লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির দায়িত্ব ছিলেন মুকুল রায়। সভাপতি অমিত শাহ-র ঠিক করে দেওয়া টার্গেট থেকে একটু দূরে বিজেপি দৌড় শেষ করলেও অভূতপূর্ব সাফল্য পেয়েছে গেরুয়া শিবির। বিজেপি সভাপতি বলেছিলেন, বাংলা থেকে এ বার কমপক্ষে ২৩টি আসন চাই। দল জিতেছে ১৮ আসনে। অল্প ভোটের ব্যবধানে জয় মেলেনি আরামবাগে। সেটা হলে ১৯ আসনে জয় পেয়ে যেত বিজেপি। এই সাফল্য আগামী বিধানসভা নির্বাচন পর্যন্ত ধরে রাখতে এখন থেকেই ব্লু-প্রিন্ট তৈরি করছে রাজ্য বিজেপি। গেরুয়া শিবির সূত্রে খবর, এবারেও দলের নির্বাচনী কমিটির শীর্ষে থাকবেন মুকুল রায়। তাঁর নেতৃত্বেই রাজ্য বিজেপির ২০২১ সালের টার্গেট– ২৫০ আসনে জয়।
তবে কেন্দ্রীয় বিজেপির কড়া নির্দেশ, শুধু তৃণমূল কংগ্রেস থেকে নেতা ভাঙিয়ে এনে ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করলে চলবে না, তৃণমূল স্তরে সংগঠন মজবুত করতে হবে বিধানসভা নির্বাচনের আগে। ২০২১ সালের আগেও বিধানসভার ভোট হতে পারে ধরে নিয়েই সংগঠন মজবুত করার লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। এমনিতে নির্বাচনের সময়ে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ (আরএসএস) বিজেপির হয়ে মাঠে নামে। কিন্তু এ বার বাংলায় সংগঠন মজবুত করতে প্রথম থেকেই আরএসএস-এর সাহায্য নিতে চায় বিজেপি।
বিজেপি সূত্র খবর, ইতিমধ্যেই কেন্দ্রীয় নেতারা এর জন্য আরএসএস-এর সঙ্গে কথা বলেছেন। সঙ্ঘের বিভাগ স্তরের কার্যকর্তারা এখন থেকেই কর্মী বাছাইয়ের কাজ করবেন। সঙ্ঘের ওই বাছাই করা কর্মীরা সংগঠন বাড়াতে বিজেপির হয়ে কাজ করবে। বুথ স্তরে শক্তি বাড়াতে বিধানসভা নির্বাচনের আগে রাজ্যের ২৯৪ কেন্দ্রের সবক’টিতেই বিস্তারক নিয়োগ হতে পারে।
লোকসভা নির্বাচনের আগেও জেলায় জেলায় বিস্তারক নিয়োগ করেছিল বিজেপি। এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা ছিল আরএসএস-এর। সঙ্ঘের কার্যকর্তারা ঘর-বাড়ি ছেড়ে বিভিন্ন গ্রামে ও শহরে সাংগঠনিক দায়িত্ব নিয়ে যান। সেখানে থেকে বুথ স্তরে শক্তি বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করেন। গোটা বিষয়টি পরিচালনা করেছিলেন আরএসএস প্রচারক তথা এই রাজ্যের দায়িত্ব প্রাপ্ত কেন্দ্রীয় বিজেপির সহ-সংগঠন সম্পাদক শিব কুমার। খোদ অমিত শাহ বিস্তারকদের প্রশিক্ষণ বর্গে আসেন। সর্বভারতীয় সভাপতি বিস্তারকদের লক্ষ্য ঠিক করে দেন কলকাতার আশুতোষ হলে একটি কর্মিসভায়। রাজ্যে ১৮ আসনে জয়ের পিছনে সেই বিস্তারক কর্মসূচি কাজে এসেছে বলে মনে করছে বিজেপি। বিধানসভা নির্বাচনের আগেও সেই একই পথে হাঁটার সিদ্ধান্ত নিয়ে ইতিমধ্যেই ব্লু-প্রিন্ট তৈরির কাজ শুরু হয়েছে।
বিজেপি আগেই জানিয়েছে, এবার বাংলা দখল করতে মরিয়া তারা। শাসক তৃণমূল কংগ্রেস সেই দাবিকে দিবাস্বপ্ন বললেও বিজেপি শিবির মনে করছে, রাজ্যে যে শাসকবিরোধী হাওয়া রয়েছে তাতে ক্ষমতা দখল একেবারেই অসম্ভব নয়। গেরুয়া শিবিরের দাবি, গত লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি রাজ্যে ৪০ শতাংশের বেশি ভোট পেয়েছে। প্রায় ১৩০টি বিধানসভা এলাকায় এগিয়ে রয়েছে। এখন রাজ্যের ক্ষমতা দখল শুধু সময়ের অপেক্ষা।
