গৈরিকবর্ণ কনভোকেশন রোব পরে দেশের সংসদের দুই কক্ষে পাশ হওয়া আইনের প্রতিলিপি ছিঁড়ে ফেলে কি প্রমাণ করতে চাইলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রথম স্থানাধিকারী ছাত্রী দেবস্মিতা? জাতীয়তাবাদী আবেগ ও শিক্ষাক্ষেত্রে সমুচ্চ উৎকর্ষের লক্ষ্য নিয়ে গড়ে তোলা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন মঞ্চে ‘ইনকিলাব’এর নামে অর্বাচীন আবেগের অবিমৃশ্যকারি প্রদর্শন, প্রতিবাদের নামে হিতাহিত জ্ঞানশূন্যতা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতাবর্গ বোধ করি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির জন্মলগ্নে কল্পনা করেন নি। যে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয় জাতীয়তার আদর্শ নিয়ে শিক্ষা ও গবেষণার মান ও উৎকর্ষের ক্ষেত্রে আপোসহীনতা, সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন মঞ্চে লাঞ্ছিত হল ভারতের সংসদীয় গণতন্ত্র এবং তা-ও আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম এক মেধাবী ছাত্রীর দ্বারা। প্রকৃত মেধার এমন অবনমন বা মেধা ও মূল্যবোধের এই বিসদৃশ ব্যবধান কি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্মলগ্নে কল্পনা করা গিয়েছিল? মনে হয় না। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এঞ্জিনিয়ারিং ফ্যাকাল্টির প্রাক্তনী হিসেবে এসবের পিছনে পরিপক্ক রাজনৈতিক মস্তিষ্কের প্রভাব অনুমান করতে অসুবিধা হয় না।

কিছু শিক্ষক ও কিছু বয়োজ্যেষ্ঠ মেন্টর তারুণ্যের প্রগলভতায় উচ্ছ্বল ছাত্রদের ধরে কিভাবে তাদের অপরিপক্ক মস্তিষ্কে প্রোথিত করে দেন ‘ইনকিলাব’ এর নামে ধ্বংসাত্মক বিভেদকামীতার বীজ এবং কিভাবে তাদের উদ্বুদ্ধ করেন প্রগতিশীলতার নামে অসহিষ্ণু আচরণ করতে, তা খুব কাছ থেকে দেখেছি। এই মেন্টররা, এই শিক্ষকরা যে ভারতবিরোধী বিভেদকামী শক্তির প্রতিনিধি তা বলার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী হিসেবে কোনো রাখঢাক করার প্রয়োজন এই মুহূর্তে অনুভব করছি না। কারণ এই ধরণের রাখঢাক করার প্রবণতাই রাজ্য হিসেবে পশ্চিমবঙ্গকে সেই জায়গায় নিয়ে দাঁড় করিয়েছে যেখান থেকে মানবতাসমৃদ্ধ গণতন্ত্রের পথে ফিরে আসতে গেলে নির্জলা সত্য বলার ও দেখার সৎসাহস প্রদর্শন করতে হবে।

যাঁরা CAA’র বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছেন, তাঁদের অধিকাংশই হয়ত আইনটি একবার পড়েও দেখেন নি। যাঁরা ছাত্রছাত্রীদের ক্ষেপিয়ে তুলছেন, তাঁরাও যে আইনটি সম্বন্ধে না জেনেই তাদের উস্কানি দিচ্ছেন, এমন বোধ করি নয়। ‘পাকা মাথা’রা তাঁদের ‘টার্গেট’দের ভুল বোঝাচ্ছেন। ছাত্রছাত্রীদের কাছে এই ‘মেন্টর’দের কথা ‘ঋষিবাক্য’তুল্য। তাঁদের বক্তব্যকে ক্রস-ভেরিফাই করতে বোধ হয় যায় না তারা। এই ‘মেন্টর’দের পরিচালনায় তারা চলছে প্রিকনসিভড্ নোশন নিয়ে। তারা হয়ত ধরেই নিয়েছে যে লেজিসলেশন যখন ভারতীয় জনতা পার্টির নেতৃত্বাধীন, তখন আইনটি ধর্মীয় পক্ষপাতদুষ্ট না হয়েই যায় না।

