বিপুল জনাদেশ সম্বল করে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর,
স্বাভাবিকভাবেই, দেশব্যাপী কর্মী-সমর্থকরা বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসে মেতেছেন।
উচ্ছাসে মাতবেনই– এটাই স্বাভাবিক এবং এতে অন্যায়েরও কিছু নেই। সময়ের
নিয়মেই এই উচ্ছ্বাস আবার একদিন থিতিয়েও আসবে। আর তখনই শুরু হবে বিজেপির
আসল পরীক্ষা, তখনই বোঝা যাবে, জয়ের আনন্দে আত্মহারা বিজেপি কি দিগভ্রষ্ট
হয়েছে, নাকি সে তার লক্ষ্য সম্বন্ধে অবিচল আছে? তখনই প্রমাণ হবে,
আত্মতুষ্টি বিজেপিকে গ্রাস করতে পারল, কী পারল না। বিজেপির এবারের এই বিপুল
জয়ে পশ্চিমবঙ্গের অবদান অনস্বীকার্য। বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত
শাহ নির্বাচনের আগে দাবি করেছিলেন, বিজেপি এই রাজ্য থেকে এবার ২৩টি আসন লাভ
করবে। বিজেপি পেয়েছে তার কাছাকাছি ১৮টি আসন। সাংগঠনিক দুর্বলতা না থাকলে
বিজেপি এবার অনায়াসেই ২৩ কেন, ২৫টি আসন পেয়ে যেতে পারত। জনসঙ্ঘের
জন্মলগ্ন থেকে এখন পর্যন্ত এই রাজ্যে কী জনসঞ্জ, কী বিজেপি কেউই এই চোখ
ধাঁধানো ফল করতে পারেনি। ফলত, জাতীয় রাজনীতির স্তরে পশ্চিমবঙ্গই এখন
আলোচ্য বিষয়। লোকসভা নির্বাচনে এই রাজ্যে বিজেপির এই ফলাফল রাজ্য-রাজনীতির
গতিপ্রকৃতিতেও অনেকখানি পরিবর্তন এনেছে। নির্বাচনী ফলাফল বেরনোর পর
বিজেপিসহসাই এই রাজ্যে ভবিষ্যতেরশাসনকর্তার মর্যাদা পেতে শুরু করেছে।
বর্তমান শাসক তৃণমূল কংগ্রেসকে অনেক ক্ষেত্রেই কোণঠাসা অবস্থায় দেখা
যাচ্ছে। ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপিই যে ক্ষমতায় আসবে— এমন একটা
ধারণাও সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু এসব ছাপিয়েও যে বিষয়টি বড়ো হয়ে
উঠছে, তা হলো, তৃণমূল। কংগ্রেস দলটি আদৌ পরবর্তী বিধানসভা নির্বাচন। অবধি
তার অস্তিত্ব বজায় রাখতে পারবে কিনা। ফলাফল বেরনোর পর থেকেই তৃণমূল
কংগ্রেসে ধস নামতে শুরু করেছে। সব জেলাতেই দলে দলে কর্মী ও স্থানীয় নেতারা
বিজেপিতে যোগ দিচ্ছেন। বিজেপি রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ তো ঘোষণাই করে
দিয়েছেন, গোটা জুন মাস ধরে বিজেপিতে যোগদান মেলা চলবে। আর এক বিজেপি নেতা
এবং এবারের নির্বাচনে এই রাজ্যে বিজেপির ভালো ফলাফলের মূল কারিগর মুকুল
রায় বলেছেন, একশোরও বেশি তৃণমূল বিধায়ক বিজেপিতে যোগ দিতে চাইছেন।
পশ্চিমবঙ্গের এই দলবদলের ঢেউ আছড়ে পড়েছে দিল্লির আঙিনাতেও। প্রধানমন্ত্রী
নরেন্দ্র মোদী পর্যন্ত বলেছেন, ৪০ জন তৃণমূল কংগ্রেস বিধায়ক বিজেপিতে
যোগদান করবেন। অবশ্য শুধু তৃণমূল কংগ্রেস নয়, সিপিএম এবং কংগ্রেস কর্মীরাও
বিজেপিতে যোগ দিচ্ছেন। তবে দলবদলুদের ভিতর সংখ্যাধিক্য তৃণমূল কংগ্রেসেরই।আপাতদৃষ্টিতে
বিষয়টি দেখতে ভালোই লাগে। মনে হতেই পারে বিজেপি এই রাজ্যে আরও বেশি
শক্তিশালী হচ্ছে। কিন্তু এই মনে লাগাটাই শেষ কথা নয়। বিজেপি কার্যালয়ে
দলবদলের লাইনের যে ছবি প্রকাশিত হয়েছে সংবাদপত্রে, তা কিন্তু মনে কিছু
আশঙ্কারও জন্ম দিচ্ছে। একটু পিছনে ফিরতে হবে। ২০১১ সালে সিপিএমের
বিপর্যয়ের পরও তৃণমূল কংগ্রেস দপ্তরে এইরকমই দলবদলুদের ভিড় পড়ে
