প্রথমপর্ব : অথঃবিশালাক্ষীদেবীকথা
তন্ত্রসারে বিশালাক্ষীদেবীর পূজা ও মন্ত্রাদির বিষয় এইরূপ লিখিত আছে –
“ধ্রুবমাদ্যং সমুদ্ধৃত্য মায়াবীজং সমুদ্ধরেৎ।
বিশালাক্ষীপদং ঙেহস্তং হৃদন্তং যন্ত্রমুদ্ধয়েৎ ॥
অষ্টাক্ষরী মহাবিদ্যা অষ্টসিদ্ধি প্রক্ষা শিবে ।
প্রসঙ্গাৎ কথিত বিদ্যা ত্ৰৈলোক্যয়ং দুর্লভা প্রিয়ে ॥”
বিশালাক্ষী:
“মনোরমাং ভানুমতীং বিশালাং বহুদীমথ।”
বিশালাক্ষী শব্দের অর্থ হলো আয়তনয়না। বিশাল অক্ষী যার তিনি হলেন বিশালাক্ষী। এককথায় ,আয়তলোচনা। ইনি আদিম, প্রাচীন দেবী। ৬৪ যোগিনীর তালিকায় দেবী বিশালাক্ষীর নাম পাওয়া যায় কালীর সহচরী রূপে । কবি মুকুন্দ মিশ্র বিশালাক্ষীকে রঙ্কিনী , চন্ডী, ত্রিপুরা সুন্দরী ও পার্বতী বলে উল্লেখ করেছেন । তিনি বলেছেন বিশালাক্ষী হলেন দেবী মহামায়া। দেবী তাঁর সুবিশাল নেত্র দ্বারা পৃথিবীর পাপ পুন্য ও মহাকালের গতিকে অবলোকন করছেন। তাই তিনি বিশালাক্ষী বা বিশাললোচনা দেবী নামে পরিচিত হয়েছেন। অর্থাৎ দেবীদুর্গা ও বিশালাক্ষী অভিন্ন।
বিশালাক্ষ (পুং) বিশালে অক্ষিণী যন্ত সমাসে যচ , অর্থাৎ হর, মহাদেব ….
“অনিলশ্চনলশ্চৈব বিশালাগোহথ কুণ্ডলী।”
বিশালচক্ষু বা সুনেত্র….
বিশালাক্ষী : বিশালাক্ষ-ঙীষ , তিনি উত্তম নারী , তিনি বিশ্ব , তিনি নাগদন্তী , তিনি পাৰ্ব্বতী, দুর্গাদেবী।
ভারতের বারাণসী শহরের বিশ্বনাথ মন্দিরের পশ্চাদে মীরঘাটে বিশালাক্ষী দেবীর প্রধান মন্দিরটি অবস্থিত। হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী এই মন্দির পুরাণে উল্লিখিত ৫১ শক্তিপীঠের অন্যতম।
কথিত আছে, বিষ্ণুর সুদর্শন চক্রে সতীর দেহ ছিন্নভিন্ন হওয়ার সময় দেবীর কর্ণ ও কুণ্ডল এখানে পতিত হয়েছিল। সেই কারণে দেবী এখানে মণিকর্ণি নামেও পরিচিত। তবে কোনো কোনো পণ্ডিত মনে করেন, কর্ণকুণ্ডল অলংকারমাত্র, তা দেহের অঙ্গ নয়। তাই এই মন্দিরকে শক্তিপীঠ না বলে উপপীঠ বলাই শ্রেয়। অন্য একটি কাহিনিসূত্র থেকে জানা যায়, এই মন্দির একটি শক্তিপীঠ। কারণ এখানে দেবীর তিন অক্ষি বা চোখের একটি পতিত হয়েছিল। দেবীর দিব্যচক্ষু সমগ্র বিশ্বকে দেখতে পায়, তাই দেবীর নাম এখানে বিশালাক্ষী। এই পীঠের শিব কালভৈরব নামে পরিচিত।
বিশালাক্ষী দেবী প্রকৃতপক্ষে একজন সুপ্রাচীন মিশ্র কৃষ্টির দেবী। বিশালাক্ষী দেবীর পূজায় দেখতে পাওয়া যায় অতি প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার থেকে আগত , বিষেশত দ্রাবিড় সংস্কৃতির সমন্বয়। মহেঞ্জোদারো হরপ্পা সময়কাল হতে দ্রাবিড়গনের নিকগ অন্যতম একজন তান্ত্রিক দেবতা ছিলেন দেবী বিশালাক্ষী। এই পূজা উপলক্ষে মাঙ্গন করা হয় বা গোষ্ঠীপতির নায়কত্বে সমষ্টিগতভাবে উপাসনা করা প্রভৃতি রীতিনীতি, লোকাচার লক্ষ্য করা যায়। এই পদ্ধতি সুপ্রাচীন ভারতের একটি সুনির্দিষ্ট প্রথা ছিল। পরবর্তীকালেকালেও উত্তরসূরীগন এই প্রথা গ্রহণ করেন। মাতৃ আরাধনা, প্রকৃতি পূজা একটি প্রাচীন ঘটনা ।
