অনন্তকোটি-ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টিকারিণী ব্ৰহ্মশক্তি দেবী মানবীকে নীলাম্বরে সুখাসীনা দেখলেন এবং তাঁরই শ্ৰীমুখ হতে তাঁর মহিমাবাণী শ্রবণ করলেন –
“অহং রাষ্ট্ৰী সংগমনী বসূনাং চিকিতুষী প্রথমা যজ্ঞিয়ানাং
* * *
ময়া সোহান্নমত্তি যো বিপশ্যতি যঃ প্রাণিতি য ঈং শৃণোত্যুক্তম্ ৷
অমন্তবো মাং ত উপক্ষীয়ন্তি শ্রুধি শ্রুত শ্রদ্ধিবং তে বদামি ৷৷
* * *
যং যং কাময়ে তং তমুগ্ৰং কৃণোমি
তং ব্ৰহ্মাণং তমৃষিম্ তং সুমেধাম্ ৷” – [ঋক্, দেবীসুক্ত]
“আমিই সমগ্র জগতের রাজ্ঞী, আমার উপাসকেরাই বিভূতিসম্পন্ন হয়; আমিই ব্ৰহ্মা এবং ব্ৰহ্মজ্ঞানসম্পন্না, সকল যজ্ঞে আমারই প্রথম পূজাধিকার; দর্শন, শ্রবণ, অন্নগ্ৰহণ ও শ্বাসপ্রশ্বাসাদি প্ৰাণিজগতের সমগ্ৰ ব্যাপার আমার শক্তিতেই সম্পাদিত হয়; সংসারে যে কোন ব্যক্তি শুদ্ধভাবে আমার উপাসনা না করিয়া আমার অবজ্ঞা করে, সে দিন দিন ক্ষীণ ও কালে বিনষ্ট হয়; হে সখে, অবহিত হইয়া যাহা বলিতেছি শ্রবণ কর – শ্রদ্ধার দ্বারা যে ব্ৰহ্মবস্তুর সন্দর্শন লাভ হয়, আমিই তাহা; আমার কৃপাতেই লোকে শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করে; আমার কৃপাকটাক্ষেই পুরুষ – স্রষ্টা, ঋষি এবং সুক্ষ্মবুদ্ধিসম্পন্ন হয় ।”
ভারতের মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষিকুলে নারীর পূজার প্রথম প্রচার । উপনিষদ-প্ৰাণ ঋষি দেবীমহিমা প্ৰাণে প্ৰাণে প্ৰত্যক্ষ অনুভব করে গাইলেন –
“অজামেকাং লোহিত শুক্লকৃষ্ণাং
বহ্বীঃ প্ৰজাঃ সৃজমানাং সরূপাঃ ৷
অজো হ্যেকো জুষমাণোহনুশেতে
জহাত্যেনাং ভুক্তভোগামজোহন্যঃ ॥”- [শ্বেতাশ্বতর]
“শুক্লকৃষ্ণরক্তবর্ণা সত্ত্বরজাস্তমোগুণময়ী, অনন্যসম্ভবা এক অপূৰ্বা নারী অনন্যসম্ভব এক পুরুষের সহিত সংযুক্ত থেকে আপনার অনুরূপ বহু প্রকারের প্রজাসকল সৃজন করছেন” – ইত্যাদি ।
আত্মস্বরূপে বর্তমান দেবীমহিমা প্ৰত্যক্ষ করিয়াই তিনি শিক্ষা দিলেন – “ন বা অরে জায়ায়ৈ কামায় জায়া প্ৰিয়া ভবত্যাত্মনস্তু কামায় জায়া প্ৰিয়া ভবতি ।” – [বৃহদারণ্যক, ৬ষ্ঠ অধ্যায়, ৫ম ব্ৰাহ্মণ, ৬]
“জায়ার ভিতরে আত্মস্বরূপিণী দেবী বর্তমানা বলেই জায়াকে এত প্রিয় বলে বোধ হয় ।”
ঋষিদিগের পদানুসরণে কৃতাৰ্থ হয়ে মনু আবার গাইলেন –
“দ্বিধাকৃত্বাত্মনো দেহমর্দ্ধেন পুরুষোহভবৎ ৷
