামে পরিচিতি লাভ করে । এহেন নামকরণের আরো একটি কারণ হলো, দেবী কামতেশ্বরী ছাড়াও ভগবান বিষ্ণু এই রাজবংশের কুলদেবতা । বিভিন্ন ঐতিহাসিক গ্রন্থ সহ আলমগীরনামা ইত্যাদিতেও এই মুদ্রার উল্লেখ আছে। এই মুদ্রার আরো একটি নাম ছিল , তাহল #শিবটঙ্ক বা #শিবাঙ্কটঙ্ক । কারণ , এই মুদ্রা বা টাকার গাত্রে শিব, শিবদুর্গা মূর্তি বা নাম খোদিত ছিল।
কোচবিহারের পরমপুরুষ বিশ্বসিংহ কোনরূপ টাকার মুদ্রণ করিয়েছিলেন কিনা তা সঠিক ভাবে বলা যায় না। তবে কোনো কোনো কুলজী অনুসারে কোচবিহারের পুরুষসিংহ বিশ্বসিংহের ভ্রাতা চন্দন ১৩ রাজশকায় সিংহাসন লাভ করেন এবং পরে আদিপুরুষ বিশ্ব রাজা হলে নিজের নামে সিক্কা মুদ্রণ করেছিলেন। এই রাজশকা ১৫১০ খ্রিস্টাব্দ থেকে আরম্ভ হয়েছিল এবং সেই বছরই চন্দন কুচবিহারের রাজা হয়েছিলেন । চন্দন ৪০ বৎসর বয়সে দেহত্যাগ করলে বিশ্বসিংহ রাজা হন। ছেলে নরনারায়ণের সময় থেকে নিয়মিতভাবে যে টাকা তৈরি করেছিলেন তা ছিল রূপার এবং তনখার ন্যায় দেখতে। সেই মুদ্রার ওজন ছিল প্রায় ১৬৫ গ্রেণ ও গোলাকার।
রাজাদের নামে নারায়ণ শব্দের ন অক্ষরের নিচে মনোগ্রাম এবং ক্লিনফ্লয়েল চিহ্ন দেখতে পাওয়া যায় । রাজা প্রাণনারায়ণ ১৬৪৯ খ্রিস্টাব্দের একটি মুদ্রায় বিন্দু চিহ্ন দেখতে পাওয়া যায়। এছাড়া কোন কোন মুদ্রায় ঢেঁরা ও অর্ধচন্দ্র বা চন্দ্রবিন্দু ইত্যাদি চিত্র দেখতে পাওয়া যায় । ধৈর্যেন্দ্রনারায়ণ ও হরেন্দ্রনারায়ণ ছাড়া অন্য কোন রাজার টাকায় এধরনের চিহ্ন দেখা যায় না । কোচরাজাদের আগে কোচবিহারে খেন রাজারা রাজত্ব করতেন । সেই বংশের শেষ রাজা #নীলাম্বরকে হারিয়ে হোসেন শাহ কামতা রাজ্য অধিকার করেছিল।
এইসকল খেন রাজাদের কোন মুদ্রা এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়নি । তবে তাঁদেরও মুদ্রা ছিল বলে মনে হয়। রাজপাটে কাছে টাঁকশাল নামক স্থানে যে সমস্ত প্রস্তরখন্ড পড়ে থাকতে দেখা যায় সেখানে রাজাদের তৈরি কিছু মুদ্রা পাওয়া যাবে এ ধরনের অনুমান অনেকেই করে থাকেন।
কোচবিহারের যে সমস্ত মুদ্রা পাওয়া যায় সেখানে মূর্তি মুদ্রিত নেই । এদের সোজা ও উল্টো দিকে শুধু সংস্কৃত ভাষায় ও বাংলা অক্ষরে লেখন থাকত। সোজা দিকে রাজার উপাধি এবং উল্টোদিকে রাজার নাম ও তারিখ মুদ্রিত হতে দেখা যায় । এইরীতি নরনারায়ণের পুত্র লক্ষ্মীনারায়ণের রাজত্বের কিছু সময় অবধি প্রচলিত ছিল । পরবর্তীকালে , কোচবিহারের পশ্চিমাংশ #মোঘলদের অধিকারে চলে গেলে, রাজারা পুরো টাকা তৈরীর অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে কেবলমাত্র #আধুলি তৈরীর অনুমতি পান।