দেবপ্রসাদ ভট্টাচার্য মহাশয় বলেছেন আদি শক্তি দেবী, যিনি নিত্য কিংবা সনাতনী , তিনি ভাগ হয়ে যান চরিত্রের আপাত ভিন্নতায়। ভাগ হয়ে যান সমাজ জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে র , একাধিক রূপে। বেদের উষা সরস্বতী, অদিতি বা পৌরাণিক দুর্গা, চন্ডী তন্ত্রের মধ্যে হয়ে যান জগতধাত্রী, অন্নপূর্ণা, চামুন্ডা , দশমহাবিদ্যা।আবার সেই আদি শক্তিই সকল দার্শনিক ব্যাখ্যা থেকে বেরিয়ে এসে নেমে আসেন মাটির নিকট নিতান্ত লৌকিক রূপে। তিনি তখন আমাদের গৌরী ,উমা বা মঙ্গলকাব্যের মঙ্গলচন্ডী বা অন্নপূর্ণা। তিনি তখন বন্যপশুর রক্ষীয়ত্রী চন্ডী, তিনি তখন কৃষি জীবী বা বল্লুকা কুলে মাছ ধরা শিবের ঘরণী। তিনি ভালোবাসেন শাঁখা পড়তে। তিনি ধান ভাঙেন, বেতের ধামা কুলো বোনেন, সংসার প্রতিপালন করেন। যোগনিদ্রা হতে তিনি যুক্ত হন গ্রামীন আচার অনুষ্ঠানে, আশা আকাঙ্খায়।ফ্রাই বলেছেন A divine figure বা Earth a female figure….. দেবীকে খুঁজে পাওয়া যায় প্রাচীন ভাবনায়। সব কিছুর সমন্বিত চেহারা নিয়েই তিনিই দেবী দুর্গা , আদিমাতা , পৃথিবীমাতা। এক ও অদ্বিতীয়া দেবীরই সাত্ত্বিকী , রাজসী, তামসী শক্তিকে অবলম্বন করে মহালক্ষ্মী , মহাসরস্বতী , মহাকালীর উদ্ভব। এনারা একই আদিশক্তির ত্রিতত্ত্ব।
মেসোপটেমিয়া সভ্যতা থেকে মহেঞ্জদারো হরপ্পা সুপ্রাচীন ভারতবর্ষ , চীন থেকে জাপান মহামাতৃকার আরাধনা করা হত সেই সুপ্রাচীন কাল হতে মহামাতৃকা দেবীর আরাধনা করা হত ইতিহাস পূর্ব কাল হতে। সেই সুপ্রাচীন কাল থেকেই তিনি বহুরূপে ব্যাপ্ত। কখনো তিনি সিংহবাহিনী সিবিলি, কখনো তিনি যুদ্ধের দেবী সিংহ বাহিনী ইস্তার , কখনো তিনি ব্যাঘ্র বাহিনী সৈন্ধ্বব দেবী। কখনো তিনি গ্রিক শস্যের দেবী দিমিতার। কখনো তিনি জাপানে জুনতেই ক্যানন (Juntei Kannon)” ১৮ হাতের দুর্গা ।মহাযান পরিব্রাজকদের হাত ধরে দেবীর এই রূপ জাপানে পৌঁছায় ৭০০ শতাব্দীর কাছাকাছি।ভারতের দ্রাবিড় সভ্যতায় মাতৃ-তান্ত্রিক দ্রাবিড় জাতির মধ্যে মাতৃদেবীর পূজার প্রচলন ছিল। কুশান রাজা কনিস্কের মুদ্রাতেও খোঁজ পাওয়া যায় সিংহবাহিনী দেবী নানা-র। তুর্কমেনিস্তান ও আফগানিস্তানে প্রচলিত ছিল এই দেবীর মাহাত্ম্য। তিনি ত্রিশক্তি দেবী রূপে পূজিতা হতেন প্যাগান আরবে লাত, উজ্জা , মানাত।