অৰ্দ্ধেন নারী তস্যাং স বিরাজমসৃজৎ প্ৰভুঃ ॥” – [মনুসংহিতা ১-৩২]
সৃষ্টিপূর্বে ঈশ্বর আপনাকে দুইভাগে বিভক্ত করিয়া এক অংশে পুরুষ এবং অপরাংশে নারীমূর্তি পরিগ্রহ করলেন । অতঃপর বিরাট ব্রম্ভাণ্ড সেই নারীর দেহ ।”
“যত্ৰ নাৰ্য্যস্তু পূজ্যন্তে নন্দন্তে তত্র দেবতাঃ ৷
যত্ৰৈতাস্তু ন পূজ্যন্তে সৰ্বাস্তত্ৰাফলাঃ ক্রিয়াঃ ৷৷”
“যে গৃহে নারীগণ পূজিত হন, সেই গৃহে দেবতাসকলও সানন্দে আগমন করেন; আর যে গৃহে নারীগণ বহুমান লাভ না করেন, সে গৃহে দেবতাদিগের উদ্দেশ্যে অনুষ্ঠিত যাগযজ্ঞাদি কোন ক্রিয়াই সুফল প্রসব করে না ।”
এইরূপে ভারতের ঋষিকুলই জগতে নারীমহিমা প্ৰথম অনুভব ও প্রচার করলেন । জগৎ নির্বাক ও উদ্গ্রীব হয়ে তাঁদের সেই পুতবাণী শ্রবণ করল – মোহিতচিত্তে নারীপ্রতীকে মাতৃপূজার, দেবীপূজার, তাঁদের সেই আয়োজন দেখতে থাকল এবং মুগ্ধ হয়ে তাঁদের যথাসম্ভব পদানুসরণ করতে কৃতসঙ্কল্প হল ।
হে দেবী মানবি ! এইরূপে ভারতই তোমার দেবীমূর্তির নিষ্কাম পূজা জগতে প্ৰথম করে ধন্য হল – সকলের শীর্ষস্থান অধিকার করল ! ভারত সেই দিন হতেই তোমায় কুলদেবীরূপে গৃহে গৃহে পুজা ও সম্মান করতে থাকল ।
পূর্ব পূর্ব পর্বেই আমি আলোচনা করেছি যে কি কি কারনে পটের পূজা বীরভূম তথা রাঢ় অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল। আরো কিছু কারণ এখন আলোচনা করব:
১. রায়বাড়ি, খরুন এবং ভাণ্ডারী পরিবার – রাজনগর …মতানুসারে মৃন্ময়ী মূর্তি তৈরীর শিল্পী না থাকার নিমিত্ত হয়ত পটের পূজার সূচনা হয়।
যদিও ধরে নেওয়া হয় খরুন রায়ের পূজা ৩৫০ বছরের পুরাতন।রানী ভবানীর আমলে এখানে জমিদারিদের পত্তনী দেওয়া হয়। রামকানাই রায় পূজার সূচনা করেন। কিন্তু রাণী ভবানীর সময় যদি হয় তাহলে সালটা ১৭৪৮….অর্থাৎ পূজার বয়স ২৫০ বছরের আশেপাশে। বর্তমানে ৩০ শরিক , ৩২ উপশরিক মিলে ৬২ টি পারিবারের পূজা । এছাড়াও বাঙাল বাড়ির পূজা, চ্যাটার্জি বাড়ির পূজা, কামার বাড়ির পূজা , শাঁখারী বাড়ির পূজা হয়ে থাকে।সব পূজাগুলি মিলে অবশ্যই একটি সাংস্কৃতিক পরিক্রমন তৈরি হয়।
সপ্তমীর দোলা আনা, বলিদান, দোলা ঘট বিসর্জন ইত্যাদি কাজগুলি রায় বাড়ির চন্ডীমন্ডপ থেকে ধারাবাহিক ভাবে হয়ে থাকে। এমনকি নবপত্রিকা বাঁধার কাজ শাঁখারী বাড়ি , কামার বাড়ি নিজের মন্ডপে করলেও বাঙাল বাড়ি, চট্টোপাধ্যায় বাড়ি ও রায় বাড়ির নব পত্রিকা রায় বাড়ির মন্ডপেই বাঁধা হয়।
