এরাজ্যে বিরোধীদের বিভ্রান্তিকর অপপ্রচার

‘আধার কার্ড’-এর সঙ্গে ‘প্যান, ‘ভোটার’ ও ‘রেশন কার্ডের সংযুক্তিকরণ। এবং ওইসব কার্ডে নিজেদের নাম-ঠিকানা সংশোধন বা শুদ্ধিকরণের যে অভিযান চলছে কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশে তাকে কেন্দ্র করে এ রাজ্যে জনমনে সৃষ্টি হয়েছে। প্রবল বিভ্রান্ত ও ভীতি। রেলে, বাসে, হাটে, বাজারে সর্বত্র একটাই কথা— অসমের মতো এরাজ্যেও হচ্ছে ‘এন আর সি বা নাগরিকপঞ্জি। তাদের বক্তব্য, এন আর সি হলে পূর্ববঙ্গ বা অধুনা বাংলাদেশ থেকে আগত উদ্বাস্তুদের এদেশ থেকে বাংলাদেশে তাড়িয়ে দেওয়া হবে। নয়তো তাদের ঠাই হবে ‘কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে’, যা এক মূর্তিমান নরককুণ্ড। আর এই মহামারীর মতো ছড়িয়ে পড়া প্রচার বা প্ররোচনা দ্বারা মানুষ হচ্ছে প্রভাবিত ও বিভ্রান্ত। এদের মধ্যে যেমন রয়েছেন শিক্ষিত মানুষ, তেমনি রয়েছেন সাধারণ মানুষও। আশ্চর্যের এটাই যে, শিক্ষিত ও সচেতন মানুষদের আচরণও। সাধারণ মানুষদের মতো। তারাও বিভ্রান্ত, ভীত ও উদ্বিগ্ন। চোখেমুখে তাদেরও অসহায়তার ছায়া। তাদেরও জিজ্ঞাসা, তাদের বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেবে না তো? তাদের জেলে পোরা হবে না তো? আরও কত কী! এক্ষেত্রে শিক্ষিত – অশিক্ষিত নির্বিশেষে অস্তিত্বের সংকটে ভোগা উদ্বাস্তু বাঙ্গালিরা এসে দাঁড়িয়েছেন এক সারিতে। সবাইবিক্ষুব্ধ, বিভ্রান্ত। কিন্তু প্রতিবাদের ভাষা নেই। আসলে এঁরা যে ঘরপোড়া গোরু, তাই সিঁদুরে মেঘকে তারা ভয় পাচ্ছেন। কারণ জিন্নার দ্বিজাতি তত্ত্ব (হিন্দু-মুসলমান। এক জাতি নয়)-এর ভিত্তিতে ভারত ভাগের শিকার হয়েছেন পাকিস্তান বিশেষত পূর্ব পাকিস্তানের বাঙ্গালি হিন্দুরা। পাকিস্তান ইসলামিক দেশ হওয়ায় পূর্ব পাকিস্তানের। হিন্দুরা হন ‘কাফের’ (বিধর্মী) প্রতিপন্ন। আর সেই অপরাধে উগ্র হিন্দু বিদ্বেষী জেহাদি মুসলমানদের দ্বারা অত্যাচারিত, অপমানিত, লাঞ্ছিত ও ভিটেমাটি থেকে উৎখাত হওয়া হিন্দুরা নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় জন্মভূমি ছেড়ে ভারতের ত্রিপুরা, অসম ও পশ্চিমবঙ্গে এসে ঠাই নিতে হন বাধ্য। স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টি হলেও হিন্দু নির্যাতন সমানে চলতে থাকায় বাংলাদেশ থেকেও লক্ষ লক্ষ হিন্দু ভারতে আসতে বাধ্য হন। তাই পূর্বপাকিস্তান। ও অধুনা বাংলাদেশ থেকে বাস্তুচ্যুত হিন্দুরা এদেশে আশ্রয় নিয়ে যখন একটু গুছিয়ে বসেছেন তখন এন আর সি-র নামে আবার বাস্তুচ্যুত