তন্ত্রের আরাধ্যা দেবী ব্রহ্মময়ী যাঁকে শ্রীশ্রীদুর্গা, শ্রীশ্রীকালী, শ্রীশ্রীসরস্বতী, শ্রীশ্রীলক্ষ্মী নামে পুজো করা হয়ে থাকে। ‘‘ওঁ ক্রীং কালিকায়ৈ নমঃ’’ মন্ত্রে দেবীকে আবাহন করা হয়। দুর্গা-চণ্ডী-কালী একই সত্তায় মহাশক্তি রূপে পরিণত হয়েছেন। ‘দেবঃ তেজঃ সম্ভবা’ রূপে তিনিই কালী কাত্যায়নী, চণ্ডী রূপে তিনি বধ করেন চণ্ড-মুণ্ড অসুরদ্বয়কে। দুর্গা রূপে বধ করেন দুর্গমাসুরকে। আবার তিনিই কালী রূপে পান করেন রক্তবীজ অসুর-রক্ত।
বহু নামেই তিনি বিরাজিতা। কালী, মাতঙ্গী কালী, ছিন্নমস্তা কালী, শ্মশান কালী, কালা কালী, ভৈরবী বা ভদ্রকালী, ষোড়শী কালী, কমলা কালী, ধুমাবতী কালী। এই সব নাম ও রূপের বাইরেও মহাশক্তি সর্বত্র বিরাজ করছেন। জলে, স্থলে, অন্তরীক্ষে, বৃক্ষে, লতায়, ঔষধিতে, মানবের দেহে, মনে, প্রাণে, বুদ্ধিতে, অহঙ্কারে। সবেতেই আছেন। তিনি আছেন মানব চেতনায়, স্মৃতিতে, শ্রদ্ধায়, নিদ্রায়, ক্ষুধায়, তৃষ্ণায়, ক্ষমায়, লজ্জায়, শান্তিতে, শক্তিতে। মাতৃ রূপে তিনি সর্বত্রই সংস্থিতা।
তিনি আদ্যাশক্তি মহামায়া। কোথাও তিনি দুর্গা ও কালীর যৌথ রূপ। দেবীর অর্ধাংশে দুর্গা ও অর্ধাংশে কালী। দুর্গার অংশটি পঞ্চভূজা ও কালীর অংশটি দ্বি-ভূজা। তিনি কালিকা, তিনি শ্যামা, তিনি ভবতারিণী। তান্ত্রিক মতে আবার তিনি ‘অষ্টধা’ বা ‘অষ্টবিধ’। এই ‘অষ্টধা’ হলেন চামুণ্ডাকালী, দক্ষিণাকালী, ভদ্রকালী, রক্ষাকালী, গুহ্যকালী, শ্মশানকালী, মহাকালী, শ্রীকালী।
কালিকাপুরাণে আমরা দেখি আদি শক্তি রূপে তিনি যোগীদের মন্ত্র ও তন্ত্র উদঘাটনে তৎপর। তিনি চতুর্ভূজা, খড়্গধারিণী, বরাভয়দায়িনী, নরমুণ্ডধারিণী। তিনি লোলজিহ্বা ও মুণ্ডমালা বিভূষিতা। তিনি মুক্তকেশী, কৃষ্ণবর্ণা, শিববক্ষে দণ্ডায়মানা মাতৃমূর্তি। তিনি মূলত শাক্তদের দ্বারা পূজিতা হন এবং একাধার দশমহাবিদ্যার প্রথমা দেবী ও বিশ্বসৃষ্টির আদি কারণ। অন্ধকারবিনাষিণী তিনিই, দেবতা তথা শুভাশুভ শক্তির সম্মিলিত রূপ।
‘‘ওঁ করালবদনাং ঘোরাং মুক্তকেশীং
চতুর্ভূজাম।
কালিকাং দৃক্ষিণাং দিব্যাং মুণ্ডমালা
বিভূষিতাম।।’’
ভারতবর্ষে তথা বাংলায় দেবী দুর্গাই তাই কখনো জয়দুর্গা ,কখনো বনদুর্গা, কখনো তিনি কুমারীআম্বান, কখনো তিনিই বিশালাক্ষী….তিনি ক্রমে যুদ্ধ রূপ হতে সৌম্য শান্ত রূপ পরিগ্রহ করেছেন।
একাদশ দ্বাদশ শতাব্দীতে বজ্রযানী তন্ত্র ও সহজিয়া বৌদ্ধমার্গীয়গন দেবী বিশালাক্ষীকে উপাস্য হিসাবে গ্রহণ করেন । শ্রী চৈতন্য পূর্ব যুগ থেকেই দেবী বিশালাক্ষী ছিলেন বৈষ্ণব সমাজের উপাস্য দেবী। কিন্তু চৈতন্যদেবের প্রভাবে বৈষ্ণব সমাজের বাইরে সাধারণ কর্মজীবি মানুষের কাছেও তিনি পুনরায় উপাস্য হিসাবে বিস্তার লাভ করেন ।