গিয়েছিল। বাঁধ ভাঙা স্রোতের মতো দলে দলে সিপিএম কর্মীরা এসে ভিড় করেছিল
তৃণমূলে। কলেবর বৃদ্ধি হয়েছিল তৃণমূলের। কিন্তু এই অনিয়ন্ত্রিত বৃদ্ধি যে
তাদের পক্ষে ভালো হয়নি তা এখন উপলব্ধি করছে তৃণমূল। দলে অবাধ বেনোজল
প্রবেশ করলে যে ভালো হয় না— তা এরও আগে উপলব্ধি করেছিল সিপিএম। সিপিএমের
তিন দশকের শাসনকালে বহু বেনোজল ওই পার্টিতে ঢুকেছিল। সিপিএমও তখন কলেবর
বৃদ্ধির জন্য এদের সাদরে স্থান দিয়েছিল দলে। পরে বুঝতে পেরেছিল কোন
ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের এরা জন্ম দিয়েছে। বোঝার পর নিজেদের রাজ্য সম্মেলনের
রাজনৈতিক প্রস্তাবে অনিয়ন্ত্রিত বৃদ্ধির বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করেছিল।
ততদিনে অবশ্য যা ক্ষতি হবার তা হয়ে গিয়েছিল সিপিএমের।
এখন প্রশ্ন
হচ্ছে, এই দলবদলু কারা? সিপিএম থেকে তৃণমূল, তৃণমূল থেকে বিজেপি–শাসক
পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে যারা জামা বদলাচ্ছেন— এরা কারা? প্রথমেই বলে নেওয়া
ভালো—এরা কোনো আদর্শের তাগিদে অন্য কোনো দলে এসে ঢুকছেন না বা কোনো
আদর্শের সংঘাতে এরা কোনো দলবদল করছে না। নির্বাচনী ফলাফল প্রকাশের পরই এদের
দলবদলের মূল কারণ, নিজেদের ব্যক্তিস্বার্থটি রক্ষা করা এবং ক্ষমতার বলয়ের
ভিতর থেকে লাভের গুড় খেয়ে যাওয়া। কাজেই সিপিএমের সময়ে এরা সিপিএম,
তৃণমূলের সময়ে তৃণমূল এবং বিজেপির সময়ে বিজেপি।
প্রশ্ন হচ্ছে, এই
দলবদলুদের নিয়ে বিজেপি আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে কতটা মোকাবিলা করতে পারবে
তৃণমূলের? নাকি, এতে তৃণমূল কংগ্রেসেরই সুবিধা হবে। বিজেপি নেতা মুকুল
রায় একটি গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রেখেছেন এই প্রসঙ্গে। গত ৪ জুন মহারাষ্ট্র
নিবাস হলে দলীয় কর্মীদের সামনে বক্তব্য রাখতে গিয়ে মুকুল বলেছিলেন-
“আপনারা কি চান ২০২১ সাল পর্যন্ত এ রাজ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার
থাক?যদি তা না চান, যদি চান আগেই সরকারটা পড়ে থাক, তাহলে মমতার দলকে
আমাদের দুর্বল করে দিতেই হবে। মুকুলের এই তত্ত্বকে মান্যতা দিয়েছেন দলের
সভাপতি অমিত শাহও। দিল্লির বিজেপি নেতারা মনে করেন যে, উঁচু থেকে
নীচু—সর্বস্তরে যদিতৃণমূলে ভাঙন ধরিয়ে দেওয়া যায়, তাহলে অকাল নির্বাচন
অবশ্যম্ভাবী। এছাড়াও তাদের আরো একটি ধারণা আছে যে, বহু জায়গায় বিজেপি
সাংগঠনিকভাবে যথেষ্টই দুর্বল। সেই জায়গাগুলিতে যদি সংগঠন বৃদ্ধি করতে
হয়—তাহলে অন্য দল থেকে লোক দিয়ে আসা অবশ্যম্ভাবী। অবশ্য বিজেপির একটা
বৃহৎ অংশই এই অতি সরল ব্যাখ্যা মেনে নিতে আগ্রহী নন, বরং তাদের বক্তব্য যে
মুখগুলির বিরুদ্ধে এতদিন লড়াই করে এসেছি, তাদেরই এখন বিজেপিতে টেনে নিলে
দলের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যার খেসারত দিতে হবে বিধানসভা নির্বাচনে।
এই আশঙ্কা থেকেই সম্প্রতি মনিরুল ইসলামের যোগদানের পরে দলের এক বৃহৎ অংশ
প্রতিবাদেমুখর হয়েছিল। জাতীয় নেতৃত্বও এদের ফুৎকার এক ফুয়ে উড়িয়ে দিতে
পারেননি। ফলে মনির এখন কোল্ড স্টোরেজে।
আশঙ্কা যে একেবারেই অমূলক তা
