ক’বছর আগেও যা ছিল অন্যতম বড় ইস্যু, উনিশের ভোটে সেটাই ভ্যানিশ!
গড়ে ওঠা কারখানা থেকে শেডের গায়ে জঙ্গল, বুলডোজার দিয়ে সেই কাঠামো গুঁড়িয়ে দেওয়া থেকে সর্ষে বীজ ছড়ানো, সমস্ত ছবি দেখা হয়ে গিয়েছে সিঙ্গুরের। মাঝে আন্দোলন, মৃত্যু, ভয়, সরকার পরিবর্তন, আদালতের রায়, ভোটের ইস্যু হয়ে ভেসে থাকা, সব দেখে ফেলেছে বেড়াবেড়ি, জয়মোল্লা, খাসেরবেড়ি-সহ সিঙ্গুরের গ্রাম কে গ্রাম। রাত পোহালেই ভোট। সিঙ্গুর নিয়ে তেমন তাপউত্তাপ নেই। কিন্তু সিঙ্গুর চষে ফেলে হুগলি কেন্দ্রের বিজেপি প্রার্থী লকেট চট্টোপাধ্যায় জানালেন, সেই মানুষগুলোই বলছেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাল্লায় পড়ে তাঁরা খুব ভুল করে ফেলেছিলেন। তবে সিঙ্গুরের শাসক দলের গর্ব এখনও অটুট। তাঁরা এখনও বুক বাজিয়েই বলতে ভালবাসেন, ‘আমরা ইতিহাস গড়েছি। যে ইতিহাসের কথা জানে গোটা দুনিয়া।’
বিজেপি তাঁকে প্রার্থী করার পর সাময়িক ক্ষোভ হয়েছিল কর্মীদের। কেন বহিরাগত, কেন জেলার কেউ নন, এ সব নিয়ে প্রকাশ্যেই সেই ক্ষোভ উগরে দিয়েছিলেন বহু বিজেপি কর্মী। কিন্তু যে দিন থেকে জেলায় পা রেখেছেন লকেট, সে দিন থেকে সে সব উধাও। ঝড় তুলে দিয়েছিলেন প্রচারে। সিঙ্গুরেই গিয়েছেন অন্তত চোদ্দ-পনেরো বার। ব্যাণ্ডেলের বাড়ির ড্রইং রুমে বসে বিজেপি-র মহিলা মোর্চার রাজ্য সভানেত্রী বললেন, “অনুপাত দেখতে গেলে, সবাই এখন সিঙ্গুরে শিল্প চায়।”
হুগলি কেন্দ্রের মধ্যেই পড়ে সিঙ্গুর। ঐতিহাসিক এই জায়গা নিয়ে লকেটের কী ভাবনা? উত্তর যেন ঠোঁটেই লেগেছিল তাঁর। স্পষ্ট বলে দিলেন, “আমি চাই সিঙ্গুরে আবার টাটাই আসুক। শিল্প হোক। তৈরি হোক কয়েক হাজার কর্মসংস্থান।” সেই কথার রেশ ধরেই ফের আক্রমণ শানালেন কালীঘাটের দিকে। বললেন, “মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে মুখ্যমন্ত্রী হবেন বলে টাটাকে তাড়িয়েছিলেন। কৃষকদের ঘাড়ে পা রেখে মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন। কিন্তু তাঁদের জন্য কিচ্ছু করেননি।”
সিঙ্গুরের তরুণ প্রজন্মের একাংশের মধ্যেও বাড়ছে অসন্তোষ। চাষ করা যায় না জমিতে। হয়নি কর্মসংস্থানও। অনেকেই বলছেন, “আমাদের আমও গেল। ছালাও গেল। এখন করবটা কী?”
তারপরই প্রত্যয় ঝরে পড়ল অভিনেত্রী থেকে নেত্রী হওয়া লকেটের গলা থেকে। বললেন, “আমি জানি সিঙ্গুরের মানুষ যখন শিল্প চাইছে, তখন সিঙ্গুরে শিল্প আসবেই। একটু চেষ্টা করলেই আসবে।”
কিন্তু তৃণমূল?
টাটাকে তাড়ানো নিয়ে গর্বই রয়েছে সিঙ্গুরের তৃণমূলের। সেই আন্দোলনের অন্যতম নেতা বেচারাম মান্না বললেন, “সিঙ্গুর তো মাইলফলক। এখানকার কৃষকরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন।” লকেটেকেও কটাক্ষ করতে ছাড়েননি প্রাক্তন কৃষিমন্ত্রী। তাঁর কথায়, “২৩মে-র পর ওঁকে আর সিঙ্গুরে দেখা যাবে না। কিন্তু পাঁচশো বছর পরেও সিঙ্গুর আন্দোলন লেখা থাকবে স্বর্ণাক্ষরে। লেখা থাকবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম।”
ইচ্ছুক, অনিচ্ছুক, চারশো একর, পাঁচ ফসলি জমি, ধর্ণা, অনশন, তথ্য কেন্দ্রে বুদ্ধ-মমতা মিটিং, রাজভবনের ঐতিহাসিক বৈঠক- সব কিছুর শেষে সত্যি এটাই, সিঙ্গুরে শিল্প হয়নি। দেশের শীর্ষ আদালত রায় দিয়ে বলে দিয়েছে জমি অধিগ্রহণে প্রক্রিয়াগত ত্রুটি ছিল। জমি ফিরিয়ে দেওয়ার সেই রায় শুনে উচ্ছ্বসিত তৃণমূল সরকার আরও একধাপ এগিয়ে ঘোষণা করেছিল, ওই জমিকে চাষযোগ্য করে দেবে।
কিন্তু বাস্তব কী?
সেখানে এখন তিন মানুষ সমান উলুখাগড়ার বন। সিঙ্গুরের গ্রামে গ্রামে কথা বললেই বোঝা যায়, তাঁরাও জেনে গিয়েছেন, এ জমিতে আর যাই হোক, চাষ হবে না। মাটি লোপাট হয়ে গিয়েছে। বড় বড় গর্তে জল পড়লে দিঘির চেহারা নেয়। যাঁরা ছিলেন অনিচ্ছুক, তাঁরাও এখন বিডিও অফিসে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন জমির কাগজপত্রের জটিলতা কাটাতে। সুযোগ খুঁজছেন, ভাল দাম পেলেই বেচে দেবেন জমি। কিন্তু স্বপ্নে বিভোর লকেট, দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ের ধারে ওই জমিতে কারখানা হবে। চিমনি দিয়ে ধোঁয়া উড়বে। শ্মশানের নিস্তব্ধতা ভেঙে ফিরবে প্রাণ। যেমনটা হচ্ছিল বছর বারো আগে!