সম্প্রতি কলকাতায় এসেছিলেন বিজেপির সর্বভারতীয় সংগঠন সম্পাদক রাম লাল। তিনি রাজ্য ও জেলা স্তারের নেতাদের পাশাপাশি নব নির্বাচিত সাংসদদের নিয়ে বৈঠক করেন। সেখানেই তিনি বিধানসভা ভোটের আগে দলের কর্তব্য ঠিক করে দেন। বলেন, এখন থেকেই দলকে বিভিন্ন ইস্যুতে আন্দোলনে থাকতে হবে। শীঘ্রই যেসব বিধানসভা আসনে উপ-নির্বাচন হবে সেখানে জয়ের লক্ষ্য স্থির করতে হবে। তৃণমূল কংগ্রেস ভেঙে বিজেপির দিকে আসা পুরসভার উপরে শুধু ভরসা না করে আসন্ন পুর নির্বাচনগুলিতে জয়ের লক্ষ্য নিতে হবে। নেতৃত্ব দেবেন দলের ১৮ সাংসদ।
ইতিমধ্যেই বিজেপিকে রুখতে কোমর বেঁধে নেমেছে তৃণমূল কংগ্রেস। শাসক দল মূল ইস্যু করেছে বাঙালিয়ানা। সেই পথে শাসকের বিরোধিতা না করে রাজ্য বিজেপিকে কেন্দ্রীয় নেতাদের নির্দেশ, বাংলায় শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থানকে মূল ইস্যু করার পাশাপাশি এখন থেকেই নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল নিয়ে প্রচার শুরু করতে হবে। আপাতত এই তিনটিই হবে বিজেপির প্রচারের হাতিয়ার। সঙ্গে রাজ্য সরকারি কর্মীদের ডিএ, অনুপ্রবেশ, এনআরসির মতো ইস্যু থাকলেও নতুন প্রজন্মকে কাছে টানতে বিজেপির সিদ্ধান্ত, কর্মসংস্থান ইস্যুই হবে বিধানসভা ভোটে প্রধান অস্ত্র।
লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি এই রাজ্যে বামভোটের একটা বড় অংশ নিজেদের ঝুলিতে এনেছে। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের নির্দেশ, ওই ভোট ধরে রাখতে হবে। যে ভোট একবার পদ্ম বোতামে এসেছে তা যাতে চলে না যায় সেই লক্ষ্য নিয়ে ভোট বাড়াতে হবে। বিজেপি নেতৃত্ব মনে করছে, লোকসভা নির্বাচনে যে বামভোট তাদের ঝুলিতে এসেছে সেটা বিধানসভা নির্বাচনেও আসবে তা ধরে নেওয়া ঠিক হবে না। তবে কী ভাবে ওই ভোট ধরে রাখা যায় তার স্ট্র্যাটেজি তৈরি করতে হবে।
ইতিমধ্যেই রাজ্য বিজেপি কেন্দ্রের নির্দেশ মতো ব্লু-প্রিন্ট তৈরির কাজ শুরু করে দিয়েছে বলে খবর। শুরুতেই চারটি ক্যাটেগরিতে ভাগ করা হয়েছে ২৯৪ আসন। ‘এ’ ক্যাটেগরিতে লোকসভা নির্বাচনে এগিয়ে থাকা ১৩০টির মতো আসন। এর পরে ‘বি’ ক্যাটেগরিতে রয়েছে মোট ৬৫টি আসন। যে সব লোকসভা আসনে জয়ে এসেছে তার মধ্যে পিছিয়ে থাকা বিধানসভা আসন ও অল্প ভোটের ব্যবধানে হারা লোকসভা আসেনের বিধানসভাগুলি রয়েছে এই ক্যাটেগরিতে। এর পরে ‘সি’ ও ‘ডি’ ক্যাটেগরিতে রয়েছে কঠিন ও খুব কঠিন আসনগুলি। কেন্দ্রীয় এক নেতা এই প্রসঙ্গে বলেন, “শেষে থাকা ‘সি’ ও ‘ডি’ ক্যাটেগরিতে থাকা একশোটির মতো আসনেই আসল চ্যালেঞ্জ। কোনও ভাবে সেই আসনের ৫০ শতাংশ দখল করতে পারলেই ২৫০-এর টার্গেটে পৌঁছানো আর কঠিন থাকবে না।”
ওই নেতার বক্তব্য, অন্যান্য রাজ্যে বিজেপি ঠিক এই ভাবেই ক্ষমতায় এসেছে। ‘এ’ ও ‘বি’ ক্যাটেগরির আসনে জয় সুনিশ্চিত হওয়ার পরে ‘সি’ ও ‘ডি’ ক্যাটেগরির আসন দখলের লক্ষ্যে জোর দেওয়া। পিছিয়ে থাকা ক্যাটেগরির আসনই আসলে জয় এনে দেয়। উত্তরপ্রদেশ থেকে ত্রিপুরা এই ছকেই জয় পেয়েছে বিজেপি। এবার সেই পরীক্ষিত ছকেই বাংলা দখলের লক্ষ্য।