নরনারায়ণের টাকার লেখন বাংলা অক্ষরে এবং গোলাকার ছিল । সেই মুদ্রার সোজা দিকে শ্রীশ্রীশিবচরণকমলমধুকরস্য এবং উল্টোদিকে শ্রীশ্রীমন্ননারায়ণস্য বা নারায়ণভূপালস্য_শাকে_১৪৭৭ এই লিপি উৎকীর্ণ হতে দেখা যায় । লক্ষ্মীনারায়ণের টাকার সোজা দিকে নারায়ণের মুদ্রার ন্যায় লেখন ছিল, উল্টো দিকে ছিল শ্রীলক্ষ্মীনারায়ণস্য শাকে ১৫০৯ বা ১৫৪৯। লক্ষ্মীনারায়ণের নাতি শ্ৰীমৎপ্রাণনারায়ণস্য শাকে ১৫৫৪ বা ১৫৫৫ বা ১৫৫৯লিপি দেখা যায়। এঁর একটি টাকায় #শাকে_১৪০ অর্থাৎ #রাজশকা_১৪০ মুদ্রিত আছে।
প্রাণনারায়ণের পুত্র মোদনারায়ণের একটি আধুলি পাওয়া গিয়েছে । যাতে রাজশকা ১৭০ মুদ্রিত আছে। খ্রিস্টীয় আঠারো শতকের মধ্যভাগে পর্যন্ত রাজা মহীন্দ্র নারায়ণ ব্যতীত অন্য সকল নৃপতির তারিখহীন এবং আংশিক লেখন যুক্ত আধুলি পাওয়া গেছে। নরনারায়ণের ভাতুষ্পুত্র রঘুদেবনারায়ণ এবং তাঁর পুত্র পরীক্ষিতনারায়ণের টাকা নরনারায়ণের টাকার অনুকরণে তৈরি ও তাতে হরগৌরী নাম উল্লেখ করা আছে।
এ পর্যন্ত পাওয়া গিয়েছে তার মধ্যে সবথেকে পুরনো নরনারায়ণের প্রচলিত মুদ্রা। এখনো অবধি তাঁর মোট পাঁচটি টাকা পাওয়া গিয়েছে যার ওজন ১৫৭.৫ গ্রেন থেকে ১৫৮.৪ গ্রেন । লক্ষ্মীনারায়ণের মোট ১৮ টি টাকা ও সাতটি আধুলি পাওয়া গিয়েছে । মুদ্রাগুলির ওজন ১৪৭.৯ গ্রেন থেকে ১৫৫.৪ গ্রেন। আধুলি গুলির ওজন ৭২.৯ গ্রেন থেকে ৮৫.৯ গ্রেন। এগুলির বেশিরভাগই ১৫০৯ শাকের। একটিতে রাজশকা ৯২ লেখা আছে। লক্ষ্মীনারায়ণণের পুত্র বীরনারায়ণের টাকা অবশ্য এখনো অবধি আবিষ্কৃত হয় নি। লক্ষ্মীনারায়ণের পৌত্র প্রাণনারায়ণের নয়টি টাকা এবং নয়টি আধুলি পাওয়া গিয়েছে। মুদ্রাগুলির ওজন ১৪২ গ্রেন থেকে ১৫৩.৪ গ্রেন এবং আধুলি গুলির ওজন ৬১.৩ গ্রেন থেকে ৭৮.৭ গ্রেন ছিল। এই রাজার মুদ্রায় যে শাক শব্দটি পাওয়া গিয়েছে তা শকাব্দ বা রাজশাক উভয়কেই বোঝায়। প্রাণ নারায়ণের মুদ্রায় চারিটি তারিখ দেখা যায় – শাকে ১৪০, শাকে ১৫৫৪ , শাকে ১৫৫৫ এবং শাকে ১৫৫৯ ।
প্রাণনারায়ণের পুত্র মোদনারায়ণের সময় থেকে কোচবিহারের রাজমুদ্রা তৈরি একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়। তার সময় তৈরি মাত্র একটি আধুলি পাওয়া গিয়েছে। যার ওজন ৭৫.২৮ গ্রেন। মোদনারায়ণের পরবর্তী রাজাদের আধুলি ছাড়া অন্য কোন মুদ্রা পাওয়া যায়নি । যেসব আধুলির ওজন ৬২ গ্রেনের কম এবং ৭০ গ্রেনের অধিক নয়।
শিবেন্দ্রনারায়ণের সময় থেকে কিছু টাকা পুনরায় চালু হয় । এই সময় টাকা বা মুদ্রা গুলিতে পুরানো বাংলা বা মৈথিলি বড় হরফের বদলে বর্তমান বাংলা বাংলা ছোট হরফের ব্যবহার শুরু হয় । ওই নৃপতির সোনার ১৬ টি এবং রূপার ৮ টি মুদ্রা আবিষ্কার হয়েছে। সোনার টাকাকে অর্ধমোহর এবং রূপার টাকাকে আধুলি বলা হতো।