কিন্তু বলা যাচ্ছে। ইতিমধ্যেই বিভিন্ন এলাকা থেকে এই দলবদলুদের বিরুদ্ধে
অভিযোগ উঠছে। উত্তরবঙ্গে অন্য দল থেকে বিজেপিতে এসে এমপি হয়ে যাওয়া এক
নেতার অনুগামীরা ইতিমধ্যেই বলতে শুরু করেছেন, আমাদের বিজেপিতে ঢোকায় যারা
বাধা দিয়েছিল, এবার তাদের আমরা দেখে নেব। অন্য দল থেকে এসে এমপি হয়ে
যাওয়া এক নেতার সম্বন্ধে জানা যাচ্ছে যে, তিনি এখন বিজেপির একটি সাংগঠনিক
জেলার সভাপতি হতে চাইছেন। বিজেপির অন্দরে কান পাতলেও এই বাছবিচারহীন যোগদান
মেলার বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকট হচ্ছে। এরকমটা চললে, দলে যে চরম বিরোধ
অবশ্যম্ভাবী তা না বললেও নয়।
এই সংকটের ভিতর থেকে বিজেপি বেরিয়ে আসবে
কীভাবে। প্রথমে মনে রাখতে হবে, ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি অনেকটাই
জিতেছে মোদী হাওয়ায় এবং মমতার প্রতি মানুষের বিরূপতার কারণে। ২০২১-এর
বিধানসভা নির্বাচনে এই মোদী হাওয়া অনুপস্থিত থাকবে। তখন রাজ্যের ইস্যুতে
ভোট হবে। ফলে, তখন বুথ স্তরে সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা থাকবে। আর রাজ্যের
ইস্যুতে যখন ভোট হবে— তখন মানুষ নিশ্চয়ই বিজেপির ভিতর এমন মুখ দেখতে চাইবে
না— যে মুখগুলির প্রতি বিতৃষ্ণ হয়ে মানুষ তৃণমূলের ওপর আস্থা হারিয়েছে।
এই দুটি বিষয় মাথায় রাখলেই বিজেপি দলবদলুদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে ওঠার
বদলে বরং এখন থেকেই বুথস্তরে সংগঠন জোরদার করার দিকে মনোযোগী হবে। বিজেপিকে
এটা মনে রাখতে হবে, যে ১৮টি আসন বিজেপি এই রাজ্যে পেয়েছে, সেই আসনগুলি
পাওয়ার পিছনে তৃণমূল ছেড়ে আসা মনিরুল ইসলামদের কোনো অবদান নেই। বরং অবদান
রয়েছে সেই হাজার হাজার বিজেপি কর্মীর—যারা এত বছর ধরে নানাবিধ অত্যাচার
সহ্য করেও বিজেপির সংগঠন গড়ে তুলেছেন। কাজেই বিজেপির আরো বেশি করে তাদের
উপর আস্থা রাখতে হবে। সংগঠনে আরও বেশি করে গুরুত্ব দিতে হবে তাদের।
দলবদলুরা কোনো দলের সম্পদ হতে পারে না কখনো। কারণ, আদর্শহীন এই দলবদলুরা
নিজেদের সময় সুযোগমতো জামা বদলে নিতে পারে। কাজেই, কাল যে এরা বিজেপির
জামাও খুলে ফেলবে না— তার গ্যারান্টি কী? ভাড়াটে সৈন্য নয়, নিজের অনুগত
সৈনিকের ওপর ভরসা করেই ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচন লড়তে নামা উচিত বিজেপির।
সেই সঙ্গে বিজেপিকে এও মনে রাখতে হবে বিজেপি দলটির একটি আদর্শ রয়েছে, তার
কিছু নির্দিষ্ট রাজনৈতিক কর্মসূচি রয়েছে। বেনোজলের আধিক্যে সেই আদর্শ এবং
কর্মসূচি যেন ধুয়ে মুছে না যায়। আবার এটাও ঠিক, রাজনীতিতে রণকৌশলও
জরুরি। সেই রণকৌশলের দিক দিয়ে দেখতে গেলে, প্রতিপক্ষ শিবিরকে ভাঙিয়ে
আনতেই হবে তাকে দুর্বল করার জন্য। রামায়ণে স্বয়ং রামচন্দ্রও তার
প্রতিপক্ষ শিবিরকে ভাঙিয়েছিলেন। কাজেই ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে
এই। রাজ্যে তৃণমূল কংগ্রেসকেও একই উপায়ে দুর্বল করে দিতে হবে। এই রণকৌশল
মাথায় রেখেই অমিত শাহ, মুকুল রায়রা বারবার দল ভাঙানোর কথা বলছেন। কাজেই
দল ভাঙবেই। অন্য দল ভেঙে বিজেপিতে লোক ঢুকবেই। শুধু বিজেপির দরকার একটি
ছাঁকনি। যে ছাঁকনি বালি-কাঁকর আটকে দেবে।
আদিনাথ ব্রহ্ম
2019-06-14