হাওড়া ও হুগলি জেলার বহু স্থানে কৈবর্ত সম্প্রদায় বিশালাক্ষী দেবীর পূজা করে থাকেন এবং তাঁরা দেবীর পূজার প্রচলন করেছিলেন বলে জানতে পারা যায় । কারণ তাঁদের বিশ্বাস ছিল যে দেবী অপার কৃপা করুণায় নদীতে মাছ ধরা এবং জঙ্গলে নিরাপদে বিচরণ করা সম্ভবপর। পরবর্তীকালে নদীপথে বাণিজ্য করতে যাওয়া সওদাগরদের উপর দেবী প্রভাব বিস্তার করেছিলেন । শিয়াখালার উত্তর বাহিনী বিশালাক্ষী এবং বাদলহাটীর বন বিশালাক্ষীকে কেন্দ্র করে আজও প্রচলিত আছে বহু বহু লোককাহিনী প্রচলিত আছে। ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হয়ে দেবী বিশালাক্ষী হয়ে উঠেছেন লৌকিকদেবী। তিনি হয়ে উঠেছেন গ্রামদেবী এবং আঞ্চলিক দেবী ।
হরিপাল থানার অন্তর্গত হরিপাল – ভান্ডারহাটী বাসরাস্তার পশ্চিমপ্রান্তে একটি প্রাচীন গ্রামের নাম হল – বলদবাঁধ । অতীতে এই গ্রামের নাম ছিল কৃষ্ণবল্লভপুর। গ্রামনাম পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে গ্রামদেবী বিশালাক্ষীর নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িত। গ্রামটি একসময় জাহানাবাদ পরগনার অন্তর্গত ছিল । বর্ধমান রাজ প্রতাপ চন্দ্র রায় গ্রামের বিশালাক্ষীর সেবা পূজার জন্য দুই বিঘা পাঁচ কাঠা জমি দান করেছিলেন। পরবর্তীকালে বলদবাঁধের জমিদারি লাভ করেন শ্রীরামপুরের মুখোপাধ্যায়রা। তবে কিয়দংশের মালিক ছিলেন পানিশেওলার সারদাচরণ মিত্রের পরিবারবর্গ । পুরাতন পর্চায় বলদবাঁধ মৌজায় পত্তনীদাররূপে বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের নাম পাওয়া গিয়েছে।
গ্রামনামের উৎস স্বরূপ এতদঞ্চলে একটি আকর্ষণীয় লৌকিককথা প্রচলিত আছে । জনশ্রুতি অনুসারে বা কিংবদন্তি অনুসার একবার একদল ডাকাত সোনাটিক্রি গোয়ালপাড়া থেকে ১০৮ টি গাভী ও ধানের গলা থেকে ধানের বস্তা চুরি করে কানা নদী পেরিয়ে দক্ষিণের অরণ্যের মধ্যে প্রবেশ করেছিলেন । ডাকাত দলের লুন্ঠনকৃত প্রতিটি গাভীর পৃষ্ঠে তিনটি করে ধানের বস্তা ছিল। সোনাটিক্রির গোয়ালারা ধাওয়া করে প্রায় ফেলেছিললেন। ফলে বাধ্য হয়ে গাভী নিয়ে নদী পার হয়ে কৃষ্ণবল্লভপুরের সাঁইবালা অরণ্যে প্রবেশ করেছিলেন । সেখানে নদীর বাঁধের উপর দাঁড়িয়ে #বিজবনে একটি কম্পমান প্রদীপের শিখা দেখতে পান। বিজবন অর্থাৎ বিজুবন> বিজবন = বিজন অরণ্য।
তখন ডাকাত সর্দার গলায় গামছা দিয়ে বলেছিলেন, ” তুমি যে দেবদেবী হও না কেন, আমাদের এই বিপদ থেকে রক্ষা করো ।” সর্দারের আহবানে দেবী সাড়া দেন । তখন সবে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে।গোয়ালারা নদী পার হয়ে বাঁধের উপর এসে দেখলেন যে ধৃত ডাকাতদের নিকট কোনো গাভী নেই বরং আছে বলদ। ফলে গোয়ালারা প্রমাণের অভাবে হতাশ হয়ে সোনাটিক্রি গ্রামে ফিরে যান।