নরেন্দ্রনারায়ণ ও নৃপেন্দ্রনারায়ণের যথাক্রমে ১২ টি অর্ধমোহর ও ৫ আধুলি এবং ৬ টি অর্ধমোহর ও ১১০০ টি আধুলি পাওয়া গিয়েছে। রাজরাজেন্দ্রনারায়ণ , জিতেন্দ্রনারায়ণ ও জগদ্দীপেন্দ্রনারায়ণের সোনার ও রূপার টাকা এখনো নানা জায়গায় দেখা যায়। রাজরাজেন্দ্রনারায়ণের টাকা পূর্ববর্তী রাজাদের থেকে একেবারে অন্য ধরনের ছিল । এতে চিরাচরিত শিবচরণকমলমধুকরস্য ইত্যাদির পরিবর্তে #যতোধর্মস্ততোজয় ও রাজচিন্হ বা coat of arms – যেমন সিংহ ও হাতির মূর্তি মুদ্রিত আছে। পরবর্তী পর্যায়ে নৃপতিদের মুদ্রায় সেই অংশে সিংহের বদলে বাঘের মূর্তি স্থান পায়।
নৃপেন্দ্রনারায়ণ , রাজরাজেন্দ্রনারায়ণ , জিতেন্দ্রনারায়ণ ও জগদ্দীপেন্দ্রনারায়ণের মুদ্রাগুলি যথাক্রমে সন ৩৫৪ শকা , রাজশকা ৪০২ , রাজশকা ৪০৪ ও রাজশকা ৪১৩ য় তৈরি। নৃপেন্দ্রনারায়ণ বা ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে যে সব মুদ্রা তৈরি হয়েছে সেগুলি ঠিক নিয়মিত ভাবে প্রস্তুত হয় নি। সেগুলি তৈরি হতো রাজাদের অভিষেককে স্মরণীয় করে রাখার প্রয়োজনে।
নারায়ণী মুদ্রাকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা যায় –
পুরানো এবং নতুন। নরনারায়ণের সময় থেকে দেবেন্দ্রনারায়ণের সময় পর্যন্ত মুদ্রাগুলিকে পুরান এবং পরবর্তী সময়ে মুদ্রাগুলিকে নতুন বলে গণ্য করা হয় ।
মোঘলদের সময় থেকে মুদ্রা নির্মাণ বন্ধ করার চেষ্টা হয়েছিল , কেবল আধুলি তৈরির হুকুম ছিল। পরে ভারতে ব্রিটিশ শাসন কায়েম হবার পর থেকে ,ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নিজেদের ক্ষমতা বাড়ানোর উদ্দেশ্যে কোচবিহারের রাজাদের স্বাধীনভাবে টাকা তৈরির অধিকারকে নানাভাবে খর্ব করার চেষ্টা করতে থাকে। কিন্তু হরেন্দ্রনারায়ণ প্রমুখ নৃপতিদের দৃঢ় মনোভাবের জন্য সে চেষ্টা তখনকার মতো ব্যাহত হয় । ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দের এক আদেশের বলে ব্রিটিশ সরকার এই টাকা তৈরীর অধিকার ও ব্যবহার রহিত করে দেয়। ফলে একদিকে যেমন কোচবিহারের রাজাদের প্রচলিত মুদ্রা এবং আধুলি কোচবিহারে ব্যবহার বন্ধ হয়ে যায় , অন্যদিকে ব্রিটিশ সরকারের টাকার প্রচলন হয়। সেজন্য রাশি রাশি নারায়ণী মুদ্রা ধ্বংস করা হয়েছিল বা বিক্রি করা হয়েছিল এবং লোকের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়া হয়।