জাতীয়তাবাদী ভাবধারার প্রতি এই বিদ্বেষ যাদবপুরের ছাত্রছাত্রীদের একটা বড় অংশের মধ্যে সুপরিকল্পিতভাবে প্রোথিত। বামপন্থী সেই অন্ধ অসহিষ্ণুতারই উদগ্র প্রকাশ এখন আর একবার ঘটছে CAA-বিরোধিতা উপলক্ষ্যে। CAA’র মত একটি সর্বাঙ্গসুন্দর আইনকে অযথা নস্যাৎ করার উন্মাদনায় মথিত হয়ে উঠছে দশকের পর দশক ধরে পশ্চিমবঙ্গের কোণায় কোণায় জাতীয়তাবোধের প্রতি জমে থাকা বিদ্বেষের তীব্র হলাহল। একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের ভাবধারা ও যুক্তিপরম্পরা সম্বন্ধে সম্যক না জেনেই বিদ্বেষের যে তীব্র বিষক্রিয়া প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ায় এবং ছাত্র বিক্ষোভের মঞ্চগুলিতে, তা সম্যক উপলব্ধি করলে ভয়ে শিহরিত হবেন যে কোনো ধীমান সংবেদনশীল ব্যক্তি। রাজনৈতিক মতদ্বৈধের নামে বিদ্বেষের এ কোন্ ভয়াবহ তাণ্ডব? নচেৎ দেবস্মিতার মত মেধাবী ছাত্রী আইনটির প্রতিলিপি ছিঁড়ে ফেলতে পারতেন কি? ছিঁড়ে ফেলার মধ্য দিয়ে কি বার্তা দিতে চাইলেন তিনি? এটিই কি যে দেশের একটি আইনকে তিনি/তাঁরা পূর্ণতঃ প্রত্যাখ্যান করছেন? কিন্তু তাঁরা কি জানেন যে CAA প্রত্যাখ্যান করলেও যেমন কাউকে কিচ্ছু পাইয়ে দেওয়া যায় না, তেমনই কারুর প্রতি কোনো বঞ্চনা আটকানোও যায় না? বরং কিছু অসহায়, অত্যাচারিত মানুষের কাছ থেকে সুস্থ জীবনের অধিকারটুকু কেড়ে নেওয়া হয় মাত্র? কারণ CAA কাউকে কোনোকিছু থেকে বঞ্চিত করার আইন নয়। তাঁরা কি উপলব্ধি করতে পারেন যে, যে মানুষগুলো প্রাণ ও মান বাঁচাতে ছুটে এসেছেন ভারতের দুয়ারে, CAA প্রত্যাখ্যান করলে তাঁদেরকে পরোক্ষে মৃত্যু বা ধর্মান্তরিত হওয়ার দিকে ঠেলে দেওয়া হয়? ছাত্র-বোধ তো হওয়ার কথা অনেক বেশি স্পর্শকাতর ও নির্ভেজাল যুক্তিনির্ভর। তবে এক্ষেত্রে একদল অত্যাচারিত মানুষের প্রতি এমন‌ কঠোর ও অসংবেদনশীল তাঁরা কেন হচ্ছেন? কোথায় খামতি রয়ে গেল তাঁদের মনস্তাত্ত্বিক কোমলতার প্রতিপালনে? কি কারণে তাঁদের গ্রাস করল এমন অযৌক্তিক ও অমানবিক অসহিষ্ণুতা? যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় বার বার আমাদের সুযোগ দিচ্ছে সেই আত্মসমীক্ষার।