উন্মুক্ত প্রান্তরে একটি মৃৎনির্মিত বেদীর উপর সেই অজানা দীপশিখা প্রজ্জ্বলিত ছিল। দেবী বিশালাক্ষী তখন অরণ্যের মধ্যে এক তান্ত্রিক সাধক দ্বারা পূজিতা হতেন। দেবীর অবয়ব ঢিল একটি কৃষ্ণবর্ণের শিলাখণ্ড। ডাকাত সর্দার পরে সেই স্থানে একটি মৃৎ দেবালয় নির্মাণ করেন। দেবীকে সেথায় পুনশ্চ প্রতিষ্ঠা করেন বুদ্ধ পূর্ণিমা তিথিতে ছাগ বলি দিয়ে। তান্ত্রিক সেবিত দেবী ডাকাত দ্বারা পূজিত হতে থাকেন। কানা নদীর বাঁধের উপরে দেবীর কৃপায় গাই বা গাভী রূপান্তরিত হয়েছিল বলদে। তাই লোকমুখে কৃষ্ণবল্লভপুর গ্রামের নাম হয় বলদবাঁধ।
ডাকাত দ্বারা পূজিতা দেবী বিশালাক্ষী কালক্রমে সেই বলদবাঁধ গাঁয়ের গ্রামদেবীর আসন লাভ করেন। স্থানীয় কৈর্বত , মাহিষ্য , বর্গক্ষত্রিয় ও কুম্ভকার সম্প্রদায়ের উপাস্য দেবীতে পরিণত হন।অন্ত্রিক মতে উপাসনার নিমিত্ত জনৈক তান্ত্রিক কর্তৃক নির্মিত প্রাচীন ও আদি পঞ্চমুন্ডির আসনের উপর দেবী স্বমূর্তিতে বিরাজিতা ।
বর্ধমান রাজ প্রতাপচন্দ্র রায়( ১৭৯১ থেকে ১৮২১ খ্রিস্টাব্দ ) ও মহারাজাধিরাজ মহতাবচাঁদ (১৮৩২ থেকে ৭৮ খ্রিস্টাব্দ) এনাদের অর্থানুকূল্যে বিশালাক্ষী একটি মন্দির ও মূর্তি নির্মিত হয় । মহতাবচাঁদ বঙ্গের প্রায় সর্বত্র পত্তনী তালুক ও কলিয়ারী ইজারা দিয়ে প্রচুর অর্থ উপার্জন করেন। এছাড়াও দেববিগ্রহের নিমিত্ত কিছু অর্থ ব্যয় করে আদর্শ জমিদার রূপে প্রতিষ্ঠিত হবার চেষ্টা করেন। বর্ধমানের জমিদারীর প্রায় সবটাই পত্তনি তালুক রূপে ইজারা দেওয়া ছিল এবং সাধারণ প্রজার সঙ্গে তার কোনোও সম্পর্ক ছিল না বলে জানতে পারা যায়। এই সময় থেকেই মুখোপাধ্যায় ও মিত্ররা বলদবাঁধের পত্তনী লাভ করেন ।
আদিতে বলদবাঁধে সেই ডাকাত নির্মিত তাল পাতার ছাউনি দেওয়া মাটির মন্দির ছিল । পরবর্তীকালে পেটাই ছাদ ও সম্মুখস্থ অংশে এসবেস্টসের ছাউনি দেওয়া হয়। ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে মৃৎনির্মিত দেবী মূর্তি ভেঙে ফেলা হয় । পুরাতন মূর্তিটির মুখমণ্ডল ছিল গোলাকৃতি , ত্রিনয়নী চতুর্ভুজা। মূর্তির এক হাতে ছিল খড়্গ ও অন্য হাতে ছিল ছিন্ন মুন্ড। নয়ন ছিল টানা টানা। কিন্তু মূর্তিতে কিছু ফাটলের সৃষ্টি হওয়ায় নষ্ট হয়ে পড়ার ভয়ে মূর্তিটি নিয়ম মেনে ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ।