পরবর্তীকালে নারায়নী মুদ্রা পরিণত হয়েছিল এক বিরল বস্তুতে। অবশ্য কিছু কিছু স্বদেশী এবং বিদেশী মিউজিয়ামে রক্ষিত আছে। এই মিউজিয়াম গুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল – কলকাতা ইন্ডিয়ান মিউজিয়াম , আশুতোষ মিউজিয়াম, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ , এশিয়াটিক সোসাইটি , পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পুরাতাত্ত্বিক গ্যালারি , গৌহাটিতে অবস্থিত আসাম সরকারের মিউজিয়াম।বিদেশী মিউজিয়ামগুলির মধ্যর ব্রিটিশ মিউজিয়াম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । এছাড়া কোচবিহার জেলার সরকারী তোশাখানায়, আসাম সরকারী তোশাখানায় , কোচবিহার রাজবাড়ি এবং কোচবিহার সাহিত্যসভায় এই ঐতিহাসিক মুদ্রা কিছু কিছু সঞ্চিত আছে।
এই নারায়নী মুদ্রা কিভাবে এবং কোথায় তৈরি হতো তার কোন সঠিক হদিশ পাওয়া যায় না। তবে কোচবিহার শহরের কাছে #টাকাগাছ নামে গ্রামের টাঁঁকশাল থেকে বছরে প্রায় ৫০০০০ নারায়নী মুদ্রা প্রস্তুত হতো, ঐতিহাসিকরা এরকম মনে করে থাকেন। এরকম মনে করার কিছু কারণ আছে…. টাঁকশালের টাকা মুদ্রণের কাজ দেখাশোনার জন্য একজন মোটা মাহিনার রাজকর্মচারী নিযুক্ত ছিলেন । তাঁকে #ভান্ডারঠাকুর বলা হতো । ১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দেও কোচরাজাদের এই টাঁকশাল থেকে প্রায় ৩০০০০ আধুলি তৈরি হয়েছিল। সে সময় একটি রূপার আধুলিতে প্রায় ১/৪০ ভাগ তামা মেশানো হতো। ১০০ টি সিক্কার বদলে ১১৫ – ১১৯ টি নারায়ণী মুদ্রা পাওয়া যেত।
নরনারায়ণের সময় থেকেই নারায়ণী মুদ্রা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। এই নারায়ণী মুদ্রার চাহিদা ক্রমশ সমগ্র পূর্ব এবং উত্তর পূর্ব ভারতের প্রায় সব কটি রাজ্যেই ছড়িয়ে পড়ে। জয়ন্তিয়া, কাছাড়, ডিমরুয়া ইত্যাদি অঞ্চলের রাজারা নারায়ণী মুদ্রার অনুকরণে মুদ্রা নির্মাণ করতে থাকেন। ভুটান এবং আসামের মানুষদের নিকট এই টাকার চাহিদা এবং জনপ্রিয়তা ব্যাপক মাত্রায় বৃদ্ধি পায়। এই সময় অনেক অসাধু লোক পাইকারী হারে নারায়ণী মুদ্রা তৈরি করে গোপনে অন্য রাজ্যে চালান দেবার চেষ্টাও করেছিল।
কোচবিহার সহ সম্পূর্ণ পূর্ব ভারতে ব্রিটিশ শাসন কায়েম হবার পরেও লোকদের কোম্পানির টাকার চেয়ে কোচরাজাদের নারায়ণী মুদ্রার উপর মানুষের আস্থা ও আগ্রহ অধিক ছিল। নারায়ণী মুদ্রাকে কোচবিহারের অধিবাসীরা লক্ষ্মীজ্ঞানে ভক্তি ও পূজা করতেন ।
নারায়ণী মুদ্রা আমাদের অহংকার ….
©দুর্গেশনন্দিনী (Durgeshanandini)
তথ্যঃ ১. গৌড়ের ইতিহাস
২. কোচ কিংস অফ কামরূপ
৩. কোচবিহার জেলার পুরাকীর্তি