ওসব দেশগুলি থেকে মুসলিমরাও এদেশে এসেছেন। কিন্তু এসেছেন অন্যতর কারণে, ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার হয়ে নিশ্চিতভাবেই নয়। কারণ ইসলামিক দেশে ইসলাম ধর্ম পালন করতে গিয়ে কোনো মুসলিমের পক্ষে নিপীড়িত হওয়া বাস্তবপক্ষে কি সম্ভব? তৎসত্ত্বেও তর্কের খাতিরে যদি ধরে নিই যে আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মত ইসলামিক দেশগুলি থেকে মুসলিমরাও ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার হয়েই ভারতে এসেছেন, তবে নিশ্চিতভাবেই প্রশ্ন উঠতে বাধ্য যে সেক্যুলার ভারতবর্ষ কি তবে ইসলাম ধর্মপালনের জন্য মুসলিমদের কাছে ইসলামিক দেশগুলির চেয়েও বেশি ইসলামবান্ধব? যুক্তিসঙ্গতভাবে তা হওয়ার কোনো কারণ নেই এবং সেইজন্যই ইসলামিক দেশের মুসলমানরা তাঁদের নিজেদের দেশে ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার হলেও, তা থেকে বাঁচতে তাঁরা ভারতবর্ষের মত একটি সেক্যুলার দেশে আসতে চাইতে পারেন না। তাহলে এই আইনের পরিপ্রেক্ষিতে আফগানিস্তান পাকিস্তান ও বাংলাদেশে ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার ঐসব দেশের হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, শিখ, পার্সি ও খ্রীষ্টান ইত্যাদি ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা ঐসব দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদের সঙ্গে সম-মানদণ্ডে বিবেচ্য হবেন কি করে?

২০১৪ সালের শেষ দিন পর্যন্ত যে সব আফগান, পাকিস্তানী বা বাংলাদেশী মুসলিম এদেশে এসেছেন এবং বাস করছেন, তাঁরা কোনোভাবেই নিপীড়নের যাতনায়, স্থাবর সম্পত্তি হারিয়ে, প্রাণ ও মান বাঁচাতে পালিয়ে আসা ঐসব দেশের সংখ্যালঘু লোকগুলির সঙ্গে সম-মাপকাঠিতে বিচার্য হতে পারেন না। হলে সেটি সমদর্শীতা নয়। ঐসব দেশের এই সংখ্যালঘু মানুষগুলো পাকিস্তান, আফগানিস্তান বা বাংলাদেশে ফিরে গেলে হয় তাদের ধর্মান্তরিত হতে হবে, নয়ত প্রাণ দিতে হবে। ঠিক এই পদ্ধতিতেই ১৯৪৭ এর পর থেকে পাকিস্তান ও বাংলাদেশে হু হু করে কমেছে সংখ্যালঘু জনসংখ্যার শতকরা হিসাব। তবে কি এমন শরণার্থীদের অস্বীকার করা ভারতের চিরায়ত দর্শনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ? কখনই না। উক্ত তিন প্রতিবেশী ইসলামিক দেশের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী এবং ঐসব দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম—উভয়ের পরিস্থিতি ও অবস্থার ভিন্নতাই তাঁদের প্রতি ভারত সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতার কারণ। দৃষ্টিভঙ্গির এই তারতম্যকে অসাম্য বললে সত্যের অপলাপ হয়। এ বিষয়ে উল্লেখ্য, যাঁরা আইনটি একবারও পড়েছেন, তাঁরা জানবেন যে CAA2019 এ ‘মুসলিম’ শব্দটি একবারও উল্লেখিতমাত্রও হয় নি। আইনটি মুসলিমদের বঞ্চিত করার আইন নয়, যাঁরা প্রাণ ও মানসম্মান বাঁচাতে আমাদের তিনটি প্রতিবেশী ইসলামিক দেশ থেকে ২০১৪ সালের ৩১শে ডিসেম্বরের মধ্যে এদেশে পালিয়ে এসেছেন তাঁদের স্বীকৃতি দেওয়ার আইন।‌

উক্ত দেশগুলির মুসলিমরাও যে এদেশের নাগরিকত্ব পাবেন না এমন কিন্তু নয়। এই CAA আইন না থাকলে তাঁরা যে উপায়ে নাগরিকত্ব পেতে পারতেন, এখনও ঠিক সেই একই উপায়ে নাগরিকত্ব পেতে পারেন। সেখানে কোনো তারতম্য হয় নি। ২০১৪’র শেষ দিন পর্যন্ত এদেশে আসা ঐসব দেশের সংখ্যালঘুদের জন্য ন্যাচারালাইজেশনের শর্ত শিথিল করা হলেও ঐসব দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদের জন্য সেই শর্তাবলী পূর্ববৎই রয়েছে, শিথিলও হয় নি, কঠিনও হয় নি। তফাৎ বলতে শুধু এইটুকুই যতটুকু তফাৎ না থাকলেই বরং সাম্য লঙ্ঘিত হত। যাঁদের অবস্থা, পরিস্থিতি এক নয়, তাঁদের সম-মানদণ্ডে বিচার করা ন্যায়ও নয়, সাম্যও নয়। কিন্তু দেবস্মিতার মত ছাত্র ছাত্রী এই সামান্য বিষয়টি উপলব্ধি করতে অক্ষম, এমন ভাবতে বড় অস্বস্তি হয়। তবে কি উচ্চকিত স্লোগান সর্বস্ব ছাত্ররাজনীতি প্রকৃত মেধা ও উপলব্ধির জগতে বামনে পরিণত করছে আমাদের তরুণ প্রজন্মকে?