বলদবাঁদ অঞ্চলের অমূল্য পাল , বিভূতিভূষণ মিত্র, সতীশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ মূর্তি ভাঙ্গার বিষয়ে সহমত পোষণ করলে আম্রগাছিয়ার ভবানী রায় ও বলদবাঁধের অমরনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপর মূর্তি ভাঙার দায়িত্ব দেওয়া হয় ।
জনশ্রুতি আছে যে, ভবানী রায় ও অমর বন্দ্যোপাধ্যায় নির্ধারিত দিনে তারা স্নানপর্ব সেরে ঠাকুর তলায় এসে উপস্থিত হন এবং অগ্রজদের নির্দেশে কাজ শুরু করেন। দেবীমূর্তি ভাঙার সমু সেবায়েত হরিচরণ চক্রবর্তী কপালে রক্তবর্ণ তিলক ও কন্ঠে রুদ্রাক্ষ মালা ধারণ করে কুশাসনে বসে উচ্চ স্বরে মন্ত্র পাঠ করছিলেন। বিগ্রহের ভেতর থেকে সাপের হিস হিস শব্দ শোনা যাচ্ছিল। শোনা যায় , ওই সময় যখন বিগ্রহের ক্ষুদান্ত্রের ভিতর হতে কিছু সাপ বেরিয়ে পাশের জমিতে গিয়ে আশ্রয় নেয়। মূর্তি ভাঙার কার্য সম্পন্ন হলে ফাটল হয়ে যাওয়া সেই মূর্তি নিয়ে পাশের জমিতে সমাধিস্থ করা হয়। এর পর ভবানী ও অমরনাথ পুনরায় স্নান করেন। সেই সমাধি ক্ষেত্রের উপরে একটি ক্লাবঘর নির্মিত হয়েছে।
তখন মন্দির সংলগ্ন একটি অশ্বথ গাছ ছিল । সামনে ছিল সাঁইবালার বন । সেখানে সদ্য জন্মানো মৃত শিশুদের সমাধিস্থ করা হতো। প্রসবকালীন আঁতুরবস্ত্র মাটিতে পুঁতে দেওয়া হতো ।তখনও বালিখাদ কাটা শুরু হয়নি । বিধুমনী দাসী প্রধান রাস্তা থেকে পশ্চিমদিকে একটি মেঠো পথ দিয়ে সেই সময় বিশালাক্ষীতলার পাশ দিয়ে কদমতলা অভিমুখে চলে গিয়েছিল । সেই পথে গরুর গাড়ি চলত। এখন বোধয় স্বচ্ছ জলে ভর্তি দুটি বালিখাদের মাঝখান দিয়ে চওড়া মোরাম রাস্তায মন্দিরকে দান হাতে রেখে কুমোর পাড়ার দিকে চলে গেছে এঁকে বেঁকে। পথের দুধারে বড় বড় শিরীষ গাছ।
১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে শুরু হয় বালিখাদ কাটা দেবী সিংহরায়ের উদ্যোগে। এনার পুত্র দীপক সিংহরায়ের অর্থানুকূল্যে বলদবাঁধে বিশালাক্ষীদেবীর নতুন মন্দির নির্মাণ হয়েছে। প্রসঙ্গত দেবীর ফাটল ধরা মৃন্ময়ী মূর্তি ভেঙে সমাধিস্থ করার একটি বছর বাদে নবকলেবর নির্মিত হয়। দর্শনমূর্তি নির্মাণ করেন ভান্ডারহাটী- তালচিনান গ্রামের শিল্পী ভূতনাথ চিত্রকর। লোহার কাঠামো বা অবয়ব খাঁচার উপর সিমেন্ট জমিয়ে ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে এই মজবুত বিগ্রহ নির্মাণ করা হয়। প্রতি দশ বছর অন্তর বিগ্রহের অঙ্গরাগ করা হয়। বতর্মানে অঙ্গরাগ করেন ভূতনাথের বংশধর সুকুমার চিত্রকর।
কিন্তু কেমন দেখতে সেই মূর্তি ? কেমনই বা দেবীর ভৈরবকে দেখতে? কেমন পূজা হয় দেবীর? আর সেই দেবীর শিলাখন্ড তারই বা কি হল?
ক্রমশঃ
দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ হুগলি জেলার লৌকিক দেবদেবী