মন্ডপ চত্বরেই রয়েছেন লক্ষ্মী জনার্দন। নিত্য সেবা হয়। দুর্গা মন্দিরের পাশেই শিব ও মনসা দেবীর অবস্থান। পূজা শুরুর দিনগুলিতে স্থানীয় এলাকায় মৃৎ শিল্পীর অভাব এবং চিত্রকর বা পটুয়াদের প্রাচুর্য হেতু এখানে পটের পূজা….পূর্বে পট আঁকতেন খরুনের বাসিন্দা ষষ্ঠী মালাকার , পরে তা সম্পন্ন হত হলধর মালাকারের মাধ্যমে। এখন পট আঁকেন বুদ্ধদেব মালাকার। এই পরিবারই পট অঙ্কন করে আসছেন বংশানুক্রমে। বর্তমানে আধুনিকতার ছোঁয়াতে পট প্রায় শোলার মূর্তির আকার ধারণ করেছে। উল্লেখ্য এই পটে কিন্তু গনেশ ও কার্তিক থাকেন না।
বর্তমানে এই পূজার ব্যয় ৪০০০০ টাকা।এই আয় কিছু পরিমানে ঠাকুরের নামাঙ্কিত জমি থেকে ও বাকিটা শরিকদের দেয় চাঁদা ও দ্রব্যাদি থেকে হয়ে থাকে। পূজার পরে পট বিসর্জন হয় না। পরের বছর মহালয়ার দিন বিকেলে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার মাধ্যমে বিসর্জন করা হয়।
ভাণ্ডারী পরিবারের আদি বাস ছিল গুজরাটে। বর্ধমানের রাজারা তাঁদের কাজে এঁদের নিয়ে আসেন। সেখান থেকে বীর রাজারা রাজনগরে এনে বসতি করান। সম্ভবত তাঁদের কোনো পূর্বপুরুষ রাজ পরিবারের কোনো কাজে নিযুক্ত ছিলেন।
পরিবারের এই পূজা বীর রাজাদের আমল থেকে চলে আসছে। সময় কাল প্রায় ৮০০-৯০০ বছর।এই পূজা বীর রাজাদের দেওয়া। মৃৎ শিল্পীদের অভাবেই পটের পূজা হত। আগে পট কিনে আনতেন । এখন নিজেরাই আঁকেন। পূজা হয় বৈষ্ণব মতে। অষ্টমীতে হয় চালকুমড়ো বলি। এখানের পূজার বৈশিষ্ট্য হল পূজায় ঢাক বাজে না। পূজার খরচ পরিবারের নিজস্ব। আগে রাজনগরের গোলক দত্তের পরিবার ডালা ভরে পূজার সামগ্রী দিতেন। এখন বন্ধ। শোনা যায় নিমড়েতে নাকি দেবোত্তর ১২ বিঘা সম্পত্তি ছিল। পূজার পরেও পট থাকে ঠাকুর দালানে। পরের বছর দুর্গা ষষ্ঠীতে পুরাতন পট বিসর্জন হয়।
২. ২৫০ বা ৩০০ বছর পূর্বে পট পূজাই প্রচলিত ছিল।অর্থনীতি, ভবিষৎ প্রজন্মের অনিশ্চয়তার কথা ভেবেই পটের পূজার প্রচলন – সরকার পরিবার তেঁতুলতলা কড়িধ্যা প্রমুখরা এমনটাই মনে করেন।