হওয়ার আতঙ্কে তারা যে বিভ্রান্ত ও দিশেহারা হবেন তা তো স্বাভাবিকই। এমনিতেই উদ্বাস্তু বা হিন্দু শরণার্থীরা অসমের এন আর সি-র ঘটনায় ও রটনায়। ভীতসন্ত্রস্ত। কারণ একটা মানুষ ক’বার উদ্বাস্তু বা বাস্তুহারা হতে পারে? তাছাড়া বাংলাদেশ সরকার সাফ জানিয়ে দিয়েছে, বাংলাদেশ কাউ কে ফেরত নেবে না। এহেন পরিস্থিতিতে উদ্বাস্তু বা শরণার্থীদের মনে। একটাই প্রশ্ন, তবে কী তাদের ঠাঁই হবে জেলে? তাই উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা অযৌক্তিক নয়।তবে এই উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, আতঙ্ক ও বিভ্রান্তির জন্য একমাত্র দায়ী মুসলমান তোষণকারী, বিশ্বাসঘাতক ও দেশদ্রোহী বাম-সেকুলার দলগুলি। এমনিতেই বামেরা এ রাজ্যে বিলুপ্তির পথে। আর কংগ্রেস এখন সাইনবোর্ড সর্বস্ব দল। পক্ষান্তরে, শাসক তৃণমূলের শুরু হয়েছে ‘অন্তৰ্জলি যাত্রা। তাই তারা নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় বিগত নির্বাচনে হারানো উদ্বাস্তু ভোট ফিরে পেতে রাজ্যের সর্বত্র গোপনে চালাচ্ছে অপপ্রচার যে, মোদী সরকার এরাজ্যেও অসমের মতো এন আর সি চালু করে বাংলাদেশ থেকে আসা হিন্দুদের তাড়াবে, নয়তো জেলে পুরবে। কেন্দ্র বিরোধী এক শ্রেণীর সংবাদমাধ্যমও সেই অপপ্রচারের সুরে ধরেছে পোঁ। স্বভাবতই অপপ্রচারের আগুন ছড়িয়েছে জনারণ্যে। গোয়েবলসীয় মিথ্যে প্রচার ‘ভাইরাল’ হতেও সময় লাগেনি। বহু। মানুষ ওই অপপ্রচারের শিকারও হয়েছেন। অনেকেই বলছেন, বিজেপিকে ভোট দিয়ে ভুল করেছি, আর নয়। তারা যে ওই অপপ্রচারের শিকার তা বলাই বাহুল্য। তবে আশ্চর্যের বিষয়, বিজেপির নেতা-কর্মীরাও ওই অপপ্রচারের মোক্ষম জবাব দিতে বড্ড দেরি করেছেন। অবশ্য দেরিতে হলেও কেন্দ্র ও রাজ্য নেতৃত্ব অবস্থা বেগতিক বুঝেই সংবাদমাধ্যমে বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছেন হিন্দুদের আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই। একজন হিন্দুকেও দেশ থেকে তাড়ানো হবে না। সবাই নাগরিকত্ব পাবেন।
সত্যি বলতে কী, ‘আধার কার্ড’-এর সঙ্গে অন্যান্য কার্ডের সংযুক্তিকরণের মাধ্যমে সরকার চাইছে একটি মাত্র আসল পরিচয়পত্র তৈরি করাতে, যাতে ভুয়ো ও একাধিক পরিচয়পত্র বাতিল হয়। এমনকী তার লক্ষ্য, নাম-ঠিকানার ভুলভ্রান্তি সংশোধন পূর্বক নির্ভুল পরিচয়পত্র নির্মিত হোক, যা জনগণনায় সাহায্য করতে পারে। তার সঙ্গে এন আর সি-র কোনো সম্পর্ক নেই। যা কেবল অপপ্রচার এবং সবই রাজনৈতিক। তাই সবাইকে সাবধান থাকতে হবে।
ধীরেন দেবনাথ