যে আইন সংসদের দুই কক্ষে পাশ হয়ে বর্তমানে দেশের আইনে পরিণত হয়েছে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের নামে বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্যকেই বয়কট করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির অবমাননা করা কি আবশ্যক ছিল? আচার্য বিনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অর্থ কি? শিক্ষা ও বিদ্যার্জনের স্বীকৃতিস্বরূপ ডিগ্রি লাভ করার দিনে আচার্য অর্থাৎ গুরুকে বয়কট ও অপমানের এই সংস্কৃতি কি আমাদের পরিচিত? বরং ডিগ্রি লাভের পর আচার্যের কাছেই কি পেশ করা যেত না প্রতিবাদপত্র? কিন্তু আচার্যকে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশেই বাধা দেওয়ার মাধ্যমে সমাবর্তন মঞ্চে তাঁর আসন শূন্য রেখে ডিগ্রি লাভের যে প্রহসন চলল, সে সংস্কৃতি আমাদের অপরিচিত। এরা আদতে রাজ্যপাল যে পদাধিকার বলে আচার্য, সেই প্রাতিষ্ঠানিক সত্যটিকে আদত সত্য বলেই মানে না। অর্থাৎ এরা প্রতিষ্ঠান বিরোধী, ধ্বংসাত্মক। কিন্তু রাজ্যপালের আচার্য হওয়ার নিয়মটি তো সাংবিধানিক, বিজেপি সরকারের বানানো নয়। তবে এদের প্রতিবাদ কিসের বিরুদ্ধে? সংবিধানের বিরুদ্ধে?

বাস্তব হল, ১৯৪৬এ নোয়াখালীতে যা শুরু হয়েছিল, সেই হিন্দুঘাতী দাঙ্গা বাংলাদেশে হয়েছে বার বার। ঝাঁকে ঝাঁকে। ১৯৫০এ প্রথমে ঢাকা, তারপর বরিশালে, ১৯৬৪ তে খুলনা, নারায়ণগঞ্জ, ময়মনসিংহ, রাজশাহী, সিলেট ও ঢাকায়। ১৯৭১ এ মুক্তিযুদ্ধের সময় নৃশংস, সুপরিকল্পিত হিন্দু হত্যাযজ্ঞ হয়েছে বাংলাদেশের সর্বত্র। তারপর ১৯৮৮তে স্বাধীন বাংলাদেশেও হল দাঙ্গা, বাবরি মসজিদ ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে এই গুজব ছড়িয়ে। তারপরের ভয়াবহ দাঙ্গা সে দেশে হয়েছিল ২০০১ সালে, বিএনপি-জামাত জোট ক্ষমতায় আসার পর। তারপর ২০১৩য় এবং ২০১৬ তেও। ঘটিয়েছে বাংলাদেশের মৌলবাদী মুসলিম সমাজ, যা আজও থামে নি। আজও যে কোনো সামান্য অজুহাত তৈরি করে হিন্দুদের ওপর চড়াও হয় তারা, দখল করতে চায় হিন্দুদের অধিকারে থাকা সম্পত্তিরাশি, ভেঙ্গে ফেলে মন্দির, হত্যা করে পুরোহিতদের। এই দাঙ্গা-সংস্কৃতি থেকে বাঁচতেই নিজের দেশে স্থাবর সম্পত্তি ফেলে রেখে ঝাঁকে ঝাঁকে এপারে চলে এসেছেন বাংলাদেশের হিন্দু বাঙালী। এবং এমনভাবেই, স্থাবর সম্পত্তি নিজের তুতোভাইয়ের তত্ত্বাবধানে রেখে ওপার বাংলা থেকে কোনো একদিন চলে এসেছিলেন আমার ঠাকুরদাও। আর কোনোদিন তাঁর বা আমাদের কারুর হয় নি সেখানে ফিরে যাওয়া। কি হয়েছিল সেসব সম্পত্তির, তাও জানা যায় নি আর কখনও।