২৫০ বছর আগে স্বপ্নাদেশ পেয়ে শুরু হয় সরকার পরিবারের পটে দুর্গা পূজা।গোপীবল্লভ সরকারের মতে তখন পটই প্রচলিত ছিল। তাছাড়া উত্তর পুরুষের অর্থনৈতিক কথা ভেবেও পটেই পূজা হয়। বর্তমানে পূজার দুই শরিক। অষ্টমীতে ছাগ বলি হত। ১০ বছর আগে শরিকি কারনে বন্ধ হয়। পরে পুরোহিত বিধান দেন বলি শুরু করতে হলে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। তাই এখন সপ্তমী ও নবমীতে চালকুমড় বলি হয়। দেবত্তর সম্পত্তি নেই। পরিবার পরিজন মিলিয়ে পূজার খরচ বহন করা হয়।
৩. যেহেতু কন্যাই লক্ষ্মীর রূপ, তিনিই সংসারের সমৃদ্ধির মূল কারণ হয়ে থাকেন তাই বহু পরিবার কন্যার বিবাহ হয়ে অন্যত্র চলে গেলে মৃন্ময়ী মূর্তির বদলে পটের পূজা শুরু করেন । আবার নতুন বউ লক্ষ্মী রূপে গৃহে এসে মায়ের আরাধনা শুরু করেন। যেমন – চন্দ্রবাড়ি।
কড়িধ্যা চন্দ্র পরিবারের পূজার বয়স প্রায় ২৫০ বছর। পূজার সূচনা হয় সেই বাড়ির বউ এর হাত ধরে। কড়িধ্যার সেন পরিবারের কন্যার বিবাহ হয় চন্দ্র পরিবারে। প্রতি বছর যেমনটি উমা বাপের বাড়ি আসেন তেমনটি গৃহের বধূও বাড়ি চলে যেতেন। তাঁর মূল অভিযোগ ছিল চন্দ্রবাড়িতে পূজা নেই। তখন তাঁর পিতা ঘট স্থাপন করে পূজার নিদান দেন। পূজার শুরু হয় তাঁর উদ্যোগে। ১২৪৭ সালে পাকা মন্দির তৈরী হয়। বর্তমানে পূজার দশটি শরিক।এক একবার এক এক শরিক পালা করে পূজার দায়িত্ব নেন।পূর্বে জমি থেকে পূজার খরচ এলেও এখন আর নেই। বর্তমান খরচ ২০০০০ টাকা। পূর্বে সপরিবারে মা দুর্গার পট আসত সিউড়ির মালিপাড়া থেকে, বর্তমানে বিগত ১০ বছর ধরে গ্রামের শ্যামল দে পট আঁকেন। পট বিসর্জন হয় পরের বছরে বোধনের আগের দিন।
৪. প্রতিমা আনতে গিয়ে বা অন্য কোনো কারনে দেবীর অঙ্গহানি হয়ে যাওয়ার ফলে পট পূজার প্রবর্তন হয় । যেমন – পাঁচরার বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবার, বাহিরীর ভট্টাচার্য পরিবার।
পাঁচরার বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবারের পূজার বয়স ১৫০ বছর। পট আঁকার নির্দিষ্ট কোনো শিল্পী নেই। পরিবারে একটি পূজার দরকার এই হিসাবেই মায়ের পূজার সূচনা ও বংশ পরম্পরায় তা চলে আসছে। বর্তমানে যদিও পট যিনি আঁকেন তাঁর নাম লালন কবিরাজ।গাঁয়ে আরো চার পাঁচটি পূজা হয়। দুর্গা পট সপরিবারে অঙ্কিত হয়।পূর্বে মূর্তি পূজা হত । কিন্তু একবার বর্ধমান জেলার বনগ্রাম থেকে মূর্তি আনতে গিয়ে ,দেবীর আঙুলে খুঁত আসে। স্বপ্নাদেশ পেয়ে তাঁরা পটের পূজার সূচনা করেন। নবমীর দিন কুমারী পূজা হয়। সপ্তমীর দিন চালকুমড়ো , অষ্টমী নবমীতে ছাগ বলি হয়। পূজার খরচ প্রায় ৬৮ হাজার টাকা। শরিকি পূজায় পালি ধরে পূজার খরচ হয়। প্রতি বছর পট বিসর্জন হয় হিংলো নদীতে।