তাই এই হতভাগ্য মানুষগুলোকে, যাঁরা ২০১৪ সালের ৩১শে ডিসেম্বরের মধ্যে এদেশে এসেছেন এবং এদেশেই বসবাস করছেন পরিচয়হীন, কাগজহীনভাবে, তাঁদেরকে ভারতের নাগরিকত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে এবং সেই মর্মে আইন পাশ করে স্বাধীনতা উত্তরকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানবিক সিদ্ধান্তটি নিয়েছে ভারতসরকার। বাংলাদেশ থেকে যাঁরা সম্পত্তি হারিয়ে এদেশে এসেছেন, তাঁদের সেই হারানোও একপ্রকার ত্যাগই; সে ত্যাগ ঐচ্ছিক না হলেও। এবং সে ত্যাগ দেশের জন্যই, কারণ অবিভক্ত বঙ্গপ্রদেশের বিভাজনে তাদের কোনো লাভ হয় নি, হয়েছে শুধুই ক্ষতি। স্বাধীনতার ৭২ বছর পর বাংলাদেশের হিন্দু বাঙালী তাঁদের সেই ত্যাগের স্বীকৃতি প্রথম পেলেন নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের মাধ্যমে।

তাই এই মানুষগুলোর অস্তিত্ব রক্ষার পাশে যাঁরা দাঁড়াতে চাইছেন না এবং নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরোধিতা করছেন, তাঁরা আদতে কোন্ বৃহত্তর গ্লোবাল লবির সুপরিকল্পিত প্রচারের প্রতিনিধিত্ব করছেন, তা পশ্চিমবঙ্গের তথাকথিত সুশীল নাগরিক সমাজ অনুমান করতে পারে কিনা জানিনা, কিন্তু উদ্বাস্তু মানুষ মাত্রেই তা বুঝতে পারছেন। দাঙ্গাকবলিত মাটির উত্তাপ তাঁরা জানেন। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের মাধ্যমে বাংলাদেশের দাঙ্গা-সংস্কৃতির ওপেন সিক্রেটটি সত্য হিসেবে বিশ্বের দরবারে ডকুমেন্টেড বা তথ্যায়িত হোক, সেটি নাগরিকত্ব আইন বিরোধী এই লবিটির পক্ষে মেনে নেওয়া সহজবোধ্য কারণেই কঠিন হচ্ছে।

ইসলামিক অপসংস্কৃতির হাত থেকে অবিভক্ত ভারতের এই মানুষগুলোকে বাঁচানোর এই প্রয়াসটুকু করা বর্তমান ভারতের নৈতিক কর্তব্য ছিল, যা এই সরকার পালন করেছে। এই কাজ বিরোধিতার নয়, মানবিক সমর্থনের।‌ গণতন্ত্রে যে কোনো প্রতিষ্ঠানকে টিঁকিয়ে রাখার দায় এবং গণতন্ত্রকে রক্ষা করার দায় পালন করার মধ্যেই থাকে সাধারণ মানুষের নিজেদের রক্ষাকবচ। CAA-বিরোধী রাজনৈতিক প্রতিবাদের নামে যাদবপুরে আচার্য বিনা সমাবর্তন অনুষ্ঠান পালন করার মধ্য দিয়ে সেই প্রাতিষ্ঠানিকতার রক্ষাকবচকে পূর্ণতঃ ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে যে বিশাল গ্লোবাল লবি দেবস্মিতাদের মত বোড়েদের কাজে লাগাচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলে, পশ্চিমবঙ্গকে দ্বিতীয় কাশ্মীর হওয়া থেকে আটকানোর চেষ্টা শুরু করা উচিত।

দেবযানী ভট্টাচার্য্য

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এঞ্জিনিয়ারিং ফ্যাকাল্টির প্রাক্তনী, বহুজাতিক সংস্থার এক্সিকিউটিভ, বর্তমানে পেশায় ম্যানেজমেন্ট কনসালট্যান্ট।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.