বাহিরী বীরভূম বোলপুর থানার অন্তর্গত এক বর্ধিষ্ণু গ্রাম। গ্রামটি বীরভূমে উল্লেখ্য তার প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক বিশেষত্বের জন্য। এই গ্রামে মহাপ্রভু শ্রী চৈতন্য দেব বিশ্রাম নিয়েছিলেন। গ্রামের মাঝে রয়েছে মহাপ্রভুর বিশ্রাম মন্দির। গ্রামে মোট তিনটি পটের দুর্গা এবং ৩০ টি মৃন্ময়ী দুর্গা পূজা হয়। পটের দুর্গা ভট্টাচার্য, চৌধুরী ও রায় পরিবারে পূজিতা হন। ভট্টাচার্য বংশের পূজার বয়স ৫০০ বছর। ভট্টাচার্য পরিবারকে গ্রামে গুরু পরিবার বলে মান্য করা হয়। ভট্টাচার্য পরিবারের ঠাকুর ঘরে আছে পঞ্চমুন্ডির আসন। বংশের অন্যতম পুরুষ সারদাপ্রসাদ ভট্টাচার্য মহাশয় সাধক ছিলেন। এখানে বহু সাধকের আগমন ঘটেছিল ও বহু সাধক সমাধিস্থ হয়েছেন। অষ্টমী ও নবমীর দিন এখানে বলি হয়। এনাদের গৃহদেবতা গোপাল ,নারায়ন এবং শিব। গৃহের অভ্যন্তরে এই তিন দেবতার মন্দির রয়েছে এবং বাহিরে রয়েছে দুর্গা মন্দির ও কালী মন্দির ।গৃহে পঞ্চমুন্ডির আসন থাকার নিমিত্ত সারাবছর অন্নভোগ হয়। দুর্গা পট মন্দিরে থাকেন এবং বিসর্জন হয়না। কোন এক সময় মাটির প্রতিমা হতো, কিন্তু তাঁর অঙ্গহানি ঘটলে পটের পূজার সূচনা ঘটে। বর্তমান দুর্গাপটটি একসময় তৈরি করেছিলেন হাটসেরান্দির কালীপদ সূত্রধর , পটে রঙের আঁচড় দিয়েছিলেন আদরগোপাল সূত্রধর ( এই সূত্রধর বংশ সম্পর্কে আমি পরের পর্বে আলোচনা করব ) । পট প্রতিবছর রং করা হয় না । যদি পটের রং বিবর্ণ হয়ে যায় তবেই পটে রঙের আঁচড় পড়ে। বর্তমানে পূজার মোটামুটি খরচ ৫০০০০ টাকা….পালি অনুযায়ী খরচ হয় । দেবোত্তর সম্পত্তি বলতে আছে দুই থেকে আড়াই বিঘা জমি ।
৫.পূজার ইচ্ছা হল, কিন্তু মূর্তি কেনার সামর্থ নেই। মা , পুরোহিত প্রমুখ আদেশ করলেন ঘটেপটে পূজা করার। সেই থেকেই পটের পূজার সূচনা হয় বহু পরিবারে। যেমন হাটসেরান্দি ,চট্টোপাধ্যায় পরিবার।
হাটসেরান্দি বীরভূম জেলা তথা সমগ্র পশ্চিমবঙ্গে বিখ্যাত পটের দুর্গা পূজার জন্য। বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুরের মল্ল রাজাদের পটের দুর্গা যেমন ঐশ্বর্য , বৈভবে বাংলা খ্যাত , ঠিক তেমনি হাটসেরান্দির পটদুর্গা শিল্পের অন্যতম স্মারক বলে বিবেচিত হয়। পুরো গ্রামে ২৪ টি পূজা হয় । তার মধ্যে ৭ টি পটের দুর্গা পূজা।বেশ অদ্ভুত ঘটনা। একই গ্রামে ২৪ টি পূজা….হাটসেরান্দি এমন কিছু বর্ধিষ্ণু গ্রাম নয়। হাটসেরান্দি কথার অর্থ হল পথের পাশে হাট যুক্ত বসতি ( কমলকান্তি ঘোষ, শ্রদ্ধান্জলি পুস্তিকা, হাটসেরান্দির উৎস সন্ধানে)… শোনা যায় প্রাচীন কালে গ্রামের সব পূজাই ছিল পটের। এখন চট্টোপাধ্যায়, মুখোপাধ্যায় , রায়, ঘোষ , পাল ও দুই মন্ডল বাড়িতে পটে পূজা হয়।
পালবাড়ির দুর্গা পট স্থায়ী প্রায় ৪০ বছর আগে থেকে। এক মন্ডল ও ঘোষ বাড়ির পট আঁকতেন রত্নাকর মেটে, চট্টোপাধ্যায় ,মুখোপাধ্যায় ও রায় বাড়ির পট আঁকতেন আদরগোপাল সূত্রধর , মানিকচন্দ্র সূত্রধর।
হাটসেরান্দি গ্রামের সমস্ত পূজাগুলি একসঙ্গে বারি বা দোলা বা ঘট আনতে যান গ্রামের কোলে বয়ে চলা কাঁদর থেকে । সমারোহপূর্ন এই অনুষ্ঠানটি দেখার মত । এরপর সবাই যে যার মত পূজামণ্ডপে চলে যান এবং যথা নিয়মে পুজো কর্মে লিপ্ত হন । গ্রামে কোন পুজোই ২০০ থেকে আড়াইশ বছরের পুরোনো নয় । যদিও অনেকেই মনে করেন এই পুজো গুলো ৩০০ বছরের প্রাচীন। তাই প্রাচীনত্ব সম্পর্কে কোন সূত্র মেলে না এবং কেন এত পূজা তার ব্যাখ্যা কেউ দিতে পারেনা….. পূজার উদ্ভব সম্পর্কে কোন তথ্য নেই…..
চট্টোপাধ্যায় পরিবারের কাছ থেকে জানা যায় যে হঠাৎ করে পুজোর ইচ্ছে হলে মূর্তি কেনার সামর্থ ছিলনা ….তখন মা দুর্গা নাকি মেয়ে সেজে এসে বললেন,” মন খারাপ করিস না ঘটে পটে পূজা কর ।” আর ঘোষ পরিবারের থেকে জানা যায় আর্থিক কারণে অনেকটা পটের পূজার সূচনা ঘটেছিল ।দক্ষিণপাড়ার নিমতলা মন্ডল বাড়ির পুজো কয়েক বছর ধরে পটে পুজো হচ্ছে । তার আগে শুধুমাত্র ঘটে পুজো হত । তবে বহু আগে নাকি পটেই হতো। যে কোনো কারণেই তা বন্ধ হয়ে গেছিল । হাটসেরান্দির পূজা আমাদের কাছে রহস্য। বাড়ি সংলগ্ন মাটির ঠাকুরবাড়ি ,কারুর আবার বাড়িতে নয় পাড়ার মধ্যে একান্ত পারিবারিক আবহে পূজা হয় ।একমাত্র চট্টোপাধ্যায় বাড়িতেই রয়েছে বৈভব, খাওয়া-দাওয়া, আড্ডা। দিনগুলি লোক সমাগমে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। পাল বাড়ির পট কখনোই বিসর্জন হয় না। চট্টপাধ্যায় বাড়ির পট ঠাকুর দালানে অবস্থান করে এক বছর অন্যান্য বাড়ির পট বিসর্জন হয়ে যায় দশমীর দিন।
এখনো অবধি যতগুলি কারন আলোচিত হয়েছে সেখানে কোথাও আমরা বর্গি হাঙ্গামা, সাঁওতাল বিদ্রোহের ইঙ্গিত পাই নি।কিছু পরিবারের অর্থনৈতিক দুর্বলতার কথা কথা জানতে পারলেও এমন কিছু দুর্বলতা ছিলনা যে পূজা করতে পারতেন না।একটা সময়ের হিসাবে দেখা যায় পরিবারগুলোর নূন্যতম পূজার খরচ ছিল বিশ হাজার টাকা, সবচেয়ে বেশি ছিল একলক্ষ টাকা। এখন বর্তমানে তার পরিমান কি হারে বৃদ্ধি হয়েছে তা যে কেউ অনুভব করতে পারবেন।
বীরভূমের পটের দুর্গা পূজার প্রচলন পশ্চিমবঙ্গের যেকোনো জেলার তুলনায় অনেক বেশি।বীরভূমের সংস্কৃতি প্রাচীনতমদের মধ্যে একটি। বিভিন্ন পর্যায়ে , পরিবর্তনে , গ্রহণে বর্জনে এই অঞ্চলের সংস্কৃতির বরং আদিরূপটিকে ধরে রাখার প্রাণপন চেষ্টা করেছে।রাজনৈতিক উত্থান পতনেও বারংবার বীরভূমবাসীর স্বাধীনচেতা মনোভাবের প্রকাশ ঘটিয়ে নিজের ভূমিতে স্থির থাকতে চেয়েছেন। বহু মতের এখানে আগমন ঘটেছে কিন্তু বীরভূম নিজের গ্রহণ বর্জনের মাপকাঠি তৈরী করে নিয়েছে। একটা সময় বীরভূমের শাসকগণ হিন্দু মন্দির দেবদেউলের জন্য দান করেছেন বিঘা বিঘা সম্পত্তি।
বীরভূমের পটের দুর্গা পূজার প্রচলনের ক্ষেত্রে বীরভূম অঞ্চল তথা বৃহৎ রাঢ় অঞ্চলের নিজস্ব সংস্কৃতিক বির্বতনকেই একমাত্র কারণ হিসেবে মনে করা যেতে পারে। এছাড়া আরো কিছু বির্বতনের কারন আছে –
১. আদিম শিকারজীবী মানুষের চেতনা।
২. নব্যপ্রস্তর যুগের শেষভাগে কৃষির উদ্ভাবন এবং সেই সঙ্গে পৃথিবী পূজা ও মাতৃ পূজার প্রচলন।
৩. দীর্ঘকাল নিজস্ব ঘেরাটোপে কাটানোর ফলে বিশ্বাসের বনিয়াদগুলির দৃঢ়তা প্রাপ্তি।
৪. হরপ্পা মহেঞ্জোদারো সভ্যতার প্রভাব।
৫. ঐতিহাসিক যুগে বিভিন্ন বহিরাগত শক্তির আক্রমনের ফলে নিজেদের সুরক্ষাচক্রকে দৃঢ় করার চেষ্টা এবং এর ফলে জন্ম নেওয়া স্বাধীনচেতা এক অনমনীয় মনোভাব।
৬. তন্ত্র ও গুপ্ত সাধনা
৭. পটুয়াদের বিপুল প্রভাব। পাশাপাশি মৃৎশিল্পীদের অভাব।
ইত্যাদি নানা কারণে বীরভূমে পটপূজার এত বিস্তৃতি এমনটাই আমাদের পর্যবেক্ষন। আশাকরি ভবিষৎ প্রজন্ম এই সংস্কৃতিকে মুছে ফেলতে দেবেনা।বরং আরো উন্নত গরিমাময় এর প্রচার করবে , বীরভূমের সংস্কৃতিকে তুলে ধরবে বঙ্গ সংস্কৃতি তথা ভারত সংস্কৃতির আঙিনায়।